E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সৈয়দ শামসুল হকের আশি : কিছু অপ্রাসঙ্গিকতা 

২০১৫ ডিসেম্বর ২৮ ১৩:৫৩:০১
সৈয়দ শামসুল হকের আশি : কিছু অপ্রাসঙ্গিকতা 







 

মজিদ মাহমুদ :: কবি সৈয়দ শামসুল হক আশি বছর অতিক্রম করলেন। মানব-জনমে বয়সের স্বল্পতার খেদ তাঁর ঘুচে গেল। তাঁর মতো সৃজনশীল মানুষ আরো বেশি দিন বেঁচে থাকুন- এটিই আমাদের কাম্য; কিন্তু ঈশ্বর মানুষকে বয়সের যে জিন-কোড দিয়ে বানিয়েছেন, তাতে এরচেয়ে খুব বেশিদিন বাঁচার সুযোগ কম; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আশিতেই সিল হয়ে গিয়েছিলেন; আর এ নিয়ে চরম রবীন্দ্র-ভক্তদেরও খেদ নেই যে, তিনি বয়সের অভাবে তাঁর ভালোটা দিতে পারেননি; যদিও শক্তিমান বহুলেখক অল্প-বয়সে পটলতোলায় তাদের ভক্তকুলের সেরাটা না পাওয়ার কষ্ট রয়ে গেছে। আশি বছরের পরে যে খুব একটা বাঁচা সম্ভব নয় তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথও মজা করেছেন- ‘আয়না দেখেই চমকে বলে,/‘মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে,/বেশিদিন আর বাঁচব না তো '/ভাবছে বসে একা সে।/ডাক্তারেরা লুটল কড়ি ,/ খাওয়ায় জোলাপ, খাওয়ায় বড়ি ,/ অবশেষে বাঁচল না সে/ বয়স যখন একাশি।’ একজন সৃষ্টিশীল মানুষের বয়স কত তা নিয়ে ভাবা ফালতুমি; বয়স দিয়ে কেউ লেখক হয় না।

সৈয়দ হক নিঃসন্দেহে সময়ের একজন শক্তিমান লেখক- গদ্যপদ্য নাটকসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি নিরলস কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সফল; লেখার জন্য তেমন ঝুঁকি ছাড়াই তিনি এতটা বছর পার করে এসেছেন; এমন একটা জীবনের আকাঙ্ক্ষা যে কোনো লেখকের কাম্য; কিন্তু পৃথিবীতে কোনো ভোজই মাঙনা নয়; এর জন্য চাই মেধা, পরিশ্রম ও সময়কে নিজের মত করে ব্যবহার করার দক্ষতা, সেটি তাঁর ছিল।

২.
সৈয়দ হকের সাথে আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা আছে বা নাই। তার মতো একজন অগ্রজ লেখকের সঙ্গে তরুণ সাহিত্যকর্মীরা সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইবেন সেটিই স্বাভাবিক। তবে আমার লেখক জীবনে ব্যতিক্রম হয়েছে- হয়তো অন্তর্মুখিতার কারণে কোনো অগ্রজ লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি; যা হয়েছে পুরোটাই চলতি পথে; দীর্ঘ তিরিশ বছর ঢাকায় থাকার সুবাদে রাস্তায় কিংবা অনুষ্ঠানস্থলে অনেকের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে; অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্টতাও হয়েছে। এই পরিক্রমায় সৈয়দ হকের সঙ্গেও অনেকবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, ঘনিষ্টতা হয়নি। তাঁর অনুজ লেখকদের অধিকাংশেরই ধারণা সৈয়দ হক কথা বলেন স্বরযন্ত্র দিয়ে, আর দেখেন অনুপস্থিত দৃষ্টি দিয়ে। লেখক হিসাবে অবশ্য এরচেয়ে বেশিটা তার কাছে প্রত্যাশা করা বাতুলামি; কারণ অতিরিক্ত সম্পর্ক লেখার ক্ষেত্রে ক্ষতি করে। তবু অন্যদের অভিযোগ তার দৃষ্টিভঙ্গি কখনো বস্তুগত প্রয়োজন ছাপিয়ে উপরে উঠতে পারেনি।


সৈয়দ হকের সাহিত্য নিয়ে বিগত দুই দশকে আমি তিনটি প্রবন্ধ রচনা করেছি; আমার ক্ষেত্রে এটি একটি ব্যতিক্রম- কারণ জীবিত লেখকদের ওপরে লেখার বিড়ম্বনা সর্বদা এড়িয়ে চলতে হয়েছে; তবু ওইসব লেখার ক্ষেত্রে সাহিত্য-সম্পাদকগণের কৃতিত্বই সর্বাধিক। তবে তার সাহিত্যকীর্তির প্রতি ভালোবাসা না থাকলে সম্ভব হতো না।

