E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ০৯ ১৬:৪৬:৪৫
আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প







 

সৈকতের ফটোগ্রাফার

গত শীতে একবার কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। চমৎকার জায়গা। যারা পাহাড় পছন্দ করে তাদের জন্য পাহাড় আছে। যারা দ্বীপ পছন্দ করে তাদের জন্য দ্বীপ আছে আর সবার পছন্দ সমুদ্র তো আছেই। কক্সবাজার সত্যিই খুব সুন্দর জায়গা। বেলা তখন দশটা মতো বাজে। আমি সমুদ্র তীরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। দূর থেকে দেখলাম, একজন মানুষ উবু হয়ে শুকনো বালুর মধ্যে দু’হাত ডুবিয়ে কী যেন করছে। বালু নিয়ে খেলাটা এখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার।

সমুদ্র তীরে বসে ভেজা বালু দিয়ে মানুষ বিভিন্ন রকমের ভাস্কর্য তৈরি করে। কিন্তু শুকনো বালু দিয়ে তো ভাস্কর্য হয় না। ব্যাপার কী দেখতে এগিয়ে গেলাম। লোকটি যেভাবে বালুর মধ্যে তার দু’হাত সঞ্চালন করছেন তাতে তিনি যে কিছু হারিয়েছেন তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

বললাম- কী ? কিছু হারালেন না-কি? লোকটি কোনো কথা না বলে তার হাত দুটো আরো দ্রুত বালুর মধ্যে চালাতে শুরু করলেন। হাত তিনেক সামনে বালুর মধ্যে কী একটা চকচক করছে দেখে এগিয়ে গেলাম। বস্তুটি হাতে তুলে দেখলাম সেটি একটি আংটি, মেয়েদের আংটি।

বললাম- আপনি কি আংটি খুঁজছিলেন? লোকটি একটু উত্তেজিত হয়ে বলল,
- হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি পেয়েছেন ?

আমি বললাম- জিনিসটা তো মনে হচ্ছে সোনার। সোনার জিনিস সাবধানে রাখা ভালো। নিন। আংটিটা বাড়িয়ে ধরতে লোকটি তার হাতখানা পেতে ধরলো। চোখে কালো চশমা আর অমন ভাবে হাত পেতে রাখতে দেখে বুঝলাম সে অন্ধ। আমি আংটিটা তার হাতে রাখলাম। আংটিটা হাতে পেতেই তাকে বেশ শান্ত দেখালো।

ভদ্রতা করে বললেন- আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি বললাম-ঠিক আছে। লোকটি বলল,
-বেড়াতে এসেছেন ?
-হ্যাঁ গতকালই এসেছি।
-কেমন লাগছে সমুদ্র ?
-খুব ভালো। সুন্দর দৃশ্যের সাথে সাথে এমন তাজা হাওয়া আর কোথায় পাওয়া যায় বলুন? লোকটি একটু নীরব থেকে বললেন,
-তা ঠিকই বলেছেন। আরো ক্ষাণিকটা সময় নীরব থেকে লোকটি বললেন,
-সমুদ্র সুন্দর। মানুষকে মোহিত করাই তার কাজ। তবে ঐ রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে ভয়ংকর হিংসা। আমি হেসে বললাম,
-বুঝলাম না। লোকটি একটু থেমে বললেন,
-এতো সহজে বোঝার কথাও নয়। লোকটির কথাবার্তা আমার বেশ লাগছিল। বললাম,
-চলুন না ঐখানে গিয়ে একটু বসি। সৈকতের প্রান্তে লোকজন তেমন নেই তাই ছাতা বসানো মাচাগুলো খালিই পড়ে আছে। আমরা একটি মাচায় গিয়ে বসলাম। একটি ছেলেকে দেখলাম কাঁধে কতগুলো ডাব ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটির কাছ থেকে দু’টো ডাব কিনে দু’জনে খেয়ে সমুদ্রকে সামনে নিয়ে বসে আছি। লোকটি কোনো কথা বলছে না দেখে বললাম,
-আপনি কি এখানেই থাকেন ? না-কি আমার মতো বেড়াতে এসেছেন ? লোকটি তার চোখে থাকা কালো চশমাটি সোজা করে ভারী গলায় বললেন,
-আমি এখানেই থাকি। সমুদ্রকে ছেড়ে আমার আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। যেতেও চাই না। আমি আরও একবার সমুদ্রের হিংসার কবলে পড়তে চাই না। বললাম,
-মানে ?
-সে অনেক কথা। আপনার শোনবার সময় হবে ? আমি বললাম,
-অবশ্যই হবে। লোকটি একটি লম্বা শ্বাস নিয়ে তার গল্প বলতে শুরু করলেন।

