E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শাফিক আফতাব এর গল্প

২০১৬ জানুয়ারি ০৩ ১৫:১৪:০৮
শাফিক আফতাব এর গল্প







 

রূপলাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর

স্ত্রী মরে যাবার পর মাস্টার সাবের কোন কিছুতেই মন নেই- প্রাণে প্রাণ নেই, মনে মন নেই। দিনে দিনে শুকে সে হয়েছে শীর্ণ কাঠের মতো। মুখে-চোখে ফ্যকাশে আলো তাকে গ্রাস করেছে। না কামানো খোসা খোসা দাঁড়ি। ইস্ত্রিহীন কোকড়ানো পাঞ্জাবী। ভাঁজ করা হাতায় বিড়ির আগুনে পোড়ানো ক্ষত। কালিহীন জুতোর তলায় গবাদীর মল। দাঁতের পাটিতে সোনালী কেতুর। নাকের গহবরে কিছু ময়লা।

মাস্টার সাবের নাম হাবিউল আলম। বয়স ৫৫ বছর, উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা। চুল আধাপাকা। তবে গোফেই পাক ধরেছে বেশি। হাত-পায়ের গড়ন ভীষণ মোলায়েম- আঙ্গুল যেন লাউয়ের ডগার মতো। নেশার মধ্যে পান-সিগারেট। গাল দুটি ভরাট নয়- একটু বন্ধুরতা আছে। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবী তার পছন্দ। প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখন সচ্ছলভাবে দিন গেলেও একদা কষ্টের দিন ছিলো তার। যে চাকরিটা সে এখন করছে, সেটাকে মানুষ ছাগলচরা চাকরি বলতো। সেই সময় ভালো অবস্থাশালী পরিবারের ছেলেরা এই ছাগলচরা চাকরি করতো না। শোনা যায় মাস্টার সাব তিনদিন না খেযে শেষ অবলম্বন হিসেবে এই ছাগলচরা চাকরিটা নিয়েছে। তারপর তার জীবনে গেছে কত ধকল, জীবন গঠনের কত সংগ্রাম। পাড়ার মানুষ বাঁকা ভাবে দেখলেও সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো, সে একজন শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর। যে যাই বলুক, এই প্রাইমারি স্কুলের চাকরিকে মানুষ যতই ছাগলচরা চাকরি বলুক। একদিন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটবে। শিক্ষকের মর্যাদা বাড়বে। সে লেগে থাকে তাই। তখন ব্রিটিশ সরকারের আমল।


হাবিউলের চার সন্তান। দুই ছেলে- ইমন ও সুমন। দুই মেয়ে-মিলি ও লিলি। ইমন ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স করে বিয়ে করেছে ইংরেজিতে পড়া সহপাঠিনীকে।। ইমন সাহিত্যের ছাত্র হলেও সুবোধ, ক্ষুদে মেধাবী আর অহঙ্কারী। কথায় ব্যবহারে যে সব গুণ থাকলে মানুষ ভদ্র বলে- সেই ভদ্র দলের মধ্যে তার নাম শেষের সারিতে আছে, কারণ তার মেধার চেয়ে মেধার ভাণ বেশি। সর্বসাকুল্যে সে অনার্স পরীক্ষায় থার্ড ক্লাস পেয়েছিলো। আবার সাবসিডিয়ারী ফেল করেছিলো দুই দুইবার। তবু ভাবখানা এমন দেখাতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জটের কারণে তার বেরুতে বিলম্ব হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজের ছাত্র সে। ছুটিতে, বন্ধে বাড়িতে এলে কমদামী স্নোহ পাউডার গায়ে মেখে দেমাকের সহিত এমনভবে রাস্তা হাঁটতে যেন, সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণা করছে। ইংরেজি সাহিত্যে পাশ করেছে সে ঠিকই, কিন্তু পি পরে এইচ থাকলে উচ্চারণ কেনো ‘ফ’এর মতো হয়, সেটা সে কোনোদিনই বলতে পারেনি। আবার ডাক্তারকে দেখতে না দেখতেই রোগিটা মৃত্যুবরণ করলো, এই ট্রান্সশ্লেশনটিও তার দ্বারা করা সম্ভব হয়নি। সে যা হোক এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ শোনা যায়নি। তবে গাইবান্ধা চৌধুরী সিনেমা হলে কোন এক স্কুল টিচারের মেয়ের সাথে ছবি দেখতে গিয়ে মেয়ের এক প্রেমিকের হাতে ধরা পড়ে কিছু উত্তম-মাধ্যম হয়েছে বলে শোনা গেছে।


সুমন বি.এ পাশ করে পত্রিকার পাতায় চাকরি খোঁজে। মেধার বহর তার নেই বললেও চলে। তবে সে অহঙ্কারী না। সময় পেলে সকালে বিকেলে সুন্দরী মেয়ের পিছনে একটু ঘুর ঘুর শুর শুর করা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। মিলির বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর হল। সে দুই সন্তানের জননী। লিলি বাড়িতে থাকে। লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে সে বোবা হয়। এখন তার বয়স ২৬ বছর। ওর কোন কাজ নেই। শান বাঁধা পুকুরের পাড় ও ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠা ছাড়া তার আর কোন কাজ নেই তার, যেন তার কিছুই করার নেই। আদীঅন্তহীন সময় তার কাটে না। মুখ দিয়ে কী যেন বিড় বিড় করে যায়, কেউ বোঝে না তা ; মা বুঝতো, সেই মা তো নিরুদ্দেশে হারিয়ে গেলো।


