E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাসুম বিল্লাহ’র অণুগল্প

২০১৬ মে ০৯ ১৫:২০:৪৩
মাসুম বিল্লাহ’র অণুগল্প







 

মিলাদ

জজ মিয়ার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হলেও কানে বেশ শুনতে পান। নাতি দিদার ঘরের বারান্দায় বসে- বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই...
তিনি বিছানায় অাধশোয়া হয়ে নাতির পড়া শুনছেন। এক ফাঁকে চোখ তুলে টিনের চালের দিকে তাকাতেই শুষ্ক ঠোঁটে শব্দহীন মলিন হাসির রেখা ফুটে ওঠল। মনে মনে বলেন, আমার ঘরটাও বাবুই বাসা। তফাত নিজের হাতে বানাতি পারিনি, বড়ছেলে বানায়ে দিয়েছে।

জজ মিয়া সময় নিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ছেলের দুইতলা বাড়িতে তার জায়গা হয় না বলে পাশে একটা কাঠের খুপরি ঘর তুলে দিয়েছে। যে ঘরে একটা খাট ছাড়া আর কিছু ধরে না।
একদিন দুপুরে ছেলে বাড়ি ফিরে তাকে পাঁজাকোলা করে এখানে রেখে যায়। এতে তিনি কোনো অসুবিধা মনে করেননি। তার বয়স হয়েছে, বিছানা-পত্তর নষ্ট করে ফেলেন, ছেলের বউ এইসব সহ্য করতে পারে না।

তিনি এ ঘরটা নিয়ে বাবুই পাখির মতো বড়াই করলেও প্রতিবেশীরা ঘরটাকে ‘মুরগীর খোপ’ বলে ফিসফাস করে। কথাটা তার কানেও এসেছে, কিন্তু তিনি গা করেন না, সে বয়সও তার নেই। আর কয়দিন মাত্র, হুট করে একদিন তার চলে যাবার সময় হবে। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন, এই বয়সে এরচে ভালো ঘর, ভালো খাট, বিছানা-বালিশের কোনো দরকার হয় না। ইদানিং বিছানা, লুঙ্গি নষ্ট করে ফেলছেন। কাউকে ডাক না দিয়ে ওই অবস্থায় পড়ে থাকেন। গন্ধটা যখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তখন ছেলের বউ গলা ফাটিয়ে পুরো গ্রাম জানিয়ে তাকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করে দিয়ে যায়। বৃদ্ধ জজ মিয়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করেই রাখেন। মনে মনে হিসাব কষেন, দিন আর বেশি নেই, তোমার আর বেশিদিন কষ্ট করতি হবে না বৌমা।

আজ দুপুরটা যেন ফুরাচ্ছে না। পেটের ভেতর ফাঁকা হয়ে আছে। সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে খিদে তো লাগবেই। এছাড়া শুয়ে বসে উল্টাপাল্টা ভাবনা ভেবেই সময় কাটছে। সকাল থেকে বিয়ের দিনের স্মৃতিটা ঘুরেফিরে ভাবছেন, ভাবনায় ছেদ পড়ল হঠাৎ, নাকের মধ্যে পোলাও আর মাংসের ঘ্রাণ টের পান। সঙ্গে সঙ্গে হুরমুড় করে ঘ্রাণটা ঢুকে পড়ে, তিনি নাক টেনে টেনে ঘ্রাণটা আরো ভেতরে নেয়ার চেষ্টা করেন।

তিনি নাতি দিদারকে মিহি গলায় ডাক দেন। দিদার প্রথমবার শুনতে পেল না, দ্বিতীয়বার শুনতে পেয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, দাদাজান, আমারে ডাকতিছেন? নাতির গলাও তিনি শুনতে পেলেন না বলে যতটা সম্ভব চড়া গলায় ডাক দিলেন, ভাই, একটু শুনয়ে যাতি পারো?
দিদার ছুটে আসে।
-দাদা, কী কবা তাড়াতাড়ি কও?
-পোলাও-মাংস রান্না হচ্ছে নাকি?
-হচ্ছে, চিন্তা করতি হবি না, তোমারে না দিয়ে আমি খাবো না-
দিদার দৌড়ে বাড়ির গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়।
জজ মিয়া টের পান তার দীর্ঘদিনের শুকিয়ে যাওয়া গলার ভেতর গাঢ় জলে ভরে উঠছে।

দুপুরে ভাতের প্লেটে হাত দিয়েই তিনি চমকে ওঠেন, নাক টেনে টেনে ঘ্রাণটা নেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু হতাশ হন তিনি, ছেলের বউকে বলেন, পোলাও এর গন্ধ পাচ্ছিনে যে বৌমা?
-আপনেরে পোলাও-মাংস দিলি তো পাবেন।
-ক্যান, পোলাও-মাংস রান্ধিছো যে!
-আপনার পেটে ওইসব সইবে বলেন, পেট নষ্ট হলি তো আমারই সব করতি হবে!

বৃদ্ধ জজ মিয়া আর কিছু বলেন না, শুধু মাথা বার কয়েক নাড়েন।

সেদিন বিকেলে নাতি দিদারকে দিয়ে অচিনপুর মাদ্রাসার মুদি দোকানদার আফজালকে খবর দিয়ে আনিয়েছেন। জজ মিয়া আফজালের হাত ধরে বলেন, তুমি আমার কাছে কয় টাকা পাবা?

আফজাল ঠিক মনে করতে পারে না, তবে মনে করার ভঙ্গি করে বলে, শ পাঁচেক হতি পারে কাকা।
জজ মিয়াকে বেশ লজ্জিত দেখায়।

তিনি বলেন, আমার কাছে তো কিছুই নেই, আমার ছাওয়ালরে কলি পরে তোমারে দিয়ে দেবেনে।
আফজাল মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, চাচা একবার আমি চাইছিলাম, কিন্তু আপনের ছাওয়াল মুখের ওপর বইলে দিয়েছে, কোন টাকা সে দিতে পারবি না।

জজ মিয়ার চোখে অবিশ্বাস।

আফজাল দোকানদার তাকে আশ্বস্ত করে বলে, কাকা, আপনের চিন্তা করতি হবি না, টাকা আমার লাগবি না।

আজ জজ মিয়ার বাড়ি জুড়ে পোলাও-মাংসের ঘ্রাণে ভরে উঠেছে। পুরো গ্রামবাসীর দাওয়াত। মিলাদে কোনো ত্রুটি রাখতে চাচ্ছে না তার ছেলে মোতাহার। বাপের মিলাদ বলে কথা। জজ মিয়া মারা গেছেন তিন দিন হলো।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test