বছর তিনেক আগের কথা। তখন অক্টোবর মাস। গরমটা সবে একটু ধরতে আরম্ভ করেছে। একদিন সকালে ঘরের বাইরে চোখ মেলেই বুঝলাম, আবহাওয়াটা ভারী সুন্দর। এক আকাশ নীল আর সবুজ গাছের পাতায় মৃদু তালের দোদুল বাতাস। সূর্যের মিষ্টি আলো চারদিকটাকে কেমন যেন মায়ার এক বাঁধনে বন্দি করে রেখেছে। ফটোগ্রাফারদের জীবনে এমন দিন প্রতিদিন আসে না। তাই ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখটা ভালোকরে ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ক’দিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অলস বসে থাকলে যা হয় তাই। কপালের ডান পাশটা সারাক্ষণই টনটন করে। রাতে প্রচন্ড ঘাম দিয়ে ঘুমটা যখন ভেঙে যায় তখন বুঝতে পারি জ্বরটা নেমে গেলো। শরীরের এমন অবস্থা থাকা সত্ত্বেও কাজে বের হতেই হয়। রোজগার না করলে আমাদের মতো ফটোগ্রাফারদের পেট চলে না। তাই ছবি তোলার সরঞ্জাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সৈকত থেকে আমার ডেড়া টা বেশ দূরে। গাড়িতে যাওয়ার পয়সা নেই তাই হেঁটে যাচ্ছি। গত ছয় মাস হলো ঘরে বসে আছি। গরমের সময় এখানে লোকজন তেমন আসে না তাই আমাদের মতো পেশাদার ফটোগ্রাফারদের এই ছয় মাস খুব দৈন্য দশায় কাটে। গত পনেরো দিন ধরে পকেটে মাত্র সাত টাকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ছাদেক ভাইয়ের দোকানে বেশ টাকা বাকি পড়েছে। ব্যবসা মানেই লেন-দেন। একতরফা কেবল দেন হলে চলে না কিছু লেন-ও করতে হয়। ছয় মাস হলো ছাদেক ভাইকে কোন লেন করা হয়নি তাই দোকানের সামনে গেলেই তিনি ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকেন। করাটাই স্বাভাবিক। ছয় মাসে আট হাজার টাকা বাকি পড়েছে। ছাদেক ভাই লোক ভালো। এত টাকা বাকি থাকা সত্ত্বেও তিনি যে এখনও সদাই দিচ্ছেন এটাই তো আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। অন্য কোনো দোকানি হলে এতদিনে নিশ্চয় জব্দ করে ছাড়তো। যা হোক, বিচে পৌঁছে বুঝলাম লোকজন গত কালের থেকে একটু বেশি। লোকজনের ভিড় দেখলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। ক্যামেরাটা দ্রুত প্রস্তুত করে এগিয়ে চললাম। বলা ভালো, কক্সবাজার হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। বিচিত্রতার দরুন বিভিন্ন স্পটকে এখানে বিভিন্ন নামে চেনা যায়। সমুদ্র সৈকতে যারা নতুন আসে তাদের বড় অংকটাই সুগন্ধা বিচে নামে। সমুদ্র দেখার প্রথম অনুভূতি তাদেরকে এক কথায় মোহগ্রস্ত করে ফেলে। এই সময় মিষ্টি স্বরে- ছবি তুলবেন ছবি? বললেই কাজ হয়ে যায়। ভ্রমণার্থীদেরকে বিভিন্ন পোজে রেখে সাটার চেপে পটাপট ছবি তুলে ফেলতে হয়। সামনে কয়েকজন নারী-পুরুষ আর বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দেখে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম তাদের পাশে ফটোগ্রাফার মাজেদ দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম এরা মাজেদের কাস্টমার। আমি আর আগালাম না। মাজেদ আমাকে দেখে বলল,
- কী জামাল দা? কেমন আছ? শরীরটা ভালো?
আমি মাথা দুলিয়ে বোঝালাম, ভালো। আমাকে যারা মোটামুটি চেনে তারা বেশির ভাগই আমার নামের পেছনে ‘দা’ শব্দটি জুড়ে দেয়। আমার জানা মতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদেরকে মানুষ দাদা বলে সম্বোধন করতে গিয়ে সংক্ষেপে ‘দা’ বলে কিন্তু আমি তো হিন্দু নই, মুসলিম। তবু কেন যে তারা আমার নামের শেষে ‘দা’ শব্দটা জুড়ে দেয় তা জানি না। বয়স হয়েছে বলেই কি? অভাবের তাড়নায় শরীরে বয়সের একটা ভার এসেছে সত্যি কিন্তু বছর হিসাব করলে গত আগস্টে বিয়াল্লিশে পা দিয়েছি। আমার মনে হয় বিয়াল্লিশ খুব বেশি কিছু না। আমার চেয়ে বয়স্ক লোকও তো আছে, কই তাদের নামের শেষে তো কেউ ‘দা’ বলে না ! তাহলে কি আমার চেহারায় কিছু আছে? আমি তো হিন্দু মুসলিমের চেহারায় আলাদা কিছু দেখতে পাই না। ধুত, বলছে বলুক। নামের শেষে ‘দা‘ শুনতে মন্দ লাগে না।

বেলা বারোটা বেজে গেছে। আমি এখনও সমুদ্র তীরে খোলা বালির উপর বসে আছি। দুপুরের দিকে কিছু মানুষ সমুদ্রে নামে। কক্সবাজারে শীত একটু দেরিতেই আসে তাই পানিতে অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁপাঝাঁপি করা যায়। ঝাঁপাঝাঁপির মাঝে মাঝে চলে ছবি তোলা। আমার বয়স হয়েছে, টগবগে জোয়ান ফটোগ্রাফারদের সাথে ছোটাছুটি করে পেরে উঠি না। ছোটাছুটি করে ছবি তোলা যায় না। ছবি হচ্ছে একটি শৈল্পিক ব্যাপার। আমার কাছে এক একটি ছবি মানে এক একটি গল্প। আমার কাছে ছবি মানে জীবন্ত একটি ক্ষণকে ফ্রেমে বন্দি করে রাখা।

