E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রোকন রকি’র গল্প

২০১৫ ডিসেম্বর ১৮ ১৩:০৯:১৯
রোকন রকি’র গল্প

রেলগাড়িতে হঠাৎ দেখা 

ট্রেন ছাড়ছে। দৌড়ে এসে অনেক কষ্টে ট্রেনটা ধরতে পারলাম। ফাঁকা একটা সিট পেয়ে বসে বসে হাঁপাচ্ছি। অনেকদিন পরে এমন দৌড় দিলাম। পা দুটো খুব ব্যাথা করছে। আজকাল শারীরিক পরিশ্রম তেমন করতে পারি না। একটুতেই হাপিয়ে উঠি। হাত পা ব্যাথা হয়ে যায়। বয়স আর কত হবে। ২০ পেরিয়ে ২১শে পা দিয়েছি। অথচ এই বয়সেই এমন অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাই।

সামনের সিটে একটা মেয়ে বসে আছে। আমাকে হাঁপাতে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। এই দুপুরে এমন দৌড়ে এমনিই আমার অবস্থা খারাপ তার উপর এমন তাচ্ছিল্যভরা হাসিতে মেজাজ আরো খারাপ হলো।

চোখ বুজে সিটে হেলান দিতেই একটা ঘুম ঘুম ভাব আসছিল। এমন সময় কানের কাছে হঠত একটা হকার চিৎকার করে উঠলো, “এই বাদাম। দুই একশো নেন। নিজে খান বাসা বাড়ির জন্য নিয়ে যান”। এভাবে ঘুম ভাঙ্গানোর অপরাধে বাদামওয়ালাকে ঠাঁটিয়ে দুই চড় দিতে ইচ্ছে করছে। গা মুচড়িয়ে সামনের দিকে তাকেতেই দেখি সামনের সিটের মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে লাল সালোয়ার কামিজ, হাতে ঘড়ি, চোখে লাল ফ্রেমের চশমা, চেহারাতে যদিও একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে তবে বাইরের বেশভুষা সম্পুর্ন সাদাসিধা। অদ্ভুত রকম সুন্দর। বাতাসের ঝাপটায় মাঝারি সাইজের অবাধ্য চুল গুলো বারবার তার মুখে গিয়ে পড়ছে। লাল ফ্রেমের ভেতর থাকা কালো চোখ দুটো চেয়ে আছে দিগন্তপানে। কি আশ্চর্য কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটিকেই আমার অসহ্য লাগছিল। অথচ এখন...! একেই হয়তো বলে এক দেখাতেই প্রেমে পড়া। ক্ষণিকের প্রেম, ইনফ্যাচুয়েশন আরকি।

মেয়েটার দিকেই চেয়ে ছিলাম। পেছনে শুনি এক বয়স্ক মহিলা এক নাগাড়ে দোয়া করে যাচ্ছে, “আল্লাহ ব্যাটাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দুহাত ভরে রোজগার করার তৌফিক দান করেন......”। দোয়া প্রাপ্তির আশায় অনেকে তার হাতে পাঁচ টাকা দশ টাকা দিচ্ছে। সেখান থেকে টাকা নিয়ে সে আমাদের পাশে আসলো। কণ্ঠে বাজছে, “জোহর গেল আলে ডালে, মগরোব এশা হলো না......”। এক লোক ১ টাকা হাতে দিতে মহিলা বললো, “এক টাকা দিয়া কি করব বাবা। জিনিস পত্রের যে দাম”!

আম্মার কথা মনে পড়লো। একা কাজ করতে তার কষ্ট হয়। কিন্তু কাজে সাহায্য করার মতো কোনো লোক পাওয়া যাচ্ছে না। পাড়ার দুইজনকে বলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেছেন। তাদের উত্তর ছিল, “শেষ পর্যন্ত মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাবো”? অথচ তারাই আবার বছরান্তে রোজার ঈদে ফেতরার টাকা নিতে গ্রাম থাকে গ্রামে ছুটে বেরায়।

মহিলার দোয়া পড়াতে আবার চমক ভাংলো। মহিলাকে দুই টাকা দিতে ইচ্ছে করলো। আবার ভাবলাম দুইটাকা দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে একটা সিগারেট কিনে খাওয়া যাবে।

একটা দIর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকালাম। মেয়েটি তখনো বাইরে তাকিয়ে আছে। তার লাল ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ দুটো দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। পাশের এক ভদ্রলোক আমার দিকে রুঢ় ভাবে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে চোখ সরালাম।

পাশের সারিতে চার জন বসে ছিল। তাদের গল্পের দিকে কান গেল।
-আপনি এখন কি করছেন?
-এইতো রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের ছোট একটা পোস্টে আছি।
-বাহ! ভালো ভালো। তাহলে তো আয় রোজগার ভালো?
-আপনাদের দোয়ায় চলে আরকি। আপনার শালার খবর কি? কি করছে সে এখন?
-পুলিশে চাকরী হয়েছে। ট্রেনিং শেষ। এখন খুলনাতে আছে।
-এমনিই হলো? না......?
-আজকাল এমনিতে কি কোনো কিছু হয়? ৭ লেগেছে।
-বেতন কিরকম জানেন কিছু?
-১০ মত পায়। কেবল শুরু তো।

