E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

যুথিকা বড়ুয়া’র গল্প

২০১৬ জুলাই ১২ ১৪:২৯:০৯
যুথিকা বড়ুয়া’র গল্প







 

জীবন তৃষ্ণা

ক’দিন যাবৎ লাগাতার ঠান্ডা আবহাওয়া। ভোরের দিকে শীততাপ নিয়ন্ত্রণে ভরে থাকে সারাঘর। উঠতেই ইচ্ছে করেনা বিছানা ছেড়ে। তন্মধ্যে লং-উইকেন্ড্ হলে বেশ মজা হয়। পালা করে রাতভোর চলে কাব্য জলসা কিংবা সহেলিদের নৃত্যগীতের আসর। তারপর মধ্য রাত্রিরে বিছানায় গেলে সকালে ঘুমই আর ভাঙ্গতে চায় না।
এমনিই এক ভোর রাত্রের কথা। ক্লান্ত দেহের অবসন্নতায় বিছানায় শুয়ে পড়তেই কখন যে নিদ্রাদেবীর বাহুমন্ডলে কুম্ভকর্ণের মতো বেহুঁশ হয়ে পড়লাম, টের পাইনি। ইতিমধ্যে খট্খট্ শব্দে নড়ে ওঠে দরজার কড়া। হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম ভেবে তন্দ্রাজড়ানো চোখে লাফ দিয়ে উঠি। জানালা দিয়ে দেখি, তখনও আবছা অন্ধকার বাইরে। চারদিক কূয়াশাচ্ছন্ন। নীরব, নিস্তদ্ধ। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা কিচ্ছু। রাজ্যের পশু-পক্ষীরাও সব নিদ্রায় মগ্ন। রাস্তার বিজলীবাতিগুলি নিভু নিভু প্রায়। হৃদস্পন্দনের মতো ঘড়ির কাঁটা চলছে টিকটিক শব্দে। যেন রহস্যাবৃত এক অতন্দ্র মায়াবী রাত। মনে হচ্ছিল, ডানলভের পালঙ্কে শুয়ে যেন স্বর্গেই ভাসছি।

শুনলাম কান পেতে। নাঃ, সত্যিই তো, কে যেন দরজা নক্ করছে। ভাবলাম, গোয়ালা এসেছে দুধ দিতে। কিন্তু সকাল না হতেই! বিব্রোত হয়ে ক্ষীণ মৃদুস্বরে বললাম,-‘কিরে মদন, তোর ঘুম নেই! ভোর না হতেই দুধ দিতে এসেছিস। দিলি তো ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে!’
কিন্তু কোথায় মদন! কারো সাড়া-শব্দ নেই। দরজার কড়া নড়াও বন্ধ হয়ে গেল। অথচ ক্ষণপূর্বেও শব্দদূষণে কানে একেবারে তালা লেগে যাচ্ছিল। হঠাৎ পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে চমকে উঠলাম ঘড়ি দেখে।-এ কি, মাত্র সাড়ে চারটে বাজে। মদনের কি হলো আজ! তক্ষুণি বিকট শব্দে আবার নড়ে ওঠে দরজার কড়া। কিঞ্চিৎ বিব্রোত হয়ে মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে দ্রুত নেমে আসি বিছানা ছেড়ে। -কি মুসকিল! আজ এমন বিহ্যাভ্ করছে কেন মদন! ফাইজলামি করবার আর সময় পেলনা! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা। দেবো আচ্ছা করে তোর কানটা মুলে।

ইতিপূর্বে চুড়ির ঠুন্ঠুন্ শব্দ শুনে আমি চমকে উঠি। বুকটা ধুক্ধুক্ করে কেঁপে ওঠে। একেই কাঁচা ঘুম থেকে উঠেছি। নাক কান সব বন্ধ হয়ে আছে। গলা দিয়ে স্বরই বের হচ্ছে না। কিন্তু দরজার ওপ্রান্তে কার যে আর্বিভাব, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। জানালায় উঁকি দিয়ে ফ্যাস্ ফ্যাস্ শব্দে বললাম,-‘কে ওখানে?’
বলে দ্রুত দরজাটা খুলতে যেতেই দরজার ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে মহিলা কণ্ঠস্বর। আমি থমকে দাঁড়াই। সে যেন একেবারে আহাল্লাদে ফেটে পড়ছে। সহাস্যে বলছে,-‘এ্যাই, আমিরে আমি, শ্রাবণী, শীগ্গির দরজা খোল! দ্যাখ্ কাকে নিয়ে এসেছি সঙ্গে!’

শ্রাবণী, নামটা শুনে পড়ে গেলাম বিস্ময়ের ঘোরে। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে! কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পাচ্ছিনা, কে এই মহিলা!
আমতা আমতা করে বললাম,-‘কিন্তু এই অসময়ে! সঙ্গে কে এসেছে?’

ক্ষীণ বিব্রত কণ্ঠে শ্রাবণী বলল,-‘আরে বাবা, দরজাটা খোল আগে। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে বাইরে!’

