E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

যুথিকা বড়ুয়া’র গল্প

২০১৬ মে ০৭ ১২:৩৮:১৪
যুথিকা বড়ুয়া’র গল্প






 

মাতৃত্ব

( এক )

সারাদিনের ক্লান্তিতে কখন যে তন্দ্রা লেগে এসেছিল চোখে টেরই পায়নি সুধারানি। হঠাৎ বাসন-পত্রের টুং টাং শব্দে ধড়্ফ্ড়্ করে ওঠে। মুহূর্তের জন্য স্বপ্ন না বাস্তব ঠাহরই করতে পাচ্ছিল না। চোখ পাকিয়ে দ্যাখে চারদিকে, শব্দটা এলো কোত্থেকে! শোনে কান পেতে। তক্ষুণিই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে বাবলা। কত আর বয়স ওর। বছর সাতেকের হবে। মায়ের অজান্তে রান্নাঘরে ঢুকে এই কান্ড।

ক্ষীর মিঠাই, পিঠা-পায়েশ খুব প্রিয় বাবলার। সকালে খেয়ে ওর মন ভরেনি। বাটিটাই বড় ছিল। সুধারানি দিয়েছিল নামমাত্র। ঐটুকু খেয়ে তৃপ্তি হয় কারো! পেটের এককোণাও ভরেনি বাবলার। অপেক্ষায় ছিল, মা অন্যমনস্ক হলেই চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকে ইচ্ছেমত ক্ষীর খাবে। অথচ তেমন সাহসী বুদ্ধিমান, চালাক-চতুর ছেলেও নয়। মা জানতে পারলে যে উত্তম মধ্যম পিঠে পড়বে, তা ওর বেশ ভাল করেই জানা ছিল। কিন্তু অবোধ নাবালকের মন, অতসব ভেবে দেখার ফুরসৎ কোথায়! পাড়ার ঝন্টুর সাথে বিস্তৃত আঙ্গিনায় মারবেল খেলায় এতো মত্ত হয়েছিল, রান্নাঘরের বারান্দায় ডালের বড়ি শুকোচ্ছিল, হঠাৎ কাঁক এসে ঠোঁকর দিতেই সুধারানির বজ্রকণ্ঠে ও’ চমকে ওঠে। -‘ছ্যামড়া তুই করস কি ঐখানে! আমার এত্তো সাধের বড়িগুলারে মরার কাঁকে মুখ দিল, তুই চোখে দ্যাখস নাই!’
গজ গজ করতে করতে বড়িগুলোকে পাহাড়া দিতে সুধারানি বারান্দাতেই মাদুর পেতে শুয়ে পড়ে। বাবলার অবগত আছে যে, মায়ের বিশ্রাম নেওয়া মানেই এক্ষুণি ঘুমিয়ে পড়বে। মনে মনে পরিকল্পনা করে, মায়ের চোখদু’টো বুজে এলেই পিছন দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়বে। মন্ত্রের মতো জপতে থাকে, কখন মায়ের চোখের পাতাদুটো বুজে আসবে। আর ঠিক তক্ষুণিই দৌড়ে পা টিপে নৈঃশব্দে রান্নাঘরে ঢুকে, দরজা বন্ধ করে ক্ষীরের পাতিলাটাই নিয়ে বসেছিল খেতে। কিন্তু বেচারা একটুও মুখে দিতে পারে নি। সবে মাত্র আঙ্গুল ডুবিয়েছে, তক্ষুণি জানালার ধারে বসে থাকা হুঁলো বিড়ালটা মিঁয়াউ করে ডাক দিতেই চমকে ওঠে বাবলা। আর ক্ষীরের পাতিলাটা সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকে ছিটকে পড়ে বাসন-পত্রের ওপর। ভয়ে আতঙ্কে বাবলা স্বগতোক্তি করে ওঠে,-‘সর্বণাশ, এতোগুলি ক্ষীর, পাতিলা শুদ্ধু সব পড়ে গেল মাটিতে। কি হবে এখন!’

কিন্তু কিছু হবার কি আর অপেক্ষায় থাকে! ততক্ষণে একটা লেগে আরো তিনটে পড়ে। পড়তে পড়তে বাসন-পত্রের টুং টাং শব্দের প্রতিঃধ্বনিতে কানে একেবারে তালা লাগার উপক্রম। হুড়মুড় করে সব বাবলার পায়ের উপরে পড়ে। অসহ্য যন্ত্রণা। বাবলা চিৎকার করে ওঠে,-‘ও মা, মা গো! আমার পা-দুটো ভেঙ্গে গেল গো!’