কয়েক মাস কেটে যায়। যে যার কাজে ব্যস্ত। মা মরে যাবার পর লিলি কেঁদেছে সবচেয়ে বেশি। দুঃখটা বুঝি ওরই বেশি ছিলো; অনুভব বোঝা যায়, ওর কান্নায়। তবু সে বাবার টুক টাক কাজ করে দেয়।


বৌমার নাম প্রিয়াংকা। সে রাজ পরিবারের সন্তান। পূর্বপুরুষ ছিল জমিদার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারীর বিলোপ ঘটেছে। তবুও ধ্বংসাবশেষ যা আছে পুরানো ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করে। দ্বিতীয় পক্ষ্যের স্ত্রীর ঘরের সন্তান প্রিয়াংকা। সৎ মায়ের সংসারে কত যুদ্ধ করে লেখাপড়া শেষ করতে হয়েছে তাকে। সে বোঝে অর্থের গুরুত্ব। সম্পর্কের তারে বাঁধা আত্মীয়তা তার ভালো লাগে না। শ্বশুরের দেখাশুনা করে না সে। প্রিয়াংকারও গোয়েন্দাকাহিনির অন্ত নেই। উল্লেখযোগ্য হলো ইমনের সঙ্গে বিবাহের তিনমাস আগে গাইবান্ধার উপশম ক্লিনিকে তার ওএমআর হয়েছিলো। নবীন ডাক্তারনি ছিলো হাবিউলের ভাগ্নে রোহানের স্ত্রী লাবণী। সেইসূুত্রে সংবাদটা প্রাপ্ত হয় হাবিউল। কিন্তু নিজের বউমার কথা কীভাবে সে রাষ্ট্র করে দেবে ? আর ইমনও অমন এক্সক্লসিভ এলাকা থেকে ধরা খেয়ে অবশেষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য হয়।


সুমন নবীন যৌবনের উত্তাল তরঙ্গে ভাসছে। ইমন কলেজে অধ্যাপনা করে; সংসার দেখাশোনা করে। তার কাছে জীবনের টাকাটাই আসল। তাই সে ছলচাতুরি করতে ছাড়ে না। অফিসের ফাইল পাড় করা, প্রিন্সিপালের তোষামোদী করা সে এখন হরহামেশা করে। এখন সে চুটিয়ে কুঞ্জবনে যায়, ওএমআর করা রাধার কুঞ্জে গুঞ্জন করে। ভুঞ্জনে মুখরিত করে রাতের আঁধার।


মিলি শ্বশুর বাড়ি। লিলি তো এই সুন্দর পৃথিবীটাকে শুধু দেখে দেখে যায়। দেখা ছাড়া কোনো কাজ নেই ওর! বাক প্রতিবন্ধির কী কাজ থাকবে এই মায়াময় ধরায়!


তাহলে মাস্টার সাহেবের উপায়?


কয়েক মাস মাস্টার সাহেব ভালোই ছিলো। স্ত্রী শোকে কান্নাকাটি করলেও স্কুলে ক্লাশ নিতে তার অংক কষতে ভুল হতো না। ইদানিং তার অংক ভুল হয়। চক ডাস্টার ক্লাশের টেবিলে রেখে টিচার্সরুমে চলে আসে। দোকানে বিড়ি নিয়ে দাম দিতেও ভুলে যায় মাস্টারসাব। একদিন তো মেঘার দোকানে চা খেয়ে দাম না দিয়ে যেতে থাকলে মেঘারবেটা যা তা বলে ফেললো। আবার মজুমদার হাট থেকে একদিন বাড়ি ফিরতে উষ্টা খেয়ে পড়ে গিয়ে নাক ফাটিয়ে বাড়িতে আসে। বউ মা দেখেও তার পটিটটির ব্যবস্থা করেনি। সেই বোবা মিলি টিটল দিয়ে কাটা জায়গাটা মুছে দেয়।


হায় মানব জীবন! কি বন্ধন মানুষে মানুষে। একজনের অনুপুস্থিতিতে অন্যজন কেমন অসহায়। অংক ভুল হয়ে যায়! নাক ফাটে, দাম দিতে ভুলে যায়। নির্ঘুম রাত কাটে।


স্ত্রী থাকতে মাস্টার সাহেব সময় মতো খেতে পেতো। স্বাস্থ্যটা ভালো ছিল। গায়ের তেলটা, সিগারেটের প্যাকেটটা, পানের ডিব্বাটা চাওয়ার আগেই সামনে হাজির হতো। রাত্রিতে বিছানা থাকতো- যেন ফুল শয্যা। বড় পরিচ্ছন্ন ছিল মাস্টার সাহেবের স্ত্রী। তা না হলে শেষ বয়সেও বিছানাকে ফুল শয্যার মতো মনে হবে কেন? সপ্তাহের সাত দিন পরতো সাত রংয়ের পাঞ্জাবী। বড় ভাব ছিলো দু’জনাতে। মানুষেরা বলাবলি করতো এমন মহব্বত তাদের লাইলী মজনুর মতো মনে হয়।