হঠাৎ অসময়ে বিনা নোটিশে অচেনা মহিলার আগমনে অস্বস্তিবোধ করি মনে মনে। কিঞ্চিৎ গড়িমশি করে বললাম,-‘না খুলবো না! আগে বল, সঙ্গে কাকে নিয়ে এসেছিস!’

অসন্তোষ গলায় শ্রাবণী বলল,-‘ন্যাকামি করিস না! তুই জানিস না কে! দ্বীপকে নিয়ে এসেছি। আমার সন্দীপ। ও’ আমার, আমারই থাকবে চিরদিন। কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেবো না। কেউ পারবে না আমার হৃদয় থেকে ওকে ছিনিয়ে নিতে। কোনদিনও না!’

হ্যাঁ, এইবার মনে পড়েছে, খুব দস্যি মেয়ে ছিল শ্রাবণী। কাউকে গ্রাহ্য করতো না। খই ফোটার মতো চোখেমুখে এক নিঃশ্বাসে কথা বলতো। যেমন একরোখা, জেদী, তেমনি বিরল ওর সেন্টিমেন্টাল। কোনো জিনিসই ওর ছুঁতে পারতো না কেউ। কারো সাথে শেয়ার করতো না। একাই ভোগ করতো। সেই শ্রাবণী! কিন্তু তা কেমন করে সম্ভব! সন্দীপ তো অন্য এক মহিলাকে বিবাহ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল শুনেছিলাম। আজ এতদিন পর ওকে পেল কোথায়! আশ্চর্য্য, কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা!

সবুর সয়না শ্রাবণীর। ক্ষণিকের নীরবতায় অস্থির হয়ে ওঠে। খুব জোড়ে ধাক্কা দিতে লাগল দরজায়। -‘ওঃ হোঃ, বলছি না দরজা খুলতে।’ বলেই খিলখিল্ করে হেসে ওঠে শ্রাবণী।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম বিস্ময়ে। রুদ্ধ হয়ে গেল আমার কণ্ঠস্বর। অভিভূতের মতো হাঁ করে চেয়ে থাকি। বিশ্বাসই করতে পাচ্ছিনা। ফূর্তিতে মন-প্রাণ যেন একেবারে টববগ করছে শ্রাবণীর। খুশীর প্লাবনে হৃদয়ের দুকুল যেন ভেসে যাচ্ছে। বলে কি শ্রাবণী! আজ এতকাল পর ওইবা এলো কোত্থেকে!

চকিতে একটুকরো বেদনাময় স্মৃতির তীব্র জাগরণে মনটা আমার উদাস হয়ে গেল। আমি হারিয়ে গেলাম কল্পনায়। তারপর ধীরে ধীরে আমার মনঃশ্চক্ষে উদ্ভাসিত হতে লাগল, পাথরের মূর্তির মতো বোধশক্তিহীন শ্রাবণীর সেই বিষাদাচ্ছন্ন মুখখানা।


(দুই)
শ্রাবণী ছিল অসাধারণ সুন্দরী, লাবণ্যময়ী এক উদ্বিগ্ন যৌবনা অনন্যা। লম্বা ঘনকালো রেশমী চুল। তিখালো নাক। দুইভ্রুর মাঝখানে ঝুলে থাকতো একগোছা কোঁকড়ানো চুল। তেমনি হরিণাক্ষীদু’টির মায়াবী চাহনি। ঠোঁটের বাঁদিকে কালো একটা তিল। শ্বেতাঙ্গদের মতো দুধসাদা গায়ের রঙ। অথচ কি মসৃণ, কোমল! যাকে পলকমাত্র দৃষ্টিপাতে নজর ফেরায় কার সাধ্য। বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান প্রতিটি মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতো। যেমন প্রজাপতির মতো প্রাণবন্ত চঞ্চল তেমনি ওর ঠোঁটের কোণে তরতাজা হাসির একটা রেখা সর্বদা লেগে থাকতো। এমনিতেই হাসির একটা ছোঁয়াচে রোগ ছিল। কাউকে হাসতে দেখলে কি রগড়টাই না করতো। নিজেও হাসতো আর পাঁচজনকেও হাসাতো। কিন্তু ওর এই বেলেল্লাপণা একদম পছন্দ করতেন না ওর মাতা রেনুবালাদেবী। তিনি ছিলেন সেকেলে মহিলা। তার সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। উঠতে বসতে আপত্তি, অভিযোগ। মন্ত্রের মতো সারাক্ষণ রান্নাঘরে বসে বসে গজ্গজ্ করতেন। অথচ কৈশোরের দৌড়-ঝাঁপ পেরিয়ে যৌবনের চৌকাঠে পৌঁছে সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল শ্রাবণী। কিন্তু ওর মনপাখী কখন যে পাড়ার নবাগত উজ্জ্বল সুদর্শণ গৌরবর্ণের সন্দীপের হৃদয়দ্বারে উড়ে গিয়ে বসলো, তা নিজেও টের পায়নি শ্রাবণী।

