E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমিনুল ইসলাম এর কবিতা

২০১৫ ডিসেম্বর ২০ ১৩:৪৫:২১
আমিনুল ইসলাম এর কবিতা






 

অপ্রষ্ফুটিত দুপুর

প্রভাতী পাহাড়ে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে ঝর্ণা
চারপাশে কুয়াশারঙের ছায়া
বাঘ সাপ শেয়ালের চোখ
হাতের তালুতে সূর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়
অর্ধ-আবৃত পৈথানে
ছোঁয়ামাত্র রাজকুমারীর চোখ মেলে
জেগে উঠবেন পরী
জেগে উঠেই হয়ে যাবেন স্রোত ঢেউ বাঁক;
কিন্তু কোথাও কোনো নৌকার ছায়া নেই।
ভীরু সকাল হয়ে কাঁপছে অপ্রস্ফুটিত দুপুর!


ঘোড়সওয়ার

‘আয় চলে আয় দ্রুত-এদিকেই তোর মঞ্জিলেমকসুদ’-
আঁধারের জানালায় এই ডাক প্রায় অপ্রতিরোধ্য; আর
আঁধারেই বের হয়ে পড়ি আমি-আমার সঙ্গী ঘোড়া
আমি জানি না-ঘোড়াটিও জানে না-গন্তব্যের দূরত্ব
কিংবা পথের নিশানা। ঘোড়ার ওপর আমার কোনো
নিয়ন্ত্রণও নেই; তার নিজেরও আছে কি না বুঝি না।
লাগামে টান দিলে সে বাড়িয়ে দেয় গতি-ভয়ে কেঁপে
উঠি আমি; লাগাম ছেড়ে দিলে এলোমেলো দৌড় দেয়-
আমি হয়ে উঠি তরঙ্গায়িত যমুনার বৈঠাহীন নৌকো।
ঘোড়াটির শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে আমি নিঃসন্দেহ;
বোরাকের অধিক ক্ষিপ্রতায় সে আমাকে নিয়ে যায়
চাঁদের দেশে; অভ্যর্থনা জানায় পাথরের গুটি আর
জলের কঙ্কাল; চরকা নিয়ে কেটে পড়ে বুড়ি-উধাও
হয়ে যায় পরীরা; সেখানে ভালো লাগে না বেশিক্ষণ,
বুঝতে পারি এ আমার গন্তব্য নয়। ঘোড়াটি নিজেও
জানে না কুহকীকণ্ঠে কখন ডেকে ওঠে কোন্ ঠিকানা!
তবে নাম বলে দিলে অমনি সে দৌড় দেয় পিঠে নিয়ে
আক্রান্ত সওয়ার; রহস্যের রাজধানী বলার সাথে সাথে
সে আমাকে আসহাবে কাহাফের অন্ধকারে পৌঁছে দিয়ে
ঘামাদ্র শরীরে একপাশে হাঁপায়- তাকে দেখে লেজ
নাড়ে মৃত কুকুরটি; কিন্তু সেটা আমার গন্তব্য বলে
আমি মেনে নিতে পারি না; স্বর্গশিল্পীদের গান শোনার