আর মাস্টার সাব বিয়েটাও কি করছে যে সে ঘরে। বড় বুনিয়াদী ঘর ছিলো। বিশাল বাড়ি। টিনসেট বিল্ডিং। সেই ব্রিটিশ আমলের বাড়িতে কী যে কারুকাজ। দেয়ালে আলপনা আঁকা। বাড়ির সামনে বিশাল পুকুর। পুকুরের চারধারে নারকেল আর সুপারীবন। বাড়িতে পিছনে বিশাল বাঁশঝাঁড়। প্রাচীর দিয়ে বাড়ি ঘেরা। শানবাঁধা পুকুরের জলে কী সুন্দর রুই কাতলার বিচরণ। গোয়ালে কয়েকটি দুধেল গাই। হালচায়ের কয়েকটি বলিষ্ঠ বলদ। ঘরের ভাতই শুধু নয়, কয়েকশ মন করে ধান বিক্রি করতো প্রতি মৌসুুমে। সেই ঘরে বিয়ে করে মাস্টারসাব। মাস্টারসাবের বংশবুনিয়াদ ভালো না থাকলেও সরকারী চাকরি করায় ছোট্ট মেয়েটাকে মাস্টারসাবের হাতে তুলে দেয়। কারণ মাস্টারসাবের শ্বশুর নিয়ামতউল্লাহ বেপারি ঠিকই জানতো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একদিন উন্নতি হবেই। ছাগলচরা চাকরি যতই মানুষ বলুক, একদিন জাতীয়করণ হবে প্রাইমারী স্কুলের চাকরি।


মাস্টারসাবের স্ত্রীর নাম আলেয়া। সেই আমলে ক্লাস ফাইভ পড়া। আর মক্তব সিবেরা তো আছে। মাস্টার সাবের বিয়েটাও আবার নাটকীয়তায় ভরা। প্রথম পোস্টিং হয়েছিলো কামারজানির ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায়। রাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা। কাঁচারাস্তা। দুচারদিন পায়ে হেটে স্কুল করতেই পায়ের গিঁটে গিঁটে ব্যথা ধরে যায় তার। অগত্যা বনলতা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি নিয়ামতউল্লাহর বাড়িতেই জাগির থাকতে হয় তাকে। আচারে ব্যবহারে অমায়িক আর সোনার ছেলে। যেমন লম্বা, সেনাবাহিনীর অফিসার! শেষ বয়সে নিয়ামতউল্লাহ আলেয়াকে মাস্টারসাবের হাতে তুলে দিয়ে ইন্তেকাল করেন।


সেই ব্রিটিশ আমলের বাসররাতে মেয়েরা কান্নাকাটি করতো। কিন্তু আলেয়ার কান্না কেউ শোনে নাই স্বর্ণলতা গ্রামে। মাস্টারসাব এমন রোমান্টিক আর নান্দনিক মানুষ যে স্ত্রীকে মন দিয়েই ভালোবেসেছিলেন। সেই প্রথমরাত, আলেয়ার কোলে মাথা রেখে মাস্টারসাবের মনে হয়েছিলো সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় হারিয়ে যাওয়া তার মায়ের কোল। আজন্ম দুঃখদারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া মাস্টারসাব সেদিন মায়ের কোল ভেবে এক পশলা কেঁদেছিলো। শাশ্বত নারীর শুশ্রুষা পুরুষের চোখে জল ঝরায়। তাই বুঝি, প্রথমরাতের ভোরে নিয়ামতউল্লাহ পুকুরে নগ্নদেহের ছলাৎছলাৎ শব্দে কারো ঘুম ভাঙায়নি। সেদিন শুধু গল্প হয়েছিলো। টুপটুপ গল্প। রাজবাদশার গল্প। নদীতীরের গল্প। আর জীবনের গল্প। সেদিন দুটিমন অঙ্গীকার করেছিলো, জীবনের চলার পথে তারা কোনোদিন কাউকে ভুল বুঝবে না। বিশ্বাস হারাবে না কেউ কারো উপর। সেদিন ছিলো হাতে হাত রেখে জীবন গঠনের পাঠ। সেই বাসররাতে আলেয়া মাস্টারসাবকে জীবনের পাঠ শিখিয়েছিলো । সেই শেখানোয় চলে গেছে দাম্পত্যজীবনের আটাশটি বছর। তারপর অকস্মাৎ কী হলো! এক মহাজীবনের ডাকে, আলেয়া প্রস্থান করলো মাস্টাসাবের স্কুল থেকে, টিসি নিয়ে চলে গেলো এক মহাবিদ্যালয়ে।


অনাহার আর অনাদরে মাস্টার সাহেবের অবস্থা এখন শীর্ণ পাট কাঠির মতো। বুকের পাঁজরগুলো জলছাপের মতোন ভেসে উঠেছে। একদিকে স্মৃতিকারতা, অন্যদিকে আধুনিকা ছেলেবউয়ের অবহেলা, অনাদর আর অনীহা। সে ভাবে- আমার কী নেই। আমার কী হাঁসে খাইছে ! তিলতিল করে আমি এই সাম্রাজ্য গড়েছি। তবে কষ্ট কেন? কারো করুণা কেনো?