শুধু কি যন্ত্রণা, মাকে স্মরণ করতেই ভয়-ভীতিতে বাবলা একেবারে আড়ষ্ঠ হয়ে যায়। র্থ র্থ করে গা-হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। গলা শুকিয়ে আসে। ছুটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসবে, সে ক্ষমতাও নেই। বড্ড লেগেছে পায়ে। তবু খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। আঙ্গুলের ডগায় যেটুকু ক্ষীর লেগে ছিল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটুকুই চেটে চেটে খায় আর মনে মনে ভাবে,-‘মায়ের হাত থেকে আজ আর রক্ষে নেই। কপালে দুঃখ অনিবার্য।’

এদিকে ক্ষীরের গন্ধ্যে ছেয়ে গিয়েছে সারাঘর। পা ফেলবার জায়গা নেই। মুহূর্তে একঝাঁক মাছি এসে বনবন করে ঘুরছে চারিদিকে। বাবলার চোখেমুখেও ছিটকে পড়েছে। ওকে অদ্ভুত লাগছে দেখতে। মনে হচ্ছে, ক্ষীরের পাতিলা থেকে ডুব দিয়ে উঠেছে।

ইতিমধ্যে বাসন-পত্রের টুংটাং শব্দ শুনে ধড়ফড় করে ওঠে সুধারানি। দৌড়ে রান্নাঘরে আসতেই বাবলার ঐ বীভৎস চেহারা দেখে সাংঘাতিক চটে যায়। একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। অনায়াসেই বুঝতে পারে, ও ক্ষীর চুরি করে খেতেই ঢুকেছিল রান্নাঘরে। হাতের সামনে একটা ঝাঁটা ছিল। সেটা হাতে নিয়ে চোখমুখ রাঙিয়ে তেড়ে আসে। বিচিত্র মুখাবয়বে গলার স্বর বিকৃতি করে বলে,-‘হতচ্ছাড়া, রাক্ষশ। তড় এত্তবড় সাহস!’
বলে ঝাঁটা দিয়ে দমাদম পিটাতে শুরু করে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে বাবলা। মায়ের পা-দু’টো জড়িয়ে ধরে বলে,-‘মা, মাগো, আমায় মেরনা মা, মের না। আর কোনদিনও করবো না। কক্ষনো তোমার অবাধ্য হবো না।’

পাষাণ হৃদয় সুধারানির। সহজে গলবার নয়। শাড়ির আঁচলটা কোমড়ে গুঁজতে গুঁজতে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে ওঠে,-‘আঃ, হইছে, পা ছাড় আমার। তড়ে না বাটি ভইর‌্যা দিছিলাম। খাইয়া প্যাট ভরে নাই! বাসনগুলারে তো সব দিছস ফ্যালাইয়া। আমার কাম একখান বাড়াই রাখছস। পাইছস কি আমারে। এত্তো জ্বালাশ ক্যান, কয়?’
বাবলার কানদু’টো খুব জোরে মুলে দিয়ে বলে,-‘হারামজাদা, তলে তলে এত্ত বুদ্ধি তর। চুরি বিদ্যাও শিখ্যা গ্যাছ! তরে আবার যদি রান্নাঘরে দেখি, তর ঠ্যাঁং-দুইটারেই ভাইঙ্গা দিমু।’
বলে হিংস্র বাঘিনীর মতো কটাক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে হাঁপাতে থাকে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের গরম শলাকা বের হচ্ছে। যেন গিলেই খেয়ে ফেলবে বাবলাকে।

ইতিমধ্যে বাবলার বাবা শশী ভূষণের গলা শোনা গেল। তিনি হলেন আরেক জগতের মানুষ। প্রচন্ড মাছ ধরার বাতিক। একরকম নেশাও বলা যায়। ছুটির দিনে বাড়িতে দর্শণই পাওয়া যায় না। তন্মধ্যে প্রতিদিন একঘেঁয়ে মায়ে-পুতের পাঁচালী শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গিয়েছে। সাত সকালেই ছিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন মাছ ধরতে। পড়ন্ত বিকেলে ফিরে এসে হাঁক ডাক দিয়ে বলেন,-‘কোই গো ছোট গিন্নী, কোই গ্যালা! আইশ্যা ধরো শীগ্গির। একখান গঙ্গার ইলিশ আনছি!’

স্বামীর আওয়াজ কর্ণগোচর হতেই রক্তের চাপ আরো দশডিগ্রী বেড়ে যায় সুধারানির। রাগে মুখের পেশীগুলি ফুলে লাল হয়ে ওঠে। সবুর সয় না। ঝাঁটা হাতেই উত্তপ্ত মেজাজে হন্হন্ করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে অভিযোগ করে ছেলের বিরুদ্ধে।-‘ওগো শুনছো, তোমার গুনধর পুত্রুর কি করসে দেইখ্যা যাও। আমার হাঁড়-মাংস এক্কারে চিবাইয়া খাইতাছে। আমি আর পারুম না। সহ্য হইতেছে না আমার। অড় শীগ্গির একখান্ ব্যবস্থা কড়!’

