E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সুনীতি দেবনাথ এর কবিতা

২০১৫ ডিসেম্বর ২২ ১১:৪০:২৪
সুনীতি দেবনাথ এর কবিতা






 

অন্দরে অন্তরে


অন্ধকারের চেয়েও গাঢ়তম কোন অন্ধকার
ব্যাপ্ত আজ চারপাশে —
এ অন্ধকার মুছে দিতে চায়
মানবিক সুচেতনা আর নরম বোধকে।

অন্দরে অন্তরে ঢেউ ওঠে সর্বনাশা
কেঁপে ওঠে শিকড়ের আদিম সংসার,
আমি নদীর মত হতে চেয়েছি বেগবতী
নদীও যে ভাঙ্গার খেলায় তীর ভাঙ্গে,
ঘর ভেঙ্গে মন ভেঙ্গে চটুল খেলায়
মেতে ওঠে সর্বনাশা আরেক নেশায়
ভাবিনি সেকথা কোনদিন, তাই
হয়ে গেছে ভুল, অবশেষে কান্নানদীর
বিবশ বিকল মরা স্রোতের ঢেউ গুণি।

নদীও যে একদিন মরে যায় তীব্র
পিপাসার বালুচরে ধু ধু হাহাকারে
জানিনি সেকথা কোনদিন, তাই
হয়ে গেছে ভুল, একদম বড়সড়।
স্রোত চাই জল চাই নদীর প্রার্থনা
শেওলার ভাঁজে ভাঁজে কেঁদে চলে,
পলিমাটি ধুয়ে যায় বালি শুধু ওড়ে
চিকচিক করে চর তপ্ত দুপুরে নির্জনে।
হু হু করে কেঁদে চলে বিমনা বাতাস
কোথা তুমি স্রোতোবতী সাগরে যাবে
না নাকি আর কোনদিন,
আর কোনকালে ঢেউয়ের দোলায়?

স্রোতহীন গতিহীন আবদ্ধ প্রবাহে শুয়ে
অন্ধকার চরে অন্দরে অন্তর খুঁড়ে চলে
পেয়ে যায় নদী ধ্বংসস্তুপে অপরূপ চিত্রশালা
প্রাণের স্পন্দনহীন ছবি,
খণ্ড খণ্ড ঘরবাড়ি ভাঙ্গাচুরা সবকিছু
তারি মাঝে কোলে শিশু জীবন্ত ফসিল
চোখ বুজে বসে আছে শাশ্বত জননী
মৃদু হাসি মুখ তার আলোর ঠিকানা।
অন্যপাশে মুণ্ডহীন কবন্ধের অগুন্তি
সারি শুয়ে আছে কতকাল কে জানে!

এই অন্ধকারে এই কালান্তরের কূলে
সৃষ্টির পরম বাণী অন্দরে অন্তরে হাসে
স্রোতের আবর্তের মত জননীর হাসির মত আলোর
স্পন্দনের মত অদ্ভুত রূপে
যতই বিনাশী হাওয়া হোক উতরোল একদিন
আলোর প্রবাহে শিশু কোলে
জননীই নিয়ন্ত্রী হবে নতুন সভ্যতার।


কালান্তরের কন্যারা

(উৎসর্গ : শ্রদ্ধেয় বাচিক শিল্পী জনাব বদরুল আহেসান খান,
বাংলাদেশ।)