আমার চোখ আগাগোড়া ভালো। একজন ফটোগ্রাফারের কাছে চোখ দু’টোই তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। চোখ ভালো বলছি এই কারণে যে এতটা দূর থেকেও এক জোড়া নর-নারীকে আমি ঠিক দেখতে পেলাম। ধীর পায়ে তারা এদিকেই আসছে। ভেজা বালুর উপরে তাদের রঙিন প্রতিফলন দেখে চোখে ক্যামেরা লাগালাম। ল্যান্ডস্কেপে বন্দি করে ফেললাম একটি ছবি। ডিজিটাল ক্যামেরা তাই ছবি কেমন হয়েছে স্ক্রিনে দেখে নেয়া যায়। ছবিটা সত্যিই ভীষণ সুন্দর হয়েছে। সমঝদার লোক হলে নিশ্চয় ছবিটি নেবে। যুগলটি বেশ কাছে চলে এসেছে। আমি আবার চোখে ক্যামেরা লাগালাম। জুম করে ভদ্রলোকের চেহারাটা কাছে নিয়ে এলাম। মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা বলিরেখাগুলো দেখে বুঝলাম লোকটির বয়স আমার থেকেও বেশি। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বুঝলাম ক্লাস ওয়ান ভদ্রলোক মানে সাহেব লোক। সাহেব লোকেদের ছবি তুলে দারুন মজা। এরা ছবি তোলার খরচ নিয়ে দাম-দর করে না। এক বার এক সাহেব মাত্র দশটি ছবি তুলে আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সেই সাহেবের চেহারাটা এখনও আমার মনে আছে। তবে দামি পোশাক পড়লেই সাহেব হওয়া যায় না। কিছু লোক আছে যাদের দামি পোশাকের ভেতর ছোটোলোকের স্বভাবটা থেকেই যায়। যা হোক এই ভদ্রলোককে তো আমার সাহেব বলেই মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক কাছে আসতেই আমি আর দেরি না করে বললাম,
-স্যার ছবি তুলবেন, ছবি ? লোকটি প্রথমে আমাকে পাত্তা দিতে চাইল না। কিন্তু সাথে থাকা মেয়েটি বলল।
-চলো না ছবি তুলি। ভদ্রলোক মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
-ইউ শিয়র ? মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল।
-হুম।
দেখলাম মেয়েটিকে। বয়স কতো হবে, একুশ-বাইশ। ফর্সা সুন্দর একখানি মুখ। সরু থুতনির উপর পাতলা একজোড়া গোলাপি ঠোঁট। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটি যখন হাসছিল তখন কীসের যেন এক গর্জন তুলে সমুদ্র ঝাঁপিয়ে পড়ছিল তটরেখায়। সরু সুন্দর নাকের দুই পাশে লালাভ দুটি গাল। ঝলমলে এক মাথা চুল। সেই চুলের মোহনিয় গন্ধ মেয়েটিকে ঘিরে অদৃশ্য একটি বলয় তৈরি করে প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে। এলোমেলো বাতাসের ভাব দেখে বুঝলাম লম্পট বাতাস সুযোগের সদ্ব্যহারে একেবারে মত্ত। মেয়েটি বার বার তার সরু আঙুলগুলো দিয়ে চুলগুলোকে শান্ত রাখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমার বিয়াল্লিশ বছরের শরীরের মধ্যে থাকা তরুণ মনটা কোনো শাসন না মেনে বলে উঠল, হায় ! আমি যদি বাতাস হতে পারতাম। পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করলাম। খেয়াল করে দেখলাম মেয়েটি নাকে নাকফুল পড়েনি। নতুন যুগ পড়েছে। এখন বিবাহিত মেয়েরা অনেক সময় নাকফুল পড়ে না।
-ক্যামেরা ভালো? ভদ্রলোকের কথায় আমার চমক ভাঙল। কিছুটা চটুল কণ্ঠেই বললাম।
-ভালো, ভালো স্যার। আবহাওয়াটাও ভালো। খুব সুন্দর ছবি আসবে স্যার। তুলব?
ভদ্রলোক মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
-হ্যাঁ তোলো।
সম্মতি পেয়ে ঝটপট ক্যামেরা প্রস্তুত করে ফেললাম। রোদটাকে পেছনে ফেলে দু’জনের যুগল ছবি তুলতে যাব এমন সময় ভদ্রলোক বললেন,
-আমার নয়, শুধু ওর ছবি তোলো।
ভদ্রলোকের কথা মতো সোনালি কিরণকে মেয়েটির ডান-গালে ফেলে ক্যামেরায় চোখ লাগালাম। আহ্ অসাধারণ ! যেন সোনা দিয়ে গড়া একখানা মুখ। সুন্দর মুখখানা যেন ছবি তোলার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। জীবনে অনেক, অনেক মানুষের ছবি তুলেছি কিন্তু এতটা সুন্দর মুখ আমার ক্যামেরায় বোধকরি কখনও দেখিনি। এক কথায় পারফেক্ট ক্যামেরা ফেইস। আর দেরি না করে আমার পঁচিশ বছরের দক্ষ হাত ক্যামেরাটাকে বেশ কায়দা করে মেয়েটির চোখের উপর ফোকাস করল। আহ্, অসাধারণ দুটি চোখ। এমন নীল চোখ কি এ দেশের মেয়েদের হয় ? আমার অভ্যস্থ আঙুল সার্টারে আঘাত হানল। কেমন যেন নেশা নেশা লাগছিল আমার। ক্যামেরায় চোখ রেখে একটার পর একটা, একটার পর একটা ছবি তুলছিলাম। এক পর্যায়ে ভদ্রলোক বললেন,
-ঠিক আছে। এ পর্যন্তই থাকুক। আমরা উঠেছি হোটেল বিচ টপে, রুম নম্বার ৯০৭। বিকেল তিনটার মধ্যে প্রিন্ট নিয়ে চলে এসো। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-স্যার ওটা পাঁচতারা হোটেল। আমাদের ওখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। ভদ্রলোক হেসে বললেন,
-কী নাম তোমার ?
-স্যার জামাল।
-ঠিক আছে আমি সিকিউরিটিকে বলে রাখব। বলে ভদ্রলোক মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের ফেলে যাওয়া পথের দিকে। একবার মনের মধ্য থেকে বলে উঠল, মেয়েটির সাথে ভদ্রলোকের বয়সের ফারাকটা অনেক। মেয়েটি কি ভদ্রলোকের স্ত্রী ? মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খটকা লাগল। মনকে বোঝালাম, কাস্টমাররা সম্পর্কে কে কার কী হয় তা জেনে আমার কাজ কী?