আবার ক’টা দিন কেটে গেলো।


সকাল। শীতের সকাল। মিষ্টি রোদে প্লাবিত সমস্ত পৃথিবী। কুয়াশাও পড়েছে ভীষণ। একটু ঠা-া বাতাস। তবু মিষ্টি রৌদ্রে প্রাণে স্পন্দন জাগে। নিস্তেজ নুয়ে পড়া প্রাণেও জাগে কোলাহল। মনে হয় বসন্ত অপেক্ষা করছে যেন দরজায়-জানালায়।


মাস্টার সাহেব বাজারে যাচ্ছিল চায়ের নেশায়। তাছাড়া সকালে খিচুরীর নেশাটাও তার ঘোর।
পথে আকবর আলীর দেখা হলে বলল :


-বাড়িতে বুঝি বাহে আর চা টা হয় না? তোমার ছেলে বউ যে কি এই বয়সে তোমার একি হাল করেছে ?
মাস্টার সাহেব কান্না কান্না গলায় বললো- চা টা হয়- কিন্তু হয়না আমার। মানে আমার মতো হয় না।
আকবর আলী গ্রাম সম্পর্কে মাস্টার সাহেবের ভাতিজা। তাছাড়া একসাথে চাকুরিও করেছে কিছুদিন।
দুই জন একসাথে বিনোদপুর বাজারে এসে আবুলের চায়ের দোকানে বসলো। একটু পর আসলো জব্বার মাস্টার, রিয়াজুল মাস্টার আর হায়দার আলী দর্জি।


কে একজন বলে উঠলো- কি মাস্টার সা’ব আর কি কিছু হবে না? তোমার কি কিছু নেই?


মাস্টার সাহেব একটু রেগে উঠলো, বললো- হ, আমার তো হাঁসে খাইছে। কিছু নাই মানে, এখনও দুই একটা হজম করতে পারিম হে!


রিয়াজুল বলে উঠলো- একি তোর হাল! বউটা মরে যাবার পর তুই এতিমের মতো হয়ে গেলি যে! ইংরেজি সাহিত্য পড়া বউটা কি তোর একটু খোঁজ খবর নেয়না ? এভাবে চললে তুইতো বেশি দিন বাঁচবি না রে !
জব্বার বলে উঠলো- আরে ছেলেরা যখন শিক্ষিত হয়েও এ হাল করেছে- তবে তোকে আর একটা নিকাহ করে ছাড়ব।


মাস্টাবসাব এদিক সেদিক ছালিছুলি করে তাকায়, কোনো কথা সরে না তার মুখে ! ইতিম বাচ্চার মতোন কষ্টে সকালের নাস্তাটা সারে আবুলের স্টলে।


মাস্টারগণ সবাই মাস্টার সাহেবের বাল্যবন্ধু।


কুয়াশা একটু একটু করে কেটে গেছে। রোদের তাপ একটু একটু করে বাড়তে লাগলো। চায়ের আড্ডা চলতে চলতে বেলা বেজে গেলো নয়টা। মাস্টার সাহেবগণ সবাই যাবেন স্কুলে। যাবার সময় জব্বার উঁচু গলায় বললো- এত ধন সম্পদ জমি দিয়ে কী হবে রে ? বিয়ে আর একটা তোকে করিয়েই ছাড়ছি। দেখি, শালারপুতদের শিক্ষা হয় কিনা। বাপকে চেনেনা ! সুখে থাকতে ভূতে কিলায় ।


স্কুলে আজ ঠিকমতো ক্লাশ নিতে পারলো না মাস্টারসাব। ছাত্রদের কী পড়াতে কী পড়িয়েছে, নিজেও জানে না সে। দুই দুই চার না লিখে আজ সে লিখেছে পাঁচ। সকাল সকাল বাসায় ফিরে কিছু না খেয়ে আজ সে বিকেল বেলাই দিয়েছে দিব্যি ঘুম। জীর্ণ শীর্ণ ক্লান্ত অবস্থায় লোকটি ঘুম না দিবেই বা কেন। ঘুম ছাড়া আজকাল তার আর কোন কাজ নেই। সে চায় চির অনন্ত শান্ত এক ঘুম। কিন্তু সে ঘুম চাইলেই পাওয়া যায়?


মাস্টার সাহেবের আজ সেই ঘুম নাকি ?


রাত নটা বাজে। তার শোবার ঘরে কেউ আসেনি খোঁজ নিতে। সন্ধ্যা বেলার দিকে বোবা লিলি এসে দেখেছে বাবা ঘুমাচ্ছে নাক ডেকে। বাবার দুঃখ বোঝে সে। কিন্তু বোবা অসহায় মেয়েটির পা দু’টো অবশ। আজকাল সে ঠিক মতো হাঁটতেও পারে না। বাবার জন্য সে কী-ইবা করতে পারে?