সে তো বহুকাল আগে
বিরহী শাপগ্রস্ত যক্ষ প্রিয়তমাকে
মেঘদূতের হাতে পাঠায় প্রেমপত্র,
পৌঁছেনি পত্র তবু চিরন্তন হয়ে
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহী অন্তরে মাতন তুলেই যায়।
যক্ষ আর যক্ষপ্রিয়া শাশ্বতের ঘরে
চিরায়ত বিরহী যুগল স্থানু হয়ে আছে।
সুনীলবাবু তোমার নীরার কথা বলছি --
বহুদিন বাঙালি যুবক নীরাকে দিয়েছে প্রেমাঞ্জলি আর
বাংলার যুবতীরা মনে মনে নিজেকে নীরা ভেবে চমকে
এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়েছে লাজুক।
আজ তুমি অতীতের প্রান্তরে অতিকায় ক্যানভাসে
বর্ণিল প্রস্তরখন্ডে খোদাই করা আকাশ ছোঁয়া প্রতিমূর্তি!
বিস্ময়ে মাথা উঁচু করে দেখে সেই সময়ের তোমাকে
আজকের নিরীখে বহুমাত্রিক অতিমানব মনে হয়।
তোমার যৌবনবতী গহীনা নীরা বহু পথ হেঁটে
আজো কোন রহস্য ছুঁয়ে রোমাঞ্চে উষ্ণতা ছড়ায়
উঁচু পর্বত শিখরবাসিনী চর্যাপদের শবর বালিকার মত,
চুলে গুঁজে ময়ূরপাখ গুঞ্জামালা গলায় নিরবধি
কালের প্রাঙ্গণে যেমন করে রহস্যে ঘোরপাঁক খায়।
নাটোরের বনলতা সেন এখনো বেতের ফলের মত
শান্ত চোখে চেয়ে কাকে যেন বলে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
ফুল্লরার বারমাস্যা বেহুলার ভেলা লহনা খুুল্লনা
গীতিকার মহুয়া মলুয়া আরো সব যুবতী কন্যা
আজো যেন সুখ দুঃখ হাসি কান্না প্রেম নিয়ে
বাংলার চিরন্তনী নারীরা সব আম কাঁঠাল শেওড়ার ছায়ায়
ছায়া ছায়া মায়াবী বৃত্তে লঘু ছন্দে ধ্রুপদী ঝংকারে হেলেদোলে
হেসেখেলে প্রেমে অপ্রেমে ভাসে শুধু।
সেই সব মধুরা কন্যারা এপারে ওপারে সেপারে
কোনোপারে আজ আর নেই, পাবে না খোঁজে কোনদিন।
বেদরদী এই কালে সেসব কন্যাদের মত যাপনের রীতি নীতি নেই,
দ্রৌপদীর বস্ত্র আর কোন সংবেদী সখা বাড়ানোরও নেই —
দুঃশাসনেদের সংখ্যা গেছে বেড়ে পথে ঘাটে ঘরে।
আজকের কন্যারা রক্তাভ আকাশ তলে প্রতিবাদী মিছিলে হাটে,
স্লোগানে স্লোগানে আত্মার বিদ্রোহ ঘোষণা করে,
রক্ত তাদের আলপনা আঁকে প্রকাশ্যে রাজপথে।
ইট পাথর ভাঙ্গে, কলে কারখানায় স্বল্প মূল্যে খিদমত খাটে,
তবু সন্তানের অনন্ত ক্ষুধা, যাপনের নিষ্ঠুর গ্লানি
সারাদিন সারারাত সারাটি সময় দংশন করে শুধু।
গ্রামে গঞ্জে আরো সব পুঁতিগন্ধময় নিরক্ত জীবন কান্না ভুলে
জেনে গেছে এমনি হয়, এর নাম বেঁচে থাকা।
ভিন্ন চিত্রে বহুতলের খাঁচায় বন্দি সোনার ময়নারা
অদৃশ্য শেকলের জ্বালায় জ্বলে ছটফট করে,
স্ট্যাটাস বাঁচাতে স্বদেশী দেহে বিদেশী পোশাক
হাই স্পিডে ড্রাইভ ঝাঁ চকচকে শপিং মল স্যুইমিং পোল
সুরা হাতে শাকী অন্তঃসারশূন্য আমদানির ভিন্নতর
জীবনালেখ্য!
আল্ট্রা কনট্রাস্টের বিকট পাঞ্চিং একুশের প্রগতি!
স্বপ্নের কন্যারা হারিয়ে যায় প্রেম কাঁদে নীরবে নিভৃতে।
দেখছি শুনছি ভাবছি —
ক্রোধ আমার চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে বলতে চায়
—হেই, হচ্ছেটা কি? থামাও এসব,
উপর নিচের সব জঞ্জাল ঝেঁটিয়ে বিদেয় করো।
সমান তালে একসাথে মেলাও পা, বাঁচার জন্য জোরসে চলো!


