E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নীপবীথি’র গল্প

২০১৬ মে ১৬ ১৮:০২:৩৬
নীপবীথি’র গল্প






 

লেমনরাইস

সকাল থেকেই বাড়িসুদ্ধ লোকজনের হইচই। সাংঘাতিক তোড়জোড় চারিদিকে, আর হবেই না বা কেন? দুদিন পরেই তো পঁচিশে বৈশাখ। আর বাঙালী হয়ে তার প্রাণের ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ কে কি ভোলা যায়? না সে সম্ভব কখনো? আর এসব সবকিছুর প্রধান উদ্যোক্তা হলেন এ বাড়ির সত্তর বছরের বৃদ্ধ যুবক লেখার শ্বশুর মশাই। কিভাবে কি হবে, কিই বা না হবে,বলতে গেলে গোটা পরিবারের এখন একটাই লক্ষ্য।


শ্বশুর মশাই এর কথা অনুযায়ী এবারে রবি ঠাকুরের মায়ার খেলা নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হবে, পঁচিশে বৈশাখের সন্ধ্যায়। প্রচণ্ড ব্যস্ত এখন তাই সবাই। শ্বশুর আর বৌমা দুজনে মিলিয়ে বেশ একটা নাটকের টিম ও তৈরি করে ফেলেছে। পাড়ার অন্যান্য প্রতিবেশী আর লেখার নিজের দলের বাচ্চাকাচ্চারাই মূলত নাটকের অভিনেতা,অভিনেত্রী।তার মাঝে বাড়িতে থাকলেই ব্রত এসে ওর ওস্তাদি জাহির করে যায়, যদিও ব্রতর এসবে কোনোদিন কোনো রকমের উৎসাহ ছিলো না নিজের,তবুও বাড়িতে এমন অনুষ্ঠান হলে তার মন্দ লাগেনা। মাঝে মাঝে তো দু এক কাপ বেশি চা পাওয়া যায় আর এই সুযোগে তার বেসুরো গলাটাও একটু সুযোগ পায় ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর উপর ওস্তাদি জাহির করতে।

তার আর পর নেই কোনো ঠিকানা...
সকাল থেকেই ব্রত এই গানটাই গুনগুন করে গেয়ে চলেছে যথারীতি। মান্না ওর প্রিয় শিল্পী হলেও হেমন্তের এই গানটা ওর মন জুড়ে অনেকখানিই জায়গা দখল করে রেখেছে। সকাল, সন্ধ্যা,রাতের মাঝ ঘুম ভেঙে ওঠার মুহুর্তে, সে অর্থে বলতে গেলে ওর বেসুরো গলায় যতোই সুরের অসুরেরা বাস করুক না কেন,সব অসুর যেন শান্ত সরল জল হয়ে যায় ওর এই অতি প্রিয় গানটি আওড়ানোর সময়। লেখা ও বাঁধা দেই নি কখনো,যতই অন্য কোনো সুরের সাধনার কালে সে ব্যাঘাত ঘটাক না কেন। মাঝে মাঝে লেখা হয়তো হেসে ফ্যালে গান শুনতে শুনতে,যদিও সে কথা ব্রত বুঝতে পারে,তাও সুর প্রিয় অসুর কণ্ঠ কি আর তাতে দমবার পাত্র। বরং আরো জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে গান চলে তার।

কান তাই এখন সয়ে গেছে লেখার। আসলে পথযাত্রা তো দু এক দিনের নয়,দীর্ঘ উনিশ বছরের।অবশ্য সেভাবে বলতে গেলে তারো আগের থেকেই। একসাথে পড়তে পড়তে তো সেই কোন ছোট্টবেলার থেকে তারা এক পথের পথিক।আর সেই সুবাদে লেখার কানের সহ্য ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ। প্রথম প্রথম যে বারণ করেছে কিংবা ওর নিজস্ব বন্ধু মহলে হাসাহাসিও হয়নি ব্রতর সুর সাধনা নিয়ে তেমন নয়,কিন্তু ইংরেজী সাহিত্যের প্রথম ধারার ছাত্র ব্রত যতই শান্ত সিষ্ঠ ভদ্র নম্র গোছের মানুষ হোক না কেন, ছোট বেলার বান্ধবী লেখার প্রতি সবসময়ই তার ডোন্ট কেয়ার ভাব। অবশ্য এই ডোন্ট কেয়ার মনোভাবটাই বোধহয় লেখাকে এতো নিবিড় ভাবে টেনেছিল ব্রতর প্রতি।