রাত ১টা ৩০ মিনিটের দিকে মাস্টার সাহেবের ঘুম ভাঙলো। শীতের রাত। শির শিরে বাতাস। আকাশে চাঁদ চতুর্দশীর। কুয়াশায় ছেঁয়েছে প্রান্তর। কোথাও কোন আলো নেই। আলো আছে বাইরের পৃথিবীতে। মাস্টার সাহেবের আকাশ ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন।


ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর মাস্টার সাহেব ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকালেন। বউমা যথারীতি খাবার টেবিলে খাবার রেখে গেছে।


মাস্টার সাহেবকে ঘুম থেকে ডেকে আদর করে আর কে খাওয়াবে ? যে ছিলো, সে তো এখন শুধুই স্মৃতি। একটা শির শিরে বাতাস শীতের এই রাতের ভিতর জানালার ভিতর দিয়ে ঢুকে মাস্টার সাহেবের বিবর্ণ শীর্ণ হৃদয়ের ভিতর গিয়ে কী যেন বলল। মাস্টারসাব দুলে উঠলো জলোচ্ছ্বাসে যেমন দুলে ওঠে সাগর। ভোরের প্রথম সূর্য যেমন এক ঝলকেই সারা পৃথিবীতে আলোয় উদ্ভাসিত করে- তেমনি একটি মাত্র শির শিরে বাতাস তার সমস্ত দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তি আনন্দ-বেদনা ভেসে উঠলো। অস্থির হয়ে উঠলো সে। রাতের খাবার খেলোনা। বড় সুগৃহীনি ছিলো আলেয়া। আলেয়াকে আজ আলেয়ার মতো মনে হয়।


রাত বাড়ছে। সমস্ত পৃথিবী নীরব নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই যেন। জেগে আছে মাস্টার সাহেব, আর শিশির পড়ছে। টপ টপ শিশির। সমস্ত শিশির উন্মুখ করে তুলছে মাস্টার সাহেবকে। সে আলেয়ার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।


-তুমি আমাকে একা ফেলে রেখে চলে গেলে! তোমার একটুও দয়ামায়া নেই। একটুও------।


আর কিছু জানা যায়নি। প্রথম ভোরে আযানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়েছিলো দশদিগন্ত। মোরগ ডেকেছে, রাতজাগা পাখিরা ভোরে কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে দিয়েছে শিশুর। আজ রাতে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র-অধ্যাপকগণ পাশ্চাত্য স্টাইলে উপভোগ করেছে সুরা। সুধায়, সুরায় গড়াগড়ি খেয়েছে পুলকের বাগানে। বিয়ে হবার বেশ ক’বছর হলো, তবু অঙ্কুরোদ্গম নেই। ভ্রণের চিহ্ন নেই। রাবেয়া ক্লিনিক, গাইবান্ধা আধুনিক ক্লিনিক, তাজুননাহার আপার পরামর্শ কোনো কিছুতেই কাজ হয় নি। শেষে সোলেমান ফকিরের তাবিজ ঝুলিয়েছে বুকে, হাতে আর পালঙ্কের কোণায়। তবু কাজ হয় নি। আজ আল্লাহ রসুলের নাম নিয়ে তারা মধুর মিলনে মোহনায় মিলেছিলো। তারা যুগল স্নানে এসে দেখে ; বাবা, মার কবরের পাশে অচেতন পড়ে আছে।

ধরাধরি করে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। মাস্টার সাহেব জ্ঞান হারিয়েছে। বোবা লিলি হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। পোষা কুকুর পাশে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। সে বুঝতে পারছে একটা কিছু হয়েছে।


সকাল হলো। ডাক্তার এলো। জুম্মু ডাক্তার। পাশের বাড়ির আরো লোকজন। কয়েক ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো মাস্টার সাহেবের। থার্মোমিটারে তার জ্বর উঠেছে ১০৩ ডিগ্রী। সেদিন জ্বর কমলোনা। তার পরের দিনও না। স্কুল থেকে হেডমাস্টার সাহেব এবং অন্যান্যরা এসে তাকে দেখে গেলো। শ্বশুর বাড়ি থেকে বড় সম্বন্ধি আসলো কিছু ফলমুল আর একটা ঘিয়ে পাঞ্জাবী নিয়ে। কয়েকদিন পর মাস্টারসাব একটু সুস্থ্য হয়ে উঠলো। কিন্তু পূর্ববৎ তার ভুল হতে থাকলো। হাতে কলম রেখে সে ছাত্রদের কলম চায়। চোখে চশমা রেখে বলে, আমার চশমা কোথায় গেলো রে ! কুদ্দুস..... ?


ছেলেদের অনাদর আর অবহেলায় বড় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো মাস্টার সাহেব। তার কী নেই- সবই আছে। আছে অঢেল সম্পত্তি। তিলতিল করে সে সা¤্রাজ্য গড়েছে। বাবার পৈত্রিকসূতে জমি পেয়ছিলো আটাশ শতাংশ। তা থেকে সে এখন আঠারো বিঘা সম্পত্তির মালিক। আলেয়ার কঠিন সাধনা আর নিজের কঠো অধ্যবসায়ে সে দিন আনে দিন খায় প্রবাদ ঘোঁচাতে সক্ষম হয়েছে। সে যা করেছিলো তার ছেলে মেয়ের জন্য। শেষকালে এমন গতিক হবে তার কি জানা ছিলো। সে ভাবে, মানব জীবন আর ক’দিনের। ক্ষণভঙ্গুর পৃথিবীতে ধন সম্পদের বড়াই যেন বালির বাঁধের মতো। নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও বাকীর খাতায় শূন্য থাক। কথাটা কী উড়িয়ে দেওয়ার মতো। ? হয়তবা নয় ? মাস্টার সাহেব মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে, নিজের কাছে নিজেই সে যেন ভাইভা পরীক্ষা দিচ্ছে। সে নিজকে নিজেই প্রশ্ন করছে, নারী পুরুষের মিলনেই তো পৃথিবী সুন্দর। ইসলমে তো চারটি পর্যন্ত বিবাহ করার নিয়ম আছে। খাওয়াতে পরাতে পারলে সমস্যা কীসের? সে ড্রেসিং ডেবিলের সামনে যায়, আধাপাকা চুলগুলো বুলায়, নিজকে বলে, তুমি কি আসলেই বুড়িয়ে গেছো, পারবে না একটা বউ পালতে ? পারবে তো ? সে বুকে একটা থাপ্পর মারে, বিবাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

