E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বিআরটিসি বাসের দোতলায় বসা সেই মেয়ে

২০১৫ নভেম্বর ০৪ ১৬:১৭:০৩
বিআরটিসি বাসের দোতলায় বসা সেই মেয়ে

রণজিৎ সরকার : মনটা খারাপ। ভীষণ খারাপ। কিছু ভালো লাগে না আমার। কয়েক দিন হলো। একটা কথা মনে পড়লে বার বার মন খারাপ হয় আমার।

মন খারাপ নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। বাসস্ট্যান্ডে এলাম। দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। গাড়ি এল। বিআরসিটি গাড়ি। গাড়ির দোতলায় উঠলাম। যাত্রীরা বসে আছে। একটা সিট ফাঁকা। ফাঁকা সিটের পাশে একটা মেয়ে বসা। ফাঁকা সিটে ব্যাগ রাখা। বুঝতে পারলাম ব্যাগটা মেয়েটার। মেয়েটা হয়তো ইচ্ছে করে ব্যাগ রেখেছে। যেন কোনো পুরুষ মানুষ তার পাশে বসতে না পারে।

আমি সিটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু মেয়েটাকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছি না। মেয়েটার পরনে টি-শার্ট আর জিনস প্যান্ট। চশমাটা কপালের ওপর রাখা। কপালে বড় একটা লাল টিপ। লাল টিপ দেখে তার কথা মনে পড়ে গেল আমার। যার জন্য আমার মন খারাপ।

কারণ তার আজ জন্মদিন। তার জন্মদিনে আমি অনেক কিছু উপহার দিতাম। এর মধ্যে তার পছন্দের লাল টিপটাও থাকত। কিন্তু তাকে আর কোনো উপহার দেওয়া হয়নি। না দেওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে।

আমি দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর মেয়েটা ডান পাশের ব্যাগটা সরিয়ে নিল। তারপর কাছে রাখল। মেয়েটা আমার দিকে তাকাল। আমি বুঝতে পারলাম, সে আমাকে বসার অনুমতি দিয়েছে।

আমার ধারণা ভুল ছিল। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বসলাম। তাকে ধন্যবাদ জানানোর সাহস পাচ্ছি না। গাড়ির অনেক যাত্রী আমার দিকে তাকাল। বুঝতে পারলাম, মেয়েটার পাশে বসার জন্য তারা তাকাচ্ছে। এর মধ্যে গাড়িতে বেশ কিছু যাত্রী উঠল।

গাড়ি ছাড়ল। আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। হঠাৎ মেয়েটার মোবাইল ফোনে কল এল। মেয়েটা কল রিসিভ করল। তারপর রেগে বলল, ‘আমি বাসের ছাদে বসে আছি।’

মেয়েটার কথাটা শোনার পর আমার মনটা একটু ভালো হলো। মোবাইল ফোনের অপর পাশের মানুষ কী বলছে, তা আমি শুনতে পাচ্ছি না। আমার শোনার কথাও না। কারণ মোবাইল তো মেয়েটার কানে। শুনতে পারতাম, যদি মোবাইলে লাউড স্পিকার থাকত। কিন্তু লাউড দেওয়া নেই। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা আবার বলল, ‘মানে বোঝ না? আমি বিআরটিসির বাসের দোতলায় বসে আছি।’

এর মধ্যে প্যান্টের ডান পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। মোবাইল ফোনের লক খুললাম। তারপর নেট সংযোগ দিলাম। ফেসবুক ওপেন করলাম।
মেয়েটা কিছুক্ষণ পর বলল, ‘মতিঝিল পৌঁছাতে আমার আরো কিছু সময় লাগবে। তুমি অপেক্ষা করো।’

ফেসবুক দেখতে দেখতে ভাবলাম, তার জন্য হয়তো প্রিয় কেউ অপেক্ষা করছে। আমি ফেসবুকিং করছি। মেয়েটার দিকে চুপেচাপে তাকালাম। যেন সে বুঝতে না পারে। দেখি মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু পর দেখি, সেও মোবাইল ফোনে ফেসবুক ব্যবহার করছে।

এর মধ্যে গাড়ি ফার্মগেটে এল। বেশ কিছু যাত্রী নেমে যাওয়ার পর একটা লোক উঠল গাড়িতে। লোকটার দিকে তাকালাম ভালো করে। দেখি তার বাঁ হাত নেই। আর ডান পা নেই। স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে গাড়ির সামনের দিকে গিয়ে দাঁড়াল। দেখে মনে হলো- সে ভিক্ষা চাইবে সবার কাছে থেকে। কিন্তু না। তার কাঁধে রাখা ব্যাগটা সামনে নিল। ব্যাগটা স্ক্র্যাচের এক পাশে রেখে বলল, ‘আপনাদের যাত্রা শুভ হোক। আল্লাহ আপনাদের ভালোভাবে গন্তেব্যে পৌঁছে দিক।’

এই বলে তার ব্যাগ থেকে ছোট একটা যন্ত্র বের করল। তারপর বলল, ‘আল্লাহ নাম জপ করতে পারবেন। নিজের জন্য নিতে পারেন, পারেন বাসার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্যও। যারা দেখতে চান, তারা হাতে নিয়ে দেখতে পারেন।’

অনেকেই হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। আমি লোকটিকে দেখতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম, লোকটির মতো অনেকেই আছে। তারা ভিক্ষা করে। সে ভিক্ষা করে না। তার কর্ম করে খাওয়ার ইচ্ছে দেখে অবাক হলাম। কয়েকটা যন্ত্র বিক্রি হলো। জ্যাম ছাড়ল। লোকটি গাড়ি থেকে নেমে গেল ধীরে ধীরে। গাড়ি ছাড়ল।

তাকিয়ে দেখি মেয়েটি আমার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবার ফেসবুক ব্যবহার করতে লাগলাম। আর ভাবলাম, মেয়েটা হয়তো আমাকে কিছু বলবে। কিন্তু না। কিছু বলছে না। আমিও কথা বলছি না।

গাড়ি বাংলামোটর এল। আমি মোবাইলে নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলাম। গাড়ি শাহবাগে এল। আমি গাড়ি থেকে নামলাম অতৃপ্তি নিয়ে।

মধুর ক্যানটিনে গিয়ে আবার ফেসবুক লগ-অন করলাম। দেখি একটা মেসেজ। মেসেজে লেখা ‘আমি আপনার পাশের সিটের মেয়েটি।’ মনের ভেতর একটা ভালো লাগা শুরু হলো আমার।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test