E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প

২০১৬ জুলাই ১৪ ২১:১১:১২
আনিসুর রহমান আলিফ’র গল্প







 

কাঁচের চোখ ৩

তোমরা কাঁচের চোখে দেখো তাই অনুধাবন করতে পারো না। কাঁচের চোখে দেখলে অনুধাবন করা যায় না। আজ মনুষ্য সমাজের এই চিত্র তোমাদের ঐ স্থির দৃষ্টির উপর পড়ে ঠিকই কিন্তু ঐ প্রতিবিম্ব তোমাদের মনকে আলোড়িত করে না। দৃষ্টির সাথে সাথে তোমাদের মনও আজ পাথরসম। অনুধাবন করার শক্তি, বিবেকের বিচার আর মনুষ্যত্ব নামের উজ্জ্বল জ্যোতি থেকে আজ তোমরা বিচ্যুত। তবে দেরি হয়নি খুব। তোমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় প্রতিনিয়ত যারা চাতকের মতো চেয়ে থাকে তাদের আর্তি ভরা ডাকে সারা তোমাদেরকে দিতেই হবে, তোমাদেরকে ফিরতেই হবে।

সজল ভালো ছেলে। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। বন্ধু-বান্ধবের সাথে তেমন কোনো আড্ডা নেই, বাজে কোনো নেশা নেই। মসজিদে গেলে প্রায়শই তার সাথে আমার দেখা হয়। সুন্দর করে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে। সজল কে আমার ভালো লাগে, তাই মাঝে মাঝেই আমরা ব্যাংক চত্বরে ফাস্টফুডের দোকানে বসতাম। এটা সেটা নিয়ে কথা বলতাম। ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলোকে ভাগাভাগি করতাম।

একদিন মাগরিবের নামাজের সময়। ওজু করে মসজিদে ঢুকেছি, দেখি সজল। আমাকে দেখে ইশারায় সালাম জানাল। আমরা পাশাপাশি নামাজে দাঁড়ালাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম তার নামাজে দাঁড়াবার ধরন আগের মতো নেই। কেমন যেন এলোমেলো। দাঁড়ানো, রুকু করা, সেজদা করা সবকিছুতেই কেমন যেন আলাদা আলাদা ভাব। নামাজ শেষে ব্যাপার কী জিজ্ঞাসা করতে সে একটু হেসে বলল,
-এতদিন ভুলের মধ্যে ছিলাম। এখন যেভাবে নামাজ আদায় করছি এটাই সহি। বললাম,
-কে বলেছে?
-হুজুর বলেছে। হুজুর বড় আলেম লোক। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তিনি গিয়েছেন, দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেছেন। হুজুর বলেছেন এই ভাবে নামাজ পড়তে হয়। তিনি আরো বলেছেন, এইভাবে ছাড়া যারা নামাজ পড়ে তাদের কারোরই নামাজ হয় না। বললাম,
-আমাদের পূর্ব পুরুষরা তো এই ভাবেই পড়েছে তাদের নামাজ কি হয়নি? সজল বলল,
-না, তাদের কারোরই নামাজ হয় নি।
সজলের মুখে এমন ভয়াবহ কথাটা শুনে মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। আমি আর কথা না বাড়িয়ে তার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। এমন ধরনের কথায় মনের মধ্যে আমার কেমন যেন কী হচ্ছে। অজানা সব প্রশ্নের সাথে যুক্তি আর উত্তরের খেলা শুরু হয়েছে। কার নামাজ কবুল হয় আর কারটা হয় না তার সার্টিফিকেট কি মানুষ দিতে পারে?