সকাল থেকেই লেখা আজ খুবই ব্যস্ত।বলতে গেলে সে সবসময়ই ব্যস্ত।ইস্কুল, কাজকর্ম,ঘরবাড়ি,শ্বশুর সংসার,স্বামী সামলিয়েও লেখার নিজের ব্যস্ততা,নিজের লেখালেখি।একহাতেই গোটা সংসারের ভার।কি আর হবে, বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধুর মতো শ্বাশুড়ী গত হন। তারপর সত্তর বছরের যুবক শ্বশুর আর পাঁচ বছরের শিশুর মতো সহজ সরল মানুষটাকে নিয়েই লেখার শুরু হয় জীবন লেখার বাস্তব পথ।

সবই আছে পরিবারের,আনন্দ,হাসি,সুখ দুঃখ,কান্না,বিরহ; শুধু নেই বলতে একটা ফুলের মতো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। চারবার মিস্ ক্যারেজের পর দীর্ঘ সাবধানতার পরেও একটা ফুল ফুটেছিলো বাগান আলো করে, নাম ও রেখেছিলো গোলাপ, কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদ হয়তো ছিলোনা সেই বাগানের প্রতি। ঝরে গেল অকালেই, মাত্র চারবছর বয়সেই। লেখা তাই আজ জীবন যুদ্ধের লেখিকা। এতো কাজের পরেও সে পাড়ার একটা চাইল্ড কেয়ার সোসাইটির সাথে যুক্ত। তাই প্রায় দিনই বাড়িতে লেগেই আছে অনুষ্ঠান,খাওয়া দাওয়া, গান, কবিতা, নাটক। অবশ্যই সেই সাথে ব্রত র বেসুরো গান। আসলে এইটুকুই তো জীবনের আসল পাওয়া। কে আর থাকে পৃথিবীতে চিরকাল। তাই যেটুকুই আছে, তাই দিয়েই তো আসল জীবনের ছন্দ গান। হারিয়ে তো সবই যায় সেই,তবুও সেটা জেনে বুঝে তাকে ধরে রাখতে পারেই বা কয়জন!

কাল রাতভর জুড়ে আকাশ তোলপাড় করে বৃষ্টি হয়েগেছে।তবুও কিন্তু আজ সকাল দেখলে বোঝার উপায় নেই তা। চারিদিকে রোদের লুকোচুরি খেলা বাতাসের বয়ে যাওয়া হাতের স্পর্শে,আর সেই সাথে ভেজা মাঠের মেঠো আঘ্রাণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া ফড়িংদের রোদখেলা। আর এমন একটা দিনে কি থামতে পারে ব্রতোর ' তার আর পর নেই'...। বলাবাহুল্য,আজ আবার রবিবার। সারাসপ্তাহের অফিসের সাহেব আজ তার আসল মেজাজে। কে দেখলে বলবে,এই মানুষটাই অফিসে এতো রাশভারী, গম্ভীর। আর ছুটির দিন মানেই বাড়িতে আর পাঁচটা বাঙালি বাড়ির মতোই উৎসব, খাওয়া দাওয়া। রাঁধুনি তো অবশ্যই লেখা।

রান্নাটা ও ভালোই করে, সেই সাথে অতিথি আপ্যায়ন। নিজের হাতে বাজার ঘাট করে রান্না করে সবাইকে একসাথে বসে খাওয়ানোর যে আজও সুখ আছে, তা বোধহয় লেখাকে দেখলেই বোঝা যায়।নিজে সন্তানহারা, তবুও কি,অন্যের ছেলেমেয়েদের যে আদরে যত্ন করে,তা দেখে বোঝার উপায় নেই কিছু।তবুও যে কেন আজকাল এতো আনন্দ উৎসব,রান্না প্রিয় লেখার চোখে মাঝে মাঝেই জল চলে আসে!

