E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প

২০১৬ মে ২৯ ২২:৪০:৪৫
আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প







 

কাঁচের চোখ- ১

তোমরা কাঁচের চোখে দেখো তাই অনুধাবন করতে পারো না। কাঁচের চোখে দেখলে অনুধাবন করা যায় না। আজ মনুষ্য সমাজের এই চিত্র তোমাদের ঐ স্থির দৃষ্টির উপর পড়ে ঠিকই কিন্তু ঐ প্রতিবিম্ব তোমাদের মনকে আলোড়িত করে না। দৃষ্টির সাথে সাথে তোমাদের মনও আজ পাথরসম। অনুধাবন করার শক্তি, বিবেকের বিচার আর মনুষ্যত্ব নামের উজ্জ্বল জ্যোতি থেকে আজ তোমরা বিচ্যুত। তবে দেরি হয়নি খুব। তোমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রতিনিয়ত যারা চাতকের মতো চেয়ে থাকে তাদের আর্তি ভরা ডাকে সারা তোমাদেরকে দিতেই হবে, তোমাদেরকে ফিরতেই হবে।

আজ প্রথম পার্বিক পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হবে। স্কুলের সামনে তাই অভিভাবকদের বিরাট এক জটলা। অন্য সকলের মতো সাব্বিরের মা মিসেস জামানও অপেক্ষা করছেন। সাব্বির দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। আজকাল দ্বিতীয় শ্রেণি মানেই অনেক কিছু। দ্বিতীয় শ্রেণির পরেই আসবে তৃতীয় শ্রেণি। এখন থেকে ভালো করতে না পারলে জেলা স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব হবে না তাই ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে অভিভাবকদের চেষ্টা এবং চিন্তা দুটোই বেশি। ক্ষাণিক বাদেই ঘণ্টা পড়ল। যারা ভালো ফলাফল করেছে তাদেরকে ছুটে আসতে দেখা গেল। ব্যাপার কী? সাব্বির এখনও আসছে না কেন? তবে কি তার রেজাল্ট খারাপ হল? কিন্তু পরীক্ষা তো তার ভালই হয়েছিল। হল থেকে বেরিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর সে ঝর-ঝর করে বলে গেছে। তাহলে দেরি করছে কেন? মিসেস জামানের চোখে উৎকণ্ঠার দৃষ্টি। ক্ষাণিক বাদে সাব্বির এলো। মুখ তার মলিন। রেজাল্ট মানে পরীক্ষার খাতা সহ রেজাল্ট। খাতাটা সে মায়ের হাতে দিল। খাতাগুলো হাতে নিয়ে উপরে লেখা নম্বরগুলো দেখলেন মিসেস জামান। বাংলা বিষয়ের নম্বর দেখে মাথায় হাত রেখে অনেকটা টলতে টলতেই স্কুলের সামনে আমগাছটার নিচে গিয়ে বসে পড়লেন তিনি। একী? আশির মধ্যে আটান্ন! সাব্বিরের মুখে আতঙ্কের ছাপ।

কোমল-কচি মুখখানা তার একবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মিসেস জামান ব্যাগের মধ্যে থেকে পানির বোতলটা বের করে একটু পানি পান করলেন। গত তিন মাসে ছেলের প্রতি যে অক্লান্ত পরিশ্রম তিনি এবং তার স্বামী করেছেন তার এই ফল! মিসেস জামান দ্রুত খাতার পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে শুরু করলেন। একী ! উত্তর তো সব মনে হচ্ছে ঠিকই আছে তবে স্যার কেটে দিয়েছেন কেন ? সাত থেকে আটটা সঠিক উত্তর লাল কালিতে ক্রস করা। মিসেস জামানের মাথা গরম হতে শুরু করেছে।