মসজিদের সামনে বেশ একটা জটলা। ভাবলাম জামাত বুঝি শেষ হয়ে গেছে। ওজু করতে বসেছি। হঠাৎ হৈ-হল্লা শুরু হলো। সজলের কণ্ঠ শুনে উঠে দাঁড়ালাম। জটলাটার কাছে এগিয়ে যেতে বুঝলাম সজলের সাথে মসজিদ কমিটির সদস্যদের উচ্চবাচ্য চলছে। ভীরের মধ্যে দাঁড়িয়ে শুনলাম সজল বলছে,
-আপনারা যেভাবে নামাজ পড়েন এটা সহি না। আমার কাছে কিতাব আছে। কিতাবে লেখা আছে কীভাবে পড়লে নামাজ সহি হয়। সদস্যদের মধ্যে থেকে উত্তেজিত কণ্ঠে একজন বলল,
-তোদের কিতাব কারা ছাপে তার খবর আমরা জানি। আর একটা কথা বললে মার খাবি। ভাব ধরছ না ?
সজল গর্জে উঠে বলল,
-আমি নতুন ভাব ধরি নাই, নতুন ভাব ধরছেন আপনারা।
-আপনারা বেদাতের মধ্যে ডুবে গেছেন। সদস্যদের মধ্যে থেকে আরো একজন এগিয়ে এসে বলল,
-সজল শোন, আমার দাদাকে আমি এইভাবে নামাজ পড়তে দেখেছি। বাবা আমাকে এইভাবেই নামাজ শিক্ষা দিয়েছেন। ইমাম সাহেব সুরা শিখিয়েছেন। আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ, আমার জীবদ্দশায় এ দেশের মানুষকে আমি সাধারণ ভাবেই নামাজ পড়তে দেখেছি। আমার তো মনে হয় নতুন কিছু তোরাই সৃষ্টি করেছিস। তোরাই বেদাত করছিস। আর তাছাড়া ভুল ধরার তুই কে? ভুল ধরার জন্য মাওলানা আছেন, মুফতি আছেন, ইমাম সাহেবরা আছেন।
হিস্টিরিয়া রোগীর মতো গজ গজ করে সজল বলল,
-আমাদেরও মুফতি আছে। মাওলানাও আছে।
-আরে যা যা তাদের কাছে যা।
-হ্যাঁ তাই যাব। তোমাদের মতো বেদাতিদের সাথে এই মসজিদে নামাজ পড়ব না।

সজল এখন আর আমাদের সাথে এক মসজিদে নামাজ পড়ে না। মাঝে মাঝে তার সাথে আমার দেখা হয় কিন্তু সেই আগের মতো সালামও দেয় না, কথাও বলে না। সজলকে এখন যাদের সাথে মিশতে দেখি তাদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি না। ওদের কথা বলা, ভাব-ভঙ্গি, কেমন যেন আলাদা। সাধারণ মানুষের সাথে ওরা তেমন একটা মেশে না। সারাক্ষণ কী সব বই পরে আর সেই বইয়ের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। সম্প্রতি জানতে পেরেছি ওরা কী একটা সংগঠনের সাথে নাকি জড়িত। ধর্ম পালন করতে সংগঠন লাগে নাকি? ধর্ম নিজেই তো একটা বিরাট সংগঠন। বিরাট এই সংগঠনের মধ্যে আরো সংগঠন তৈরি করার কী প্রয়োজন আছে তা বুঝি না।

সজলের বাবার সাথে সেদিন বাজারে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে বললেন,
-বাবা কেমন আছ? বললাম,
-ভালো। তিনি আক্ষেপ করে বললেন,
-আমার ছেলেটার যে কী হয়েছে? সারাক্ষণ কী এক ধর্মীয় সংগঠন নিয়ে পড়ে আছে। পড়াশোনায় আগের মতো মন নেই। কলেজেও ঠিকমতো যায় না। বলে ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া দুনিয়াবি জ্ঞানের নাকি কোনো মূল্য আল্লাহ্ পাকের কাছে নেই। এসব কী কথা? এসব কী কোনো সুস্থ মানুষের কথা। তুমি ওকে একটু বুঝিও বাবা।

কিছুদিন থেকেই শুনছি সজলরা নাকি একটি মসজিদ নির্মাণ করবে। মসজিদ নির্মাণ করা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। কিন্তু যা শুনলাম তাতে তো সংঘর্ষ বেঁধে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। মতি মিয়ার কাছ থেকে ওরা যে দশ শতাংশ জমি কিনেছে এখন সেখানে নাকি ওরা মসজিদ গড়বে। কিন্তু মতি মিয়া সহ এলাকার মানুষ সেখানে তাদেরকে মসজিদ গড়তে দেবে না। এলাকার মানুষ মসজিদ গড়তে দেবে না এমনটা তো শুনিনি কখনও। বরং মসজিদের জন্য এলাকা-বাসীকে জমি ওয়াকফ করতেই দেখেছি। ভালো মতো শুনে যা বুঝলাম, ওখানে ওরা ওদের মতাদর্শের মসজিদ নির্মাণ করতে চায়। সমাজের থেকে, ধর্মের সাধারণ স্রোতধারা থেকে ওরা আলাদা হতে চায়।

