E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ওমর শামস এর কবিতা

২০১৫ ডিসেম্বর ২৪ ১৩:১৪:২৬
ওমর শামস এর কবিতা






 

তদন্ত

যখন জ্যোৎস্নার ভিতরে তাকে খুন করা হলো,
সেই হত্যাকা- তারা দেখেছিলো।

এখন সবাই চুপ।

সবাই, মানে গুলির শব্দ শুনে
যারা মুখ বাড়িয়েছিলো জানালায়,
শিশুদের টেনে যারা খিড়কি এঁটেছিলো,
যারা দরোজা ধ’রে দাঁড়িয়েছিলো,
বসেছিলো উঠোনে-
যারা দেখেছিলো
এবং যারা দ্যাখেনি অথচ জানতো,
তারা সবাই চুপ।

বড় বেশি চুপ।

তদন্তের দায়িত্ব আমার :

সংবাদদাতাকে জিজ্ঞেস করলাম, ষড়যন্ত্রের কথা-
কোনো সংবাদই তিনি পাননি পথ ঘুরে।
পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা-বিবৃতির কথা-
কোনো ফাইলই তারা খুঁজে পান না এখন।
ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম পোস্ট-মর্টমের কথা-
তথ্যের বদলে তিনি দিলেন সংশয়।

অথচ সেই মধ্যরাত্রির সপ্তর্ষি সাতটি শপথসহ
সাক্ষী দিয়েছে পাশবিক হত্যার :
আমাকে জ্যোৎস্না জানিয়েছে আততায়ীর আনন,
শিশির জানিয়েছে তার পায়ের দাগ,
ঘাস দেখিয়েছে জমাট রক্ত।

গুলির শব্দ শুনে সচকিত হয়েছিলো যে সারস,
সে আমাকে শুনিয়েছে হত্যার বিবরণী।

অথচ মানুষের চোখে কাচ
কানে শিশে
জিভে পাথর;
মাথায় মরুভূমির বিভ্রান্ত বালি।
যাকেই জিজ্ঞেস করি,

সে কিছুই জানে না
সে কিছুই জানে না।



জীবন

জীবন মানেই নিজেকে টিকিয়ে রাখা,
একজন বললো।
ক্ষুধা
মারি
দুর্যোগ
এবং প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রাখা,
বললো, জিরাফের গলার-মতো জয়ী স্বর বাড়িয়ে।

জীবনের শাঁস হচ্ছে আরেক জীবন।
পার্থিব তুচ্ছতার মধ্যে পারলৌকিক জীবনের জন্য
প্রস্তুতি নেয়াইতো শ্রেষ্ঠ পথ-
বললো আরেকজন,
হেরা পাহাড়ের গুহার অন্তর্গত অন্ধকারের মতো
আনত ধেয়ানী মুদ্রায়।

জীবন, সে-তো পদ্মপাতায় জল,
উপভোগ ক’রে নাও- একজন,
এই ব’লে পোড়ালো তারার দীপ
দেয়ালির রাত্তিরে।

জীবন মানেই শিল্প, বললো আরেকজন।
ডাল শুকনো হোক
ডাকো দুটো চড়ুই,
সরাও মেঘ,
হাওয়া, কাঁপাক কিছু শাখা,
ঝরাক মল্লিকা-

দৃশ্য শিল্পিত হলো।
ছোট-ছোট সৌন্দর্যকে বিকশিত ক’রে তোলাই তো বেঁচে থাকা,
এই ব’লে তুলে ধরলো
নির্মেঘ আকাশের আদিগন্ত ক্যানভাস।

জীবনের ব্যাখ্যা তো দার্শনিকরা দিয়েছেন,
মোদ্দা কথা হচ্ছে জগৎ ও জীবনটাকে পাল্টানো,
বললো অন্য কেউ।

জীবন!
রুদ্ধ কণ্ঠে বললো আরেকজন-

মুছলো সব রোদ্দুর
উড়লো সব পাতা
ঝরলো সব বৃষ্টি
শুকোলো সব নদী
সব বালি ফুরোলো
সব বালি ফুরোলো।

জীবন! জীবনের আমি কিছুই বুঝিনি।



বিব্রত বর্ণমালা

হে আমার বর্ণমালা,
কুণ্ঠিত অবনত বিসর্গ অনুঃস্বর নিয়ে এখনো দ্বিখণ্ডিত:
ক্রিয়াপদে কর্দম কণ্টক,
কি ক’রে এগোবো শুধু অব্যয়-সর্বনামে?
কোথায় কাহ্নিলা, ল্ইুপাদ, শবরীপাদ?
ওঁরা তো শুধু পটমঞ্জরি আর রামক্রির ঘুম-পাড়ানিয়া সুরে
ভবনদীর করুণা-নৌকা পারাপার ক’রে গেলেন।

বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস?
বৃষ্টিচোয়া গোলপাতার ছাউনীর তলে শুধু
স্যাঁতসেঁতে শ্রাবণের লীলা লিখে গেলেন ভূর্জপত্রে।

সারমর্ম হচ্ছে ইতিহাস,
ইতিহাসের বিবর্তনের সূত্র:
সারমর্ম হচ্ছে প্রকৃতি,
প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক নিয়মাবলী।

ঋষি রবীন্দ্রনাথ, তিনিও আকাশভরা সূর্যতারা দেখে দেখেও
উপনিষদ কথামৃত কয়ে গেলেন
যদিও অনির্বচনীয় লিরিকে।

না ভাব হয়, না অভাব যায়।
তুমি কি জানো,
কতো দূর এগোলো মানুষ?
কি ক’রে জানবে?
কে তোমাকে বলবে?
চাঁদ সওদাগর ফিরবে ব’লে কথা দিয়ে
কোথায় হারিেেয় গ্যালো সপ্তডিঙ্গা-সারিসহ
মালাবার চম্পার বিপ্রলব্ধ কুয়াশায়!

কি ক’রে শুনবে?
কেউ কি শুনিয়েছে,
আমূল একা সামুদ্রিক তরঙ্গে-নিস্তরঙ্গে ক্ষুব্ধ
শৈল তিমির সঙ্গে ক্ষুদ্র এক নাবিকের
মল্লযুদ্ধ ও বিজয়-

কেউ কি শুনিয়েছে,
কি করে দুটো সমুদ্রের সঙ্গমে উন্মত্ত
হয়ে ওঠে গর্জনশীল চল্লিশ-

সবই তো হয়,
শৃঙ্গের নয়
ঢেউয়ের নয়
অরণ্যের নয় তুষারের ওপারে-

দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, তিনিও তো ফিরলেন না যে
তোমরা শুনবে অন্তত গিরিশৃৃঙ্গ আর হিমবাহ
অতিক্রমের কথা-

আর এখন?
দ্যাখো, দ্যাখো অক্ষর ছুটে যাচ্ছে-
তোমারই মতো বর্ণমালা।
বর্ণমালা যারা যুদ্ধ, সমুদ্র, গিরি, দরি,
বুদ্ধিÑহোক না কখনো কূট, বিজয় দীপ্ত।
ইতিহাস, অন্তত একালের ইতিহাস ও বিজয়
দ্যাখো, দ্যাখো ছুটে যাচ্ছে আলোর তরঙ্গে:

গৃহ-গ্রহ-পৃথিবী ছেড়ে অন্য নক্ষত্রে অন্য হৃদয়ে
দূর স্থল-জল-বায়ুবাসীদের জলপাই পল্লব পরিয়ে।

বর্ণমালা,
হে আমার বিব্রত বর্ণমালা,
কতো দূর এগোলো মানুষ,
আর তুমি কি এখনো খ- ৎ-র মতো
মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে সহ্য-কি-অসহ্য
ধোঁয়া ধুল শ্যাওলা বৃষ্টি বিজড়িত অজর মফস্বলে?


অশোকের চাকা
প্রজাগণই আমার সন্তান, উহাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গলসাধনই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য।
-সম্রাট অশোক
আপনিও হাত দ্যান, -বঙ্গের বৃক্ষরে ধ’রে দিই দৃঢ় ঝাঁকা।
মৃত ডাল ঝ’রে যাবে-কীটদষ্ট মেওয়া যতো, পচা অতি-পাকা।
পরস্বাপহারী পাখি,-কঠোর ক্লিন্ন ঠোঁটঅন্ধ কোটরে করে বাস। ঝাঁকা দ্যান,
স্তম্ভ কাৎ : উড়ুক বিহঙ্গম-সানন্দে গড়াক ফের অশোকের চাকা।


পাতা কুড়োনোর পরে
উৎসর্গ : আফরিনা হাসান

এক কালে পাতা-কুড়োনী ছিলো মেয়েটি;
সীতাকু- থেকে কুয়োকাটা পর্যন্ত সব পাতা কুড়িয়ে-
কুড়োতে-কুড়োতে হলুদ-বাদামী পাতার মধ্যে
হাড়-নারী-শিশু-দেহ দেখে, চল্লিশ বছর ধ’রে
শরীর, হাওয়ার কান্না শুনে-শুনে- ভাবলো:
সারাদেশ সে এবার ঘাস বুনবে,
সু রে লা স বু জ অ ন ন্ত ঘাস।