শুরু হলো কনে দেখার পালা।

২.
পৃথিবীটা একটা বিরাট খেলাঘর। এই দু’দিনের খেলা ঘরে কেউ চায় সমস্ত পৃথিবীটাকে কাঁপাতে। আবার কেউ চায় একটু আহার- দু’ বেলা দু’ মুঠো ভাত। দু’ বেলা দু’ মুঠো ভাত পেলে চাওয়ার কিছু থাকে না তাদের। যেমন থাকেনা বিনোদপুরের কাদের ব্যপারীর। এক সময় পাটের ব্যবসা করে প্রচুর টাকা পয়সা কামিয়েছিলো লোকটি। টাকাগুলো গেলো কোথায়? যাবে আর কোথায়। সংসারে তার সমস্যার সংখ্যা তো কম নয়। কোন ছেলে নেই। ছয় মেয়ে। স্ত্রী মারা গেছে সাত নম্বর বাচ্চাটা প্রসব করার সময়। ওই বাচ্চাটা ঠিকই ছেলে ছিলো। কিন্তু মরা বাচ্চা জন্মাবার সময় মা জরিনা বেগম মারা যায়। সেই সময় লোকটা যে উদাসীন হয়েছে ব্যবসায় আর মন দিতে পারেনি ভালোমতো। পিতা পিতার মতো হয়ে- কখনো মাতার মতো হয়ে ছয় সন্তানকে মানুষ করেছে সে। স্ত্রী মারা যাবার সময় প্রথম মেয়ে শিউলিকে বিবাহ দিয়ে যেতে পেরেছে কাদের বেপারী। এখন দ্বিতীয় মেয়ের বয়স ২৪ বছর। তৃতীয়টির ২০। চতুর্থটির ১৭। তিনটিই মোটামুটি বিবাহের উপযুক্ত হয়েছে। বিয়ের ঘর এসেছিলো বেশ কয়েক জায়গা থেকে। এ চাই, ও চাই। কাদের ব্যপারীর সামর্থ নেই ‘এ’ ‘ও’ দেয়ার। তাহলে কে তার মেয়েদের বিনা পয়সায় বিয়ে করবে?


তারউপর আবার সৎ ভাইয়ের উপদ্রব। সে থাকে সাদুল্যাপুরে। নিসন্তান চাচা তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে মানুষ করে। আচমকা এসে সে জমির অংশ বিক্রি করে। এদিকে দুই দুইবার বন্যায় সরাইখানার জমির ফসল গেছে মাইর। সে এখন চোখে সরষে ফুল দেখে। মেয়েদের সুপাত্রে পাত্রস্থ করা তো দূরের কথা, দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটে না তার।


কিন্তু জীবন কি থেমে থাকে ? কারও জন্য কেউ কি আটকে যায়? জীবনের গতি কি কেউ আটকাতে পারে।? নদীর স্রোত যেমন- মানুষের জীবনও তেমন। বয়ে যাওয়া চলে যাওয়া-। কোনো না কোনো ভাবে চলে-। মানুষের জীবন চলে। চলবেই। সেই অনাদি থেকে চলছে-। অনন্তকাল পর্যন্ত চলবে-।


ব্যাপারী সাহেবের সংসার পালহীন নৌকা। আয় উপার্জন নেই। যৌতুক দেয়ার মতো কোন সামর্থ নেই। তাই বলে তার মেয়েদের বিয়ে হবে না? হবে । হয়ত মনের মতো হবে না। সব কিছুই কি মনের মতো হয়? ঘয় ? সব হয় না। এই তো নিয়ম।


বিয়ের বয়স নাকি পার হতে চলছে জরিনার। গ্রামের মানুষ অনেকে অনেক কিছু বলে। বললে আর কী হয়। গ্রামের মোড়ল কানকাটা কুদ্দুস বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। বাধ সেধেছে কাদের ব্যাপারি নিজে। কারণ একই সঙ্গে ব্যবসা করেছে কাদের ব্যাপারি। তাছাড়া তার মেয়ে জরিনা ধর্মপূর পি এন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেছে।

আমাদের মাস্টার সাহেবের শ্বশুর বাড়ি এই বিনোদপুরে। কাদের ব্যপারী সম্পর্কে গ্রামের সম্পর্কে শ্বশুর হয়। মাস্টার সাহেবের আসা ছিলো মাঝে মাঝে এই বাড়িতে। জরিনাকে চেনে সে। সম্পর্কে দুলাভাই হয় মাস্টাসাব। মাঝে মাছে শালি দুলাভাইয়ের মধ্যে মজাক টিটকারী হয়েছিলো বই কি! মাস্টারসাবের মনে পড়ে কাদের ব্যাপারী তো এখন কন্যাদায়গ্রস্ত। সে একটা পথ বের করতে চায়। নিজের বিয়ের কথা তো নিজে বলাটা কেমন হয়। জব্বার মাস্টারের কথা মনে হয় তার । জব্বার তার বাল্যবন্ধু, মনখুলে গোপণ কথা বলতে সমস্যা নেই।


