E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাসুম বিল্লাহ'র অণুগল্প ''মায়া''

২০১৫ নভেম্বর ১৮ ১০:৩১:৫৬
মাসুম বিল্লাহ'র অণুগল্প ''মায়া''







 

ক’দিনেই মিডিয়ার আলোচিত মডেল রেহনুমা । শহরের বিশাল বিশাল বিলবার্ড এখন তার দখলে। শাদা প্রাইভেট কিনেছে চারদিন আগে। নতুন গাড়ি পুরান ঢাকার গিঞ্জি গলিতে সাই-সাই করে ছুটতে পারে না। গাড়ির ভেতরে রেহনুমার চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তি ফুটে ওঠে। পুরনো বাসাটার ওপর মায়া ধরে গেছে বলে, বাসাটা ছাড়তে পারেনি এতোদিন। এবার না ছাড়লেই নয়। বাসায় মিডিয়ার নামী-দামী মানুষ আর বিনোদন সাংবাদিকদের ভীড় লেগেই থাকে। পুরনো বাসায় বড় বড় অতিথিদের সামনে কেমন যেন আড়ষ্ট লাগে রেহনুমার। অবশেষে নিজেদের মহল্লায় বিশাল এক অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলায় ফ্ল্যাট কিনে পরিবার নিয়ে উঠে এল দামী মডেল রেহনুমা।
নতুন বাসায় দ্বিতীয় রাত। মঙ্গলবার। দুই শিফটের শুটিং শেষ করে গভীর রাতে বাসায় ফিরল রেহনুমা। পোশাক পাল্টে, মেকাপ তুলে ফ্রেস হতে ক্লান্তিতে দু’চোখ ভেঙে পড়ছে। শরীর টানছে বিছানার দিকে। শরীরকে বিছানার ওপর সঁপে দিল। অচেনা একজন বয়ষ্ক মহিলার কণ্ঠ শুনে ঘুম কেটে গেল রেহনুমার। আতংকে চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। আবছা আলোয় দেখলোÑএকজন মহিলা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
‘কে আপনি? আমার রুমে ঢুকলেন কীভাবে?’ কেঁপে উঠল রেহনুমার গলা।
‘আমি মাধবীলতা নিয়োগী।’ শাড়ির আঁচল কপাল অবধি টেনে দিতে দিতে বলল।
‘এখানে কেন?’
‘এটা আমাদের বাড়ি।’
‘বাপি, বাপি...।’ রেহনুমার গলার জোর বাড়ল না। ফ্যাঁসফ্যাঁসে শোনাল।
‘এ বাড়ি আমাদের ছিল। কিন্তু দুষ্টলোকেরা পুরনো বাড়িটা ভেঙে এ দশা করেছে।’ খেদ মেশানো কন্ঠে বলল।
‘বাড়ি পুরোনো হলে ভাঙবে না?’ যুক্তি রেহনুমার।
‘তাই বলে পুকুর ভরাট করে ফেলতে হবে? সজনে গাছটাও কেটে ফেলবে? গেটের কাছে তুলশি গাছটাও? এ তো বাড়ি নয়, জেলখানা!’
রেহনুমা দ্বিতীয় কোনো কথা বলার আগে অজ্ঞান হয়ে গেল।

সকাল ১১ টার কাটা পেরিয়ে গেছে। আসগার আলীর ডাকে ঘুম ভাঙল রেহনুমার। চোখ মেলে বাবাকে সামনে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল মেয়ে। রুমের ভেতর ইতিউতি চেয়ে বলল-‘ওই মহিলা কই, বাপি?’
‘কোন মহিলা?’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন আসগার সাহেব। রেহনুমা গত রাতের ঘটনা বাবাকে বললো। শুনে আসগর সাহেব বললেন-‘রাতে স্বপ্নে মানুষ কতো উল্টা-পাল্টা দেখে। এ নিয়ে ভাবিস না।’
‘অ্যাপার্টমেন্টের মালিকের সাথে কথা বলে দেখবে, বাপি?’ রেহনুমা বলে।
‘আচ্ছা, তুই শান্ত হয়ে বোস, আমি কথা বলে দেখছি...।’

ফোনে দীর্ঘ কথা শেষে আসগর আলী রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। মেয়ের মুখ শুকিয়ে পাংশু।

রেহনুমা শুটিং-এ। উত্তরা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত। সন্ধ্যায় আসগার সাহেব বাসাতেই থাকেন। সকালের পত্রিকা দ্বিতীয়বারের মতো নেড়েচেড়ে দেখছেন। ঐ মুহূর্তে কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পেলেন। পিপ হোল দেখলেন-অচেনা বয়স্ক লোক। দ্বিধাগ্রস্ত নিয়ে দরজা খুললেন।
‘নমস্কার। আমি সতীশ নিয়োগী। ভেতরে আসতে পারি?’
‘কি ব্যাপারে বলুন?’
‘এ বাড়ি এক সময় আমার ছিল।’
‘কিন্তু।’ চিন্তায় ডুবে গেলেন আসগার সাহেব। সবিৎ ফেরে সামনে দাঁড়ানো লোকটির কথায়।
‘মশাই, কি তখন থেকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন?’
আসগার সাহেব কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।
সতীশ নিয়োগী ভেতরে ঢুকে সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বলে, ‘এক গ্লাস জল দিতে পারেন মশাই?’ আসগার সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক গ্লাস পানি এনে বাড়িয়ে ধরলেন।
‘ধন্যবাদ।’ বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন সতীশ নিয়োগী। একটু থেকে বলে-‘আমার স্ত্রীর নাম মাধবীলতা নিয়োগী। আজ থেকে ৬৫ বছর আগে এ বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে আমরা অন্যত্র চলে যাই। কিন্তু আমার স্ত্রী বাড়ির ওপর মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। আলতাবুর রহমান সাহেব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততোদিন বাড়িটা টিকে ছিলো। তারপর তার ছেলে-মেয়েরা এ বাড়ি ছেড়ে নতুন ঢাকায় নিজেদের নতুন বাড়িতে চলে গেল। সেকারণে এ বাড়ি ডেভেলপারদের দিয়েছে। সবই বুঝি আমি। কিন্তু আমার স্ত্রীর পুরনো স্মৃতি সব মুছে গেছে। ভাইসাহেব, মাধবীলতা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কিছু মনে করবেন না। ও মাঝে মাঝে এখানে আসবে।’
লম্বা কথা শেষে সতীশ নিয়োগী উঠে দাঁড়ালেন। তারপর পেছন না তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আসগর সাহেব শরীরে শীত শীত বোধ করছেন, কে যেন তার কণ্ঠ চেপে ধরেছে, তিনি অবিশ্বাসী চোখে দেখলেন, সতীশ নিয়োগী নামের লোকটি দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে।

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test