সেবার কাল-বৈশাখীর প্রচন্ড ঝড়ে পাড়ার মুখুজ্জ্যে জ্যোঠার গাছের আমগুলিসব ঝোরে গিয়েছিল। আর ঝড় থামতেই পাড়ার ছেলে-মেয়েরা সব হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ছুটে যায় আম কুড়োতে। ছুটে গিয়েছিল শ্রাবণীও। যেদিন প্রথম দর্শণে স্মার্ট, হ্যান্ডসাম তরুণ যুবক সন্দীপের পুরুষোচিত চেহারা এবং মিশ্রব্যক্তিত্বের এক মুগ্ধ আকর্ষণে ওকে বুদ করে রেখেছিল। ভিতরে ভিতরে এক ধরণের কোমল অনুভূতির তীব্র জাগরণে শ্রাবণীর হৃদয়পটভূমিতে প্রচন্ড আলোড়ণ সৃষ্টি করেছিল। যেদিন ভালোবাসার বীজ রোপন করতে ওকে প্রচন্ডভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সেদিন মনমন্দিরে প্রথম স্থাপণ করেছিল, ওর জীবন দেবতার আসন। যার আধিপত্য ছিল শুধুমাত্র সন্দীপের। যা কেউই জানতো না।
প্রতিদিন কলেজ শেষে ফিরতি পথে ষ্টেশনের সংলগ্ন প্রকান্ড কদমগাছের নীচে তীর্থের কাকের মতো সন্দীপের অপেক্ষায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেতো। অথচ একবারও ভেবে দেখলো যে, সন্দীপের হৃদয়ের গভীরে কখনো পৌঁছাতে পারবে কি না। কখনো ওর নাগাল পাবে কি না। কখনো ওর মনের ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে পারবে কি না। অথচ দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সন্দীপের মনের খোঁজ না পেলেও ওর চোখের ভাষায় সন্দীপ নিজেই বুঝে নেবে, শ্রাবণীর কোমল হৃদয়ের উষ্ণ অনুভূতির কথা। ওর মনের কথা। সন্দীপ ওর প্রতি আকৃষ্ট হবেই! ওর প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়বেই! শ্রাবণী কোনদিনও হার মানেনি। আজও মানবে না। হার মানতে শেখেনি শ্রাবণী।

একদিন পড়ন্ত বিকেলে স্নিগ্ধ হাওয়ায় ছাদের রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শ্রাবণী। আপনমনে গুনগুন করে গান গাইছিল। হঠাৎ রাস্তার মোড়ে সন্দীপকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনটা ওর অনাবিল খুশীতে ভরে ওঠে। মনে মনে বলে,-‘আজ কিছুতেই ওকে ছাড়ছি না, এই সুবর্ণ সুযোগ। বাবু না কি মেয়েদের দিকে তাকান না! কখনো মেয়েদের সান্নিধ্যে যাননা! হুঁঃ সাধু পুরুষ। দাঁড়াও, কেমন করে বশ করতে হয়, তোমায় দেখাচ্ছি।
এই ভেবে শ্রাবণী উর্দ্ধঃশ্বাসে দৌড়ে নিচে নেমে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। ততক্ষনে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। দেখামাত্র বুকটা ওর ছ্যাঁৎ্ করে ওঠে। হ্দ্স্পৃন্দনও আরো দ্রুতগতীতে চলতে থাকে।-‘এ কি, এত বড় বড় স্যুটকেস্ নিয়ে সন্দীপ যাচ্ছে কোথায়? ও’কি দেশ ছেড়েই চলে যাচ্ছে না কি! কিন্তু কেন?’ চাপা আতর্নাদে স্বগতোক্তি করে ওঠে শ্রাবণী।
ইচ্ছে হচ্ছিল, দৌড়ে গিয়ে সন্দীপকে বাঁধা দিতে। ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কৈফেয়ৎ চাইতে। কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? কতদিনের জন্য যাচ্ছে? কবে ফিরবে? কিন্তু সেই কৈফেয়ৎ শ্রাবণী চাইবে কেমন করে? কোন্ অধিকারে? কোন্ সূত্রে? ও’ হয় কে সন্দীপের! সম্পর্ক তো দূর, আলাপ-পরিচয়ই হয়নি এখনো ওর সাথে! তা’হলে!

শ্রাবণী নীরব, নির্বিকার। চাপা বেদানায় বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। নিরুপায় হয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চেয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। হারিয়ে যায় মনগড়া এক স্বপ্নপুরীতে। নিজের ভিতরে যে তীব্র অনুভূতির জাগরণ, তাতে শিহরিত হয় ওর সারাশরীর। শ্রাবণী নিজেই টের পায় তা সম্পূর্ণ এক নতুন বিস্ময়। এক অভিনব অনুভূতি। যেদিন গহীন অনুভূতি দিয়ে প্রথম অনুভব করেছিল, সন্দীপকে সত্যিই সে মনে-প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে। সন্দীপই ওর জীবনের আনন্দ, ভালোবাসা সব। ওর হৃদয় নামক বিশাল সাম্রাজ্যের ওই একমাত্র সাম্রাজ্ঞী।