নিজের চিন্তা মাথায় উঁকি দিল। পড়াশোনা করে কি করব! চাকরী কি আদৌ পাবো! ঐরকম ৭ দিতে পারলে হয়তো সমস্যা হবে না। কিন্তু আমার মধ্যবিত্ত পরিবার কোথা থেকে এতো টাকা দিবে! রুজি রোজগারের প্রশ্নে হয়তো জমি বিক্রি করে হলেও টাকা পাওয়া যাবে। শেষ পর্যন্ত নাহয় তাই করবো। তা ছাড়া লোকটাতো বলছেই আজকাল এমনিতে কিছু হয় না। আমিই বা এমনিতে পাবো কেন!

এসব ভেবে কাজ নেই। সময়ে সব হবে। কেউ তো না খেয়ে নেই। এখন বরং মেয়েটাকেই দেখি। চশমার আড়ালে লুকোচুরি খেলা চোখ দুটো এখন স্থির হয়ে আছে। ইচ্ছে করছিল তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকি। অপলকভাবে চেয়ে থেকে সময়টুকু কাটিয়ে দেই। কিন্তু তা এখন সম্ভব না। পাশের লোকজনের চাহনি সুবিধার না। যে কোনো মুহুর্তে একটা কটুকথা বলে দিতে পারে।

কাঁকনহাট স্টেশনে এসে ট্রেন থামলো। এক ভদ্র মহিলা আমার পাশে এসে বসলেন। সাথে তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে। মেয়েটা দেখতে ঠিক পুতুলের মত। মহিলার শরীরে অলংকারের ঝলকানি। সামনের সিটের মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে একটু মুখ ভেংচালো। তার মুখ ভেংচানোর কারণ খোঁজার করার চেষ্টা করলাম। মেয়েটাকি মহিলার আভিজাত্যে ঈর্ষান্বিত? হওয়াটা অস্বাভাবিক না। নাকি তার এমন বেশভূষাকে সে তাচ্ছিল্য করছে? হতে পারে, তবে সম্ভাবনা কম। মহিলা এসে আমার পাশে বসায় মেয়ে কি বিরক্ত? শেষটা মাথায় আসতেই একটু সরে বসলাম। পাশের ভদ্র লোকটি মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। কি জানি কি দেখছে। তার তাকানো দেখে সামনের সিটের এক মুরুব্বী কেমন যে নেতিবাচক মুখভঙ্গি করলো।

ইতিমধ্যে ট্রেন ছেড়েছে। আমি মেয়েটিকে দেখছি। মেয়েটিও বারবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে আর অন্য দিকে মুখ করে মুচকি মুচকি হাসছে। সে হাসির অর্থ আমি বুঝিনা। অবশ্য বোঝার চেষ্টাও করি না। যদি নেতিবাচক কিছু হয় সেই ভয়ে। পাশে বসা মহিলার সাথে মেয়েটির বয়সের পার্থক্য করার চেষ্টা করলাম। খুব বেশি হলে ৬ থেকে ৭ বছরের দুরুত্ব হবে। কিন্তু মেয়েটিকে মহিলা বলার কথা মাথায় আসছে না। আবার মহিলাটিকেও মেয়ে বলে ভাবার কথা মাথায় আসছে না। কিন্তু আমি জানি না মহিলা আর মেয়ের ভেতর পার্থক্যটা কোথায়। থাক এসব ভেবে আর সময় নষ্ট না করে বরং মেয়েটিকেই দেখি।

কেমন যেন নেশার ভেতর চলে গিয়েছিলাম। ঘোর ভাঙ্গলো পাশে বসা অলংকার আবৃত মহিলার হঠাত খেঁকিয়ে উঠাতে। যাচ্ছেতাই বলে এক বাচ্চা ছেলেকে গালিগালাজ করছে। তাকিয়ে দেখি ঘটনা তেমন গুরুতর না। ৭-৮ বছর বয়সী ছেলেটি তার মেয়ের হাতে চকলেট গুজে দিয়েছে। এতে মহিলা চটেছেন। ছেলেটা চকলেট বিক্রেতা। দুপয়সা আয়ের জন্য এমন কাজ তারা করে। কিন্তু মহিলা এমন ভাবে ঝাড়ি না মারলেও পারতেন। আমি ১০ টাকা দিয়ে ৫টা লাভক্যান্ডি নিলাম। ছেলেটির প্রতি দয়া দেখানোই আমার চকলেট কেনার কারণ। এরকম ভাবে জনসম্মুখে অভাবীকে দয়া দেখানোতে একটা আলাদা ‘ফিল’ আছে। নিজেকে হিরো হিরো লাগে।

