E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তোমাকে অভিবাদন হে শহীদ কাদরী

২০১৬ আগস্ট ২৯ ১৬:১৮:৪৯
তোমাকে অভিবাদন হে শহীদ কাদরী

লুৎফর রহমান রিটন :


রবিবার ছুটির দিন সকাল সকাল কানাডার সেইন্ট ক্যাথেরিন থেকে দিনু বিল্লাহর ফোন--আজ সকালে কবি শহীদ কাদরী মারা গেছেন!

খুবই অসুস্থ ছিলেন। হাসপাতালে ছিলেন। আইসিইউতে ছিলেন কয়েকদিন। কিন্তু তারপরেও শহীদ কাদরীর মৃত্যুসংবাদে খানিকটা বিস্মিতই হলাম। কারণ গতকাল রাতেই আকবর হায়দার কিরণের ফেসবুক স্ট্যাটাস মারফত জানতে পেরেছিলাম যে আইসিইউ থেকে তাঁকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে এবং দুদিন পরেই বাসায় ফিরবেন শহীদ কাদরী। কিরণের স্ট্যাটাসে স্বস্তি ফিরে পেয়েছিলাম। আশাবাদী হয়েছিলাম। ভেবেই রেখেছিলাম বাসায় ফিরলেই টেলিফোনে কথা বলবো প্রিয় শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে। কারণ এর আগেও বারকয় হাসপাতালে গেছেন এবং চিকিৎসা শেষে ফিরেও এসেছেন। এবারও ফিরবেন তিনি, সেরকমই প্রত্যাশা ছিলো। আশাবাদ ছিলো। কিন্তু আর কথা বলার সুযোগ থাকলো না তাঁর সঙ্গে। শহীদ ভাই চলেই গেলেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

এইতো মাত্র কয়েক মাস আগে, মে মাসের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্ক মুক্তধারার ২৫তম আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলায় গিয়ে দেখা হলো শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে। এর আগেও আমি মুক্তধারার বইমেলায় গিয়েছি কানাডা থেকে, কিন্তু শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি একবারও। যদিও টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা হতো নিয়মিত। ঘন্টার পর ঘন্টা। অতীতের দেখা না হওয়ার ঘাটতি এবার পুরণ হয়েছিলো একাধিক সাক্ষাৎ ও আড্ডায়। তাঁর বাড়িতে একদুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজ এবং এক রাতের নৈশভোজসমেত বিপুল আড্ডার স্মৃতি এখনও সজীব আমার করোটির ভেতরে। ২০ মে দুপুরে ইকবাল হাসান আর শিখার সঙ্গে শহীদ ভাইয়ের বাড়িতে ভোজের নিমন্ত্রণে যেতে হয়েছিলো তাঁর স্ত্রী নীরা কাদরীর আন্তরিক আমন্ত্রণে। টেলিফোনে শহীদ ভাই বলেছিলেন--আরে আসো তো! কতোদিন দেখি না তোমাকে।

হ্যাঁ, বহুদিন, বহুকাল পর দেখা হলো কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো আশির দশকে, র‍্যাংকিন স্ট্রিটে, শহীদ ভাইয়ের বন্ধু মোশাররফ রসুল ও বিল্পব দাশের নিবাসস্থলে। সেবার তিনি দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশে গিয়েছিলেন দিনকয়েকের জন্যে। মোশাররফ রসুলের বাড়িতে সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত আড্ডায় তিনিই ছিলেন মধ্যমণি। সোফায় কাৎ হয়ে শুয়ে আসর মাৎ করা শহীদ কাদরী মাঝে মধ্যেই হেসে উঠছিলেন ছাদ কাঁপিয়ে। এমন নির্মল অট্টহাসি সবাই হাসতে পারে না। এর জন্যে যে প্রাণশক্তি লাগে শহীদ কাদরীর মধ্যে সেটার যোগান ছিলো অফুরন্ত। ইমদাদুল হক মিলন এবং তাপস মজুমদারও ছিলেন সেই আড্ডায়। দুর্দান্ত স্মৃতিশক্তির অধিকারী শহীদ কাদরীকে র‍্যাংকিন স্ট্রিটের সেই রাতের আড্ডার কথা মনে করিয়ে দিতেই বেদনার্ত হয়ে উঠেছিলেন শহীদ ভাই। কারণ তাঁর বন্ধু মোশাররফ রসুল ও বিপ্লব দাশ প্রয়াত হয়েছেন আজ অনেক বছর। ঢাকার সাহিত্য জগতের দুই মহাইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার এই দুজন।