ইচ্ছে হচ্ছিল, সন্দীপের আবেগাপ্লুত প্রেমের স্পর্শে ওর পেশীবহুল বাহুদ্বয়ের উষ্ণ আলিঙ্গনে একেবারে লীন হয়ে যেতে। ওর হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসার আবগাহনে নিমজ্জিত হতে। ওর পুরুষালী দেহের আবেগমিশ্রিত উষ্ণ অনুভূতিতে বুদ হয়ে থাকতে। কিন্তু পারল না। ওর সম্মুখেই চলে গেল সন্দীপ।

শ্রাবণী পারেনি সন্দীপকে বাঁধা দিতে। ওর পথ অবরোধ করতে। নিজেকে স্বেচ্ছায় ধরা দিতে, সঁপে দিতে। পারেনি, ভালোবাসা নামে চিরসত্য ও পবিত্র শব্দটা মুখ ফুটে উচ্চারণ করতে। মেঘের আড়ালে সূর্য্য ডুবে যাবার মতো চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল সন্দীপ। আর সেইদিন থেকেই মনকে প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত করতে শুরু করে শ্রাবণীর। অনুতাপ অনুশোচনায় ওর হৃদয়াকাশের বুক চিরে বারবার বেদনার ঝিলিক দিতে লাগল, কেন পারল না, ছলা-কলায়, বুদ্ধির চাতুর্য্যে সন্দীপকে প্রেমের ডোরে বাঁধতে। কেন পারল না, ওকে ওর মনের কথাটা জানাতে। কেন একটিবার নির্জন নিড়িবিলিতে মুখোমুখি ওর সাথে দেখা হলোনা।

শুধুমাত্র সুদর্শণই নয়, সন্দীপ একজন আভিজাত্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মার্জিত পুরুষ। উচ্চবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ভুলেও কোনদিন শ্রাবণীর মুখের দিকে চোখ তুলে চেয়ে দ্যাখেনি। ওদের বাড়ির আশে-পাশেও কোনদিন ওকে নজরে পড়েনি। অথচ দৃঢ় মনের অধিকারী এবং উচ্চাভিলাষী শ্রাবণী যখন যা চাইতো তা-ই হাসিল করে নিতো। সন্দীপকে ও’ ঠিকই চিনেছে। ওই ওর একমাত্র উপযুক্ত পাত্র। তবু নিরাস হয়না শ্রাবণী। অপেক্ষা করে থাকে, ভালোবাসার যে ফুল মনের অজান্তে ফুটে গিয়েছিল, তারই মধুর সুরভী ঢেলে ওর স্বপ্নের রাজকুমার সন্দীপকে মোহিত করবে। ওকে আকর্ষিত করবে। একান্ত আপনার করে ওকে প্রাণের ডোরে বেঁধে নেবে। বসাবে ওর হৃদয়ের রাজসিংহাসনে, দেবতার আসনে।

কিন্তু বিধি বাম। শ্রাবণীর স্বপ্নের রাজকুমার সন্দীপ আর ফিরে আসেনি। রসায়ন বিজ্ঞানে ডক্টরেট করতে গিয়ে পৈত্রিক বিষয়-সম্পত্তি উপেক্ষা করে সামাজিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির হাজার বৈষম্য লঙ্ঘন করে জীবনসঙ্গিনী রূপে বেছে নেয়, ইংলেন্ডের এক নব যৌবনা সুন্দরী শ্বেতাঙ্গপরীকে। সেখানেই স্থায়ীভাবে গড়ে তোলে ওর ভালোবাসার রাজপ্রসাদ। যার কোনো পিছু টানই ছিলনা।

শুনে মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে শ্রাবণীর। নিভে গেল ওর আশার প্রদীপ। শুকিয়ে গেল ওর যৌবনের ফুল। মরে গেল বেঁচে থাকার সাধ-আহাল্লাদ, ভালোবাসার ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি। জীবনে কারো গলায় সে মালা দেবে না। পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে না। মানব জাতীর পরম আকাক্সিক্ষত কামনা-বাসনার গলা টিপে ফুলের মতো জীবনটাকে নরক বানিয়ে রাখে। অর্থহীন করে তোলে। যেখানে আনন্দ নেই। চাহিদা নেই। নেই নতুন কোনো স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষা। জীবন যার কাছে অবাঞ্ছিত, নির্মোহ, তার কাছে জীবনের কিইবা থাকতে পারে।

কিন্তু শ্রাবণীকে বোঝাবে কে! একরোখা মেয়ে। বিরল ওর সেন্টিমেন্টাল। অনমনীয় তার জেদ। সারাক্ষণ মন্ত্রের মতো জপতো,-‘আলোবাসার যে ফুল না ফুটতেই ঝড়ে যায়, দেবতার চরনেই যদি ঠাঁই না পায়, তবে সে ফুল ফুটেইবা আর লাভ কি! কি হবে তাকে বাঁচিয়ে রেখে! কে দেখবে তার সৌন্দর্য্যরে বাহার! কেইবা নেবে তার সুমধুর সুবাস! জীবনে এত বড় পরাজয়? পরাজয়ের এত গ্লানি?