চকলেট হাতে নিয়ে ভাবছি মেয়েটিকে কি একটা চকলেট দেয়া যায়! সে কি রেগে যাবে? কোনো সিনক্রয়েট করবে? থাক বাবা, যেচে ঝামেলায় জড়ানোর দরকার কি! একটা চকলেট মুখে দিতেই মেয়েটি আমার মুখের দিকে এবং পরক্ষণেই আমার হাতের দিকে তাকালো। জিভটাও মনেহয় একটু নাড়ালো। একটা চকলেট দেয়া উচিৎ বলে মনে হতেই ভাবলাম মেয়েটি হয়তো অপমামিত বোধ করতে পারে। থাক না হয়। কিন্তু একা একা খাওয়ার জন্য সে কি আমাকে ছোটলোক ভাবলো?

এমন সময় টিটির এসিস্টেন্ট এসে বললো, “আপনাদের টিকিট হয়েছে”? মেয়েটি হ্যা সূচক মাথা নেড়েই আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম......
-না হয়নি।
-কোথায় উঠেছেন?
-আমনুরা।
-৪০ টাকা দেন।
-টিকিট দেন।
-টিটি এসে টিকিট দিবে। আপনি টাকা দেন।
-টিকিট ছাড়া আমি টাকা দিব না। স্টেশনে নামার পর ঝামেলা করে।
-আচ্ছা আপনি ২০ টাকা দেন। ওখানে সব আমাদের লোক থাকে। পার করে দিব।
-ভালো কথা। কিন্তু টিকিট দেন আমি টাকা দিচ্ছি।

“মানুষের ভালো করতে নেই” বলে লোকটা চলে গেল। মেয়েটা আমার দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল। আমি তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিল। সে কি আমার চকলেট খাওয়া দেখে জিভ নাড়ছিল? নাকি ভাবলো আমি কত বড় গাধা, লোকটকে আমার নিজের ভালো করতে দিলাম না। ভাবতেই পারে।

অনেক দিন আগে লোকাল ট্রেনে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট করেছিলাম শুনে পরিচিত এক আত্মীয়া আমাকে গাধা বলেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় তিনিই আবার রেজাল্ট শুনে বলেছিলেন এতো টাকা খরচ করে পড়ে কি লাভ হয়েছে। সাথে কয়েকটি প্রানীর সাথে তুলনা করেছিলেন যাদের ভেতর গাধাও ছিল। আমিও নিজেকে গাধা বলে মেনে নিয়েছি। গাধা না হলে শিক্ষা বোর্ডের ছোট পোস্টের মত কোনো চাকরী করে ভালো আয় রোজগার করার নিশ্চয়তা থাকতো।

নিজের অনুজ্জ্বল অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা মাথায় আসতেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতেও আর ভালো লাগছিল না। ক্ষণিকের প্রেম উবে গেছে। এখন একটা সিগারেট খাওয়া চাই। সামনেই স্টেশন, তাই ব্যাগটা নিয়ে একবারেই বের হলাম। যাওয়ার সময় অনেক সাহস নিয়ে মেয়েটাকে বললাম, “চলি”। মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হয়তো গাধা মানুষের মত কথা বলবে সেটা ভাবেনি।

গেটে যেয়ে একটা সিগ্যারেট ধরালাম। রাস্তার পাশের গাছগুলো কত দ্রুত সরে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আনমনে সিগারেট টানছিলাম। পেছন থেকে কে যেন ডাকলো, “এ হিরো”। ঘুরে তাকাতেই বললো
-দে টাকা দে।
হেনস্থ হওয়ার ভয়ে ১০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম।
-আচ্ছা তোমরা সবার সাথে এমন নোংরামি করছো কেন? ভদ্রভাবে চাইলেই তো পারো।
-ভদ্র ভাবে চাইলে কি টাকা দেয়রে সোনা! মানুষ ভালো কথার জাত না।
-তাহলে চেয়ে খাও কেন? কাজ করলেই পারো।
-কে কাজ দেবে? তুই? রাখবি তোদের বাড়িতে?

উত্তর খুঁজে না পেয়ে আপন মনে আবার বিড়ি টানতে লাগলাম। যে ফকির কাজ করতে চায় না তাকে কাজে রাখতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু যে কাজ করতে চায় তাকে রাখতে আমার সমস্যা কেন?

এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ট্রেন চলছে তার গতিতে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা রাস্তা পেরিয়ে কংক্রিটের দালানে ঘেরা শহরে। এক সময় গন্তব্যে পৌঁছলাম। ট্রেন থেকে নেমে ছুটতে শুরু করলাম। আরো আট দশটি ট্রেন ভ্রমনের মত ভুলে গেলাম সব। সেই মায়া কাড়া চোখের অধিকারিণী লাল ফ্রেমের চশমা পরা মেয়েটিকেও।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test