মুক্তধারার বইমেলায় মঞ্চে আটকে না থাকলে একটানা কোনো অনুষ্ঠানেই আমার থাকা হয়নি। কারণ আমার ছটফটে স্বভাব। যে কোনো পর্বে খানিকটা সময় থেকে সটকে পড়েছি। শুধু একটি আয়োজনে পুরোটা সময় ছিলাম, দর্শক আসনে। এক মুহূর্তের জন্যেও উঠে যাইনি বা যেতে পারিনি। কারণ সেই পর্বে ছিলো কবি শহীদ কাদরীর সঞ্চালনায় তাঁরই কবিতার আবৃত্তি অনুষ্ঠান 'কবিতাই আরাধ্য আমার'। তাঁর এক একটি বহুল পঠিত পাঠকপ্রিয় কবিতার জন্মবিত্তান্ত এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি বিষয়ে বলছিলেন স্বয়ং কবি শহীদ কাদরী এবং আবৃত্তিশিল্পীরা আবৃত্তি করছিলেন সেই কবিতাগুলো। এক কথায় দারূণ একটি সেগমেন্ট। অডিটোরিয়াম পরিপূর্ণ ছিলো।

দর্শকসারিতে আমার খুব কাছেই বসে ছিলেন জার্মানী থেকে আসা নাজমুননেসা পিয়ারি। সবাই জানেন তিনি শহীদ কাদরীর প্রথম স্ত্রী। এককালে ঢাকার বিখ্যাত রূপসী কন্যা। আমার সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক পিয়ারি আপার। শহীদ কাদরী সম্পর্কে কতো অজানা কথা যে আমার জানা হয়েছে পিয়ারি আপার কাছ থেকে! শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে একান্ত পারিবারিক ব্যক্তিগত সম্পর্কটি চুকেবুকে গেলেও এখনও ভালোবাসেন তিনি শহীদ কাদরীকে। সেদিন বিকেলেই চুপিচুপি জানতে চেয়েছিলাম--থাকবেন নাকি আপা শহীদ ভাইয়ের পর্বে? নাকি কেটে পড়বেন? আমার প্রশ্নে মিষ্টি হেসে বলেছিলেন--থাকবো অবশ্যই। হ্যাঁ, পুরো অনুষ্ঠানেই আমি লক্ষ্য করেছি পিয়ারি আপা অপার মুগ্ধতায় উপভোগ করছেন শহীদ কাদরীর প্রতিটি উচ্চারণ। তাঁর কবিতার আবৃত্তিগুলোও তিনি উপভোগ করছেন বিমুগ্ধ শ্রোতার ভঙ্গিতে। আজ সকালে নীরা কাদরীকে ফোন করেছিলাম সমবেদনা জানাতে। খুব স্বাভাবিক কারণেই তিনি কল রিসিভ করতে পারেননি। নীরা খুব ভালোবাসেন শহীদ কাদরীকে। অনেকগুলো বছর ধরে তিনিই আগলে রেখেছেন শহীদ কাদরীকে, পরম মমতায়। গভীর ভালোবাসায়। ভয়েস মেসেজে আমি আমার বেদনার কথা জানিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিলাম। বারবার আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিলো শহীদ ভাইয়ের স্মৃতিতে।

বার্লিনে পিয়ারি আপাকে ফোন করলাম। একটি দুটি শব্দ উচ্চারণ করেই পিয়ারি আপা কেঁদে উঠলেন--রিটন সকাল থেকেই খুব বিষণ্ণ ছিলাম। কিন্তু কাঁদতে পারছিলাম না। আপনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এতো কান্না পাচ্ছে--আবারো কাঁদছেন পিয়ারি আপা। আহারে! আমি ফোন রেখে দিলাম দ্রুত--আপা পরে কথা বলবো আপনার সঙ্গে...। শহীদ কাদরীর তুমুল যৌবনের মধুময় দিনগুলোর ছায়াসঙ্গী নাজমুননেসা পিয়ারি। তাঁদের একজীবনের যৌথহাস্যকোলাহল আর দুঃখগাঁথার যে গল্পগুলো আমরা জানি না, সেই গল্পগুলো হয়তো জানা হবে না কোনোদিন, আহারে, কতো কতো গল্প থাকে এক জীবনে!

