E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গল্প

প্রতীক্ষা

২০১৬ ফেব্রুয়ারি ১৮ ১২:৫৩:৫৯
প্রতীক্ষা






 

যুথিকা বড়ুয়া



( এক )

হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে যায় মমতার। ধড়্ ফড়্ করে ওঠে। বুকটা ধুক্ ধুক্ করে উঠেছে। র্থ র্থ করে কাঁপছে সারাশরীর। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। সকাল না সন্ধ্যে মুহূর্তের জন্য ঠাহরই করতে পাচ্ছিল না। চোখ পাকিয়ে তাকায় চারিদিকে। তখনও আবছা অন্ধকার বাইরে। দিগন্তের পূর্ব প্রান্তর জুড়ে ঊষার ক্ষীণ আলোর আভা দেখা যাচ্ছে।

পিছন ফিরতেই দ্যাখে, খোকনের ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরের দরজা জানালা সব খোলা। পাশে বাথরুমে ঝর্ণার মতো ঝির ঝির করে পাইপ কলের জল পড়ছে শোনা হচ্ছে। -‘খোকা স্নান করছে নিশ্চয়ই! কিন্তু এতো ভোরে! খোকা আজ যাচ্ছে কোথায়?’

স্বগতোক্তি করতে করতে বিছানা থেকে নেমে আসে মমতা। দ্রুত গিয়ে ঢোকে খোকনের ঘরে। ঢুকেই নজরে পড়ে, খোকনের বিছানার সংলগ্নে টেবিল ল্যাম্পের আড়ালে একটা কাপড়ের পোটলা পড়ে আছে। তার মধ্যে কি যেন বাঁধা। হঠাৎ দৃষ্টিপাতে মনে হয়েছিল, কোনো জন্তু-জানোয়ার জানালা দিয়ে ঢুকে ঘুপচি মেরে বসে আছে। আকারে বেশ বড়। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে মমতা কাছে এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখলো, সেটি কোনো জীব-জন্তু নয়, বস্তুই হবে। বাইরে থেকে ছোট ছোট বলের মতো কি কতগুলো পোটলার মধ্যে ভর্তি। ভারী জিনিস মনে হচ্ছে। কিন্তু কি হতে পারে? আশ্চর্য্য, এমনভাবে কাপড়ে বেঁধে রাখার মতো খোকার এমন কি জিনিস থাকতে পারে যে, ওর মা জানবে না! মনে মনে বলল মমতা।



স্বাভাবিক কারণে সেটা খুলে দেখার বড্ড কৌতূহল হয়। কিন্তু পোটলাটা হাতে তুলতেই চমকে ওঠে মমতা। ,-‘মা, তুমি এঘরে, কি করছ? সর্বণাশ, ওটা ধোরো না। শিগ্গির রেখে দাও!’

বলতে বলতে বাথরুম থেকে দ্রুত ছুটে আসে খোকন। খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে একরকম ছোঁ মেরে কাপড়ের পোটলাটা কেড়ে নেয়। মাকে উপেক্ষা করে বলে,-‘তুমি খামাখা ঘুম থেকে উঠে এসেছ মা। আজ আমাদের ইউনিভার্সিটিতে খুব জরুরী একটা মিটিং আছে। আর্লি মর্নিংএ-ই আমাদের সবাইকে এ্যাটেন্ড্ করতে হবে সেখানে, তাই..! যাও, যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো গে যাও!’

এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, যেন কিছুই না। অথচ ভিতরে ভিতরে ভয়ে আতঙ্কে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে ওর। ভাবছে, মা নিশ্চয়ই সব টের পেয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ বোধহয় ওকে ওয়াচ্ করছিল।



অপ্রস্তুত মমতা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলেও খোকনের বিবর্তন চেহারা লক্ষ্য করে পড়ে যায় বিস্ময়ের ঘোরে। অন্যদিনের তুলনায় খুবই অস্বাভাবিক লাগছে খোকনকে। কিছু একটা যে লুকোচ্ছে, সেটা দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়। মনে মনে স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। কি হতে পারে?