প্রথম লেখাটি ছাপা হয়েছিল আজ থেকে বিশ বছর আগে সম্ভবত ১৯৯৬ সালে তার ষাট বা একষট্টিতম জন্মদিনে ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায়। ওই লেখায় তাঁর কবিতার নানা বৈশিষ্ট্য ও নান্দনিক বিচারসহ কিছু সমালোচনায় ছিল; বয়স কম বলে কিছুটা পান্ডিত্য দেখানোর বাতিক ছিল। বিশেষ করে তাঁর প্যার্টার্ন কবিতাগুলো বিশ্বসাহিত্যে কাদের অনুকরণে লেখা হয়েছে সেগুলো বলার লোভ সামলাতে পারিনি সেদিন। এই রচনার কয়েক সপ্তাহ পরে জাদুঘরে একটি অনুষ্ঠানস্থলে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ায় নিজের পরিচয় দিয়ে জানালাম, আপনাকে নিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছি ইত্তেফাকের পাতায়। তিনি বললেন, ও তাই নাকি! তিনি তা দেখেছেন বা পড়েছেন বলে তার ভাবপ্রকাশের ধরন দেখে বোঝা গেল না। আমি অবশ্য কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিলাম; কারণ তখন তো ছিল ইত্তেফাকই প্রধান পত্রিকা; তার ওপরে প্রকাশিত সাহিত্যপাতার প্রধান আর্টিক্যালটি তাঁর চোখ এড়িয়ে গেল! হতে পারে।

এই রচনার দশ বছর পরে ২০০৫ সালে তার সত্তরতম জন্মদিনে আবারো কবি আল মুজাহিদীর অনুরোধে তাঁর কবিতা নিয়ে আরো একটি প্রবন্ধ লিখলাম। আর সেদিনই জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি কবিতার অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল; আবারও পরিচয় দিয়ে বললাম, হক ভাই, আমার নাম মজিদ মাহমুদ। এবারে তিনি চিনলেন, খুশি হলেন; বললেন, ‘তোমার লেখাটা খুব ভালো হয়েছে, অনেকেই ফোন করেছেন, এক পাবলিশার জানিয়েছেন, আমি যদি তার ওপরে একটি গ্রন্থ রচনা করি তিনি তা সানন্দে ছাপতে রাজি আছেন। এরপর তিনি বললেন, আসলে আমি বলি কি তুমি যদি আমার ওপরে এককভাবে না লিখে আমাদের সময়ের কয়েকজন মেজর কবিকে নিয়ে একটি বই লিখতে পার- সেটিই ভালো হবে।’ বিষয়টি আমারও মনপুত হয়েছিল, কিন্তু কাজটি আজও করা হয়ে ওঠেনি। তবে হক ভাই এরপরেও আমার নাম ও চেহারা মনে রাখতে পারেননি; সে গল্পটি বলছি-

প্রায় বছর পাঁচেক আগে যুগান্তর স্বজন সমাবেশের আয়োজকরা পাবনায় একটি অনুষ্ঠানে সৈয়দ শামসুল হককে প্রধান অতিথি এবং কবি ওমর আলী, কবি আসাদ মান্নান ও আমাকে বিশেষ অতিথি করে। সেই অনুষ্ঠান শেষে সার্কিট হাউজে রাতে খাওয়ার টেবিলে তিনি বললেন, ‘মজিদ কোথায় থাক? আমাদের কি কখনো দেখা হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আমি তো আপনার সাহিত্যের একজন ভাষ্যকার, মাত্র বছর পাঁচেক আগে আমি ইত্তেফাকে আপনার ওপরে যে প্রবন্ধটি লিখেছিলাম, তার প্রশংসায় আপনি আমাকে একটি বই লিখতে বলেছিলেন।’ তিনি অবশ্য স্মরণ করতে পারলেন, বললেন, ‘হ্যা মনে পড়ছে।’ তবে তার মতো একজন লেখক মনে না রাখলেও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, ওই যাত্রায় তিনি আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। পাবনা জেলার চরগড়গড়ি নামের যে গ্রামে আমি জন্মেছিলাম, সেখানে আমার প্রচেষ্টায় একটি শিশুদের স্কুল ও গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছে। তৎকালীন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কবি আসাদ মান্নানকে আগেই আমার স্কুলটি পরিদর্শনের অনুরোধ করেছিলাম। তিনি বললেন, হক ভাই ও আনোয়ারা আপাকে বলে দেখ, তাঁরাও যেতে পারেন। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। অনেকটা কষ্ট করে গ্রামের সঙ্কীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করে তাদের পৌাঁছাতে হয়েছিল। এরমাত্র কিছুদিন আগেও পদ্মাবিধৌত এই গ্রামটিতে পাঁকা রাস্তা কিংবা বৈদ্যুতিক বাতি ছিল না। আমার স্কুলের শিশুদের সঙ্গে কথা বলে, লাইব্রেরি দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। সৈয়দ আনোয়ারা হক বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এই গ্রামে এমন একটা প্রতিষ্ঠান করা কি করে সম্ভব হলো! আমি তো আসতে আসতে ভাবছিলাম, মজিদ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।’ এছাড়াও তিনি বললেন, আমার কিছু টাকা আছে, এরকম একটা প্রতিষ্ঠান আমাকে করে দিতে পার!’