শুনে হাঁ করে থাকেন শশী ভূষণ। স্তম্ভিত হয়ে যান বিস্ময়ে। সুধাবানির আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে বললেন,-‘এ তুমি কি কইলা ছোট গিন্নী? পোলাপাইন মানুষ, জ্ঞান-বুদ্ধি হয় নাই। দোষ তো করবই। তুমি না অর মা। অরে শাসন করো। একটু ধমকাও। ডর লাগাও। তুমি না কইছিলা, অরে দ্যাখবা, মানুষ করবা। হেই ভড়সায় তো তোমারে আনছি। তোমার প্যাটের সন্তান হইলে কি একথা কইতে পারতা! বুঝি না বাপু, কও ক্যা¤েœ? অন্তরে কি একটু মায়া-দয়াও নাই তোমার?’

ফোঁস করে ওঠে সুধারানি।-‘অ, এইবার বুজ্ঝি। হ্যাড় লাইগ্যাই তো চাইর চাইরটা বছর গত হইল গিয়া, আমারে আজও একখান সন্তান দিলা না। উল্টা বাপ-ব্যাটা দুজনে মিল্ল্যা আমারেই ধমকাও। জব্দ কড়। আস্কারা দিয়া পোলারে এক্কারে মাথায় তুইল্যা রাখছ। কলিজায় বাইন্ধা রাখছ। আমারে মাইনব ক্যান। হক্ কথা কইছি দেইখ্যাই তোমার জ্বলন ধরছে। বুঝি না কিছু।’
ঝট্ করে স্বামীর হাত থেকে মাছের ব্যাগটা টেনে নিয়ে উগ্র মেজাজে গজ্গজ্ করতে করতে দ্রুত ঢুকে পড়ে রান্নাঘরে।

শশী ভূষণ বরাবরই শান্তিপ্রিয় মানুষ। কোনরকম ঝঞ্ঝাট, ঝামেলা, অশান্তি তিনি মোটেই পছন্দ করেন না। সর্বদা এড়িয়ে চলেন। কখনো গায়ে মাখান না। কিন্তু আজ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত সুধারানীর অপ্রীতিকর বাক্য শ্রবণে হতাশায় মোমের মতো গলে একদম নরম হয়ে পড়লেন। একটি শব্দও আর উচ্চারণ করলেন না। চিন্তিত হয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন বারান্দায়।

এতক্ষণ আড়ি পেতে মা-বাবার কথাবার্তা সব শুনছিল বসে বসে বাবলা। কিন্তু মগজে না ঢুকলেও আলোচ্যের বিষয় বস্তু বোধগম্য হতেই ভারাক্রান্ত মনে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গোয়ালঘরের পিছনে গিয়ে চুপটি করে বসে পড়ে। বেচারার অনুতাপের শেষ নেই। নিজের ওপরই প্রচন্ড রাগ হয়। কোন্ কুক্ষণে যে রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়েছিল, মরার বিড়ালটাও মিঁয়াউ করবার আর সময় পায় নি। তাও যদি একটু তৃপ্তি ভরে খেতে পারতো। সব মাটিতেই পড়ে গেল। উফ্, মাগো। পায়ের পাতায় প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পাচ্ছে না। একসময় মনটা ওর উদাস হয়ে যায়। হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে। নিশ্চয়ই মা আমায় ভালোবাসে না। তাই তো বুকে জড়িয়ে ধরে মা কক্ষনো আমায় আদর করে না, চুমু দেয় না। কিন্তু কেন? পাশের বাড়ির ছোটনকে ওর মা কত ভালোবাসে, আদর করে। প্রতিটি পূজা-পার্বনে ওকে নতুন নতুন জামা-কাপড় কিনে দেয়। ছোটন কখনো অন্যায় করে না? সেদিন মুরগির বাচ্চাগুলিকে ফার্ম থেকে ছেড়ে দিয়ে সেই কি কান্ড। একটাকেও বাঁচাতে পারেনি। সবগুলিই গেছে কাঁকের পেটে। ঠোঁট দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে। কোই, ছোটনকে তো মারধোর করেনি ওর মা। বকাবকিও করেনি! বাবা বলে,-‘মায়ের চে’ বড় আর কেউ নেই পৃথিবীতে। মায়ের স্থান কেউ পূরণ করতে পারেনা। মাতা-পিতা দেবতার সমান। আপনগর্ভে লালিত সন্তান আর মায়ের নারীর চিরন্তন বন্ধন, সে এক অদৃশ্য শক্তি। এক অবিচ্ছেদ্য গভীর টান। তাকে ছিন্ন করা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। স্বয়ং বিধাতারও নেই। মাতা-পিতা দেব-দেবীর সমতূল্য!’
তা’হলে! আমি তো মায়েরই ছেলে। আমার মায়ের মন কেন এতো নিষ্ঠুর, নির্দয়? কেন সবসময় এমনভাবে আমায় আঘাত করে? খাবার জিনিস মায়ের অনুমতি ছাড়া খেতে গিয়ে সব পড়ে গেছে মাটিতে। এটা এমন কি গুরুতরো অপরাধ যে, মা আমায় সহ্যই করতে পাচ্ছে না। কোনো না কোনো কারণে সারাদিন শুধু মারধোর, চেঁচামিচি। কেন এমন করে মা?

ভাবতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল বাবলার। শরীরটাও ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে, পৃথিবীটাই যেন বন্বন্ করে ঘুরছে চারদিকে। তবু মা-বাবা কাউকে ডাকলো না। দু’চোখ বন্ধ করে গোয়ালঘরের বাঁশের খুঁটিতে মাথাটা ঠেকান দিয়ে মাটিতে বসে পড়ে।

ততক্ষণে ক্লান্ত সূর্য্য অস্তাচলে ঢলে পড়েছে। পশ্চিম প্রান্তের নিস্তেজ সূর্য্যরে ক্ষীণ আলোর আভা মুখের উপর এসে পড়তেই শশী ভূষণ নড়ে চড়ে বসেন। বেচারা স্ত্রী-পুত্রের ভবিতব্য রচনা করতে করতে সেই তখন থেকে অন্যমনস্ক হয়ে বারান্দায় বসেছিলেন। হঠাৎ বাবলাকে মনে পড়তেই ঘাড় ঘুরিয়ে সন্ধানী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায় আর মনে মনে বলে, কোথায় গেল বাবলা? সাড়া-শব্দই নেই। গোয়ালঘরের দিকে চোখ পড়তেই বাঁশের বেরার ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাবলাকে দেখতে পান। দ্রুত সন্নিকটে গিয়ে বড় বড় চোখ মেলে স্বগতোক্তি করে ওঠেন,‘-কি আশ্চর্য্য! বাবলা তুই কড়স কি এইখানে? ঘুমাশ পড়ছস? মায়ে মারছে বুঝি খুব!’

পিতার আলতো ¯েœহস্পর্শে ঈষৎ নড়ে ওঠে বাবলা। ওর কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে শশী ভূষণ বললেন,-‘হ্যারে, করছস কি তুই? আমি কইছিলাম, চল আমার লগে। গেরাহ্যই করলি নে। তর গা-হাত-পা এত্ত নোংরা ক্যান? সাদা সাদা এগুলা কি? কি মাখছস?’

চোখ মেলে তাকায় বাবলা। কিছু বলল না। গোমড়া মুখে একপলক চেয়ে নজর ফিরিয়ে নেয়। শশী ভূষণ বুঝলেন, বাবলা অভিমান করেছে। গোশ্যা করেছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,-‘চল বাবা, ঘরে চল। আজ একখান্ ইলিশ মাছ আনছি। মায়ে রানতাছে। গরম গরম ভাত দিয়া দুইটা খাবি চল।’

বাবলা নিরুত্তর। পদাঘাতে থপ্থপ্ শব্দ করে চলে যায় পুকুরঘাটের দিকে। মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। শশী ভূষণ আর্তকণ্ঠে বলে ওঠেন,-‘যাস কোথায় বাবলা? মায়ে মাইর দিব কিন্তু!’




( দুই)

বেশ কিছুদিন যাবৎ আমূল পরিবর্তন ঘটে বাবলার। স্কুল থেকে এসে বারান্দার এক কোণায় চুপটি করে বিষন্ন মুখে বসে থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলে না। ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া করে না। খেলতেও যায় না মাঠে। বিকেল হলেই ওর সঙ্গী-সাথিরা সবাই বাড়ির সামনে এসে ভীঁড় করে। গলা টেনে উঁকি ঝুঁকি মেরে দ্যাখে। ওকে খোঁজে। কিন্তু বজ্রকণ্ঠি সুধারানির হুঁঙ্কারের ভয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকবার সাহসই হয়না কারো। কেউ কেউ কানাকানি করে, মুখ টিপে হাসে। আর কেউ ব্যঙ্গ করে বলে,-‘কি রে বাবলা, তোর মা তোকে খুব পিটিয়েছে বুঝি!’

