E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রুমকি আনোয়ার এর কবিতা

২০১৫ ডিসেম্বর ২৬ ২৩:১১:৪০
রুমকি আনোয়ার এর কবিতা






 

পলাতক জীবন



হৃদয়ে ধারণ করা সমুদ্র ,গাঙচিলের উড়াউড়ি
বাঁধার প্রাচীর হয়ে থাকে স্বপ্নের মৈনাক পর্বত ,
কষ্টের সীমান্ত নষ্ট অতীতে ঘূর্ণায়মান ।
কেবল অতীত হাৎড়ে ফিরি ,যার কিছু অংশ
রোদেলা দুপুরের মতই উজ্জ্বল ,কিছু অংশ
কুয়াশা ঘেরা রাতের মতোই ম্লান ।

জীবনের লেনদেন চুকিয়ে দিয়ে সরে গেছে আবাল্যের বন্ধুরা ,
মিথি ,মুনমুন ,শৈলী হয়ত জগত সংসারের পুতুল খেলায় মেতেছে ।
টিনের চালে শ্রাবণ ধারায় সুরের মূর্ছণা
নারকেল পাতায় সড়সড়ে শব্দ যেন চিরুনি বুলিয়ে যায়
সেই গোল্লাছুট ,ছি বুড়ি ,সাতচাঁড়া উচ্ছল দিনগুলো ,
আজ অস্পষ্ট ধূসর ছায়া ।

রণদার পুকুরে জাল ফেলা হতো , নিজে ছিলেন নিরামিষাশী
মাছ সব বিলিয়ে দিতেন সে কি ভীড় ,
একদিন আমার সমান এক মাছ দিয়েছিলেন
মাছের মুখে সুতো গলিয়ে দিয়ে বললেন " ছেঁচরিয়ে নিয়ে যা " ,
আজ সেই পুকুরও নেই ,নেই শানবাঁধানো ঘাট
শুন্যভিটা কেবল স্মৃতি জানান দিয়ে যায় ।

জীবন বুঝি বিজয়াদশমির দেবী বিসর্জন
সঙ্গী হয়ে জেগে থাকে চাঁদ ,অর্ধ নগ্ন চাঁদ ,
আর কিছু নিশাচর পাখি ।


কবি


রাতের মধ্যাহ্নে কবি লিখে যান তার কবিতা
বাহিরে বিগলিত জ্যোৎস্না , বুনফুলের ঝাঁঝালো গন্ধ
নাকে এসে লাগে ।জোনাকিরা সখ্য গড়েছে সেখানে
শিরোনামটি লিখলেন কবি - " দয়িতার কাছে প্রার্থণা "
থিমটা সাজানো আছে মাথায় , শুধু শব্দ ,উপমা অলঙ্করণ ।
পেটে প্রচণ্ড খিদে মোচড় দিয়ে ওঠে , অতঃপর
এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ।লিখলেন-
" ক্ষয়িষ্ণু জীবনের অবসান চাই ,
স্বপ্ন ভঙ্গে কি দুর্বিষহ জ্বালা -
হৃদয় অবরুদ্ধ প্রান্তর , অসীম শূন্যতা
বৃষ্টির কান্নায় ভিজছে আকাশ
বুঝি সান্ত্বনার প্রলেপ বুলিয়ে দেয় ।
সাঁঝের পড়ন্ত বেলায় অতীত স্মৃতি চারণ ।"
- এখানে এসে থমকে গেলেন
বুকের গহিনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস -
এখনও মাসের দশ দিন বাকি ,
বাজার ফুরিয়ে গেছে , ছেলের স্কুলে তিন মাসের মাইনে বাকি
প্রকাশকের কাছে কিছু অগ্রিম চাইতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়েছে ।
মরার সিগারেট তোকে কেনো ছাড়তে পারি না !
জীবন পোড়ায় বলে তোকে পুড়িয়ে সুখ পাই ।
শরীরটা কাঁপছে বুঝি জ্বর এলো ,
হাতল ভাঙ্গা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন -
বুঝি বঞ্চিত জীবনকে উপহাস করতে
জন্মজন্মান্তরের বন্ধন কবিতার ডায়েরি ছিঁড়ে ফেললেন ,
ক্ষুধায় জুটে না অন্ন , আমি লিখি কবিতা ।
সুনাম দিয়ে কি পেট পূজা হয় , তবে আর নয় বিদায় ।