খোকনের আপদমস্তক লক্ষ্য করে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মমতা। আবার পরক্ষণেই ভাবে, নাঃ, হয়তো ওরই বোঝার ভুল হচ্ছে।

অথচ মমতা আদৌ জানেনা যে, ঐ কাপড়ের পোটলাতে কি আছে? কি সেই মারাত্মক জিনিস! মায়ের অজান্তে খোকন যে কি করতে চলেছে, সেটা ঘূণাক্ষরেও টের পেল না মমতা।



লক্ষ্য করলো, মুখখানা বিবর্ণ হয়ে গেল খোকনের। কাপড়ের পোটলাটা হাতে নিয়ে গভীর তন্ময় হয়ে কি যেন ভাবছে। কিন্তু একজন গর্ভধারিনী মায়ের মন, সত্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত কখনো শান্তি পায়না, স্বস্তি পায় না। কারণ অনুসন্ধানে প্রচন্ড উদগ্রীব হয়ে ওঠে। খোকনের মুখের দিকে গম্ভীর হয়ে পলকহীন নেত্রে চেয়ে থাকে। চোখে চোখ পড়তেই একটা শুকনো হাসির ঝিলিক দিয়ে খোকন বলল,-‘তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো মা! আরে যাও! বললাম না আমাকে এক্ষুণিই রের হতে হবে! আমি রেডি হবো, যাও।’



মায়ের সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু খোকনের নজর ঐ পোটলার দিকে। কেমন সন্দেহজনক মনে হলো মমতার। গম্ভীর হয়ে বলল,-‘খোকা, আমার মাথার দিব্যি দিয়ে বল্তো, এই সাতসকালে তুই কোন্ রাজকার্যে যাচ্ছিস শুনি? অমন ছট্ফট্ করছিস কেন তুই? গলার আওয়াজও কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। আজ লক্ষ্য করছি, কেমন ঔদাসীন্য, অন্যমনস্কভাব। বলি এতো কিসের চিন্তা তোর? সংসারে আমাদের আর আছেই বা কে? কার জন্যে এতো চিন্তা করছিস তুই?’

খোকনের মাথায় মৃদু হস্ত সঞ্চালণ করে বলে,-‘সন্তান যত বড়ই হউক, মায়ের কাছে সেই ছোট্টটিই থাকে। কোথায় যাচ্ছিস, কি করছিস, আমায় বল বাবা! মায়ের কাছে কিছু লুকোস নে। তোর ঐ পোটলার মধ্যে কি আছে রে খোকা! খুব দামী জিনিস বোধহয়?’



খোকন নিরুত্তর। পড়ে যায় বিপাকে। মায়ের জেরায় পড়ে গেলে আর রক্ষ্যে নেই। জবাবদিহী করতে করতে ওর সারাদিনের প্ল্যান-প্রোগ্রামটাই যাবে মাটি হয়ে। এইভেবে মাকে উপেক্ষা করে কাপড়ের পোটলাটা অতি সন্তর্পণে ড্রেসিং টেবিলে রেখে হঠাৎ আহাল্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে। বাধ্যগত ছেলের মতো খুব নরম হয়ে, মোলায়েম সুরে বলল,-‘তেমন কিছু নয় মা! ওটা আমার এক বন্ধুর। গচ্ছিত রেখেছিল। এইতো আজই ফেরত দিয়ে আসবো। ওনিয়ে কিছু ভেবো না! কিন্তু তুমি ঘুম থেকে উঠে এলে কেন? আমি কি দুধের খোকা? ইউনিভার্সিটির ছাত্র আমি। হাট্টা গোট্টা তরুণ যুবক। সামান্য একটা বিষয়কে এতো সিরিয়াসভাবে নিচ্ছো কেন বলো তো! আমারও তো একটা প্রাইভেসি আছে না কি! অমন হাঁ করে দেখছ কি! যাও, যাও, আরো কিছুক্ষণ গড়িয়ে নাও যাও।’



ভ্রু-যুগল কুঁচকে চেয়ে থাকে মমতা। ভিতরে ভিতরে খুব চটে যাচ্ছে। কিছু বলবার ব্যাকুলতায় ঠোঁটদু’টো কেঁপে উঠতেই ফিক্ করে হেসে ফেলল খোকন। মাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে,-‘ওঃ হো, এতো টেনশন নিচ্ছো কেন বলো তো! রিল্যাক্স মাদার রিল্যাক্স। ডোন্ট ওরি। ক’মন! আচ্ছা ঠিক আছে, উঠে পড়েছ যখন ফটাফট্ গরমা গরম এককাপ চা করে নিয়ে আসো যাও! শরীরটা একটু ঝর ঝরে হয়ে যাক!’