ইতিপূর্বে বারান্দায় বেরিয়ে আসে সুধারানি। চোখমুখ রাঙিয়ে কটাক্ষ করে বলে,-‘বান্দর কতগুলা! দরদ এক্কারে উথলে উঠতাছে! দাঁড়া, তগো দেখাই মজা!’
বলে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে উঠোনে। ততক্ষণে ছেলে-মেয়েরা ছুটে পালায়। কিন্তু মায়ের উপর অভিমান করে গোঁ ধরে ঠাঁয় বসে থাকে বাবলা। মনে মনে ভীষণ রাগ হয়। মন্ত্রের মতো জপতে থাকে, মায়ের সাথে কোনদিনও আর কথা বলবে না।

বলিহারী মহিলা সুধারানি। তার সবই দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। কোনো কথা জিজ্ঞ্যেসও করলো না। ছেলেটা কিছু মুখে না দিয়ে এতিমের মতো বসে আছে, সেদিকে গ্রাহ্যই করলো না। কোণা চোখে বাবলার দিকে একপলক চেয়ে অকারণে মুখখানা বিকৃতি করে হন্হন্ করে গোয়ালঘরের দিকে চলে গেল।

মনে মনে অবাক হয় বাবলা। বোবার মতো শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। আশা করেছিল, সুধারানি ওর কাছে এগিয়ে আসবে, মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে আদর করবে। ¯েœহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞ্যেস করবে,-‘হ্যাঁ রে বাবলা, মায়ে মারছিল, ব্যথা পাইছিলি খুব না রে! আহা, বাছা আমার! আয় বাবা আয়, আমার বুকে আয়! আর কক্ষনো মারুম না!’ কিন্তু কোই, মা তো কিছুই বলল না! তবে কি সত্যিই মা আমায় ভালোবাসে না?

তুব নিস্পাপ নাবালকের মন কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে, সন্তানের প্রতি মা কখনো এতোখানি নির্দয় নিষ্ঠুর হতে পারে। মায়ের অবাধ্য হয়েছি বলেই তো মা রেগে গিয়েছে। অন্যায় করেছি তাই। রাত পোহালে নিশ্চয়ই সব ভুলে যাবে মা। এইভেবে বাবলা উঠে দাঁড়ায়। মায়ের উপর সমস্ত মান-অভিমান মুহূর্তে সব দূরীভূত হয়ে যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যে ঢলে পড়েছে। প্রতিদিনকার মতো মুখ-হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসে। আর বাবলা পড়তে বসা মানেই ফুটবল খেলার রিলে করার মতো। দাঁড়ি নেই, কমা নেই, বিরতি নেই। একনাগারে কান তালা লাগিয়ে সজোরে পড়তে পড়তে ক্লান্ত দেহের অবসন্নতায় কখন যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, টের পায় নি। হঠাৎ ঘড়ির ঘন্টা শুনে চমকে ওঠে। চোখ মেলে দ্যাখে, রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বইপত্রর সব বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মা-বাবা কারো সাড়া-শব্দ নেই। ভাবল, নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবলা ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে নীচে। নৈঃশব্দে দরজা খুলে গলা টেনে রান্নাঘরের দিকে চেয়ে দেখল, দরজা বন্ধ, অন্ধকার। কিন্তু মায়ের ঘরের জানালা দিয়ে ঈষৎ আলোর রশ্মি এসে পড়েছে বারান্দায়। এদিকে ক্ষিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। সেই দূপুর থেকে কিছুই খাওয়া হয় নি। গিয়ে মাকে ডাকবে, সাহসেই কুলোচ্ছে না। ডাকাডাকি করলে হয়ত এক্ষুণিই চেঁচামিচি শুরু করে দেবে।
এই ভয়ে পা টিপে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই থমকে দাঁড়ায় বাবলা। মনে হলো ওর সম্বন্ধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মা-বাবা আলোচনা করছে। কিন্তু ওতো আজ কোনো অন্যায় অপরাধ করেনি। মায়ের কোনো জিনিস অনিষ্ঠ করেনি। তা’হলে!

হঠাৎ কৌতূহল জেগে ওঠে বাবলার। গিয়ে উঁকি দেয় জানালায়। শোনে আড়ি পেতে। আর শোনামাত্রই চমকে ওঠে। থ্ হয়ে যায় বিস্ময়ে। যেন আকাশ থেকে পড়ল ও’। কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। আজ এ কি শুনলো ও’! এসব কি বলছে মা? মনে মনে বিড়বিড় করে ওঠে। -আমিই মারে খাইছি। আমারে জনম দিয়া রেনুবালার পরাণ গ্যাছে। কে রেনুবালা? মা যা বলছে সত্যিই কি তাই! সত্যিই আমি ওর ছেলে নই? না, না, এ হতে পারে না। এ কেমন করে সম্ভব। কিছুতেই না। নিশ্চয়ই ও’ ভুল শুনেছে।
না, ভুল নয়। ঠিকই শুনেছে বাবলা। আঙ্গুল তুলে সুধারানি চিৎকার করে বলছে,-‘অড়ে আমি দেখুম ক্যান? ক্যান দেখুম? হে তো আমার পোলা নয়! অড়ে তো আমি প্যাটে ধরি নাই, জনম দেই নাই। হে আমার পোলা হইল ক্যা¤েœ? বান্দর একখান্! খালি ল্যাজটাই দেয় নাই ভগবানে। অড়ে আমি কক্ষনো স্বীকার করুম না। এই আমার শ্যাষ কথা!’