আমার চোখের সার্জারিজনিত কারণে গত কয়েকদিন ধরে পড়াশুনা এবং ল্যাপটপে লেখালেখি বন্ধ। কালো চশমা পরে থাকি। আজ সকাল থেকেই চেষ্টা করছি কবি শহীদ কাদরীর উদ্দেশে কিছু লিখতে। কিন্তু কিছুতেই পারছি না কিছু লিখতে। একেকজন প্রিয় মানুষের বিদায় আমাদের শব্দভাণ্ডারকে তছনছ করে দিয়ে যায়। বাক্য সাজাতে কষ্ট হয় তখন। শব্দ হাতড়ে বেড়াতে হয়। বাক্য অসম্পূর্ণ থাকে। কবি রফিক আজাদের মৃত্যুর পরেও এমনটা হয়েছে। লিখতেই পারলাম না কিছু, তাঁকে নিয়ে। শহীদ ভাইকে নিয়ে লিখতে বসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

কতো কথা মনে পড়ছে!

আমাদের যৌবনে দেখা বিস্ময়কর মেধাবীপুরুষ বিখ্যাত খালেদ চৌধুরী ওরফে প্রভুর মৃত্যুর পর একটা স্মৃতিকথা লিখেছিলাম। সেই স্মৃতিকথায় একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলেন প্রভুর বন্ধু কবি শহীদ কাদরী। ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বরে রচিত সেই স্মৃতিগদ্য থেকে খানিকটা তুলে ধরছি। কান টানলে মাথা আসে টাইপের ব্যাপার ঘটেছে সেখানে।

বলছি প্রভুর কথা কিন্তু সেখানে প্রবলভাবে উপস্থিত আরেক বিস্ময়কর মেধাবীপুরুষ শহীদ কাদরীও--'' ২০১১ সালের ১২ জুলাই প্রভুর মৃত্যুর পর তাঁর বন্ধু নিউ ইয়র্ক প্রবাসী প্রখ্যাত কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে কথা বলেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। দিনের পর দিন। শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ জমে ওঠে মুহূর্তেই। ঢাকাইয়া ডায়ালেক্টে আমার পারঙ্গমতা এবং তাঁর প্রায় সমস্ত বন্ধুকে কাছ থেকে চিনি বলে শহীদ ভাই আমার সঙ্গে গল্প করে মজা পান বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশর শিল্প-সাহিত্য এবং টেলিভিশন বিষয়ে বিপুল তথ্য আমার নখদর্পণে বলে এইসব ব্যাপার নিয়ে অনর্গল বলে যান শহীদ ভাই কোলকাতার বিশুদ্ধ বাংলা আর ঢাকাইয়া ডায়ালেক্টের মিশ্রণে। দোহার হিশেবে আমার ব্যাটিং-বোলিং পারফরম্যান্স মন্দ নয় বলে শহীদ ভাই বলতেই থাকেন বলতেই থাকেন প্রচুর নেপথ্য কাহিনি। আশ্চর্য এই মানুষটার স্মরণশক্তি। শহীদ ভাইয়ের ম্যামোরি হচ্ছে ফটোগ্রাফিক ম্যামোরি।