মমতা তক্ষুণিই চলে যায় রান্নাঘরে। ইত্যবসরে খোকন তাড়াহুড়ো করে মাথা মুছে জামা-প্যান্ট পড়ে নেয়। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রান্নাঘরের দিকে গলা টেনে একবার উঁকি মেরে দেখে কাপড়ের পোটলাটা নিয়ে চুপি চুপি পা টিপে নিঃশব্দে দ্রুত বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।



তার পরক্ষণেই চা-জলখাবার নিয়ে আসে মমতা। কিন্তু ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। দ্যাখে, খোকন ঘরে নেই। বাথরুমে গলা টেনে দেখলো, সেখানেও নেই। মায়ের অগোচরে কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে খোকন, টের পেল না। ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো, কাপড়ের সেই পোটলাটাও নেই।

তৎক্ষণাৎ চাপা উত্তেজনায় স্বগতোক্তি করে ওঠে,-আশ্চর্য্য, খোকা আজ দানাপানি মুখে না দিয়েই মায়ের অলক্ষ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল! যাবার পথে মাকে একবার দর্শণ দিয়ে গেল না! কিন্তু পোটলায় বেঁধে খোকা কি নিয়ে গেল? কোথায় নিয়ে গেল? কাকে দিতে গেল? কি ছিল পোটলার মধ্যে?

হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে মমতার। দুঃশ্চিন্তা-দুর্ভাবনায় একটা মুহূর্তও আর স্বস্তি পায় না। মমতা সহজ সরল, সেকেলে মহিলা। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। স্বামী বিয়োগের পর একেবারে নরম হয়ে গিয়েছে। কোনো বিষয়ে তেমন গভীরভাবে ভাবতে পারেনা। একটুতেই ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু আজ তার এক একটা মুহূর্ত কি অপরিসীম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় অতিবাহিত হতে থাকে। মায়ের মন, সবসময় কু-ই গায়। সারাক্ষণ বাস করে তার নিজস্ব জগতে। গ্রামের বাড়িতে শ্বশুড় কূলের ভিটে-বাড়ি সহ স্বল্প পরিমানে কিছু ধানি জমি ছিল, তাতে আনাচপাতির চাষ করে। সম্প্রতি হাঁস-মুরগীর পল্ট্রিও খুলেছে। সেখান থেকেও আমদানী হয় প্রচুর। সব মিলিয়ে উপার্জন যা হয়, তা দিয়ে মায়ে-পুতে দুজনের সংসার দিব্যি স্বচ্ছলভাবে চলে যায়। পয়সা কড়ির জন্য কখনো ভাবতে হয়না। একমাত্র সন্তান খোকনকে নিয়েই যতো চিন্তা ভাবনা মমতার। অকাল বৈধব্যে একাকীত্বের শোক-দুঃখ-বেদনা ভুলে, প্রাত্যহিক জীবনের পারিপার্শ্বিক কোন্দল-বিবাদ-বিচ্ছেদ-বেদনার কালো ছায়া থেকে দূরে সড়ে এসে এতকাল খোকনকে বুকে আলগে রেখে মানুষ করেছিল কি এই জন্যে? এইদিন দেখবার জন্যে? মায়ের মনে কষ্ট দিতে ওর বিবেকে এতটুকু বাঁধলো না? দুঃশ্চিন্তায় মায়ের শরীরের কি হাল হবে, সেকথা একবারও ভাবল না! কিন্তু খোকন আজ গেল কোথায়?