আমার কাছে ঘড়ি নেই। কয়টা বাজে জানা দরকার। কিন্তু ইদানীং কী যে হয়েছে কারো হাতে সহসা ঘড়ি দেখা যায় না। রাস্তার ওপারে বিদ্যুতের খুঁটির কাছে একটি তরুণ ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলাম। ছেলেটির হাতে মোবাইল ফোন। মাথা ঝুঁকিয়ে একমনে তাতে কী যেন দেখছে। আমি একটু কেশে বললাম,
-ভাইয়া কয়টা বাজে ? ছেলেটি ফোনের দিকে চোখ রেখেই বলল,
-কয়টা দরকার? বললাম,
-তিনটা। ছেলেটি বলল,
-এখনও বিশ মিনিট বাকি।
আমি আর দেরি না করে ছবিগুলো নিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলাম। গাড়ি বারান্দা পার হয়ে রিসেপশনে ঢুকতে যাব এমন সময় সিকিউরিটির লোক এসে আমাকে ধরে ফেলল।
-কী ? যাচ্ছ কোথায়? তোমাদেরকে আর কতবার বলতে হবে? এখানে তোমাদের প্রবেশ নিষেধ। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
-স্যার, স্যার আসতে বলেছিলেন।
-কোন স্যার?
-তা তো বলতে পারব না। তবে স্যার বলেছেন তিনটার মধ্যে ছবি নিয়ে চলে আসতে।
-তোমার নাম কি জামাল?
-হ্যাঁ।
-একটু দাঁড়াও আমি স্যারের সাথে কনট্যাক্ট করছি। ক্ষাণিক বাদে সিকিউরিটির লোকটি ফিরে এসে বলল,
-লিফ্টে নয় তলায় চলে যাও। রুম নম্বর ৯০৭। লিফ্টে উঠে ‘নয়‘ নম্বরের উপরে আঙুলের চাপ দিতেই লিফ্ট চলতে শুরু করল। নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলাম নয় তলায়। করিডোর ধরে একটু এগিয়ে যেতেই নম্বরটি চোখে পড়ল, ৯০৭। আমি দরজায় নক করতেই দরজাটা খুলে গেলো। আমাকে দেখেই স্যার বললেন,
-ভেতরে এসো। আমি ভেতরে যেতে সাহস পেলাম না। বললাম,
-না না, ঠিক আছে। ভদ্রলোক বললেন,
-ইতস্তত করো না। ভেতরে এসো। আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভদ্রলোক আমাকে সোফায় বসতে বলে ফোনটা কানে তুলেই আবার নামিয়ে রাখলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-ছবিগুলো এনেছ ? বললাম,
-এনেছি।
-ছবিগুলো কি তোমার ক্যামেরার মেমোরিতে এখনও আছে ?
-হ্যাঁ আছে।
-ওগুলো মুছে ফেল।
ক্যামেরা অন করে আমি ছবিগুলো মুছে ফেললাম। এমন অনেক ভদ্রলোক আছেন যারা চান না যে তাদের ছবি বাইরের কোনো লোকের কাছে থাকুক। কাস্টমারদের স্বার্থে আমাদের সব করতে হয়। তারা যেমনটা চাইবেন আমরা তেমনটাই করব। ইতোমধ্যে চা-বিস্কুট এর ট্রে হাতে বেয়ারা চলে এসেছে। ভদ্রলোক আমাকে খাওয়ার ইশারা করে ‘ফারিয়া’ বলে ডাকতেই পাশের রুম থেকে মিষ্টি কণ্ঠে উত্তর এলো। ভদ্রলোক উঠে পাশের রুমে গেলেন। আমি দু’টো বিস্কুট খেয়ে সবে চা’টা ধরেছি। পাশের রুম থেকে চাপা কণ্ঠ শুনতে পেলাম। মেয়েটি খুব আস্তে আস্তে বলছে,
-আমি আর দেরি করতে পারব না। তুমি বুঝতে পারছ ? দুই মাস হয়ে গেছে ! ভদ্রলোক বললেন,
-তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না ?
-করি বলেই তো কাউকে কোনো কিছু না জানিয়ে একা তোমার সাথে এসেছি। ভদ্রলোক বললেন,
-আচ্ছা, এখান থেকে ফিরে গিয়েই আমরা বিয়ের কাজটা সমাধা করে ফেলব, ওকে ? এবার হাসো। মেয়েটির হাসি আমি শুনতে পেলাম না তবে মিনিট দুই বাদে তারা দুজনেই সোফা পাতা রুমে এলেন। ভদ্রলোক বললেন,
-কই, ছবিগুলো দেখাও। আমি ছবিগুলো মেয়েটির হাতে দিলাম। ছবিগুলো দেখে আনন্দে সে একেবারে আত্মহারা হয়ে উঠল। আবেগ ভরা গলায় বলল,