আঁধারে আমি

বসতি গেড়েছি কুৎসিত এক আঁধারের সাথে
আপন বলয়ে পূর্ণিমার স্নান কথা বলে অবিরত ,
কুড়িয়ে নিতে এক আধলা জল তাও পড়ে যায়
জলও বুঝে না নারীর শরীর ।
বহতা নদীর কঙ্কাল ,পুরনো মাস্তুল ,নৌকোর গুলুই পড়ে আছে মাঠে
লতাগুল্ম ঘাসে ঢেকে আছে আমার প্রাচীন শরীর ,
স্বপ্ন সুন্দরের ছায়া মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয় বিবর্ণ চাঁদের উঠোনে
জ্যোস্না ধরতে দুহাত বাড়িয়ে দেই ,হাসে পিশাচিনী হাসি ।
প্রণয় ভাষণে অষ্ট প্রহর কথা বলতো যারা তারা কেও নেই
বসে বসে দেখি উল্কার পতন আর খসে পড়া তারা ,
নক্ষত্রেরা বলে যায় আকাশের বুকে অবাঞ্ছিত ছিল তারা
প্রকৃতি বিছিয়ে দেয় ধুম্রজাল ,অশ্বত্থের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় ।
মাড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটুকু হয় না ,শেষ বেলায় মায়া কুড়াতে নেই
চৌদ্দশ বছরের গলিত লাশ আর কত বার ব্যবচ্ছেদ হয় ?
মন্দিরের ঘণ্টা ধ্বনি কেন আমার জীবনে মৃত্যু ঘণ্টা বাজায় না
সময়ের কাঁটা উল্টো ঘুরে বুঝি কে জানে ।।



ভালবাসার পদাবলী

শোন মেয়ে কুয়াশার ঠোঁট থেকে বেদনার শব্দাবলী শোনো
গাঙের তল ছোঁয়া মৎস্য ডানার প্রেম অনিকেত সময়ের ঘরে -
জীবনের তৃষিত স্বপ্ন আজন্ম অভিলাষ
হৃদয় বন্দরে একদিন তোর গোলাপ ফুটাবো ।
আমি হবো তোরই বাসর , তোর বেদনা ছুঁয়ে নিয়নের বুদ্বুদ
গিলে খাবো ,নিরবধি কাঙালের কৃপাণ হবো ,
হাসতে কেন ভুলে গেলি ,আয়নায় বড় মলিন মুখ ,
চেয়ে দেখ নিজের প্রতিবিম্ব অচেনা মনে হবে তোর ।

কামনার গোলাপ রাঙা সুন্দরী রাতে ঘি আর চন্দন মাখানো প্রদীপ
উষ্ণতার আলিঙ্গনে ভিজাবো তোকে সঙ্গীতের মূর্চ্ছণায় দ্বিপদী নৃত্যে ,
শুধু একবার হেসে দেখ নিষিদ্ধ প্রহরগুলো কিভাবে ছিনিয়ে নেই আমি
বুক চিরে আসা দীর্ঘ নিঃশ্বাসে আগুন ধরিয়ে দিব ।
শরীরে নিবো পাপ তুই আর আমি আরাধ্যবেলায় ,
লৌকিক ,অলৌকিক অনাচার বর্ষায় ধুয়ে যাবে সব
আর যদি না হাসিস জেনে রাখিস জীবন হবে বধ্যভূমি
কোদাল ,কঞ্চি দিয়ে যখন গোর খুঁড়বি আমার
তখন দেখবি আমার ডায়েরীর পাতা গুলো নীল আকাশে উড়ে
তোকে উৎসর্গ করে গেলাম মৃতের উৎসব গুলো ।
আকাশের উপরেও যে আকাশ সেখানে জলছবি আঁকা আছে তোর ,
একদিন একঝাক পাখি এসে বসবে তোর বিবর্ণ চাঁদের উঠোনে ।।

হৃদয়ে একাত্তর

পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলো কমে এসেছিল কিছুটা
রমনার বৃক্ষগুলো নিশ্চল দাঁড়িয়ে ,
যেন এক ইতিহাসের প্রহর গুনছে
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ।
বিকেল ৪ টা ১৯৭১ ,১৬ ই ডিসেম্বর
আত্ম সমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর নিয়াজির ,
সদ্যভূমিষ্ঠ বাংলাদেশ
গগণবিদারী চিৎকার " জয় বাংলা " ," জয় বাংলা " ।
একে অপরের কোলাকুলি ,বুক ফাটা মায়ের আহাজারি ,
ধর্ষিতা মেয়ে, এখনও কিশোরী হয়ে উঠেনি ,
ভয়ার্ত ,বিহ্বল ,নির্বাক মুখ
আবিষ্কৃত হল রায়েরবাজার বধ্যভূমি ।
জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা কি নির্মম হত্যার শিকার ,
সেলিনার স্তনদুটি কাটা , ফজলে রাব্বির কলজেটা বুকের উপর
মুনীর চৌধুরীর চিৎ হয়েছিল স্যান্ডগেঞ্জিটা কালচে হয়ে আছে রক্তে ,
নাকে চাপা দিয়ে লাশ খোঁজে বুদ্ধিজীবির সন্তানেরা ।