হক ভাইয়ের এই সফরকে আমার কাছে, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি বলে প্রতিয়মান হয়েছিল। আলোচনা অনুষ্ঠানে আমি শিশু ও অবিভাবকদের বলেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে আমাদের এই স্কুল পরিদর্শন করলে যেমন তোমাদের স্মৃতি মূল্যবান হতো, আজ তোমাদের জন্য সেই ঘটনাটিই ঘটেছে। কারণ আমাদের সময়ে রবীন্দ্রনাথ নেই, শামসুর রাহমান মারা গেছেন, আল মাহমুদ নানা কারণে প্রান্তিক, এখন কেবল সৈয়দ হকের সময়। অবশ্য তাঁর সাহিত্য নিয়ে আমার বক্রোক্তিরও ছিল। হুমায়ূন আহমেদ সৈয়দ হকের কোনো এক জন্মদিনে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় লিখেছিল, ‘অনেকেই বলেন বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আসনটিই সবার ওপরে, কিন্তু তার বিবেচনায় সৈয়দ হকের অবস্থানটিই সর্বোচ্চে হওয়া উচিত।’ ১৯৯৪ সালে দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদ এর ওপর একটি রচনার উপসংহারে আমি তাঁর এই মন্তব্যের প্রতি কটাক্ষ করেছিলাম। বাংলা উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে- যা আর কারো সঙ্গে প্রযুক্ত নয়। তাছাড়া দুজন সম্পূর্ণ দু ধারার লেখক।

২.
তাঁর ওপর তৃতীয় লেখাটি লিখেছিলাম, বন্ধুবর ড. অনু হোসেনের অনুরোধে দৈনিক ডেসটিনির পাতায়। আর আমিও যখন একটি পত্রিকার দায়িত্ব ছিলাম তখন তাঁর ওপরে বিশেষ যত্নে কাজ করতে চেয়েছি। আর এসবই হয়তো তার প্রাপ্য। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটি এতকিছুর পরেও খুব একটা পরিণতি পাইনি। ঠিক আগের যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও দেখা হয়ে গেলে, তিনি নিজ থেকে কখনো বলেন না, ‘ভালো আছে?’ কিংবা ‘তোমার স্কুল কেমন চলছে?’ আমরাই জিজ্ঞাসা করি, উনি একটু ঘাড় নেড়ে অন্যদিকে মনোযোগ দেন। হয়তো এটিই তাঁর স্টাইল বা অন্য কিছু; কিংবা আমাদের মতো তুচ্ছ লেখকের ভালোমন্দে তার কি এসে যায়! চেনা কিংবা অচেনা সকল মানুষের ভাব বিনিময়ের জন্য আমাকে সর্বদা ঠোঁটোষ্ঠ প্রসারিত রাখতে হয়। যদিও সাহিত্যে মুখাপ্রেক্ষিতা ও হ্যাংলামির জায়গা নেই।

৩.
যাই হোক, সৈয়দ শামসুল হকের জন্মদিনে যে জন্য এই আশিতামামির অবতারণা, তার মূলে রয়েছে একটি বেদনা বোধ। ইংরেজের শাসনামলের শেষপাদে জন্মগ্রহণকারি একজন লেখক, যার একযুগ কেটেছে ব্রিটিশ উপনিবেশে, দুই যুগ পাকিস্তানে এবং প্রায় চার যুগ স্বাধীন বাংলাদেশে; তার জনচেতনার ধরন কি আমরা জানতে পেরেছি? পৃথিবী আদিকাল থেকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে আছে, শাসক আর শাসিতের পৃথিবী। উপনিবেশ আসে উপনিবেশ যায়, শাসন ও শোষণের রূপের পরিবর্তন হয় না; যে সত্যের জন্য মানুষ লড়াই করে, সেই প্রতিষ্ঠিত সত্য আবাও অন্য সত্যকে প্রতিহত করে; কবিকে আবার দাঁড়াতে হয় নতুন সত্যের পক্ষে। রাজদরবারে কবি সর্বদায় মুখপাত্রের কাজ করে; কবি কখনো সরাসরি প্রথম পক্ষের অবস্থান নেন, কিংবা নীরবতার মাধ্যমে। কিন্তু কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছাড়া একটি জাতি রাখালবিহীন মেষশাবকে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের বিবেকি সাহিত্যিকগণ তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন; কিংবা নশ্বরমোহ তাদের আক্রান্ত করেছে। তাদের এই ব্যর্থতা এবং ক্ষুণ্নিবৃত্তির সুযোগ নিয়ে স্বৈরশাসক, মৌলশাসক, কর্তৃত্ববাদি শাসকগণ আমাদের ওপর চেপে বসেছে।

সৈয়দ হক লেখক হিসাবে যা করছেন আমার বিবেচনায় তার সবটাই ঠিক আছে, কেবল তার অবস্থানটি ঠিক নেই। তিনি একটি স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজতান্ত্রিকতা ও প্রগতিশীলতার লড়াই চালিয়ে যেতেন তাহলে জাতির লেখক ও বিবেক গঠনে সহায়ক হতে পারত। অবশ্য কি পারত, সে আলোচনার চেয়ে কি পেরেছেন সেই আলোচনাই আজ প্রধান হয়ে থাকা উচিত।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test