শ্রাবণী পারেনি মেনে নিতে। পারেনি পরাজয়ের গ্লানি নির্বিকারে সহ্য করতে। সন্দীপকে না পাওয়ার ব্যর্থতায় ক্ষোভে, দুঃখে অভিমানে নির্বাসিত জীবনকে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়ে বদ্ধ ঘরের কোণায় আহত পাখীর মতো পড়ে থাকে, জীবনের অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায়।


(তিন)
হঠাৎ শ্রাবণীর বজ্র কণ্ঠস্বরে আমি চমকে উঠি। -‘কি হলো রে, বলছি না দরজাটা খুলতে!’

আমি হকচকিয়ে যাই। শুকনো একটা ঢোক গিলে অবিলম্বে দরজাটা খুলেই বিদ্যুতের শখ খাওয়্রা মতো শরীরের সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলিতে যেন একটা ঝটকা লাগল আমার। -এ কি, শ্রাবণীর এ বেশ কেন! মাথায় ঘোমটা দিয়ে, হাতে গলায় গহনা পড়ে একেবারে কনে সেজে এসেছে!

ওর পড়নে ছিল, রক্তজবা ফুলের মতো টকটকে লাল চওড়া পাড়ের কালো কুঁচকুচে রংএর শাড়ি। বাতাসে উড়ছে আতরের তীব্র গন্ধ। কপালে বড় একটা লাল টিপ। হাতে গলায় গহনায় ভর্তি। আবছা ক্ষীণ আলো অন্ধকারে মুখখানা স্পষ্ট দেখা না গেলেও মুক্তোর মতো ওর দাঁতগুলিকে কেমন অদ্ভুত লাগছিল দেখতে। আবার পরক্ষণেই মনে হলো, শ্রাবণীর আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। শরীরের অগ্র-পশ্চাৎই বোঝা যাচ্ছেনা। হঠাৎ সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল আমার। অজানা বিভীষিকায় বুকটা ধুক্ধুক্ করে কেঁপে উঠল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত শ্রাবণীর আগমন, ওর বিহেইভ এবং অভাবনীয় বিবর্তন রূপের দর্শণে পড়ে যাই বিস্ময়ের ঘোরে। আমি অভিভূতের মতো স্তম্ভিত হয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। আশ্চর্য্য, গতকাল ওর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই ছিলনা! গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না! আহত পাখীর মতো অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিল বিছানায়। আর আজ পায়ে হেঁটে এতদূর মেঠোপথ পেরিয়ে শ্রাবণী এলো কিভাবে? বিশ্বাসই করতে পাচ্ছি না নিজের চোখদু’টোকে। কিন্তু ওর সঙ্গে তো কাউকেই দেখছি না! কোথায় গেল সন্দীপ?

শ্রাবণী বলল,-‘এতো কি ভাবছিস! আমায় নতুন দেখছিস না কি! চল্ আমার সঙ্গে!’

লক্ষ্য করলাম, শ্রাবণী কথা বলছে ঠিকই কিন্তু ওর মুখই দেখা যাচ্ছেনা। হঠাৎ অনুভব করলাম, কে যেন আমায় গায়ে জোরে একটা ধাক্কা দিলো। আমি মুখ থুবড়ে পড়তেই সামলে নিলাম। একটা ঢোক গিলে বললাম,-‘শ্রাবনী তুই, কি ব্যাপার! ভোর না হতেই এতদূর আসলি কিকরে? তোর সন্দীপ কোথায়?’

মুখখানা আড়াল করে কাতর কন্ঠে শ্রাবণী বলল,-‘এ্যাই, মুখুজ্জ্যে জ্যাঠার আমবাগানে যাবি? কত কাল হয়ে গেল যাইনি! চল্ না, ঘুরে আসি!’

শ্রাবণীর কথা শুনে পড়ে গেলাম উভয় সংকটে।-‘বলিস কিরে! সে তো অনেক দূর পথ। দু-তিনটে শাঁকো পেরিয়ে. নালা-নর্দমা ডিঙ্গিয়ে, ধানক্ষেতের গা-ঘেষা কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে হবে। তাও এই অসময়ে!’ ম্লান হেসে বললাম,-‘গিয়ে কি করবি? এখন আম কোথায় গাছে? অঙ্কুরই বের হয়নি! কিন্তু আজ এতকাল পর পুরানো অভ্যাস তোর মাথায় চারা দিয়ে উঠলো কেন হঠাৎ! এ বয়সে এসব সাজে আমাদের! লোকে দেখলে কি বলবে বলতো!’

গম্ভীর হয়ে শ্রাবণী বলল,-‘আরে সেই জন্যই তো এলাম এখন! কেউ দেখবে না, শীগ্গির চল্! আজ ও’ও আসবে!’

স্ববিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম, -‘ও’ আসবে মানে? এই সময় আবার কে আসবে?’