এতো পতাকা কোথায় ছিল ?
হৃদয়ে সঞ্চিত স্বাধীনতার সুপ্তবাসনা
যেন হাওয়ায় পত পত করে ওড়ে
ভেসে আসে জাতীয় সঙ্গীত " আমার সোনার বাংলা ---" ।
বুকের ভিতরটা খামচে ধরেছে কে ও ?
অনুভূতিহীন ,শুন্য অন্য ভূবনের কষ্ট ,
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো ,
এই প্রথম বুঝলাম চোখের জলও কথা কয় !


ক্ষয়িষ্ণু জীবন

খোলা জানালা উদাসী হাওয়া
এলোকেশে বন্যা বয়ে যায় ,
ছনের ঘর অল্পতে বৃষ্টি এলে
মেঝে ভিজিয়ে দেয় ।
আট পৌঢ়ে শাড়ি ,আচলে তালি দেয়া -
মোটা চালের ভাত আর কলুই শাক ,
অপরের ঢেকি ভানা অলস হাত
জীবন এগিয়ে চলে কষ্টের কান্নায় ।
পরিবারে জনবল বাড়ে , দ্বিখণ্ডিত হয় ভূমি -
নিত্য অন্তঃকলহ , গোয়াল ঘরে রুগ্ন গাভী
ছিন্ন পাতায় এঁকে যাওয়া জীবন ,বাজারের ফর্দ ,
অভাব যেন পাশাপাশি হাঁটে ।

পাশে মজে যাওয়া দীঘি ,মাছে ঘাই মারে -
খুঁজে পেতে কিছু ট্যাংরা আর পুঁটি
ভাগ্য ভালো হলে শোল বা গজার,
লাউয়ের ডগার মত লক লকিয়ে
লকলকিয়ে বড় হয়ে উঠছে মেয়েটা ,ভাবনা কুড়ে থাকে ।
জোড়াতালির এই সংসার ,বড্ড ভার -
সেই সোনা বউ ,রুগ্ন ভগ্ন প্রায় আজ ,
স্বামীর কবরে গিয়ে বলে আর তো পারি না
জীবনভর বোঝা শুধু একাই সামলে গেলাম ।
কত কি পাওয়ার ছিল ,হয় না সব বুঝি বাকীর খাতা ,
পৃথিবী যদি একটা হোটেল হতো ,
খাদ্যের অভাব থাকতো না ।
গোবর লেপটে লেপটে আমিনার সংসার
যেখানে কবিতার উপকরণ আছে ,কবিতা লেখা হয় না ।


বেলা অবেলার গল্প


দুঃখ আমার সাজঘর ,কান্না আমার বাসর
একদিন ক ,খ ,গ , ঘ লিখতে শিখেছিলাম ,
আজ শব্দেরা দুর্বোধ্য ঘাতক , নষ্ট নীড়
হৃদয় মন্দিরে বেদনার আরতি কেবল ই আর্তনাদ ।
শৈশব ,কৈশোর ,যৌবণ ,বার্ধক্যে এসেও স্বপ্নের বুনন
বিধাতার অভিশাপ , সল্প আয়ু নিয়ে জন্ম আমার ,
যাদের ফেলে এসেছি পোড়া ধূপকাষ্ঠে তারা আমায় ডাকে
সময় বলে যায় ফুরিয়ে এসেছে বেলা ।

মরে গেলে কবিতাগুলো তোমাদের স্মৃতি থেকে পালাবে অন্ধকারে
নক্ষত্রের মাঝে জ্বলে ওঠা , নিভে যাওয়া মাঝে মাঝে দেখা মিললেও ,
হয়ত চিনতেও পারবেনা ধূসর দ্বীপবাসিনীকে
যাবার সময় হয়ে এলো এখনও তোমাদের কাছে আমি অচেনা ।
অনাগত পৃথিবীকে বলে যাই একদিন পাথরেও ফুল ফুটিয়েছিলাম
কালের গর্ভে মুছে গেছে তা , ছিটেফোটা যা আছে ,
ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা ছেঁড়া পাতায় , অজান্তে রয়ে যাবো কারো স্মৃতিতে
কোন এক সকালে খুন হবে ভোরের নরম আলো ।




(ও//ডিসেম্বর২৬,২০১৫)

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test