-ওহ্ কী অসাধারণ ছবি ! দেখো দেখো। বলে মেয়েটি কয়েকটি ছবি ভদ্রলোকের হাতে দিল। ভদ্রলোক ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলেন। ছবিগুলো দেখার সময় আমি তার চোখে কিসের যেন একটি ঝিলিক খেলতে দেখেছিলাম। মুখে দামি প্রসাধনী দিয়ে আড়াল করা রেখাগুলোকে কেমন যেন সংকুচিত হতে দেখেছিলাম। ছবি থেকে মুখ তুলে মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। সাথে আমিও। পকেট থেকে দু’টো এক হাজার টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন।
-তোমার তোলা ছবি পেয়ে ও খুব খুশি হয়েছে। ওর খুশি মানেই আমার খুশি, টাকাটা রাখো। এক মুহূর্ত কী ভেবে ভদ্রলোক আরো বললেন,
-কাল আমরা ইনানি বিচে যাব। ওখানে দু’টো দিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসব। তুমি কি আমাদের সাথে যাবে ? আমি বললাম,
-অবশ্যই স্যার, অবশ্যই যাব। ভদ্রলোক পকেটে হাত দিয়ে আরো দু’টো এক হাজার টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
-এটা রাখো, এটা তোমার অ্যাডভান্স। দিন হিসাবে কতো নাও তুমি। আমি আমতা আমতা করছি দেখে ভদ্রলোক বললেন পার ডে পাঁচ হাজার দিলে চলবে। কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করেছে। পাঁচ হাজার ! আমি কোনো কথা বলছি না দেখে ভদ্রলোক বললেন,
-পাঁচ হাজার কি কম হয়ে যায়? আমি শুকনো গলায় বেশ কষ্টে একটা ঢোক গিলে বললাম,
-না না, ঠিক আছে। আমি কাল সকাল আটটার মধ্যেই চলে আসব।
আজ মনটা আমার দারুন চঞ্চল। পকেটে এক হাজার টাকার চারটি নোট। একসাথে এতগুলো টাকা পকেটে কোনোদিন রাখতে পারিনি। হোটেল থেকে বের হয়ে অটো-বাইকে উঠে সোজা চলে গেলাম ছাদেক ভাইয়ের দোকানে। ছাদেক ভাইয়ের হাতে তিন হাজার টাকা ধরিয়ে দিতে তিনি অবাক হয়ে বললেন,
-ব্যাপার কী? এত টাকা এক সাথে ! আমি স্মিত হেসে বললাম,
-আজ ভাগ্য বড় ভালো। এক সাহেবকে কিছু ছবি তুলে দিয়েছি। ছবিগুলোও চমৎকার হয়েছে। সাহেব খুশি হয়ে দিয়েছেন। কাল সাহেবের সাথে ইনানি যাব। ছাদেক ভাই টাকাগুলো খাতায় যোগ করে রাখলেন। ছাদেক ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা চলে গেলাম ‘রতন’ হোটেলে। কত-দিন ‘রতন’ হোটেলে খাই না। ‘রাই’ পাতার ভর্তার সাথে ‘লইট্যা’ মাছের ঝোল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম।
খুব ভোরে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেলো। আসলে গত কালের উত্তেজনাটা এখনও রয়ে গেছে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। গোসল সেরে নাস্তা করে সোজা বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের দিকে। পকেটে টাকা আছে বলেই যে গাড়ি করে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। আটটা বাজতে এখনও অনেক দেরি। হাতে যা সময় আছে তাতে হেঁটে গেলে সময়ের আগেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। আসলে নিত্যদিন এভাবে হেঁটে হেঁটে সৈকতে যাওয়াটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হাঁটতে আমার অতটা খারাপ লাগে না বরং ভালই লাগে। আর আজ যেন একটু বেশিই ভালো লাগছে।

