E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব /বদরুল হায়দার

২০১৬ এপ্রিল ১৩ ১৮:০১:০২
বাংলা নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব /বদরুল হায়দার


নববর্ষ বাঙালির হাজারো বছরের প্রাচীন উৎসব। বাংলাদেশের মানুষের অসাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হৃদয়স্পর্শী উৎসব। পয়লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের উচ্ছাস শুরু হয়। প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতির, উৎসবের সাথে ঋতুর সম্পর্ক চিরাচরিত। এই সম্প্রতি বাঙালির জীবনে বিশেষ অর্থবহ।
বাংলা নববর্ষের শুরুতে বাঙালির আর্থ-সামাজিক অর্থনৈতিক, সাথে নান পালা-পার্বন, আচার-আচরণ মিল অর্থাৎ ঐতিহ্য সংস্কৃতি মিলে তাৎপর্যময় হয়ে উঠে । কবিগুরুর রচনায়-

“বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ
আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ।”

পেছনের যত দেনা-পাওনা, লেনা-দেনা মানুষের গ্লানি-জ্বরা থেকে নতুন বর্ষে নব উদ্দীপনায় জীবনের নতুন প্রেরণার উৎস শুরু হয়। এ যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, রোদ-বৃষ্টি, বান-তুফান নিয়েই আসে। শুরু হয় নববর্ষকে ঘিরে বাঙালির নানা আয়োজন, উন্মাদনা, উাস, আগ্রহ। দেশব্যাপী শুরু হয় বৈশাখের মেলা। বাঙালি জীবনের ব্যবহৃত সকল জিনিসের চলে নতুন অন্বেষণ।
প্রকৃতিতে নবপল্লবের শাখাপুঞ্জ যেন মন ভরে দেয়। মাঠে মাঠে সবুজ ধানের সমাহারে প্রকৃতিতে নেমে আসে প্রাণ সজীবতা। এ যেন বাঙালি জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের জায়গানে মধুর হওয়াই এ উৎসবের ধর্ম। আনন্দে প্রাণের জাগরণে নববর্ষ পালন উৎসবের আগ্রহ ও কলরব প্রতিদিনই বাড়ছে। আপন সত্তা বছরের গ্লানি হিসাব-নিকাশের ইতিবাচক অভিব্যক্তি যেন নবকল্লোলে জেগে উঠে প্রতিটি প্রাণে। মানুষ, বৃক্ষ, পানি, পশু, শষ্য, ফল-ফুলে, নদ-নদীতে আসে নতুন প্রাণের জোয়ার। মূলত নববর্ষ বরণ উৎসব অর্থনৈতিক আবর্তনের সূচক। অতীতের ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তি, নতুন আঙ্গিকে জীবনের নান অনুষঙ্গে পালা-পার্বণ, জয়-উত্থানের স্বপ্নচারী হতে আগ্রহী করে তোলে। হালখাতা খাজনা আদায়ের উপলক্ষের বাইরে আজ বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির ঐক্যের উৎসবে পরিণত হয়েছে। আচার-প্রথা নিয়ম ছাড়া পোশাক ব্যবহারী গৃহস্তর রান্না-বান্নার ব্যবহৃত নানা সামগ্রী, সাজ-সজ্জা, রঙবেরঙের বাহারি মৃৎ শিল্প, পিতল, কাঁসা, মাটির সামগ্রীর নব বাহারে সারা দেশ হয়ে উঠে স্বপ্নের প্রলেপে রঙিন।
নববর্ষের উৎসবে আলতা, ফিতা ও বর্ণিল পোশাকে বাঙালি নারী খুঁজে পায় আপন রূপের প্রতিচ্ছবি। সারা বছরের ক্লেদ, ঘৃণা, জড়তা আর জঞ্জাল ঝেড়েফেলে নবপ্রাণে উদ্দীপ্ত করে বাঙালি চেতনার রঙে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালিয়ানার নববর্ষ ফুঁটে উঠে।
আবহমান বাঙালির সহস্রাধিক বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার হলো বৈশাখী মেলা। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। সাধারণত বৈশাখ মাসের প্রথম দিন এই মেলা বসে। মেলা একাধিক দিনও চলে। বৈশাখী মেলা একটি সর্বজনীন উৎসব। এই উৎসবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই অংশ নেয়। সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে নিজেদের সাধ ও সাধ্যমতো উৎসব উপভোগ করে, আনন্দ করে। বৈশাখী মেলা বা উৎসবে সাধারণ মানুষ বেশি অংশগ্রহণ করে থাকে।