হঠাৎ যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। চমকে ওঠে সুধারানি। চোখমুখ রাঙিয়ে তীব্র কণ্ঠে গর্জে উঠলেন শশী ভূষণ,-‘তোমারে আল্বাত মাইনতে হইব। বাবলাই আমাগো একমাত্রর সন্তান। ওরে তোমারেই মানুষ করতে হইব!’
কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,-‘হায়রে আমার অদৃষ্ট! ওরে ক্যা¤েœ বুঝাই!’

শশী ভূষণের অস্বাভাবিক মুখায়ব লক্ষ্য করে নরম হয়ে পড়ে সুধারানি। গলার আওয়াজ ভারি হয়ে আসে। চোখেমুখেও অভিমানের ছাপ প্রকট। মনে মনে ভাবে, একজন বিবাহিতা স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার থেকে সে কখনোই বঞ্চিত হতে পারে না। এ অন্যায়, অবিচার। আপন সন্তানের মা হওয়াই জগতে প্রতিটি নারীর একান্ত কাক্সিক্ষত স্বপ্ন। নারীর স্বার্থকতা, পরিপূর্ণতা। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ীত করতে হঠাৎ কম্পিত স্বরে প্রতিবাদ করে ওঠে সুধারানি।-‘ওগো না, তোমার দু’টি পায়ে পড়ি। পরাণ থাকতে এ আমি কক্ষনো হইতে দিমু না। হইতে পারে না। নিজ গর্ভে ধারণ কইর‌্যা আমি আমার সন্তানের মা হইতে চাই। দোহাই তোমার,আমারে বঞ্চিত কইরো না!’
স্ত্রীর কাতর অভিযোগে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন শশী ভূষণ। চকিতে মনে পড়ে যায়, ভাগ্যবিড়ম্বণার সেই দিনের কথা। যেদিন দ্বিতীয় সন্তান লাভের প্রচেষ্টায় মা হবার সক্ষমতার ব্যথর্তার কারণে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে ছিলেন শশী ভূষণ। কিন্তু বিপদ সংকেত দেখা দিলে শুরু হয় যমে মানুষে টানাটানি। প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছিল সুধারানির। আশক্সক্ষায় শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন শশী ভূষণ। যেদিন পাশে এসে দাঁড়াবার মতো তার কেউ ছিল না। তাৎক্ষণিক বিপদ কেটে গেলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় বছর গড়িয়ে গিয়েছিল। যেকথা আজও সুধারানীর অজানা। শুধু কি তাই, বুকের পাঁজরখানাও ভেঙ্গে চৌচির করে দিয়েছিল শশী ভূষণের। সে কি অপরিসীম যন্ত্রণা নীরবে নিঃভৃতে একেলা শশী ভূষণকেই মুখ বুজে সইতে হয়েছিল, তা ঘূণাক্ষরেও সুধারানিকে কখনো জানতে দেয় নি। মনে মনে নিজে অসন্তুষ্ট হলেও চোখেমুখে ক্ষোভ, দুঃখ ও অনুশোচনার কোনো চিহ্নই তার ছিল না। নিজের অদৃষ্টকে মেনে নিয়ে বুকের কষ্টগুলিকে হাসি মুখেই গ্রহণ করেছিল, শুধুমাত্র সুধারানির মুখ চেয়ে। ও’কি জানে সেখবর? জানতেও তো চায় নি কোনদিন। কখনো ওর ভাবাস্তরও হয়নি। আবেগ-অনুভূতি কিছুই কি নেই ওর অন্তরে?