ঠিক নয়টার সময় সাহেব নিচে নামলেন। ব্যাগ হাতে লোকটিকে দেখে বুঝলাম সে ড্রাইভার। চকচকে গাড়ির পেছনে ব্যাগগুলো রেখে ড্রাইভার গাড়ির দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে রইল। সাহেব আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে বললেন,
-তুমি ড্রাইভারে পাশের সিটে বসো। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে আমার। এত দামি গাড়ি ! সাহেব মেয়েটিকে নিয়ে পেছনের সিটে বসলেন। ড্রাইভার আমাকে ইশারা করে সামনে বসতে বলল। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। এত মোলায়েম সিট ! আমি যেন সিটের মধ্যে ডুবে গেলাম। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। জীবনে এমন একটি দিন যে আসবে তা কখনও ভাবি নি। খুশির সময় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ইনানি বিচে পৌঁছে গেলাম। গাড়িটি বিচ ছাড়িয়ে ক্ষাণিকটা সামনে গিয়ে একটি কটেজের সামনে দাঁড়াল। আমাদের গাড়ি থামতে দেখেই ভেতর থেকে ম্যানেজার সহ দু’জন হোটেল বয় ছুটে এলো। সাহেবকে স্বাগত জানিয়ে তারা ব্যাগগুলো ভেতরে নিয়ে গেলো। সাহেব বললেন,
-আমার ফটোগ্রাফার এবং ড্রাইভারের জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করুন। ম্যানেজার হেসে বললেন,
-হয়ে যাবে স্যার। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আসুন, ভেতরে আসুন। সাহেব উপরে চলে গেলেন। ড্রাইভার আর আমার জন্য নিচ তলায় পাশাপাশি দু’টো রুমের ব্যবস্থা করা হলো। রুমের মধ্যে ঢুকে আমি তো একেবারে ‘থ’-পরিপাটি করে সাজানো সুন্দর একটি বিছানা। ডেস্কে টিভি রয়েছে। পাশেই অ্যাটাস্ট বাথরুম। আমি বিছানার সামনে এগিয়ে গেলাম। বিছানায় বসে বুঝলাম ওটা অস্বাভাবিক রকমের নরম। এত নরম বিছানায় ঘুম হবে কি? ক্ষাণিক বাদেই ট্রে হাতে হোটেল বয় নাস্তা নিয়ে এলো। নাস্তা খাওয়া শেষ করে ক্যামেরাটা পরিষ্কার করতে মন দিলাম। সারারাত চার্জ দিয়েছি। এক্সট্রা ব্যাটারিও আছে। তবুও একবার চেক করে দেখলাম। ক্ষাণিক বাদে ড্রাইভার এসে বলল, সাহেব বের হবেন। সঙ্গে সঙ্গে গলায় ক্যামেরাটা ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। এখন দুপুর বারোটা বাজে। ইনানি বিচ-টা অন্য সকল বিচের থেকে আলাদা। এখানে অসংখ্য নারিকেল গাছ আছে, সাম্পান আছে। ছবি তোলার জন্য যথার্থ জায়গা। আমি একটার পর একটা ছবি তুলেই যাচ্ছি। ইনানি বিচের ফটোগ্রাফাররা মাঝে মাঝে আমার দিকে ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমি সেদিকে খুব বেশি খেয়াল না করে বিভিন্ন পোজে ছবি নিচ্ছিলাম। দুপুর দুইটার দিকে হোটেলে ফিরে দুপুরের খাবার খেলাম। ড্রাইভার এসে বলল,
-স্যার আজ আর বের হবেন না। কাল সকাল দশটার দিকে বের হবেন। পাহাড়ের ঐ পাশে যাবেন।
বুঝলাম রাস্তা ঘেঁষে যে পাহাড়টা গিয়েছে তার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ওখানে তো তেমন লোকজন বসবাস করে না। নির্জন জায়গা। মনে মনে ভাবলাম সাহেবদের কতো রকমের খেয়াল থাকে এটিও বুঝি তার একটি।