(দুই)



খোকন ছোটবেলা থেকেই ধীর-স্থির-গম্ভীর। বড্ড একরোখা ছেলে। অনমনীয় জেদ। বিরল সেন্টিমেন্টাল। প্রতিটা বিষয়েই ওর বিরোধীতা, আপত্তি, অভিযোগ। প্রখর সংগ্রামী মনোভাব। যেদিন শহরের রাজপথে প্রথম ভাষা আন্দোলনের শুরুতে নবীন সদস্য আবদুল রশীদ বেকায়দায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছিল, তাদেরই বন্দুকের গুলী বিদ্ধ হয়ে। আর সেই ঘটনা সাধারণ জনগণের মনে বৈপ্লবিক চেতনার সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেই বৈপ্লবিক চেতনার বাতাবরণে খোকন আরো গভীরভাবে স্বাধীনতা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। লোকের কানাঘুষোয় শোনা যায়,-‘খোকন একজন বিপ্লববাদী স্বদেশী।’



তবু কখনও তেমনভাবে মনের মধ্যে সন্দেহের দানা বাঁধেনি মমতার। বরং মনে মনে গর্ব করতো। আত্মগর্ভে বুক ভরে উঠতো। ভাবতো, স্বদেশী মানেই তো দেশকে ভালোবাসা, দেশের জনগণকে ভালোবাসা, দেশের সেবা করা, দশের সেবা করা, জনগণের সেবা করা। এটা তো একটা মহৎ কাজ, মহা পূণ্যের কাজ। কিন্তু আজ কোণ্ কার্যালয়ে কিসের পূর্ণ অর্জন করতে গিয়েছে খোকন?



মমতা অশান্ত, উদ্বেলিত, মর্মাহত। ক্ষণপূর্বের গহীন বেদনানুভূতির তীব্র দংশণ আর ভোরের ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের প্রতিঃচ্ছবি তখনো ওর স্নায়ূকোষে ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনো জীবন্ত হয়ে দেখা দিচ্ছে। তন্মধ্যে খোকনের হঠাৎ অভাবনীয় ব্যতিক্রম চাল-চলন, কথাবার্তা, বিবর্তন চেহারা দৃষ্টিগোচর হতেই সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে। ক্রমশ অজানা আশক্সক্ষায় ঘিরে ধরে। সন্দেহ ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। খটকা লাগে মনে। প্রচন্ড ভাবিয়ে তোলে। নদীর ঢেউ-এর মতো মস্তিস্কের কোষে কোষে বার বার একই প্রশ্ন ফিরে এসে আঘাত করতে থাকে। -মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে, মাকে ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে রেখে, সম্পূর্ণ উপবাসে খোকা আজ কোথায় গেল?



সেই সকাল থেকে চা-জলখাবার নিয়ে বসে আছে মমতা। কিছুতেই মুখে ঢুকছে না। কখন থেকে কলিং বেলটা একটানা বাজজে, ওর হুঁশই নেই। হঠাৎ জানালার ধারে বসে থাকা হুলো বিড়ালটা মিঁয়াউ করে ডাক দিতেই চমকে ওঠে। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ভাবল, খোকা ফিরে এসেছে।



দৌড়ে গেল দরজা খুলে দিতে। কিন্তু দরজা খুলে দ্যাখে, একটি অচেনা অজানা যুবতী মেয়ে দরজার ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। ওর চোখে-মুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।



হঠাৎ থতমত খেয়ে গেল মমতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি বলল,-‘মাসিমা, আমি নির্মলা, খোকনের ক্লাসমেট্। মনে হলো কিছুক্ষণ আগে ওকে দেখলাম, গায়ে চাদর পড়া, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। রেল লাইন ধরে খুব জোরে হেঁটে যাচ্ছিল! ও’ কোথায় গেল আপনি জানেন?’



ফ্যাস্ ফ্যাস শব্দে মমতা বলল,-‘কোথায় গেছে, তা তো জানিনা। বলছিল, ইউনিভার্সিটিতে যাবে। কি একটা জরুরী মিটিং আছে। কিন্তু যাবার সময়...!



মমতার কথা শেষ না হতেই চাপা আর্তনাদ করে নির্মলা। -‘এ্যাঁ, ইউনিভার্সিটিতে গেছে!’



ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে নির্মলা। কিছুক্ষণ থেমে বলল,-‘সর্বণাশ, আজ ঘর থেকে ওকে বের হতে দিলেন কেন?’ বলে ধপ্ করে সিঁড়িতেই বসে পড়ে।



এ যেন মরার উপর পড়ল খাড়া। চিন্তাধারার গতীবেগ আরো তিনগুণ বেড়ে গেল মমতার। বিচলিত হয়ে ওঠে। আশক্সক্ষায় বুকের ভিতরটা ধুক্ ধুক্ করে কাঁপতে থাকে। ভয়-ভীতিতে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মনে বিভীষিকা। হঠাৎ কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে,-‘কার কি সর্বণাশ হবে মা! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি নে।’



বড় বড় চোখ মেলে তাকায় নির্মলা। খানিকটা বিব্রোত কণ্ঠে বলল,-‘কেন, আপনি খবরে কিছু শোনেন নি? ইউনিভার্সিটির চারপাশে সরকার এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে। নোটিশ ঠুকে দিয়েছে, ইউনিভার্সিটির ত্রিসীমানায় কেনো মিটিং, মিছিল করা চলবে না। আজ একটা গন্ডোগোল হওয়ার খুউবই সম্ভাবনা আছে!’



শুনে আঁতকে ওঠে মমতা।-‘এ্যাঁ, বলো কি! কিসের মিটিং? কাদের মিটিং? মিছিল করবে কেন ওরা? এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে কেন? কিসের গন্ডোগোল হবে?’



সবিস্ময়ে নির্মলা বলল,-‘সেকি, খোকন কিছুই বলেনি আপনাকে! রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা করবার দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই আন্দোলন করছে, আপনি জানেন না? আজ ওরা এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা লঙ্ঘন করে শ্লোগান দিতে দিতে এসেম্বলীর দিকে যাবে। পুলিশ নিশ্চয়ই তখন লাঠিচার্জ করবে, কাঁদানি গ্যাস ছুড়বে, ব্যস, তখন শুরু হয়ে যাবে গন্ডোগোল।’



শোনামাত্র বুকটা ধরাস করে ওঠে মমতার। ধপ্ করে বসে পড়ে সোফায়। বোবা দৃষ্টি মেলে অসহায়ার মতো চেয়ে থাকে। কণ্ঠে হতাশার সুর। একটা ঢোক গিলে বলল,-‘তা’হলে এখন কি হবে বলো তো!’



-‘না, না, কিচ্ছু হবে না। আপনি অযথা ভেঙ্গে পড়ছেন। আমি বলছিলাম, কখন কি হয়, বিপদের কথা বলা যায় না! আর তাছাড়া, খোকন বিদ্যান, বুদ্ধিমান, চালাকচতুর ছেলে। আর যাই হোক, ওর গায়ে আঁচ পড়তে দেবে না। ওনিয়ে আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না মাসিমা। আমি দেখছি, ও’ কোথায় আছে!’



নির্মলা চলে যেতেই ভারাক্রান্ত মনটা খানিকটা হাল্কা হয় মমতার। চিন্তা-ভাবনাও কিছুটা দূরীভূত হয়। শারীরিক ও মানসিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। যথারীতি নিজের কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কিন্তু তার পরেও মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে মমতার। কোথায় যেন খুব হৈ চৈ চেঁচামিচি হচ্ছে। কান পেতে শোনে মমতা। কিন্তু হঠাৎই মিলিয়ে যায় শব্দটা। ভাবল, হয়তো ওর মনের ভ্রম। -‘দূর্গা, দূর্গা! সবই তাঁরই ইচ্ছা!’ আপন মনে বিড় বিড় করতে করতে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে।









( তিন)



বেলা প্রায় দশটা বাজে। খোকন তখনও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল, ইউনিভার্সিটির চারিদিকে পুলিশ পাহাড়া। ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ কেউ দলবদ্ধ আর কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে ইউনিভার্সিটির গেটের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে।

খোকন চেষ্টা করলো, ইউনিভার্সিটির পিছনের গেট দিয়ে ঢুকতে। কিন্তু উপায় নেই। সেখানেও ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে। ততক্ষণে দলে দলে ছেলে-মেয়েরা মিছিল করতে করতে মেইন গেটের বাইরে চলে এসেছে। শ্লোগান শোনা যাচ্ছে,-“রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই!”