স্কুল শেষে সে আজ বাড়িতে যায় না। ধর্মপুর বাজারে এসে মেঘার দোকানে বসে। মনুয়া কলা দিয়ে একটা পামের রুটি খায়। তারপুর চিনি কম দিয়ে এককাপ রঙ চা খায় মাস্টারসাব। বাজারবেলা ঠিকই জব্বার মাস্টার আসে। স্টলে ঢুকেই, কী রে, বুইড়া, তোকে আজ হলকচলক মনে হইতাছে, কদিন আগে মরতে গেছিলি। তো কী খবর, বল?


মাস্টারসাব বলে, আরে, বস তো, শয়তানি করিস না। তোর সাথে কানকথা আছে।


-কানকথা বাদ দে, প্রাণ কথা বল, তোর বলতে হবে না, তোর জন্য ব্যবস্থা করেই আইসি। কাদের ব্যাপারি দোসরা মেয়ে জরিনাকে দেখেছিস তো ? আমি প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। এককথাতেই রাজি হয়ে গেলে কাদের ব্যাপারি।


-জরিনার মতামত নিসিছ, ও যদি বিয়ে না করে।


-আরে মেয়ে মানুষের মতামত, ও ঠিক হয়ে যাবে, দুই একরাত ঠিকমতো আদর আপ্যায়ন করিস, দেখবি তোকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতাছে না। খয়বর মেম্বার আসতেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ খয়বার মেম্বারও জরিনাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো কদিন আগে। পাছে কিছু একটা ফাঁস হয়ে যায়, ওরা তড়িঘড়ি উঠে চলে যায়।


কাদের ব্যপারী পৌষের সকালে গায়ে পুরানো চাদরটা মুড়িয়ে পুকুরের পাড়ে রোদ খাচ্ছিলো। এমন সময় জব্বার এসে হাজির। জব্বার কে দেখে কাদের ব্যপারী হতবাক।
চাচা কেমন আছেন ?..............


-আছি বাহে জামাই। তো তোমরা কেমন আছেন?


-আছি বা, তো একটা কথা নিয়ে আইছিলাম বাহে, মানে ওই যে জরিনা আছেনা,..................


বুঝতে পারে কাদের ব্যাপারী । জরিনা সাথে হাবিউল আলম মাস্টারের নিকাহর কথা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা উপায়ান্ত না পেয়ে রাজি হয়ে যায়, দিনতারিখ ঠিক হয়, জরিনা কিছু বলে না। কি আর বলার থাকতে পারে ওর ! পেটের ক্ষুধার কাছে মানুষের মান সম্মান আর প্রেম ভালোবাসাব বড় নয়, এই দুনিয়ায় দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পড়ে যাওয়াটাই তো আসল কথা। অনিবার্য নিয়তিকে অনায়াসে মেনে নেয় জরিনা। জব্বার মাস্টার যাবার পর জরিনা কাছে আসে, বাবা তার দিকে তাকাতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, বলে তোকে আমি আগুনের মধ্যে ফ্যালাইয়া দিতেছি রে মা ! তুই আমারে ক্ষমা করিস, আমি আর পারলাম না ! পারলাম না !!

কয়েকদিন পর একদিন মাস্টার সাহেবের বাড়িতে ঝগড়া বিবাদের আওয়াজ শোনা গেলো। বোঝা গেলো ঝগড়াটা বিবাহ সংক্রান্ত।


একটু এগিয়ে গিয়ে শোনা গেলো মাস্টার সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে সুমন বাপকে বলছে ‘বিয়ে যদি তোমাকে করতেই হয়- আমরাই তোমাকে বিয়ে দিবো। আমাদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে।


মাস্টারসাব চেঁচিয়ে উঠে বলে, চুপ কর, হারামজাদা। লজ্জা করে না, বাবার বিয়ের কথা বলতে।


-বাপের বিয়ের কথা বলতে যদি লজ্জা করতে হয়, তবে বাপটা যে বুড়ো ছেঁড়ির পিছে লেগেছে, তাতে বাপটার লজ্জা হয় না ক্যান। তোমার জন্য সমাজে আমাদের মুখ নেই। তুমি বিয়ে করলে করো, বয়সের ব্যাপার স্যাপার একটু খেয়াল করো,

ওরা চাচ্ছিলো স্বামী পরিত্যক্তা কোন মহিলার সাথে বাপের বিয়ে হয়ে যাক।


কিন্তু মাস্টার সাহেবের শরীরে একটু ধস পড়েছে, মনে তো ধস পড়েনি। এই সব স্বামী পরিত্যক্তা কোন মহিলাকে সে বিয়ে করবে না। করবে এক ষোড়শী, অষ্টাদশী কিংবা বিংশতি। সে যে ঘরের মেয়েই হোক না কেন- হোক না দিন আনে দিন খায় এমন ঘরের। দুঃখ নেই তার।


ও দিকে কাদের ব্যপারীর মেয়েরও কোন দুঃখ নেই। শুধু দু’ বেলা দু’ মুঠো ভাত চাই। চাই একটা নির্ভরতা। একটু আশ্রয়। তাই তার উচ্চাকাক্সক্ষা করা দুরাশা মাত্র।