কিন্তু শহীদ ভাই বলেন— আমার ম্যামোরির কি দ্যাখছো মিয়া ম্যামোরি তো আছিলো আমাগো বন্ধু খালেদের মানে প্রভুর। এতো পড়ুয়া ছিলো আমার এই বন্ধুটা যে কী কমু তোমারে। গেছি তোমার রামমোহন লাইব্রেরিতে। দেহি খালেদ এনসাইক্লোপিডিয়া পড়তাছে! সক্রেটিস জাতীয় লোক ছিলো খালেদ। সক্রেটিসকে গ্রিক উচ্চারণে খালেদ কইতো সোক্রাতিস। ষাটের দশকে পুরান ঢাকার গোবিন্দ ধাম নামের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা হইতো। আমাদের আরেক বন্ধু ছিলো সুকুমার মজুমদার। খুব জ্ঞানী ছিল সুকুমার। জার্মান জানতো ফরাশি জানতো। জার্মান কালচারাল সেন্টারে পড়াইতো। মার্ক্সিস্ট সুকুমার ছিলো দর্শনে বিরাট পাণ্ডিত্বের অধিকারী। ভারতীয় এবং ইউরোপীয় দর্শনে তার ছিলো অগাধ জ্ঞান। আর খালেদ ছিলো মার্ক্সবাদ আর ভারতীয় দর্শনে চ্যাম্পিয়ান। এই দুইজনের তুমুল আলাপের মাঝখানে আমি থাকতাম মুগ্ধ শ্রোতা। দুই পণ্ডিত বন্ধুর তুমুল তর্ক-বিতর্ক আমাকে ঋদ্ধ করতো। বাকিটা আমি আপটুডেট হইতাম বই পইড়া। আহারে আমাদের বন্ধু সুকুমার ৭৫/৭৬ সালের দিকে আত্মহত্যা করলো!

আমি বললাম—শহীদ ভাই প্রভুরে লইয়া মজার কিছু কন। খালি জ্ঞানের কথা ভাল্লাগে না।

টেলিফোনের অন্য প্রান্তে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন শহীদ ভাই—শোনো তোমারে বলি তাইলে প্রভুর কাণ্ড। মধ্য পঞ্চাশ-ষাইটের ঘটনা। অবজারভার তখন মতিঝিলে ছিলো না। ছিলো পুরান ঢাকায়। অবজারভারের পিছনে আল হামরা লাইব্রেরী, সদরঘাটের কাছে, তোমার প্রভু করলো কি সেই লাইব্রেরি থিকা ‘গাইড বুক টু লণ্ডন’ বইটা মাইরা দিলো! হাহ্‌ হাহ্‌ হাহ্‌। আমিও মারছিলাম একটা।

--বলেন কী! আপনারা দুজনেই বই মেরে দিলেন লাইব্রেরি থেকে?

--হ্যাঁ দিলাম। বলি তোমাকে ঘটনাটা। হয়েছি কি হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। তো অন্ধকারেই দেখি বেরিয়ে যাবার সময় হাতের কাছে পাওয়া একটা বই খালেদ তার কোটের পকেটে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। আমারও পরনে ছিলো কোট। প্রভুর দেখাদেখি আমিও একটা বই চালান করে দিলাম কোটের পকেটে। তারপর লাইব্রেরি গেটে এসে দুজনেই দিলাম একটা দৌড়। অনেক দূরে এসে জিজ্ঞেস করলাম কী নিলেন খালেদ? খালেদ বলল জানি না। এখন দেখব। আপনি কী নিলেন? আমি বললাম –হাতের কাছে যেটা পেয়েছি সেটাই নিয়েছি। দেখা গেল খালেদ চুরি করেছে ‘গাইড বুক টু লণ্ডন’ আর আমি চুরি করছি বুঝছ বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘প্রবলেমস অব ফিলসফি’ বইটা। এই ঘটনা যখন ঘটাইছি তখন কিন্তু আমার লেখা ছাপা হচ্ছে চতুর্দিকে বুঝছ? একটু একটু নামডাকও হচ্ছে। হাহ্‌ হাহ্‌ হা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়, কী কাণ্ডটাই না করেছিলাম সেদিন আমরা...

--মস্কোয় প্রগতি প্রকাশনীতে চলে গেলেন প্রভু। আপনি গেলেন না?

--না আমি যাইনি। অনুবাদের কাজে খালেদকেই দরকার ছিল তাদের।

--আপনি আর প্রভু তো একসঙ্গে অনেকদিন চাকরি করেছেন এপিএন নামের একটা প্রতিষ্ঠানে, তাই না?