পুলিশ তক্ষুণি হামলা চালায়। লাঠিচার্জ করে। কয়েকজনকে জামার কলার ধরে গাড়িতে তুলে নেয়। তখনই শুরু হয়ে যায়, হট্টোগোল, ভাগ-দৌড়, বিরূপ বিশৃঙ্খল পরিবেশ। চাদরের ভিতর থেকে খোকন এলোপাথাড়ী ছুঁড়তে থাকে বারুদের গোলা। কয়েকজন ক্যারোসিন তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় কয়েকটি পুলিশ ভ্যান। অন্যদিকে উত্তেজিত জন সমুদ্রের ক্রমাগত ঢেউ-এ ভেসে আসছে, শ্লোগানের তীব্র হুঙ্কার। জনগণের দাবি। পুলিশ ছুঁড়তে থাকে কাঁদানি গ্যাস। তীরের মতো ছুটছে বন্দুকের গুলী। ঘটছে একটার পর একটা হৃদ -কাঁপানো বোমা-বারুদের বিস্ফোরণ। চারিদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। বারুদের উগ্র গন্ধ। এমতবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা দলভঙ্গ হয়ে নিজেদের আত্ম রক্ষার্থে দ্বিগি¦দিক জ্ঞান শূন্য হয়ে অন্ধের মতো ছুটতে শুরু করে।



এভাবে একটানা চলতে চলতে একসময় থেমে যায় বোমা বারুদের বিস্ফোরণ। তীব্র আওয়াজ। মনে হচ্ছে, বিষন্ন একটা দিন। গোটা পৃথিবীটা যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। বৃষ্টি পড়ছে গুঁরি গুঁরি। দিনের বেলায় নেমে এসেছে অন্ধকার।

সকাল থেকে মন-মেজাজ একদম ভালো নেই মমতার। মরার কাঁক একটা সেই কখন থেকে তীব্র স্বরে কাঁ কাঁ করে ডাকছে। তাড়া করলেও যাচ্ছে না। যেন কিছু বলতে চাইছে। কোনো সংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে। তন্মধ্যে চতুর্দিক থেকে বজ্রপাতের মতো বোমা বাজীর আওয়াজ কানে এসে লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এক্ষুণি গায়ের উপরে এসে পড়বে। এমন বিপর্যয়ে ছেলেটা কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে, এসব চিন্তায় কিছুতেই স্বস্তি পায় না মমতা। সারাক্ষণ কত সব কু-চিন্তা,কু-ভাবনা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুস্থির হয়ে ঘরের ভিতর একদন্ডও থাকতে পারে না। বেরিয়ে আসে বারান্দায়। বারান্দায় বের হতেই থমকে দাঁড়ায়। দ্যাখে, ওর সম্মুখে প্রচন্ড মানুষের ভীঁড়। লোকে লোকারণ্যে। খুব হৈ চৈ, চেঁচামিচি হচ্ছে।

মনের অজান্তেই বুকটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠল মমতার। হৃদস্পন্দনও আরো দ্রুত গতীতে চলতে শুরু করে। সবুর সয় না ওর। তৎক্ষাণাৎ বারান্দা থেকে নেমে আসে আঙ্গিনায়। ততক্ষণে বিশাল জন-সমুদ্রের ঢেউ আরো সন্নিকটে এগিয়ে এসে উপছে পড়তে থাকে। তাকিয়ে দ্যাখে, সাদা কাপড়ে ঢাকা একদল যুবক ছেলে কাকে যেন কাঁধে চেপে উর্দ্ধঃশ্বাসে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওদের পিছন পিছন অগণিত মানুষের ভীঁড়, ঠেলাঠেলি।