শ্রাবণী নাছোরবান্দা। কোনো কৈফেয়ৎ দিতে ও’ রাজি নয়। যেতেই হবে ওর সাথে। তখনো দিগন্তের প্রান্তরে উষার প্রথম সূর্য্যরে উজ্জ্বল আলোর আভা উদ্ভাসিত হয়নি। চারদিক নিরব নিস্তব্ধ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী নিঃশব্দে পাখনা মেলে উড়ে যাচ্ছে দূর-নীলিমায়। আকাশের তারাগুলি ক্ষীণ আলোয় মিটিমিটি করে জ্বলছে। মনে হচ্ছিল, সাদা মেঘের সঙ্গে তারা গুলি লুকোচুরি খেলছে।

অগত্যা শ্রাবণীর একান্ত পীড়াপীড়িতেই ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুদূর গিয়ে লক্ষ করলাম, হঠাৎ কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল শ্রাবণীর। আমাকে পিছনে ফেলে আগে আগে হাঁটছে। কোনদিকে তাকাচ্ছে না। হাঁটছে তো হাঁটছেই।

বললাম,-‘কি রে শ্রাবণী, কথা বলছিস না কেন? বড্ড ভয় করছে আমার।’

মৃদুস্বরে শ্রাবণী বলল,-‘আজ নতুন একটা জায়গায় নিয়ে যাবো তোকে। এখান থেকে অনেক দূরে!’

বললাম, -‘সে কি রে! মুখুজ্জ্যে জ্যাঠার আমবাগানে যাবি বললি!’

কিছুক্ষণ থেমে শ্রাবণী বলল,-‘আমরা শর্টকাট পথ ধরে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি হাঁট!’
বলতে বলতে বাঁশঝাড়ে ঢুকে পড়ে শ্রাবণী। ঢুকেই চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। ততক্ষণে দিগন্তের প্রান্তে ঊষার ক্ষীণ আলো উদ্ভাসিত প্রায়। তাকাই এদিক ওদিক, শ্রাবণীকে কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। ঊষার প্রথম আলোর মাঝেও বাঁশঝারের ভিতরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। গা-টা আমার ভার হয়ে গেল। বুক ধুক্ধুক্ করে কাঁপতে লাগল। ধানের শীষের মতো লম্বা গাছ-গাছালিতে ঢেকে গিয়েছে গোটা রাস্তা। বোঝা যাচ্ছে, সামনে পথ বন্ধ। অগ্রসর হওয়া যাবেনা। আজানা আশঙ্খায় ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে সারাশরীর আমার জমে হীম হয়ে যাবার যোগার। চারিদিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। আশে -পাশে কোনো ঘর-বাড়ি নেই। লোকজন নেই।
হঠাৎ প্রলয়ঙ্করী বেগে শুরু হয় ঝড়-তুফান। ছুটে চলে দিগি¦দিকে। রাজ্যের ধূলোবালি উড়িয়ে, গাছের ডালপালা, লতা-পাতা দুমড়ে মুছড়ে লেপটে পড়ছে মাটিতে। কিছু দেখা যাচ্ছে না চোখে। আমি থমকে দাঁড়াতেই জঙ্গলের ভিতর থেকে শ্রাবণীর গলার আওয়াজ শুনে ভীষণভাবে চমকে উঠি।-‘কিরে, দাঁড়ালি কেন? আয়!’

ভয়ার্ত কণ্ঠে বললাম,-‘আসবো কোথায় শ্রাবণী? তুই কোথায়? তোকে দেখছি না কেন? ’

হঠাৎ কোথা থেকে আর্বিভূত হয়ে শ্রাবণী বলল,-‘এই তো আমি! আয় আমার সঙ্গে!’

তখন লক্ষ্য করলাম, শ্রাবণীর পাদুকা দুটি নগ্ন। নগ্ন পায়েই ঝোঁপ-ঝাঁড় ডিঙ্গিয়ে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। ওর হাত-পাদু’টোও অস্বাভাবিক লম্বা। ওর এক একটা পদক্ষেপের দূরত্বের ব্যবধান ছিল অনেকখানি। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, ওর পায়ের পাতাটা পিছন দিকে। শ্রাবণী লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। ঝোঁপ-ঝাঁড় ডিঙ্গিয়ে আমি হেঁটে পাচ্ছি না ওর সাথে। অথচ তখনো কল্পনাই করতে পারিনি, এ শ্রাবণী নয়। শ্রাবণীর অশরীরি প্রেতাত্মা। আর আমি অন্ধের মতো ওকে অনুসরণ করে আসছি। আর কিছুক্ষণ ওর সাথে থাকলে আমার ঘাড়েই হয়তো চেপে বসতো কিংবা ঘাড়টাই মটকে দিতো।

জিজ্ঞ্যেস করলাম,-‘কিরে, তুই খালি পায়ে হাঁটছিস কেন?’