ইচ্ছা প্রকাশিত হলে আলোর পায়ে সে আমাকে নিয়ে
যায় রূপের জৌলুসে দীপ্যমান স্বর্গশিল্পীদের জলসাঘরে-
মগ্নচূড়ার মতো তাদের নগ্ন বাহু আর স্বপ্নিল অধর
নেশা ধরালেও সেখানে টেকেনি আমার মন; তাদের
একজনের সোনালি আঙুলে চুমু দিয়ে ফিরে এসেছি।
কিছুদিন হয় আমি আমার হারানো প্রেমের নাম বলতেই
এক লহমায় সে আমাকে নিয়ে যায় সমুদ্রবেষ্টিত এক
সুগন্ধি-উঠোনে; সুমনা ও তার সঙ্গী নোনামদ হাতে
হাসিমুখ ছিল কিন্তু রাত না হতেই তাদের আন্তরিক
আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে আমি ফিরে এসেছি। একবার
রাতাকাশের আদিরূপ দেখার নিয়ত করলে ঘোড়াটি
আমাকে নিয়ে চাঁদের উল্টোপিঠে প্রতিস্থাপন করে,
ভয়ে শিউরে উঠে আমি আমার যৌনাঙ্গ চেপে ধরি-
হায়, এ কোন্ অন্ধকার! জোনাকিও রাখে না খবর!
সেদিন থেকে কবরের কালোভয় আমাকে মৃত্যুবিমুখ
প্রাণী করে রেখেছে-আমি আর ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম-
সমান’-গানে গলা ভেড়াতে পারি না। অথচ জীবনের
উঠোনে জিরোতেও পারি না বেশিক্ষণ! মাঝে মাঝে
ঘুমের মাঝে মুখোশপরা মুখ এসে ঘুম ভেঙ্গে দেয়-
ভয়ে ছটফট করি; ঘাম ও প্রস্রাবে নষ্ট হয়ে যায় শরীর-
বিছানার চাদর; তখন সে আমাকে পাড়ভাঙ্গা জলের
ঘূর্ণিতে জমে ওঠা স্রোতের সার্কাসে নিয়ে যায়; নাকানি-
চুবানি খেয়ে বলি: আমাকে ফিরিয়ে দাও অঘুমের ঘর!
ফিরতিপথে সে আমাকে এক হবকা তুলে দেয় জয়েন্ট-
ইন্টারোগেশন-সেলের কংকালচক্ষু কর্মকর্তাদের হাতে;
গুয়ান্তোনামোর কথা ভেবে শুকনোপাতা হয়ে ওঠে ঠোঁট!
এ অবস্থা আর কতদিন-এ হিসাব আমার কাছেও নেই।
আমি এখন আমার প্রকৃত গন্তব্যের খোঁজে আনুমানিক
কোন্ পথ ধরতে পারি-কি নাম হতে পারে সেই গন্তব্যের-
এসব ভাবনা নিয়ে বসে আছি সন্ধ্যাবৃত নদীন উঠোনে,
রহস্যের রঙ মেখে বয়ে স্রোতÑক্ষয়ে যায় পাড়; ডাঁশের
কামড়ে অস্থির মাঝে মাঝে লাফিয়ে ওঠে আমার ঘোড়া।