ইতিপূর্বে ছুটে আসে নির্মলা। ছুটে আসে, পাড়া-প্রতিবেশী, বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান সবাই। মুহূর্তে ভীঁড় জমে যায়। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি মমতা। কিন্তু আপনগর্ভে লালিত সন্তান আর মায়ের নারীর চিরন্তন বন্ধন, সে এক অদৃশ্য শক্তি, এক অবিচ্ছেদ্য গভীর টান। তাকে অবরোধ করে, সাধ্য কার! স্বয়ং বিধাতারও নেই! আর সেই অদৃশ্য বন্ধন শক্তির প্রভাবেই মমতাকে বারান্দা থেকে টেনে নিয়ে আসে আঙ্গিনায়। যার কারণ ও’ নিজেও জানতো না। আর তক্ষুণি কর্ণগোচর হয়, খোকনের নাম ধরে সবাই কি যেন বলছে। ওরা নিশ্চয়ই খোকনদের বাড়ি খুঁজজে। কিন্তু খোকন কোথায়? ওকে তো নজরে পড়ছে না। কোনো অঘটন ঘটেনি তো?

মনের মধ্যে অমঙ্গলের বাঁশী বেজে ওঠে মমতার। বুঝতে কিছু আর বাকী থাকে না। বিদ্যুতের শখের মতো হৃদয়পটভূমিতে খুব জোরে একটা ধাক্কা লাগে। বুক কেঁপে ওঠে, ঠোঁট কেঁপে ওঠে। র্থ র্থ করে কাঁপতে থাকে ওর সারাশরীর। অনুভব করে, পায়ের তলা থেকে ক্রমশ মাটি সড়ে যাচ্ছে। জমে হীম হয়ে আসছে ওর দেহ,মন সারাশরীর। স্থীর হয়ে আসে চোখের দৃষ্টি। একসময় ভাবসাম্যহীন হয়ে পড়ে। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই ওকে জড়িয়ে ধরে নির্মলা।

ততক্ষণে সাদা চাদরে ঢাকা খোকনের রক্তাক্ত মৃতদেহটাকে শোয়ানো হয়েছে বারান্দায়। যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কত নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। আজ যে জীবনের সব হিসেব চুকিয়ে দিয়ে এসেছে খোকন! কোনো চাহিদাই আর নেই। কারো প্রতি আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই, অভিযোগ নেই। কিন্তু ওর গর্ভধারিনী মা, মাকে কি জবাব দেবে খোকন? কেন মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে নীরবে চলে গেল খোকন? কেন মাকে কিছু বলে গেল না খোকন? কেন বলতে পারলো না খোকন? এ কথার জবাব মাকে দিতে পারবে কোনদিন? মমতাও কি জানতে পারবে কোনদিন? বুঝতে পারবে কোনদিন? কিন্তু কে বোঝাবে ওকে? কাকে বোঝাবে?



কারো মুখে কথা নেই। সবাই বাক্যাহত, বেদনাহত, মর্মাহত। বিমূঢ়-ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার চোখে জল। হঠাৎ ভীঁড়ের মধ্য থেকে একটি তরুণ যুবক এগিয়ে এসে বলল,-‘কই, খোকনের মা কোথায়? ওনাকে ডাকুন!’

কিন্তু কোথায় খোকনের মা? তখন ও’ আর ওর মধ্যে নেই। সম্পূর্ণ উদ্মাদ। সমানে আবোল-তাবোল বকছে। কখনো আপনমনে বিড় বিড় করছে। কখনো চোখমুখের বিকৃতি অবয়বে নিজের মনের সাথেই সমঝোতা করছে। অনেক চেষ্টা করেও মমতাকে ঘরের ভিতরে নেওয়া গেল না। বার বার শুধু বলছে,-‘আমার খোকাকে তোমরা কেউ দেখেছ? ও’ কোথায় গেছে তোমরা জানো? আমার খোকা এখনো বাড়ি ফিরে আসে নি! ওর খাবারগুলো আমি ঢেকে রেখেছি। তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও, চলে যাও! আমি তো এখানেই আছি। আমার খোকন ফিরে না আসা পর্যন্ত এই সিঁড়িতেই বসে থাকবো! তোমরা যাও।’



হঠাৎ মমতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ওঠে নির্মলা। কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ করে বলে,-‘খোকন আর ফিরে আসবে না মাসিমা! খোকন কোনদিনও আমাদের মাঝে আর ফিরে আসবে না!’


(/এস/ফেব্রুয়ারি১৮,২০১৬)

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test