উত্তরে গম্ভীর হয়ে শ্রাবণী বলল,-‘বেশী কথা বলিস না! চুপচাপ চলে আয় আমার পিছে পিছে।’

ততক্ষণে হাঁটতে হাঁটতে পোঁছে গেলাম গভীর জঙ্গলে। চারদিকে মাঁকড়শার জাল। অক্টোপাসের মতো আষ্টে-পিষ্টে ঘিরে আছে গোটা জঙ্গল। বিকট শব্দে অনবরত ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। রাজ্যের কীট-পতঙ্গ, ফড়িং-প্রজাপতি, পোকা-মাকড়গুলো সব উড়ে উড়ে চোখে-মুখে এসে পড়ছে। চারিদিকে কেঁচো, কাঠপিঁপড়া, শুঁয়োপোকা কিলবিল করছে। পা ফেলার জায়গা নেই। কোনাব্যাঙ কতগুলো থপ্ থপ্ করে লাফাচ্ছে। মাথার উপর বন্বন্ করে ঘুরছে কতগুলি জঙ্গলি মাছি। তাড়ানোই যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে বললাম,-‘তুই আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস শ্রাবণী? চারদিকে জঙ্গল। হাঁটবো কোনদিক দিয়ে?’

কিন্তু কোথায় শ্রাবনী! কোনো সাড়া শব্দ নেই ওর। কথা বলতে বলতে চোখের সামনে মন্ত্রের মতো কখন যে আবার উধাও হয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। তখনকার পরিবেশ রীতিমতো ভৌতিকই লাগছিল। জঙ্গলের ভিতর থেকে মরা কান্নার মতো শনশন্ শব্দে ভেসে আসছে বাতাসের গোঁঙানি। মনে হচ্ছিল, কে যেন কাঁদছে। অঘোর জঙ্গল, নিঝুম, জনশূন্য। এক একটা ক্ষণ ঘড়ির কাটার মতো ঝিম্ঝিম্ করে নীরবে বয়ে যাচ্ছে। অথচ তখন ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে প্রায়। এদিকে ভয়ে আঁতঙ্কে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ দিয়ে একটা শব্দও আর উচ্চারিত হচ্ছেনা। কি করবো, কোনদিকে যাবো, কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি ভারসাম্যহীণ হয়ে পড়ি। ছুটে যে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবো, সে ক্ষমতাও তখন আমার ছিলনা। মিরগি রুগীর মতো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে র্থর্থ করে কাঁপতে থাকি।

ইত্যবসরে গরুর বাছুর খুঁজতে খুঁজতে জঙ্গলে এসে পৌঁছায় মুখুজ্জ্যে জ্যাঠা। আমায় দেখামাত্র বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যান তিনি। চোখেমুখেও উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি মেলে বলে উঠলেন,-‘ওলো ছ্যামড়ি, করস কি তুই এইখানে? কহন আইছস্! রাম রাম রাম রাম, হেই জঙ্গলের ভিতর তুই আইলি কেরে? কার লগে আইছস্?’

গলা দিয়ে তখনও আওয়াজ বের হয়না আমার। ভয়ে আড়ষ্ঠ হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে হাঁ করে চেয়ে থাকি। মুখুজ্জ্যো জ্যোঠা আমার গায়ে একটা জোরে ঝাকুনি দিয়ে বললেন,-‘এ্যাই ছ্যামড়ি, হইছে কি তড়? কথা কস্ না ক্যান? কে¤েœ আইছস্ ক্! আনছে কে তড়ে?’

অপ্রত্যাশিত মুখুজ্জ্যে জ্যোঠার দর্শণে আমার হোঁশ-জ্ঞান ফিরে আসে। মুহূর্ত্যরে জন্য মনে হচ্ছিল, এতক্ষণ অথৈ জলে ডুবে ছিলাম। এখন কিনারা খুঁজে পেলাম। ফিরে এলাম বাস্তব পৃথিবীতে। তবু গলা দিয়ে আওয়াজ আর বের হয়না। তারও কিছুক্ষণ পর তো তো স্বরে বললাম,-‘আ-আমি শ্রাবণীর সঙ্গে এসেছি জ্যাঠামশাই। ওইতো আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে এখানে।’

কপালে হাত ঠুককে ঠুকতে মুখুজ্জ্যে জ্যাঠা বললেন,-‘সব্বনাশ! আমিতো দেইখ্যাই ঠাহর পাইছি! ছ্যামড়িডার কি হইছে জানস?’
আমার হাত ধরে টানতে টানতে বললেন,-‘চল্ শিগ্গীর! তোরে দেখাই শ্রাবণীরে!’

মুখুজ্জ্যে জ্যাঠার কথা শুনে আমার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার উপক্রম। হার্টবিটটা আরো দ্রুতগতীতে চলতে শুরু করে। বলে কি জ্যাঠা মশাই! তা’হলে এতক্ষণ যে আমার সঙ্গে কথা বলছিল, সঙ্গে হাঁটছিল, ও’ শ্রাবণী নয়? কিন্তু আমায় কেন নিয়ে গিয়েছিল ঐ বাঁশঝারে? কি চেয়েছিল শ্রাবণী? কি করেছে শ্রাবণী? তবে সত্যিই কি ও’....!