বৈশাখী মেলা ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক মূর্ত প্রতীক। তাই উৎসবমুখর পরিবেশে নতুন প্রত্যাশায় নতুন বছরকে সবাই স্বাগত জানায়। নতুন বছরের প্রথম দিনে সবাই সবাইকে শুভ নববর্ষ বলে সম্ভাষণ জানায়। পুরোনো বছরের জীর্ণ-জ্বরাকে বিসর্জন দিয়ে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই নতুন আশায় নতুন উদ্দীপনায় নতুন স্বপ্ন রচনা করে। ব্যবসায়ীরা নতুন বছরের প্রথম দিনে নতুন হালখাতা খুলে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। সব কিছুতেই নতুনত্বের একটা আমেজ থাকে। সবচেয়ে বেশি আনন্দে মেতে উঠে শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীরা। নববর্ষ, বৈশাখী মেলা একঘেয়ে জীবনের বাঁধাধরা গন্ডির মধ্যে ব্যতিক্রম ঘটায়। এভাবে নানা বর্ণে, নানা ছন্দে নববর্ষের আগমন ঘটে বাঙালি জীবনে। নববর্ষে প্রধান আকর্ষণ বৈশাখী মেলা। সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে মেলার জন্য। বহু বছর আগে বৈশাখী মেলা বসতো গ্রামে-গঞ্জে। ইদানীং শহরাঞ্জলে মেলা বসে এবং কোথাও কোথাও একাধিক দিন মেলা চলে।
বৈশাখের সকালে ঢাকার রমনা বটমূলে, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (স্বাধীনতা উদ্যান) রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ও ক্যাম্পাস ঘিরে শুরু হয় ইলিশ পান্ত খাওয়ার ধুম।
মেলায় শিশুদের আকর্ষণ করতে হাতি, ঘোড়া, সিংহ নানা ধরনের মুখোশ তৈরি হয়। ঘরে ঘরে নতুন পোশাক পরে শিশুরা মেলায় আসে। বিশেষ করে মাটির তৈরি বাসন কোসন, কলস, রাধা কৃষ্ণের নানা লীলার ছবি, বিখ্যাত গুণী মানুষের ছবি, বাঁশি, খেলনা, পিঠাপুলি, মোয়া, নাড়– বাতাসা, জিলাপি, বাহারি পাত্রে নিয়ে বাড়ি যেতে যেতে মেতে উঠে।
বৈশাখে বাঙালিরা তাদের আন্দর মহলের দিকে দৃষ্টি দেয়। দেশীয় উপাদানে তৈরি ঘরের আসবাবপত্র, কাঠ, বেত, বাঁশ, শোপিস, নানা ধরনের খেলনা, ব্যবহারিক জীবনের খাট-পালঙ, চেয়ার-টেবিল, আলমারি, আলনা হাট বা বৈশাখী মেলা থেকে সংগ্রহ করে।
কবিগুরুর গানে-

“শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান
সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান।”
কবিগুরুর এ আশাবাদী আহ্বানে প্রতিটি বাঙালির জাগরণে একাত্ম হয়েছে। বাঙালির নববর্ষ পালন ছাড়া এ দেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্টিও নববর্ষ পালন করে থাকে বৈশাখী উৎসবের মাধ্যমে। পয়লা বৈশাখের উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা দেশে বিভিন্ন পেশার মানুষের কর্মপরিধি বিসৃত হয়।
বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, প্রযোজক, নির্মাতা কাহিনীকার, বিভিন্ন সিনেমা, নাটক, বেসরকারি কোম্পানীগুলিও সক্রিয় হয়ে উঠে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে। এ যেন মহা আয়োজন। ধুমধাম। বিগত ১১ মাসের ঘুমন্ত আনন্দ কবিগুরুর গানে-
“ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো
একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো।”

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test