ছাদেকের মা রুপা আপা বলেছিলেন, বাংলা স্যারের কাছে কোচিং না করলে তিনি নাকি নম্বর দেন না। তিনি তো তার ছেলেকে বাংলা স্যারের কাছে কোচিং করান নি। তাহলে কি ইচ্ছা করেই স্যার এই কাজটা করেছেন! কেটে দেওয়া উত্তরগুলো তিনি বার বার দেখলেন। ভালো করে দেখলে বোঝা যায় কিছু জায়গায় ‘র’ এর ফোটা টা সামান্য নিচে পড়েছে অথবা দুটি অক্ষরের মধ্যে ব্যবধানটা সাধারণের তুলনায় একটু বেশি। এগুলো কি গুরুতর ভুল? মিসেস জামানের কান গরম হয়ে যাচ্ছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি একরকম কেঁদেই ফেললেন। এইটুকু মাত্র ছেলে, পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ব্যাট-বল নিয়ে যার খেলে বেড়ানোর কথা অথচ মা বাবার মুখে হাসি ফোটাতে সে বিকালের সময়টাতেও বই নিয়ে বসে থেকেছে। কোচিং না করার কারণে তার ছেলে আজ এত কম নম্বর পেল! মিসেস জামান চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। ঐ তো সাজিদ তার মায়ের সামনে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাজিদ বাংলা স্যারের কাছে কোচিং করেছে। একবার দেখবেন নাকি সাজিদের খাতাটা। মিসেস জামান এগিয়ে গেলেন। সাজিদের মা মিসেস জামানকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
-আপা সাব্বিরের রেজাল্ট কী?
-ভালো না আপা, বাংলায় আটান্ন পেয়েছে।
-আপনাকে তো বলেছিলাম, বাংলা স্যারের কাছে কোচিং করান। আপনি তো শুনলেন না।
-কী করব আপা, ওর বাবার যা আয় তা দিয়ে সংসার চালিয়ে একজন শিক্ষকের কাছে পড়ানোর মতো টাকা অবশিষ্ট থাকে না,তাই। কিন্তু জানেন ওর বাবা কোনো আড্ডায় যায় না। সকাল-সন্ধ্যা ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসে।
ক্ষাণিক চুপ থেকে মিসেস জামান বললেন,
-আপা আমি কি সাজিদের খাতাটা একটু দেখতে পারি?
-দেখুন না। বলে সাজিদের মা খাতাটা মিসেস জামানের হাতে দিলেন।

খাতার পৃষ্ঠাগুলো উল্টে দেখে মিসেস জামান আরো ভেঙে পড়লেন। সাজিদের লেখার মধ্যে অনেক ভুল! উত্তর এবং বানানে অসংখ্য ভুল অথচ সাজিদ পেয়েছে ছিয়াত্তর। অপর দিকে তার ছেলে যা লিখেছে তাতে অনায়াসে আটাত্তর পেতে পারতো। মিসেস জামান খাতাটা সাজিদের মায়ের হাতে দিয়ে আবার আম গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালেন। সাব্বিরের খাতাটা তিনি আবার দেখলেন, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বাংলা স্যারের কাছে যাবেন। কিন্তু গতবার এক ছাত্রের মা বাংলা স্যারের কাছে গেলে স্যার তাকে নানান ভাবে অপমান করেছিলেন। কিন্তু মিসেস জামানের উপায় নেই, অপমান করলেও তিনি যাবেন। সবাই যখন রেজাল্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল মিসেস জামান তখন ধীর পায়ে অফিস রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, বাংলা স্যার কোণের একটি চেয়ারে বসে আছেন।
-আসতে পারি স্যার?
-আসুন। মিসেস জামান এগিয়ে গেলেন। স্যার বললেন,
-কী ব্যাপার বলুন?
-স্যার আমার ছেলের খাতাটা একটু দেখবেন?
-খাতা তো দেখেছি। আবার কী দেখব?
-কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনি যদি আর এক বার খাতাটা দেখতেন।
-কেন আর এক বার দেখব ? আপনার ছেলে যা লিখেছে সেই অনুযায়ী নম্বর পেয়েছে।
মিসেস জামান আরো একটু সাহস সঞ্চয় করে বললেন,
-না স্যার, আমার ছেলে যা লিখেছে সেই অনুযায়ী নম্বর সে পায়নি।
গর্জে উঠলেন স্যার,
-শুনুন আপনাকে একটা কথা পরিষ্কার বলে দিই। যারা কোচিং করবে না তারা ভালো নম্বর পাবে না।
-কিন্তু যারা কোচিং করেছে তাদের থেকে তো আমার ছেলে ভালো লিখেছে। কেন তাকে তার যোগ্য ফলাফল দেওয়া হবে না?
-আপনি এখন আসুন। আমার অন্য কাজ আছে।
-আপনি কি খাটাতা আর এক বার দেখবেন না ?
-না, আমি খাতা দেখব না।
-সাব্বিরের মা অফিস রুম থেকে বেড়িয়ে প্রধান শিক্ষকের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। আয়া বলল,
-কী হইছে ?
-মিসেস জামান সংক্ষেপে ব্যাপারটা তাকে জানালেন। কথাগুলো শুনে আয়া বলল,
-আমার মনে হয় কোনো লাভ হবে না। আপনি কি মনে করেন হেড স্যারের অনুমতি ছাড়াই স্যাররা কোচিং করায়? কোচিং এর পয়সা হেড স্যারের পকেটেও পড়ে। এখন যান, হেড স্যার আজ আর আসবেন না।
ছেলের হাত ধরে মিসেস জামান বাড়ির পথ ধরলেন। তার মনে আজ অনেক কষ্ট। এই বিচার নিয়ে তিনি কার কাছে যাবেন? কে শুনবে তার এই আর্তি ? কে আসবে তার ছেলের জন্য ঐ মুখোসধারী, শিক্ষকবেশী ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে রুখে দেবার জন্য ?