ব্রত বোঝে সব। জানেও সে সবকিছুই।লেমন রাইস টা যতবারই বানাতে যায় লেখা আজকাল,ততবারই যেন সে উদাসীন হয়ে পড়ে।

অথচ তার হাতের এটা একটা বিখ্যাত পদ। যে এসেছে তাদের বাড়ি,তারাই জানে,রেসিপি চেয়ে ও নিয়েছে কয়েকজন। এমন তো কিছু না, সবই এখন হোটেল,রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়,তবুও সেই যে বলে না, স্পেশাল টাচ, সেটাই বোধহয়।

বারবার মনে হচ্ছিল লেখার কথাগুলো। এইতো কয়েকদিন আগেই সেই কবেকার এক পুরোনো বন্ধুর ওখানে গিয়ে কথা হয়েছিলো লেখার সেই স্পেশাল ডিস নিয়ে। কতো আনন্দ ই না হয়েছিলো সেবার। আর সেই আনন্দের কারণেই রান্না আর বাড়িতে করা হয়নি বলে অগত্যা হোটেলের আশ্রয়প্রার্থী।---আরো কত কি, রেসিপি টা লিখে দেবে লিখে দেবে করে শেষ মুহূর্তে আর লেখাই হলোনা।যদিও চিন্তা নেই হোয়াটস অ্যাপেই সব হয়ে যায় এখন!

হঠাৎ পোড়া গন্ধে লেখার ঘোর ফেরে, ভাতটা তো পুড়ে গেছে, কি করে হবে লেমন রাইস?তবে কি আজও সে ব্যর্থ! না থাক্, আজ তবে থাক্। সবকিছুই যে ঠিকঠাক হবে, এতো কোনো জীবনের কথা নয়, মাঝে মাঝে দীর্ঘ শ্রাবণ ধারার প্রতীক্ষায় থাকলেও তো শুধু ঝড় আসে আকাশ ছেয়ে,ভেঙে দেয়,ঘরবাড়ি,ডালপালা। বৃষ্টি কি আসে সবসময়ই??? তাই যা আছে তাকে নিয়ে চলো,ঝড়ই থাক্ আজ,বৃষ্টি না হয় আসবে অন্যকোন সময়,যেদিন সে চাইবে আসতে।

দূর থেকে ভেসে আসছে ব্রতর গান, বোধহয় সে আজ সুরেই গেলো। থাক্ না আর নাই বা হলো লেমন রাইস। সবদিন তো সব কিছুই হয় না,না ঈশ্বর সবাইকে সবকিছুই দেন।যা আছে,যেটুকু আছে,তাই না হয় থাক্।অনেকেই তো অনেক কিছুই পায় না, কতো হারায় কিংবা কারোর বা সব থেকেও কিছুই নেই, তবু লেখার তো আছে. ..অনেকখানিই আছে! অন্তত একটা সহজ সরল মানুষ আছে, জীবন আছে মুখোশবিহীন। জল যেমন বয়ে যায় সহজ নদীপথ ধরে,ঠিক তেমনি একটা সহজ নদীর ধারার মতোই সংসার আছে। এ পাওয়া ও তো কম পাওয়া নয়!

স্নান সেরে এলো ব্রত। ' লেখা, এখনো রেডি হওনি? তাড়াতাড়ি করো,আজ আমরা সবাই মিলে পিকনিকে যাবো কোপাই নদীর তীরে' , তোমার না বড় প্রিয় জায়গা, ওই সোনাঝুরির জঙ্গল,কোপাই এর শান্ত বাতাস,আর সেই সাথে আমার বেসুরো গলার ....তার আর পর নেই. ..নেই কোনো ঠিকানা'।

লেখা উঠে গেল, বোধহয় খুব সাজবে আজ ও, সেই নীল রঙের শাড়িতে, নীল যে ওর বড় প্রিয় রঙ।
----" আমারো পরাণো যাহা চায়,তুমি তাই"। বড় সুরে গায় লেখা।

'লেখা মা ও লেখা মা,তাড়াতাড়ি কর এবার,কতক্ষন আর এই বৃদ্ধ ছেলেটাকে দাঁড় করিয়ে রাখবি বলতো?চল যে কদিন বেঁচে থাকি, যে কদিন বা জীবন আছে সবাই মিলে একসাথে এভাবে বাঁচি,শুধু একটা কথা বলি মা তোকে প্রতিদিন একবার করে রবিঠাকুর কে স্মরণ করিস,ভুলিস না তাকে কখনও। দেখবি উনিই দেখিয়ে দেবেন তোর জীবনের সমস্ত চলার পথ'।
" আয় রে মা এবার আয়"...।

শান্তিনিকেতন থেকে

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test