যথা সময়ে মাস্টার সাহেবের বিয়েটা হয়ে যায়। আজ মাস্টার সাহেবের বাসর রাত। জ্যোৎস্নায় প্লাবিত সমস্ত পৃথিবী। কোথাও কোন শব্দ নেই যেন, বুঝি পৃথিবীর কেউ নেই। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা। পৃথিবীর সকল কলঙ্ক মুছে দিয়ে গেছে। তাই বলে মাস্টার সাহেবের হৃদয়টা হয়তবা আজ মুছে দিয়ে গেছে ব্যাপক, বিপুল। তা না হলে প্রথম স্ত্রীর সাথে বাসর রাতে হাতে হাত রেখে এই মাস্টার সাহেব শপথ করে বলেছিলো, এই হাতে হাত থাকবে চিরদিন। যতদিন বেঁচে আছি, তোমাকে ভালোবেসে যেন মরতে পারি।
আলেয়া বলেছিলো- আমি মরে গেলে তুমি আর বিয়ে করবেনা?


মাস্টার সাহেব বলেছিলো- না গো না। ইহ জীবনে কেন- পর জীবনেও আমি আর তোমাকে ছাড়া কাউকে চাইনা। মাস্টারসাব সেই বাসররাতে শুধু গল্প করেছিলো, শপথ করেছিলো, শুধু হাতে হাত রেখেছিলো, সেদিন বেলিফুলের গন্ধে মনে হয়েছিলো এই আলেয়া যেন তার কতদিনের চেনা। কাব্যতীর্থ খেতাব পাওয়া মাস্টারসাব সেই বাসররাতে কবি শাফিক আফতাবের একটা কবিতা আবৃত্তি করে।


তুমি আমার হৃদয়ে-
ফুটন্ত পুষ্পের অপূর্ব সুরভীর বন্যা,
আমার গানে নিত্য বাজানো একটা সুরের আকাশ।
তুমি আমার তটিনীর উচ্ছ্বিত উর্মির ঝিলমিল-
হাসির জোয়ারে ভরে দেয়া-
অনেক প্রণয়ের প্রজ্বলতা।
আজ আটাশ বছর পরে আরেক বাসর রাতে সে আবার আবৃত্তি করে :
তুমি আমার,
চলার ছন্দ-কবিতার শব্দ
গানের সুর
তুমি আমার সুখের নীড়-শান্তির আবাস
স্বপ্ন মধুর।


তারপর সে কোনো কথা না বলে ফণা তোলে, উপগত হয়। বিংশতি রমণীর কোমলদেহে সে তার খসখসে চামড়া ঘষে। জরিনা কিছু বলেনা, কী বলার আছে তার, সে তো এমন পরিস্থিতিই কল্পনা করেছিলো। সে কতদিন পেটপুরে খেতে পারে না। আজ গরুর ভূনামাংস দিয়ে ভাত খেয়েছে সে। আর কিছু না হোক সকাল হলে পুরো পেটে তো সে ভাত খেতে পারবে !মাস্টারসাবের রোমশবুকের খাদে সে বলকানো ভাতের ঘ্রাণ পায়। শীতের রাতে ওমের সুগন্ধের চেয়ে একথালা গরমভাতের ভাঁপ সে অনুভব করে আলেয়ার রেখে যাওয়া ফুলতোলা কম্বলের নিচে। আলেয়াকে তার হিংসে হয় না। কেনো না তার অকাল মৃত্যুই তো তাকে এ ঘরে বউ করে এনেছে। আলেয়ার ফুলতোলা লাল কম্বলের গন্ধ শোঁকে সে, আর বলে, পরকালে ভালো থাকো বুবু, আমাকে অভিশাপ দিও না! তোমার ভালোবাসার ঘরে আমি যাবো না। আমিতো এ ঘরে ভাত খেতে এসেছি। তারপর সে ভয়খাওয়া পাাখির মতোন আস্তেধীরে মাস্টারসাবের ক্লাসে মনোযোগ দেয়। মাস্টারসাব আজ বহুদিন পর ব্লাকবোর্ডে চক ঘষে ঘষে অবিরাম লিখে যেতে থাকে সুদকষার অঙ্ক। এদিকে একমাত্র ছাত্রীটি বুঝলো কি বুঝলো না? সে দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাঁশের ঝাঁড়ে পাখিরা কিচিমিচির করে ওঠে। ভোর হয়, ফুল ফোটে।

হায় মানুষ!-মানুষের মন। নদীর স্রোতের মতো মন। মন সময়ে- অসময়ে বদলায়। তা না হলে মাস্টারসাব আজ সকালে ঈষৎ ঠাণ্ড জলে স্নান করবে কেনো?


সকালের নাস্তা সেরে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবীটা পরে ফনিক্স সাইকেলে স্কুলের পথে পা বাড়ায় মাস্টরসাব। আজ তার কী সুন্দর ফুরফুরে মেজাজ! আধাপাকা চুলগুলো বাতাসে দুলছে, গোফের চুলগুলো মনে হচ্ছে লকলকে ঘাস! খসখসে শরীর লোম থেকে বেরুচ্ছে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ....


লোকে বলে, আধা মরা মানুষটা কী তাগড়া হয়ে উঠলো!

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test