আপনারা হয়তো ভাবছেন, এ তো সব জায়গাতেই হচ্ছে। এ আর নতুন কী? কিন্তু আমি বলি, কেন এমন হবে ? এই অবস্থার ফল কি শুধু মিসেস জামান আর তার ছেলে ভোগ করছে? চোখ খুলুন, অনুধাবন করুন। এর ফল একদিন আপনাকেও ভোগ করতে হবে, গোটা জাতিকেই ভোগ করতে হবে। আজ সাব্বির তার মেধার যথাযথ মর্যাদা পেল না এটা একটা ক্ষতি। আর সাজিদ মানে যে ছেলেটা কোচিং করে মেধাবী না হওয়া স্বত্বেও মেধাবীর মর্যাদা পেল সেও কিন্তু একদিন ক্ষতিগ্রন্থ হবে। এভাবে হয়তো সে স্কুল কলেজ পেরিয়ে ইউনিভারসিটিও পার করবে কিন্তু মূলত সে মেধাবী নয়। তার উপরে মেধাবীর তকমা থাকলেও ভেতরটা ফক্কা, ফাঁকা। এই ছেলে যখন কর্মক্ষেত্রে যাবে তখন কি সে তার যথাযথ দক্ষতা দেখাতে পারবে ? পারবে না। দেখছেন না, আজ ডাক্তার হয়ে, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে এমনকি প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তারা কতো অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। এই অদক্ষ, অপরের মর্যাদা চুরি করা মানুষগুলোর কারণে সাধারণ মানুষও কি ভুক্তভোগী হচ্ছে না ?

একজন শিক্ষকের মর্যাদা কতখানি? মুরুব্বীদের মুখে শুনেছি, আল্লাহ্-রাসুল এর পরে মা-বাবা আর তার পরেই শিক্ষক। শিক্ষক সত্যিই অনেক বড়। আমরা সাধারণ মানুষ শিক্ষকদেরকে সত্যিই অনেক সম্মান করি। এই সেদিনইতো, নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে অপমান করার প্রতিবাদে আমরা গোটা জাতী তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে, জনসমাবেশ করে, ফেসবুকে, টুইটারে কান ধরে বলেছিলাম, ‘সরি স্যার’। আমরা শিক্ষকদেরকে সত্যিই অনেক ভালোবাসি। শিক্ষকদেরকে অপমান করলে আমরা বসে থাকতে পারি না।

কিন্তু আজ যারা একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার পরেও নেহাৎ ব্যবসার উদ্দেশে প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন, কোচিং এর নামে গলায় পা রেখে টাকা আদায় করছেন, টাকা না পেলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চোখের দিকে তাকিয়ে নির্দ্বিধায় তাদের মেধাকে করছেন লুট। তাদের জন্য বলছি, ব্যবসা যদি করতেই হয় তবে পথে নামুন তলা-তলা বিল্ডিং গড়তে পারবেন। নির্লজ্জের মতো কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে শিক্ষকের বেশ ধরতে আপনাদের লজ্জা করে না। মনে রাখবেন আজ যা করছেন কাল তার ফল অবশ্যই পাবেন। আপনার শূন্য মস্তিষ্কের ছাত্ররা হয়তো একদিন ডাক্তার হবে, অ্যাপেন্ডিক্স সার্জারি করতে গিয়ে হয়তো কট করে আপনার শরীরের একটা ভাইটাল নার্ভ কেটে ফেলবে। আপনার ছাত্ররা হয়তো একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে, মেধা ব্যবসা করে এতদিন আপনি যা জমিয়েছিলেন তার তৈরি বিল্ডিং হয়তো একদিন আপনার মাথার উপরেই ভেঙে পড়বে। কে জানে আর কী কী অপেক্ষা করছে আপনাদের জন্য।

জনতার শক্তি অত্যন্ত প্রবল। আজ কোটি জনতার দিকে লাখো সাব্বির আর তার মা-বাবা চেয়ে আছে। তারা শিক্ষকের বেশে কোনো ব্যবসায়ীদেরকে দেখতে চায় না। তারা এই সকল অন্যায়ের বিচার চায়। হে জনতা, আপনারা আর কতদিন থাকবেন নীরব ? এই ক্ষতি কি আপনার আমার ক্ষতি নয়? এই ক্ষতির বোঝা কি আপনাকে আমাকে বহন করতে হবে না ? কবে আপনারা উঠে দাঁড়াবেন? কবে আপনাদের কাঁচের চোখ খসে পড়ে বেড়িয়ে আসবে বিবেকের চোখ? কবে সাব্বিররা তাদের যথাযথ মর্যাদা ফেরত পাবে? সমাজের এমন নষ্ট দৃশ্য আর কতকাল আমাদের চোখের উপর বয়োস্কোপের নৃত্যে নাচবে ?


পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test