আকাশের ঠিকানায় লেখা চিঠি

সোনারঙ রোদ মেখে দলিত তল্লাটে ফিরে আসা;
এ কৃতিত্ব সময়ের ।
দীনেশচন্দ্রের হাতে কুড়িয়ে নিচ্ছিÑ
পউশের রোদমাখা দিন,
হাস্নাহেনাশাসিত সাঁঝ,
আর চুম্বনখচিত বটতলার জোছনা;
শুকনোফুলের গন্ধমাখা একটি চৈত্রদুপুরের কংকাল
এবং তার পায়ের কাছে
প্রস্তরীভূত শ্রাবণরাতের একগুচ্ছ মেঘ
পড়ে আছে যেন কারও করস্পর্শের প্রত্যাশায়!
আর হাওয়ায় ওড়ে
শিমুলতুলার মতো একজোড়া গ্রন্থিচ্যুত মন।
আমি এত জাগা কোথায় পাই?
তাই জমে উঠছে আকাশের ঠিকানামুখি ভাবনা।


মহাবিশ্ব

(পৃথিবীরঙের এক মানবীকে)

অথচ তোমার জন্য বসে থাকি অজুহাতের স্টেশনে- ইচ্ছাকৃত ফেল করে
আহ্নিকগতির ট্রেন! তুমি আসতে চেয়েছো অথবা চাও-এর বেশি কোনো
কিছুই তো ঘটেনি; তোমার আসতে চাওয়াটা কেন এত ব্যঞ্জনা রচে আমার
এলোমেলো ভাবনায়- আমি সেও বুঝি না! তুমি যদিবা আসোই-সেও তো
নিজ কক্ষপথে ফিরে যাওয়ার জন্যই আসবে-এতটুকুও রয়ে যাবে না-রেখে
যাওয়ার মতো কিছুই আনবে না সাথে,-তারপরও তোমার জন্য কেন এই
অদ্ভুত অপেক্ষা?
আমি তো গ্রহ-নক্ষত্রের ভিড়ের মধ্যেই থাকি যে ভিড়ে অংশ রয়েছে
আমারও ; এমনিতেই ঝালাপালা কান; তো কীসের আবার নতুন ডাক!
অথচ তোমার কণ্ঠ শোনামাত্র কানদুটো ভারকেন্দ্র হয়ে ওঠে! মনে হয়-
মেঘলাকণ্ঠের সিক্তমাধুরী বাড়িয়ে দেয় তোমার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের পরিধি-
যা ছুঁয়ে ফেলে আমার অন্তরঙ্গ অস্তিত্বের আঙিনা,-বাকি সারাটা সময়
যা রাষ্ট্রীয় ভূগোলের মতো স্থির থাকে বেড়াহীন সীমান্তে ও সীমানায়!
আমি স্বতঃসিদ্ধের হৃদয় নিয়ে ভেবে দেখি-নিপাতনে সিদ্ধির টিকেট নিয়ে
যদিবা তুমি এসেও যাও, আমার কোনো শূন্যতাই ভরে দিতে আসবে না,
আর আমার তো কোনো শূন্যতাই নেই; সবখানেই থই থই জল; ভদ্র বাতাসের
টোকাও সয় না! তারপরও ঢ়া নদীটি নিয়ে কেন আমি অপেক্ষায় থাকি-
একখানা মেঘলা আকাশের, কিংবা উজান-উপচানো নবীন ঢলের? আমি কি
নিজের পাড় ভেঙ্গে ছড়িয়ে যেতে চাই-অগন্তব্যের বিস্তারে,-যেখানে যুক্তি-
হীনতার অবাধপ্রান্তর,-অসংসারের হরিণ-উপবন? আমার মধ্যে কে সঞ্চার
করছে এই অগন্তব্যগামী মুক্তির বেগ? আমি তো চাই না এ উড়াল; অথচ
আমার এ প্রার্থনাতেও খাদ রয়ে যায়-‘হে পৃথিবী, হে আমার ডাঙা ও জলের
সবখানি ভালোবাসা, আমাকে ধরে রাখো-বাড়িয়ে দিয়ে তোমার অভিকর্ষীয় টান!’

মিউজিয়াম

দ্রুতগামী অশ্বদল, দূরে কালো বোরকায় আবৃত গন্তব্য;
পশ্চাতে পথের দুপাশে ধুলোবালির তামাটে কুয়াশা।
গাছের পাতায় স্তনিত ক্ষুরধ্বনি। পেছনে তাকানো মানা।
তাকালে সবকিছু ঘোলাজলের আয়না। রাইডিং না জানায়
সহযাত্রীরা ছেড়ে গেছে; এখন আমার সাথি পরিত্যক্ত ঘাস।
ধানকুড়ানীর হাতে কোঁচায় তুলে নিচ্ছি অশ্বক্ষুরদলিত
আউশধানের ছড়া, ভষ্মগাদার মঙ্গলকুলো, ঝড়–কামারের
হাঁপর আর মায়ের ছেঁড়া তসবিহদানা। সোজনবেদের
বাঁশির সাথে বনলতা সেনের স্বহস্তে লেখা একখানা
পত্রও ধুলোবালির স্তুপ থেকে উঠে এসেছে। কুড়িয়ে
নিচ্ছি। করতোয়ার পাড়ে অদৃশ্য হাতে গড়ে উঠছে
মিউজিয়াম; কোঁচা ভরে গেলে- সোনালি আলোতে
মিউজিয়ামে জমা দিয়ে একদিন প্রান্তরের দিকে চলে যাবো।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test