--হ্যাঁ। ১৯৬৪ থিকা অনেকগুলা বছর পর্যন্ত প্রভু কাজ করছে রাশান সরকারী সংবাদ সংস্থা এপিএন-এ। ‘এজেন্সি প্রেস নোভস্তি’ সংক্ষেপে এপিএন। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলো খালেদ। উদয়ন, সোভিয়েত দেশসহ তিনটা পত্রিকা ছিলো খালেদের আণ্ডারে। খালেদ সোভিয়েত থিকা প্রকাশিত মার্ক্সবাদ সম্পর্কিত আরেকটা তাত্ত্বিক পত্রিকাও দেখতো। খালেদ রাশিয়া গেলো দাসক্যাপিটাল অনুবাদ করতে। প্রথম খণ্ডটা খালেদের অনুবাদ। মূল জার্মান থেকে অনুবাদ হয়েছিলো ইংরাজিতে। ওইখানে ভুল ধরেছিলো খালেদ। খালেদ খুব পান খাইতো বুঝছ? তখন ঢাকা থিকা পান-জর্দা যাইতো রাশিয়ায়, খালেদের জন্য, রেগুলার। এপিএন-এ আমার জন্যেও একটা কাজের ব্যাবস্থা করেছিল খালেদ। ইংরেজি বিভাগে।

--প্রভুর অনুবাদে প্রগতি থেকে বেরিয়েছিল একটা বই। প্রভু যার নাম দিয়েছিলেন ‘জামিলা’।

--আরে! খালেদের এই বইটা তো আমি দেখিনি! শুনেছিলাম মনে হয়। মূল বইটা চিঙ্গিস আইতমাতভের লেখা না? দেখি নাই তো!

--আচ্ছা, শহীদ ভাই, আমি যদ্দুর জানি প্রভুর সঙ্গে তাঁর বাবার একটা ঝামেলা ছিল। প্রভু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আর ফিরে যাননি। বাবার কাছ থেকে ডাইরেক্ট কোনো টাকা পয়সা নিতেন না প্রভু। কিন্তু তাঁর অসাধারণ বাবা ছেলে খালেদ চৌধুরী যাতে না খেয়ে না থাকে সে কারণে একটা ব্যবস্থা রেখেছিলেন। একটা রেস্টুরেন্ট থেকে প্রভু টাকা নিতেন প্রতিমাসে, যখনই প্রয়োজন হতো। দেখা গেল দিলদরাজ প্রভু তাঁর অভাবী বন্ধুদেরও টাকা দিচ্ছেন ওখান থেকে। বাড়তি খরচ ঠেকাতে প্রভুর বাবা নতুন নিয়ম বেঁধে দিলেন। প্রভু আর নগদ টাকা পাবেন না। কেবল খেতে পারবেন সেই রেস্টুরেন্টে। শুনেছি সেই রেস্টুরেন্টে অর্থ সংকটে থাকা সৈয়দ শামসুল হক এবং আবদুল গাফফার চৌধুরীও মাঝে মধ্যে খেতে যেতেন প্রভুর সঙ্গে। আপনিও যেতেন নাকি?

--না আমি যাইনি কখনো। আরেকটা ব্যবস্থার কথা তো তুমি বললে না।

--কোনটা শহীদ ভাই?

--খালেদ সিগারেট খেতো খুব। তার বাবা পোলার সিগ্রেট খাওনের ব্যবস্থাও রাখছিলেন বুঝছ? একটা দোকানে বলা ছিল। খালেদ ওখান থেকে সিগ্রেট নিত। শুধু নিজে নিতো না। বন্ধুদেরও দিত সিগারেটের পুরা প্যাকেট। দোকানি লিখে রাখত। বিল পেমেন্ট করতেন খালেদের বাবা।

--প্রভুর বাবা সেই মানুষটা তো অসাধারণ ছিলেন শহীদ ভাই!

--হ্যাঁ ছিলেন। কিন্তু প্রভুর সঙ্গে বনিবনা হলো না।

--প্রভুর একজন বন্ধু ছিলেন ফজলুল করিম নামে। আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বোধ হয়। ফজলুল করিম প্রভুকে তাঁর সংকটের সময় নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন।

--হ্যাঁ। সেই লোকের বাড়িতে থাকত খালেদ। থাকা খাওয়া ফ্রি। একটা দেড় তলা টিনের বাড়ির ওপর তলায় খালেদ থাকত। ওর কাজ ছিল খাওয়া আর বই পড়া। কতো যে পড়ত খালেদ! আমিও গিয়েছি ওই বাড়িতে।

--আপনি তো শহীদ ভাই দেখেছেন প্রভুর দিন গেছে কী রকম সংকটের ভেতর দিয়ে। প্রবল অর্থ কষ্ট। সীমাহীন দারিদ্র।