যখন তার ঘুমের শেষরাত সবুজ পাখাঅলা খোয়াব
এলো, সে জেগে উঠে-ঘাসের বিছনে ঝাঁপি ভ’রেÑ
কুয়াশা-আধো-অন্ধকারে অর্ধ-নিমীলিত আলোয় গায়ে চাদর
জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো বীজ ছড়াতে।
দিনাজপুরের বিরলে সে বীজ ছড়িয়েছিলো, গাইবান্ধা-
আদমদিঘি-শান্তাহারে, রাজশাহীর কাজলাদিঘীর পাড়ে ...
পদ্মা পেরিয়ে লালনের বাড়ির বেড়ার পিছনের বাঁশ-শুপারি
বনের কোলে-কোলে... নড়াইল, ঝিনাইদহ মাড়িয়ে,
ছড়িয়ে সাগরদাঁড়ির এক সমাধির পাশে এসে
দাঁড়িয়েছিলো সে এক রক্তাক্ত গোধূলিতে।
লেবু-সবুজ রৌদ্র, লিফ-গ্রীন হাওয়া আর সবুজ বৃষ্টিতে
ঘন ঘাস জাগলো ! জন্মায় নি? কি হরিদ্রা জাগানিয়া মেয়ে!

তারপর টর্নাডো এলো, সাইক্লোন এলো, সিডর এলো
সমস্ত ঘাসের ওপর উঠে এলো ট্যাংরা, টাকি, শোল- মাছ নয়
মাছের কংকালÑ পঙ্গ, পোকা নয় পোকার গলিত গাদ-
আর কালো-সবুজ ফেনা।
সে কখনো থমকালো কিন্তু থামলো না!

আকাশ যখন ডাকলো গুরু গুরু,
মেঘের দিকে বাঁকিয়ে চাঁদের ভুরু
হানলো চোখের জ্যা থেকে বিদ্যুৎ।
সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, নরসিংদি, কালিয়াকৈর
মানিকগঞ্জ, টঙ্গী, সাভার-
দালান-দালান, ট্রাক-যান, জট-ধুলো-ধোঁয়া ঢাকা ঢুকতেই-
জখম-হওয়া-রাস্তা আর মানুষ আর মানুষ। তার মনে হলো-
“এতো সবুজ ক’রে দি সব ঘাসে, সমস্ত বিল্ডিং-হাইরাইজ-টাওয়ার-
টোলবুথ, অ্যাসফল্ট, মজাডোবা, সব ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট হয়ে যাবে ঘাসে,
লিফট সহ এসক্যালেটর বারোতলা থেকে ভাটি বিমানের গেটে,
বাসে-বাসে ঘাসে-ঘাসে সকল সবুজ!”

মালিবাগের মোড়ে জং-আলকাতরার মতো কিছু বখাটের কে যেন
অ্যাসিড ছোঁড়ার মুহূর্তেই তার ঝাঁপির বিছন উড়ে গিয়ে
অন্ধ করে দিয়েছিলো দুই চোখ।
হুজুরেরা বলেছিল, “কি গজব! ঘরে যাও লেবাসের অন্তর্বাসে”।
আর তাকে হানতে এলো- কি কারণে কে জানে-
ক্ষমতা-পুলিশ-প্রশাসন-সাংসদ-পক্ষ-বিপক্ষ, মত্ত জন্তুগুলো.....

দুরভিসন্ধি গুঞ্জিত গুরু গুরু,
সেই কালো মেঘে বাঁকিয়ে চাঁদের ভুরু
হানলো চোখের জ্যা থেকে বিদ্যুৎ।

তৎক্ষণাৎ কলতা-বাজারের গলির অন্ধকার থেকে একপাল বিস্ত্রস্ত
কুকুর উত্তুঙ্গু ঢেউয়ে হা ক’রে এসে তাদের হটিয়ে যেতে বাধ্য করলো।
......এখনও......

রাত্রির অন্ধকারের পায়ের তলায় ঠেকলো ক্লান্তি- দৈন্য-দুঃখ-
লক্ষ মানুষ ঘুমোচ্ছে রাস্তায়, ফুটপাথে, আনাচে-
আঁকড়ানো শিশুটির স্তন থেকে মুখে ঢলা ঘুম।
সে হেঁটে-হেঁটে লাকসাম ফেনী হয়ে সমুদ্র-পাহাড়ের দিকে চলে গ্যালো।

“সবুজ তোমারে চাই, হাওয়ারে সবুজ,
সবুজ আগুন চাই, মানুষ সবুজ”-ঘাস তো বটেই,
সে গুন-গুন করতে-করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো পথের সানুদেশে।
যখন জাগলো তখন রামুতে আগুন-আহা! সবিতার মতো শান্তিতেও-
সবখানেই আগুন জ্বলছে :
জলে-পাতায়-প্রাসাদে-স্বাধীনতায়-সংসদে-সংবিতে
সুরেলা সবুজ ঘাস সেও জ্বলে উঠেছে রক্তাক্ত আগুনে।

আকাশ পানে হেনে যুগল ভুরু,
শুনলো মেঘের মাদল গুরু-গুরু-
আগুন তা সে যতোই দ্বিগুণ হোক,
সবুজ আমি করবো ধূসর মরু।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test