মানসিক বিভ্রান্তিতে হৃদয়-মন-প্রাণ সারাশরীর বিষন্নতায় ছেয়ে যায় শশী ভূষণের। চেয়েছিলেন গোপন করে রাখতে। কিন্তু পারলেন না। কারণ সত্য কখনো গোপন থাকে না। উপযুক্ত সময়েই তা ঝোলি থেকে বেরিয়ে আসে। লোক জানাজানি হয়ে যায়।
ধৈর্য্য ধরে না শশী ভূষণের। উত্তেজনায় ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। দ্রুত আলমিরার ড্রয়ারটা একটানে খুলে মেডিক্যাল্ রিপোর্টের কাগজটা বের করে তীব্র গলায় বলে উঠলেন,-‘এই দ্যাখো, কি লিখছে ডাক্তারে দ্যাখো। মনে কষ্ট পাইবা, তাই কই নাই। আমারও কি ইচ্ছা হয় না? আমার ইচ্ছা হয় না, তোমার কোলে একটি নবজাত শিশুর আগমন হোক। আমাদের ঘর আলো করুক। আঙ্গিনায় খ্যালা করুক। আমারে ভুল বুইঝ না ছোট গিন্নী। আমি স্বার্থপর নই।’

সুধারানি সেকেলে মহিলা। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা হলেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গভীরভাবে কখনো ভাবতে পারে না। কখনো ভাবান্তরও হয়না। কিন্তু সে যে নিজেই অক্ষম, নিজের রক্তে মাংসে গড়া সন্তানের মা সে কোনদিনও হতে পারবে না, তা বুঝতে একটুও দেরী হলো না। যা স্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করতে পারেনি। সন্তান ধারণের ক্ষমতা সুধারানির নেই। কিন্তু এতবড় দুঃখ সে কোথায় রাখবে! কেমন করে সইবে!
একটা শব্দও আর উচ্চারিত হয় না সুধারানির। রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠস্বর। শোকে দুঃখে হতাশায় পাথরের মতো শক্ত হয়ে ধপাস্ করে বসে পড়ে বিছানায়।
একেই বলে বরাত। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল জীবনে। কিছুই পূরণ হলো না সুধারানির। জীবনের সাধ-আহাল্লাদ মনবাসনা সব নিমেষে ভেসতে গেল। অথচ এতদিন শশী ভূষণকেই মিথ্যে ভুল বুঝে তার মনে কত আঘাত দিয়েছে। কত কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু শশী ভূষণ কোনদিন প্রতিবাদ করেনি। অভিযোগ করেনি। অসন্তুষ্টও হয় নি।
আজ নিজেকেই অপরাধী মনে হয় সুধারানির। অনুতাপ অনুশোচনায় মন-মানসিকতা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। অশ্রুকণায় চোখদু’টো ছল্ছল্ করে ওঠে। লজ্জায় অপমানে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকায়। ফ্যাঁচ্ ফ্যাঁচ্ করে কেঁদে উঠতেই সন্নিকটে এগিয়ে আসেন শশী ভূষণ। শান্তনা দিয়ে বললেন,-‘তুমি কান্দ্ ক্যান ছোট গিন্নী? দোষ তো আমারই। আগে কইতাম, পোলাটারে কক্ষনো মাইরত্যা না। আঘাত করতা না। যাউগ্ গিয়া। পোলা ঘুমায় পড়ছে বোধহয়। কাল সক্কাল হইলে অড়ে ডাইক্যা তোলবা। আদর করবা!’

এতক্ষণ শূন্যতাবোধে বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে উঠছিল সুধারানির। হঠাৎ বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতেই পাষাণ হৃদয়টা মোমের মতো গলে একদম নরম হয়ে যায়। অনুভব করে, মমতাময়ী মায়ের আদর-¯েœহ ভালোবাসার এক মধুর আবেশ। স্পর্শ করে ওর হৃদয়কে। জাগ্রত হয়, অদ্ভুদ এক চেতনা, এক অভিনব কোমল অনুভূতি। আর সেই অনুভূতি থেকেই মনকে আন্দোলিত করে। হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে। প্রশ্ন করে নিজেকে,-মা হারা একটি ছোট্ট শিশুকে দীর্ঘ ছয় বৎসর যাবৎ কোলে পিঠে নিয়ে বড় করেছে। যে মায়ের হাত ধরে ছোট্ট বাবলা হাঁটতে শিখেছে, কথা বলতে শিখেছে, সে তো সেই মায়েরই সন্তান। তবে আজ কেন সে তার মা হতে পারবে না? আজ কেন সেই মায়ের আদর-¯েœহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত তাকে হতে হবে? সে কেন নিগৃহীত হবে? অবহেলিত হবে? বাবলাই রায়চৌধূরী পরিবাবের একমাত্র উত্তরাধিকারী। বংশের প্রতীক। সুধারানির একমাত্র সন্তান।

হঠাৎ অশ্রু প্লাবনে গঙ্গা বয়ে যায় সুধারানির। শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে সজোরে কেঁদে ওঠে। ছোট্ট নিস্পাপ শিশু বাবলার সাথে নির্দয় নিষ্ঠুরের মতো দীর্ঘদিনের প্রবঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও দুর্ব্যবহারে অনুতাপ অনুশোচণায় বুকটা ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে নিজেকে। বাবলাকে কত আঘাত করেছে। কত মারধোর করেছে। ঠিকমতো খেতে পড়তেও দেয়নি। কত রাত উপবাসে কাটিয়েছে। কোনদিন বুকে জড়িয়ে ধরে ওকে আদর করে নি, ভালোবাসে নি।