--হ মিয়া। ফজলে লোহানীর একটা পত্রিকা ছিলো ‘অগত্যা’।
অগত্যার অফিস আছিল ইসলামপুরে। খালেদের থাকার জায়গা নাই। খালেদ অগত্যার টেবিলের উপ্রে ঘুমাইত। মাথার নিচে এনসাইক্লোপিডিয়ারে বালিশ বানায়া। সংকটের আরেকটা অধ্যায়ের কথা বলি তোমারে রিটন। খালেদ তখন থাকে বাংলাবাজার বিউটি বোর্ডিং-এ। আমাদের কাউরে খালেদ বলে নাই কী কষ্টের ভিতর দিয়া সে যাইতাছে। খাওয়ার টাকা ছিল না। প্রতিদিন সকালে বিউটি বোর্ডিং থেকে হাঁটতে হাঁটতে খালেদ যেত বহু দূরের এক বন্ধুর বাড়িতে, পাগলায়, নারায়গঞ্জে যেতে হলে পাগলা হয়ে যেতে হয়। সেখানে গিয়ে ধর এগারোটা বারোটায় খেত একপ্রস্ত। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার হাঁটা শুরু করত বিউটি বোর্ডিং-এর দিকে। শেষ বিকেলে এসে পৌঁছাত বিউটি বোর্ডিং-এ। আসলে খালেদের জীবনে এরকম অনেক চড়াই উতরাই ছিল।

--শহীদ ভাই, স্বাধীনতার আগে আপনি ঢাকা টেলিভিশনে জয়েন করেছিলেন প্রডিউসার হিশাবে। আমি শুনেছি আপনি প্রভুর উপস্থাপনায় একটা অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতেন।

--হ্যাঁ বছর দুয়েক চাকরিটা করেছিলাম। আষট্টির শেষদিকে টিভির চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। খালেদকে দিয়ে যে অনুষ্ঠানটা করতাম তার নাম ছিল ‘বিচিন্তা’।
লাইভ ছিল অনুষ্ঠানটা। বিশাল বিশাল মহীরুহকে ধ্বসাইয়া দিত খালেদ। জায়ান্ট কিলার হিশাবে আমি ইউজ করতাম খালেদকে। খালেদ চৌধুরীর বিপুল পড়াশুনা এবং ওর মেধা-প্রজ্ঞা আর স্মৃতিশক্তির সামনে টিকে থাকা টাফ ছিল। ধরো স্টুডিওতে বসাইয়া দিলাম ওরে মুনীর চৌধুরীর লগে। জইমা উঠল তর্ক মুনীর চৌধুরী ভার্সেস খালেদ চৌধুরী। অসাধারণ সেই কনভার্সেশান। তারপর মনে করো প্রফেসর খান সরোয়ার মুরশিদ। তারপর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ভার্সেস খালেদ চৌধুরী। অহ্‌ ঘাইমা উঠত একেকজন। দর্শকও বিস্মিত হইত—অধ্যাপক না পিএইচডি না কে ইনি? অই অনুষ্ঠানটা বলতে পারো আমার কিলিং মিশন আছিল। বিশেষ কইরা ফাঁপা বুদ্ধিজীবী গো অন ক্যামেরা বধ কইরা ফালাইতাম খালেদরে দিয়া। শুধু একজনকে আমি বসাতে পারিনি খালেদের মুখোমুখি।

--কাকে শহীদ ভাই?

--প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে। দৃশ্যমান কোনো কাজ নাই কিন্তু বড় বড় কথা। হ্যারল্ড লাস্কির আন্ডারে পিএইচডি করতাছিলেন। লাস্কি গেল মইরা। লাস্কি নাই অইন্য কেউ বুঝবনা তাঁর থিসিস-- এই ফিকির তুইলা তিনি তাঁর থিসিস ছুঁড়ে ফেললেন। ভাসায়া দিলেন টেমস্‌ নদীতে। পিওর বুলশিট এইটা বুঝছ? আমি চেয়েছিলাম প্রফেসর রাজ্জাককে খালেদের সঙ্গে বসাতে। অন ক্যামেরা। কিন্তু খালেদ ভীষণ শ্রদ্ধা করত প্রফেসরকে। সে কিছুতেই রাজি হল না।

--এই রকম বিধ্বংসী একটা টিভি প্রোগ্রামের প্ল্যানিংটা এলো কোত্থেকে?