পরদিন সকাল দশটা। আমি কটেজের বাইরে অপেক্ষা করছি। ক্ষাণিক বাদেই দেখলাম মেয়েটি সাহেবের হাত ধরে বের হচ্ছে। সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-পাহাড়ের ওপারে না কি বনাঞ্চল আছে ? গেছো কখনও ? আমি বললাম,
-যাই নি স্যার। তবে বনাঞ্চল মতো আছে এটা শুনেছি। বনের কথা শুনে মেয়েটি বলল,
-বাঘ-টাঘ নেই তো। আমি হেসে বললাম,
-না, বাঘ নেই। তবে প্রচুর পাখি আছে শুনেছি।
পাহাড় বড় ধাঁধার জিনিস। পাহাড়ের উচ্চতা চোখে দেখা হিসাবের সাথে মেলে না। নিচ থেকে দেখলে মনে হয় কতটুকুই আর উঁচু হবে কিন্তু উঠতে গেলে বোঝা যায় চোখ সব সময় সঠিক হিসাব বলে না। পাহাড়ে উঠতে আমার খুব কষ্ট না হলেও দেখলাম মেয়েটির সাথে সাথে সাহেবও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সাহেব ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে নিজে ক্ষাণিকটা খেয়ে মেয়েটিকে দিলেন। আমিও ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ক্ষাণিকটা গলায় ঢেলে নিলাম। ক্ষাণিক বিশ্রাম নিয়ে আমরা চলতে শুরু করলাম। পাহাড়ের এই দিকটায় জনবসতি নেই। উঁচু-নিচু জায়গা। পাহাড়ি গাছপালায় ঢাকা। সাধারণ মানুষ যে এদিকটায় আসে না সেটা বুঝেছি কোনো পথ নেই দেখে। সাহেব বললেন,
-আমরা এসেছি পাহাড়কে ছুঁয়ে দেখতে, প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুধাবন করতে। জনমানব না থাকলেই তো ভালো। আমি কথা না বাড়িয়ে ছবি তোলায় মন দিচিছলাম। মেয়েটি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-আচ্ছা আমাদের দেশে ইউরেনিয়াম পাওয়া যায় না। সাহেব হেসে বললেন,
-এখন তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছ সেখানেও পর্যাপ্ত ইউরেনিয়াম রয়েছে। মাটির ধরন দেখেই আমরা বলে দিতে পারি কেমন মাটিতে ইউরেনিয়াম থাকে। মেয়েটি বলল,
-গবেষণার কাজটি তাহলে এদেশে করলেই পারো। ভদ্রলোক হেসে বললেন,
-গবেষণা কাজে অনেক খরচ হয়। এদেশে গবেষণার জন্য যা বরাদ্দ দেওয়া হয় তা শুনলে তুমি হাসবে।
হঠাৎ কতগুলো বাদুর শ্রেণির পাখি আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। মেয়েটি বেশ ভয় পেয়েছে বুঝে তাকে অভয় দিয়ে বললাম,
-ভয় নেই। পাখির ঝাঁক। আমাদের দেখে পালিয়েছে।
সাহেব খুব ধীরে ধীরে হাঁটছিলেন আর চারপাশটা খুব তীক্ষè চোখে দেখছিলেন। এক পর্যায়ে আমাকে লক্ষ করে বললেন,
-আমাদের কোনো তাড়া নেই। বেড়াতে এসেছি ব্যস। যতক্ষণ ভালো লাগবে থাকব, ভালো না লাগলে কটেজে ফিরে যাব।
আমি মাঝে মাঝেই ছবি নিচ্ছিলাম আর না শোনার ভান করে তাদের কথোপকথন শুনছিলাম। মেয়েটি বলছিল,
-এখান থেকে ফিরেই বাড়ি যাব। মাকে সব খুলে বলব। ভদ্রলোক বললেন,
-যেভাবে বলেছিলাম সেভাবেই আছে তো।
-মেয়েটি ভদ্রলোকের একটি হাতটি শক্ত করে ধরে বলল,
-কেউ জানে না স্যার। ভদ্রলোক বললেন,
-বোঝোতো, নিউক্লিয়ার নিয়ে যারা গবেষণা করে তাদেরকে কতটা গোপনীয়তা নিয়ে চলতে হয়। এই গত সপ্তাতেই তো ফ্রান্সের একজন পরমাণু বিজ্ঞানী সন্ত্রাসীদের হাতে মারা পড়ল। মেয়েটি ভয় পাওয়া চোখে বলল,
-বলো কী !
-তাছাড়া আর কী? ওরা সব সময় বিজ্ঞানীদের কাছের মানুষকেই টারগেট করে। তাদের কাছ থেকে তথ্য নেয় তারপর সুযোগ বুঝে মেরে ফেলে। মেয়েটি বলল, নিশ্চিন্ত থাকো। তোমার আমার ব্যাপারটা আমি কারো কাছে বলিনি। আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবীও জানে না। ভদ্রলোক গাছের শাখার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-গুড গার্ল।
আরো ক্ষাণিকটা পথ চলে আমরা পাহাড়টার প্রায় শেষ অংশে এসে পড়লাম। সাহেব ঘড়ি দেখে বললেন,
-হুম বারোটা বাজে। চলো হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নেই। মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করল। সমতল মতো একটা জায়গা বেছে নিয়ে আমরা চাদর পেতে খেতে বসলাম। ছোট্ট একটি টিফিন বক্স থেকে মেয়েটি কতগুলো স্যান্ডউইচ বের করল। স্যান্ডউইচ খেয়ে ক্ষাণিক বিশ্রাম নেওয়া হলে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। যা হেঁটেছি তাতে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার তো হবেই। আর পাহাড়ে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার হাঁটা চারটি খানি কথা নয়। মেয়েটিকে দেখলাম বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমি সাহেবকে বললাম,
-স্যার আর এগোলে সন্ধ্যার আগে কটেজে ফিরতে পারব না। সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তুমি বলছ আমরা যথেষ্ট পথ হেঁটেছি।
-জ্বি স্যার।
-আচ্ছা, আজ তাহলে এই পর্যন্তই থাকুক। শোনো আমার কাছে একটা ক্যামেরা আছে। ক্যামেরাটা জাপান থেকে আনা হয়েছে। ওটা একটা বিশেষ ক্যামেরা। অসাধারণ ছবি ওঠে। তুমি কি ক্যামেরাটা একটু দেখবে? আমি বললাম,