হঠাৎ মনে পড়ে, সন্ধ্যে থেকে বাবলার আজ কিছুই খাওয়া হয় নি। আহারে, সোনা আমার, বাছা আমার। পোলাটা অনাহারেই ঘুমায় পড়ছে বোধহয়। আর ভাবতে পারছে না সুধারানি। আবেগের বশীভূত হয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্যালে। হাত-পা সারাশরীর ক্রমশ অসাড় হয়ে আসছে। কি করবে দিশা খুঁজে পায়না। হঠাৎ উন্মাদের মতো চাপা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বারান্দায়।-‘আমার বাবলা, লক্ষী সোনা আমার, বাছা আমার। আয় বাবা উঠ্। ভাত খাবি আয়।’

বারান্দায় বেরিয়েই বুকটা ওর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। থমকে দাঁড়ায় সুধারানি। দ্যাখে, গাল ফুলিয়ে আঙ্গুল কামড়ে ধরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবলা। মা হারার বেদনা আর অভিমানের সংমিশ্রণে মাসুম মুখখানা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলেও ওর নির্বাক দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন ভীঁড় করে আছে। জানতে ইচ্ছে করছে নিজের মায়ের কথা। মা কোথায় আছে? কেমন আছে? দেখতে কেমন ছিল? আরো কত কি। কিন্তু আটবছরের নাবালক শিশুর মন, কতটুকুই বা আর ভাবান্তর হতে পারে। মনকে আন্দেলিত করতে পারে।

বাবলার করুন মুখখানা দেখে বড্ড মায়া হয় সুধারানীর। আর তৎক্ষণাৎ নিঃসন্তান মায়ের শূন্য বুক জুড়ে মাতৃত্বে ভরে ওঠে। শরীরের সমস্ত অনূভূতি দিয়ে অনুভব করে, নারীর অস্তিত্ব। জীবনের চরম সার্থকতা, পরিপূর্ণতা এবং মাতৃ¯েœহের দৃঢ় বন্ধন শক্তি। যে বন্ধন শক্তির প্রভাবে সুধারানি গহীনভাবে উপলদ্ধি করে, সব হারিয়েও আজ যেন সবই ফিরে পেয়ে গেছে। নিমেষে মুছে যায়, মনের মণিকোটায় জমে থাকা সমস্ত গ্লানি, মান-অভিমান। বাবলাকে নতুন করে আবিস্কার করে। চেয়ে থাকে ব্যাকুল নয়নে। যেন কতকাল ওকে দ্যাখেনি। ধৈর্য্য ধরে না। আবেগে আপ্লুত হয়ে দুহাত প্রসারিত করে দেয়। কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠে,-‘আয় বাবা আয়,আমার বুকে আয়। আর কক্ষনো মারুম না।’
বলে দ্রুত এগিয়ে আসে। কিন্তু ছুটে পালায় বাবলা। বলে,-‘না, তুমি আমার মা নও। তোমার কোনো কথা আমি শুনবো না।’

ততক্ষণে দৌড়ে এসে বাবলাকে খপ্ করে ধরে ফেলে শশী ভূষণ। বলে-‘ছিঃ বাবা, ও কথা কইতে নাই। মায়ের কথা শুনতে হয়। যা বাব যা। মায়ে ডাকে!’
অধীর হয়ে চেয়ে থাকেন শশী ভূষণ। দেখলেন, একটুও অবাধ্য হলো না বাবলা। গুটি গুটি পায়ে কিছুটা এগিয়ে এসে থমকে দাঁড়ায়। সাশ্রু নয়নে সুধারানি বলল,-‘আয় বাবা, আমার বুকে আয়। এ অভাগিনী মায়ের বুকখানা কতকাল শূন্য হয়ে আছে বাবা। একবার মা বলে আমায় ডাক বাবা। আয় বাবা, আমার বুকে আয়।’

তক্ষুণি ছুটে এসে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবলা। অব্যক্ত আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রণে সজোড়ে কেঁদে ওঠে সুধারানী। ¯েœহাস্পদে বাবলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে গালে চুম্বনে চুম্বনে মাতৃ¯েœহে ভরিয়ে দেয়।

অদূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন শশী ভূষণ। জানালা দিয়ে অন্ধকার রাতের গ্রহ-তারা-নক্ষত্রে ভরা ঝলমলে আকাশের পানে একপলক চেয়ে ফোঁস করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।


(যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরোন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।)

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test