--ইংরেজি অই প্রবাদটা জান তো—নো ম্যান ইজ এন আইল্যাণ্ড। অইটারে সামনে রেখে অইটার বিপরীতে আমরা বলতে চাইলাম—না, কেউ একা নন, নিশ্চয়ই আছেন কেউ না কেউ। অর্থাৎ পক্ষে বনাম বিপক্ষে। কিন্তু এইরকম একটা অনুষ্ঠান করা সহজ ছিল না। আমাদের বুদ্ধিজীবী অধ্যাপকরা গৎ বাঁধা কথা বলেন। তাঁদের কথাকে কাটার জন্যে, তাঁদের কথার মাঝখানে কোপ মারার জন্যে একজন জাঁদরেল উপস্থাপক লাগে। আমার বন্ধু খালেদ ছিল সেই পাওয়ারফুল উপস্থাপক। খালি দর্শকরা না আমন্ত্রিত অতিথিরাও অনুষ্ঠানের পর আমার কাছে জানতে চাইতেন—কে এই লোক!

শহীদ ভাইকে বললাম—আপ্নের লগে প্রভুর ইমুন দোস্তি আছিল তো প্রভুর মৃত্যু সংবাদ জানার পর আপনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
শহীদ ভাই বললেন—আমি কানছি সারা রাত। ঘুমাইতে পারি নাই রিটন।

--আম্রিকা থিকা কথা কইতেন বন্ধুর লগে?

--একটা অপরাধ বোধ থিকা আমি অরে ফোন করি নাই। আমার ছোট বইনটাও চইলা গেছে। তারেও ফোন করা হয় নাই। একটা অপরাধ বোধ বুঝছ অপরাধ বোধ...।''
[সূত্র/নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে। প্রচ্ছদ মাসুক হেলাল। প্রকাশক চন্দ্রাবতী একাডেমি। প্রকাশকাল মার্চ ৩০১৩]

প্রভুর স্মৃতিকথাসহ প্রকাশিত বইটা আমি নিউইয়র্কে শহীদ ভাইয়ের ঠিকানায় এক কপি পাঠিয়েছিলাম। বইটি পেয়ে রচনাটি পড়েই আমাকে ফোন করেছিলেন শহীদ কাদরী--রিটন আমার তো ইচ্ছা করতাছে দৌড়াইয়া তোমার কাছে চইলা যাই। আহারে শহীদ ভাই, আমারো এখন ইচ্ছে করছে দৌড়ে চলে যাই আপনার কাছে। তারপর আপনাকে বলি--এখনই যাবেন না শহীদ ভাই, প্লিজ! আরো কিছুকাল থাকুন না আমাদের সঙ্গে। এই নিস্তরঙ্গ প্রবাস জীবনের শুকনো মরুভূমিতে আপনিই তো ছিলেন এক মুঠো সবুজে বৃষ্টি আর ঝর্ণার অনিঃশেষ উদ্যান হয়ে।

আজ দুপুরে শহীদ কাদরীর মৃত্যুর খবরটি জেনে খালেদ চৌধুরী ওরফে প্রভুর পুত্র প্রীতিভাজন সুজন চৌধুরী আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলো। ওকে ফোন করতেই হ্যালো বলার পরে শুধু কান্নার শব্দ শুনি। সুজন কাঁদছে ওর বাবার বন্ধুর জন্যে। শহীদ কাদরীর মতো বন্ধুদের কারণেই এখনো পর্যন্ত প্রভুর নামটা মুছে যায়নি। সুজন বললো--''বেঁচে থাকতে একেকজন বন্ধুর মৃত্যুর পর বাবা বলতেন, আমি একটু একটু করে মরে যাচ্ছি...।''

আসলেই! একেকটি স্মৃতিময় চরিত্র আমাদের ছেড়ে যায় আর আমরা একটু একটু করে মরে যাই। এই যেমন আজকেও আরো একটু মরে গেলাম একজন শহীদ কাদরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
বিদায় শহীদ ভাই।

তোমাকে অভিবাদন হে শহীদ কাদরী...।

কবি শহীদ কাদরীর স্কেচ : সুজন চৌধুরী

পাঠকের মতামত:

০১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test