-অবশ্যই স্যার। সাহেব তার ব্যাগ থেকে বিঘত সাইজের একটি চারকোনা বক্স বের করে আমার হাতে দিলেন এবং আমার ক্যামেরাটা চেয়ে নিয়ে বললেন তুমি আমারটা দিয়ে ছবি তোলো আমি তোমারটা দিয়ে দেখি কেমন তোমার ক্যামেরা। এখানে কি নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে ? আমি বললাম,
-একটু উপরে উঠলে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। সাহেব মেয়েটিকে বললেন,
-ওকে ডার্লিং তুমি ছবি তুলতে থাকো আমার একটা জরুরি ফোন করতে হবে দেখি এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় কী না। মোবাইল ফোনটাকে উঁচু করে ধরে সাহেব নেটওয়ার্ক খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি পড়লাম সাহেবের দেওয়া ক্যামেরার বাক্স নিয়ে। প্যাকেটটা খুব শক্ত করে মোড়া। প্রথমে মোটা কাগজের বাক্সটা খুলে তার মধ্যে কালো রঙের পলিথিন জাতীয় জিনিস দেখতে পেলাম। কালো পলিথিনগুলো প্যাঁচানো অবস্থায় ছিল। পলিথিন ছাড়ান হয়ে গেলে তার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে পড়ল চকচকে একটি টিনের বাক্স। বুঝলাম খুব দামি জিনিস। টিনের বাক্সটা টেপ দিয়ে মোড়া। টেপ তুলে ফেলে বাক্সটা খুললাম। ক্যামেরার মতোই দেখতে। মনে হচ্ছে খুবই আধুনিক ক্যামেরা। সার্টারের পাশে ছোট্ট সুইচটিতে চাপ দিতেই ওটা অন হলো। আমি মেয়েটিকে একটি মরা গাছের সামনে দাঁড়াতে বললাম। ক্যামেরায় চোখ রেখে বুঝলাম লেন্স কভারটি এখনও খোলা হয় নি। লেন্স কভার খুলে ক্ষাণিকটা জুম করে মরাগাছ সহ মেয়েটিকে ফোকাস করলাম। মেয়েটির মাথাটা একটু নিচু হয়ে আছে দেখে আমি তাকে মাথাটা একটু উঁচু করতে বলে ক্যামেরায় চোখ রাখলাম। হ্যাঁ এবার হয়েছে। টাইমিং পেতেই দেরি না করে সার্টারে চাপ দিলাম। কিন্তু সার্টার চাপার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের মধ্যে যেন বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেলো। প্রথমটায় চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম, কি হলো হঠাৎ করে ? ক্যামেরা নামিয়ে দুই হাতে চোখ কচলে আবছায়া ভাবে দেখতে পেলাম মেয়েটি মরা গাছটি ধরে বসে পড়েছে। ম্যাডাম ম্যাডাম বলে ঝাপসা দৃষ্টি নিয়েই আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম তাকে কিন্তু সে কোনো সারা দিচ্ছে না দেখে আমি এবার সাহেবকে ডাকলাম,
-স্যার, স্যার। কিন্তু কোথায় স্যার ! পাহাড়ের গায়ে আমার একলা আর্তনাদ বার-বার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতে লাগল। ইতোমধ্যে আমার মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। যন্ত্রণা নিয়েই আমি মেয়েটির আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। আবছায়া দৃষ্টিতে তার একটি হাত ধরলাম। হায় আল্লাহ্ এ কী? এ আমি কী স্পর্শ করলাম ! ভয়ে এক লাফে ক্ষাণিকটা পেছনে সরে এলাম। কী হচ্ছে এসব, আমি ভাবতে পারছি না। তবুও বুকে সাহস সঞ্চার করে মেয়েটিকে ডাকলাম,
-ম্যাডাম, ম্যাডাম। কোনো সারা নেই। ইতোমধ্যে মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণার সাথে সাথে শ্বাসকষ্টও শুরু হয়ে গেছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। চোখে এখন প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হাতরে হাতরে বুঝলাম ওটা একটা হাত কিন্তু সেই হাতে বুঝি কোনো চামড়া নেই। মেয়েটির সেই সুন্দর মোলায়েম হাতখানা এখন কোনো থকথকে গলিত মাংসপিন্ডে পরিণত হয়েছে। আমি হাত ধরে সজোরে টান দিলাম, কিন্তু না, তাকে তুলতে পারলাম না। এরপরে আমার আর কোনো কিছু মনে নেই।
তিন দিন জ্ঞানহীন থাকার পরে আমার চেতনা ফিরল। নিজেকে আমি একটি হাসপাতালে আবিষ্কার করলাম। হাসপাতালের ডাক্তার বললেন, উপজাতি শ্রেণির কিছু লোক আমাকে হাসপাতালে রেখে গেছে। আমার চোখ কী কারণে নষ্ট হয়ে গেছে তার কোনো সঠিক উত্তর ডাক্তার দিতে পারেন নি। তবে এটুকু বলেছেন তেজস্ক্রিয় কোনো পদার্থের বিকিরণে এমনটা হয়েছে। মনের মধ্যে বলে উঠলো, সাহেব তো তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়েই গবেষণা করতেন। তাহলে কি ঐ ক্যামেরার মধ্যে ইচ্ছে করেই তিনি কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ রেখেছিলেন ? আমাকে এবং মেয়েটিকে মেরে ফেলার জন্যই কি তিনি এটি করেছেন? ডাক্তার সাহেবকে মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। ডাক্তার বললেন, -কোনো মেয়ের খবর তিনি জানেন না। জানি জানবার কথাও নয়।

এখন আমি নিয়ম করে সমুদ্রের কাছে আসি। মুঠোর মধ্যে আংটিটা ধরে সমুদ্রের সামনে বসে থাকি। সমুদ্র এখনও তেমনি ভাবেই গর্জন করে চলে। জানি এখনও উন্মত্ত রাগে তীর ঢেলে সে ফেনা ফেলে যায়। সমুদ্রের হিংসায় আজ আমার আর কোনকিছু আসে-যায় না। আমি আংটিটাকে শক্ত করে ধরি। আমার অন্ধ চোখের কোথায় যেন ফেলে আসা দিনগুলির সাদাকালো বায়োস্কোপ চলতে শুরু করে। ঐ তো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাছে এগিয়ে যাই। মিষ্টি করে বলি, ছবি তুলবেন, ছবি ?

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test