যদি ভেবে থাকো


ভয়ে পথ হারাবো ভেবে থাকলে
সোজাসাপটা শুনে নাও
ভুল ভেবেছো সত্যিই ভুল।
পথটা যেদিন প্রথম চিনেছি
নিশ্চিত জেনেছি অন্য পথ নেই
মাঝে এলেবেলে চলা ইশারা ইঙ্গিত
ওসব হতেই পারে !
তাই বলে বেপাড়ার বেপথে?
হোক না এ পথ এবড়োথেবড়ো
পাথর ছড়ানো আগুনজ্বলা
না হয় না থাক সুশীতল মোহালি
ছায়ার নিবিড় আবিষ্ট আলিঙ্গন
আছে তো চলমানতার আহ্বান,
আক্রমণ আছে হাজারো হাজারো
বিভ্রান্তি অগুনতি লাখে লাখ
তবু জানি এ পথের শেষপ্রান্তে
আছেই আছে হাত বাড়িয়ে
ভালোবাসা নিয়ে আমার স্বজনেরা।
বহুকাল ধরে তারা রক্ত নদীতে
করেছে স্নান, হারিয়েছে কত ভুলে গেছে
ভুলে গেছে কতটা পেলো কিনা পেলো
একটাই হিসেবে বড় পাকা তারা
শত্রুকে ভাল চেনে, দূর নক্ষত্রের আলো
হয়না আলেয়া সঠিক পথে শেখায় হতে
দীপ্ত মশালখানি।
পথে নামার মানে চলা, চলার মানে
বিরামহীন না ফেরার অঙ্গীকার,
যেতেই হবে পাহাড় ঠেলে পেরিয়ে মরু
তেপান্তরের মাঠ সবুজ ধানের ক্ষেত
স্রোতস্বিনীর স্রোত ভয়ঙ্করী রাতের সীমা
কুহক বিভীষিকা, আসবে পথে বহুরূপী
মৃত্যুর মিছিল অজানা অচেনা ।
পেরিয়ে যেতে হবেই হবে —
ঐ দিগন্তে আছেই জানি স্বপ্নগুলি
সত্যি হবার পূর্ণ হবার প্রতীক্ষায়!


আমার আমি



বাউল তোর একতারাটা যেদিন দিলি
সেদিন থেকে আমি আর আমার আমি
স্বরে সুরে কোন বিবাদে হারিয়ে গেলাম
উদাস হলাম বিবশ হলাম আনমনেতে।
আমার ভেতর অন্য আমি গোল পাকায়
আবোলতাবোল ভাবনাগুলো ঘোঁট পাকায় —

স্তব্ধ রাতের চৌকাঠে বসে শুনি একতারা বাজে
বিষম সুর জীবন মৃত্যুর মিশেলে পুরাতত্ত্বেও নবীন।
আমার যত পলিমাটি তার নির্যাসে জন্ম নেয় সে,
তাকে এই আমি জানিনি চিনিনি কস্মিনকালে।
এই আমি রাতজাগা প্রহরে স্তব্ধ সুরে নিমগ্ন,
সেই আমি দাদরা তালে উচ্ছল নৃত্যে
জোছনায় স্নান করে!
উদ্ভাসিত আলোর প্রাখর্য এড়িয়ে এই আমি
গোপন মহলে লুকোতে কেবল চাই,
সে আমাকে নিয়ে যেতে চায় দ্বিপ্রাহরিক
আলোয় মরুনগরী জয়পুরী স্থাপত্যে।

এই আমি অনস্তিত্বের এককোণে চুপিচুপি শুনি
উদাসী বাউল সুর লালমাটির নিরালা পথের,
সে কেন যে অস্তিত্বের চাতালে নবরসে উতলা!
দুই আমির সমতালে নৃত্যে যুগলবন্দীর তালভঙ্গ শুধু!
কবিতার ধারে কাছে এই আমি ভুলেও ঘেঁষি না,
সেই আমি যা বলে তা কবিতার চরণ শুধু হয়।
এই আমি ভাসাই নিজেকে ভাটি স্রোতে অবহেলে
সে কেন যে উজানে সাঁতার কেটে মৌলে যেতে চায়?
দ্বন্দ্বে পড়ি কে যে সত্যি সে নাকি এই আমি —
দেখে সে খিলখিল হাসে শুধু দিয়ে হাততালি!


মোহনা


মৃত্যু থেকে মৃত্যুতে পদচারণা করে
রূপ থেকে রূপান্তরে রূপায়িত হয়ে
আমি চলেছি অন্য ভুবনের অন্য এক
অমল জ্যোতির অনাস্বাদিত মোহনায়।
কে তুমি পেছনে থেকে অবিরাম,
কে তুমি আমার আঁচল ধরে টানো?
জানো না এ জগতে এ জীবনে
স্থির কিছু নেই সবই অস্থির চলমান!
চলিষ্ণুতা জীবনের একমাত্র সত্য,
জীবনের আরেক নাম পথ, চলাই তার
সারসত্য গতিতে সমর্পিত অনির্বাণ সে!