পাড়ায় এসে দেখি, শ্রাবণীদের বাড়ির প্রাঙ্গনে লোকে-লোকারণ্য। অগণিত মানুষের ভীঁড়। বুক চাপড়ে চাপড়ে কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়েছে শ্রাবণীর শোকসন্ত্রপ্ত মা-বাবা, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন সবাই। সবার চোখে জল। প্রশ^স্ত আঙ্গিনায় সাদা কাপড়ে ঢাকা পড়ে আছে শ্রাবণীর মৃতদেহ।

আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাক্যাহত হয়ে পড়ি। দীর্ঘদিন যাবৎ শরীরের প্রতি অবহেলায় অত্যাচারে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্রাবণী যে একটু একটু করে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তা কে জানতো! মা-বাবা, ভাইবোন সবার অলক্ষ্যে গহীন নিশুতিরাতে যন্ত্রণাকাতর শ্রাবণী কখন যে নিঃশব্দে চিরদিনের মতো দুচোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো, কেউ টের পায়নি

লোকের কানাঘুষোয় জানা যায়,-ওর প্রাণপ্রতিম সন্দীপকে না পাওয়ার ব্যর্থতায়, ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে লম্বা একটি চিঠি লিখে রেখে গিয়েছে শ্রাবণী। তাতে লেখা ছিল, ভালোবাসার অগ্নিকুন্ডে আমি জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছি দ্বীপ! তুমি কেন আর ফিরে এলে না দ্বীপ! কেন রামধনুর মতো আমার হৃদয়াকাশে দর্শণ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছ দ্বীপ! জীবনে যে শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম! তোমারই প্রিয়তমা হতে চেয়েছিলাম! যে কথা তুমি জানতেও পারলে না! কেন একটিবার আমায় সুযোগ দিলে না দ্বীপ! আজ যে তুমি অন্যের। অন্যের প্রাণপ্রতিম। অন্যের পূজারী। অন্যের গৃহস্বামী। এ আমি কেমন করে সইবো বলো! আমার যে বড় যন্ত্রণা দ্বীপ। তুমি কোথায় দ্বীপ! শুনতে কি পারবে আমার এই আর্তনাদ! এ জনমে তোমার দর্শণ আর পাবো না কোনদিন! আমাদের মিলনের কোনো সম্ভবনা নেই! তাই চললাম পরলোকে। সেখানেই দেখা হবে। তখন তুমি শুধু আমারই থাকবে। শুধু আমার। আমার প্রিয়তম হয়ে, একান্তআপন হয়ে। তুমি দেখে নিও, আমি তোমার অপেক্ষায় পথচেয়ে থাকবো। তখন তুমি আমায় চিনতে পাববে তো দ্বীপ?
তুমি সুখী হও। ভালো থেকো।
চিঠির নিচে ছোট্ট করে লেখা ছিল, -আত্মঘাতী শ্রাবণী।

হঠাৎ অনুভব করি, সারাবিশ্ব ব্রহ্মান্ড জুড়ে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। এলোপাথাড়ী ঝোড়ো হাওয়ায় আমার সারাশরীর দুলছে। দুলছে গাছের ডালপালা, লতাপাতা। কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে গোটা আকাশ। দিনের বেলাই নেমে এসেছে অন্ধকার। চোখে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। সেই সঙ্গে শুরু হয় গুড়–ম গুড়–ম মেঘের গর্জন। হৃদয় কাঁপানো বিদ্যুতের বাঁকা ঝিলিক।
ক্রমাণ্বয়ে মেঘের গর্জন আর শীততাপের শীতল অনুভূতিতে ঘুমটা আমার তখনিই সত্যি সত্যিই ভেঙ্গে গেল। আমি ধড়্ফড়্ করে উঠি। তাকাই চারিদিকে, স্বপ্ন না বাস্তব, মুহূর্তের জন্য ঠাহর করতে পাচ্ছিলাম না। ঘুমের ঘোর কেটে যেতেই চোখ পাকিয়ে দেখি, কি নিরুচ্ছাস, বিষাদভরা সকাল। সূর্য্যরে আলো নেই। পাখীর কলোরব নেই। ঝুপঝুপ করে অঝোরে ঝড়ছে বৃষ্টি। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। জানালার কপাটগুলি প্রবল হাওয়ায় ঝটাং ঝটাং শব্দে অনরবত ধাক্কা খাচ্ছে। গায়ের উপর ছিটকে এসে পড়ছে বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির কণা। এমতবস্থায় ঠান্ডায় হাত-পা কুঁকড়ে আমি শুয়ে আছি বিছানায়। ইতিমধ্যে ঢং ঢং শব্দে ঘড়ির ঘন্টা বেজে ওঠে। অবগত হলাম, সকাল হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বেলা ন’টা বাজে। তবে কি এতক্ষণ এসব স্বপ্ন দেখছিলাম!

লেখক : কানাডা প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।


পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test