প্রচণ্ড হৈ-হল্লায় ঘুমটা ভেঙে গেলো। রাস্তার পাশেই আমার ঘর। চারিদিকে কেমন একটা অস্থির আনাগোনা। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলাম, লোকজন দৌড়দৌড়ি করছে। কারো কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে, কারো হাত পায়ে কাপড় বাঁধা, চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছে। শুনলাম বিরাট একটা সংঘর্ষ বেঁধেছে। সজলরা মসজিদ নির্মাণ করতে গেলে এলাকা-বাসীর সাথে সংঘর্ষ বাধে। বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছে। আমার মনের মধ্যে চলতে থাকা শঙ্কা এখন বেশ একটা আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে। কী হচ্ছে এসব ! এ দেশের মানুষের মধ্যে এমনটা তো কখনও হয়নি। যত যাই হোক ধর্মীয় বিষয়ে এই দেশের মানুষ সব সময় এক থেকেছে। কীসে তাদের মধ্যে থাকা সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ফাটল ধরাল ? কীসে জোগাচ্ছে এত হিংসা ?

ধর্ম মানেই শৃঙ্খলা, ধর্ম মানেই অনুশাসন, ধর্ম মানেই একে অপরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের একটি আশ্রয়। আর এই ধর্মই এদেশের মানুষকে শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি সুতোয় বেঁধে রেখেছে। ঈদ কিংবা পূজা যাই হোক মানুষ একে অপরের সাথে মিলে মিশে থেকেছে। ছেলে বেলায় রতনদের মন্দিরের পুজোর প্রসাদ কতো খেয়েছি তার হিসেব নেই। ঈদের দিনে রতন আমাদের বাড়ি আসতো মা ওকে সেমাই পোলাও খেতে দিতো। দুই বন্ধু কাঁধে কাঁধ রেখে এখানে সেখানে কতো ঘুরে বেড়িয়েছি। মন ভরে যে যার ধর্ম পালন করেছি। কেউ কারো প্রতি হিংসা কখনও করিনি। অথচ আজ একই ধর্মের অনুশাসনে থেকে কীসের এতো বিবেধ-বিরোধ?

বাংলাদেশে এখন বৈধ আর অবৈধ ধর্মীয় সংগঠনের সংখ্যা কতো ? হিসাবের অংকটা আমার মতো সরকারও হয়তো দিতে পারবে না। ধর্ম যেখানে নিজেই একটি শক্তিশালী সংগঠন সেখানে তার কাঁধের উপর ভর করে কারা তৈরি করছে এতসব আগাছা, পরগাছা?

আজ ইসলামের নামে হাজারও সংগঠন তাদের দোকান খুলে বসেছে। ক্ষাণিকটা হাদিস, ক্ষাণিকটা কোরআন আর নিজেদের মন মতো বেশ ক্ষাণিকটা মতবাদ জুড়ে দিয়ে তৈরি হচ্ছে একের পর এক সংগঠন। এসবের উদ্দেশ্য কী? ছোটবেলা বাবার মুখে কাঠি ভাঙার গল্প শুনেছি, বাবা বলতেন একটি কাঠিকে সহজেই ভেঙে ফেলা যায় কিন্তু দশটি কাঠি একত্র করলে তাকে ভাঙা কঠিন। আজ ওরা আমাদের সেই দশটি কাঠির ঐক্যকে ভেঙে দিচ্ছে। ওরাও জানে এদেশের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্ধন হচ্ছে ধর্ম আর এই ধর্মকে যদি হাজারও খ-ে বিভক্ত করা যায় তবে এদেশে ওরা ওদের ইচ্ছেমতো প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে।

মানুষ আজ বিভ্রান্ত। বিভিন্ন সংগঠনের বিভিন্ন মতবাদে মানুষ আজ ধর্মের বন্ধন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে। ধর্মের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধাবোধ তা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাত বারোটার পরে একজন মানুষের রাস্তায় বের হাবার স্বাধীনতা যে দেশে নাই সেই দেশে সকাল-বিকাল ইচ্ছে খুশিতে নানা নামে, নানা কামে, ধর্মীয় সংগঠন খোলার স্বাধীনতা দেখে আমরা হতবাক। সংগঠনের নামে মানুষের মধ্যে, ধর্মের মধ্যে, তথা দেশের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করার এই অশুভ প্রক্রিয়া কি সরকারে নজরে আসে না ? সময় হয়েছে কাঁচের চোখ খুলে ফেলে চর্মচোখে দেখবার।


পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test