সেই কবে ছিল এক অন্ধকার অন্তহীন
তারই মাঝে ঝলকে উঠেছিল সুপ্রকাশ
আলোয় বিভাসিত অমিয় প্রাণকণা,
প্রাণকণা সেও তো রূপান্তরিত প্রতিক্ষণ
সেও তো চলমান চিরকাল অবিরাম।
অন্ধকার থেকে আলোর বৈভবে
জন্মের প্রথম দিনে কান্নার উতরোলে
বলেছি আমি কন্যা আমি পৃথিবীর নারী
অনন্তকাল মৃত্তিকাকন্যা নারীই শুধু।
আমার কি রূপান্তর নেই, স্থির প্রতিমা?
শুধু কোমল নবনী কন্যা, মোহিনী প্রিয়া
জায়া ও স্নেহদা জননী? আর কিছু নই?
রূপান্তরহীন গতিহীন এইমাত্র পরিচয়?
সীমার বন্ধনে সীমায়িত রুদ্ধ আত্মা,
চিরন্তনী নারী তার বেশী কণামাত্র নই?
গতিশীল রূপান্তরে স্থির চিত্রকলা!

তাহলে আমি কি জীবিত নই, গতি নেই
প্রাণ নেই, পিরামিডে স্থাপিত মমি
অজন্তার গুহাচিত্র, কোণার্কের নৃত্যপরা
ভাস্করের ছেনি খোদাই পাথর প্রতিমা!
দ্য ভিঞ্চির রহস্যময়ী মোনালিসা?
তার বেশী কোনদিনই কিছুই নই?
তাই যদি হয় প্রাণহীন আবেগ,
মৃত ভাবনার খোলশে জাবরকাটা
আর স্থবিরতায় আবদ্ধ নিষ্প্রাণতা
তার বেশী অন্য কোন পরিচয়
নারীর হতেই পারে না কোনদিন।
অথচ প্রতিটি দিন প্রতিটি পল
সুতীব্র এক গতিশীল আলোড়ন
রূপ থেকে রূপান্তরে অতিক্রমন
আমাকে ভেঙ্গে নিয়ে যায় সম্মুখে
পেছনে ফেরার পথ রুদ্ধ দেখি
প্রাণের অমোঘ প্রবাহে চলমান
আমার অস্তিত্ব হাহাকারে ভেসে
অনন্ত মোহনায় মিশে যেতে চায়
সব তাহলে মিথ্যা মরীচিকা মাত্র?
আমি বিশ্বাস করি না করবোও না।

আজ আমি প্রশ্ন করতে চাই কেন,
কেন প্রবঞ্চিত আমি যুগ যুগ ধরে?
কেন আমি অধিকার আর মুক্তির
নিশ্চিত দাবি করি যখন জীবনের
মৌল অধিকারে নখ দন্ত বিদারিত
তুমি প্রশ্ন তোল নারীই দায়ী মাটি দায়ী
পৃথিবীর তাবৎ যুদ্ধ আর শান্তিহীনতার?
আমার বিস্ময় আকাশ ছোঁয়া স্তম্ভিত!
মাটি তোমার ধাত্রীভূমি নারী জননী
সেই সত্য ভুলে গিয়ে অধিকার মোহে
তাদের দায়ী করার আগে আয়নায় কি
একবারও দেখোনা স্বরূপ? স্বাধিকারে
প্রমত্ত তুমি ধাত্রী জননীকে ভাব সম্পদ
তারচেয়ে একবিন্দু কম বেশী নয়।
আমি পৃথিবীর কন্যা আজ প্রশ্ন করি—
নারীকে শৃঙ্খলে বাঁধার অধিকার
নিয়ম রীতিনীতির স্রষ্টা তুমি,
পৃথিবীকে কৃত্রিম রেখাচিত্রে খণ্ডিত
করার অধিকার কে তোমার হাতে দিল?
তুমি ভণ্ড প্রতারক, প্রতারণা শক্তি শুধু।

এবার প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হবে নিশ্চিত।
এ পৃথিবী ধাত্রী ভূমি আমার তোমার,
এই নারী মুক্ত কন্যা পৃথিবী মাতার,
এই পথ পাশাপাশি চলাচলের সকলের
আর অনন্ত এ মোহনা সবার মিলনের!
এই ভূমি, জল, আকাশ, বাতাস
বিভাসিত আলোকিত প্রাণের মহিমা
যতখানি তোমার ভাবো ঠিক ততখানি
সুনির্দিষ্ট সুনির্বাচিত তোমার আমার।
শত্রুপক্ষ কখনো ভাবিনি, মিত্র হয়ে
প্রসারিত করো হাত, হাত ধরাধরি করে
অবশ্যই পেয়ে যাবো আলোর মোহনা,
তোমার আমার স্বপ্নের সর্বশেষ ঠিকানা!

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test