E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘আরেকবার বলো তো কথাগুলো’   

২০১৬ সেপ্টেম্বর ২৯ ১৬:০৬:৩৮
‘আরেকবার বলো তো কথাগুলো’   

জাকির তালুকদার :


পৃথিবীতে এমন মানুষ খুব কমই আছে, যাকে আমি ঈর্ষা করি। সবচাইতে ধর্নাঢ্য মানুষ, সবচাইতে ক্ষমতাধর, সবচাইতে জনপ্রিয়, সবচাইতে সুদর্শন– কাউকেই আমি ঈর্ষা করিনি কখনোই। ক্ষমতাধরের আচরণে বিক্ষুব্ধ হয়েছি, অর্থ-বৈভবের দম্ভ দেখে বিবমিষা হয়েছে, কিন্তু কখনোই মনে হয়নি কেন আমি ঐ লোকটার মতো অর্থশালী বা ক্ষমতাশালী নই।

আমাকে ঈর্ষান্বিত করেছেন হোমার, বাল্মিকী, পুশকিন, দস্তয়ভস্কি, শেক্সপীয়ার, রবীন্দ্রনাথ, মার্কেজ। তাঁদের সৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি সৃজনশীলতার আগুন ঠিক কী জিনিস। মনে আছে, বরিস পাস্তেরনাকের ‘ডাক্তার জিভাগো’ পাঠের পরে মনটা অসাড় হয়ে ছিল অনেকগুলো দিন। মনে হচ্ছিল, মনের মতো লিখতে পারাটাই আসল কথা। সেই লেখা কোথায় ছাপা হবে, কে পড়বে, কি পড়বে না, সেই লেখা নিয়ে সমালোচক কী বলবেন, সেই লেখা কি কোনো পুরস্কার পাবে, নাকি তিরস্কার পাবে– এসব চিন্তা করাটা একেবারে অমূলক। আমার এই কথা শুনে সৈয়দ শামসুল হক কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়েও কাপটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

বলেছিলেন– আরেকবার বলো তো কথাগুলো। আমি আবার বললাম। তিনি আমার দিকে তাকালেন সটান দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টিতে হয়তো স্নেহ কিছুটা ছিল, তবে তার চাইতে বেশি ছিল পরীক্ষণ। তারপর জিজ্ঞস করলেন– আর কোন কোন লেখা পড়ে তোমার এমন অনুভূতি হয়েছে? আমি একমুহূর্ত দেরি না করে উত্তর দিলাম– ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর সনেটগুলো পাঠ করে এমন অনুভূতি হয়েছে। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ দেখে হয়েছে। ‘বৈশাখে রচিত পংক্তিমালা’ পাঠ করে হয়েছে। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এবং ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ দেখে হয়েছে। তিনি ঠোঁটে হাসি নিয়ে জিগ্যেস করেছেন– আমার কোনো গল্প-উপন্যাস পড়ে এমনটা হয়নি? বিনাদ্বিধায় বলেছিলাম– না। তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে আমার গল্প-উপন্যাস ততটা উৎকৃষ্ট নয়? এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তবু বললাম– অবশ্যই উৎকৃষ্ট। কিন্তু আমাকে বিবশ করে দেবার মতো নয়। আমার মনে ঈর্ষা উদ্রেক করার মতো নয়। তুমি আমাকে ঈর্ষা করো? বললাম– হ্যাঁ করি। ঈর্ষা করার অর্থ যে নতিস্বীকার করা সেটা জেনেও করি। কারণ আপনাকে ঈর্ষা না করে উপায় নেই।

আগে যেগুলোর কথা বললাম, সেগুলো তো বটেই, আপনার ‘হৃৎকলমের টানে’ পড়লেই তো বিশাল এক চ্যালেঞ্জ অনুভব করি। এমনভাবে যে জর্নাল লেখা যায়, সেটাই তো আগে জানত না বাঙালি পাঠক। আর আপনার ‘মার্জিনে মন্তব্য’ ‘গল্পের কলকব্জা’ ‘কথা সামান্যই’ তো পৃথিবীর নতুন লেখক-কবিদের জন্য দরজা খুলে দেবার চাবি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই চৌদ্দ উপদেশের পরে বাংলাসাহিত্যের কোন লেখক এমনভাবে পথ দেখিয়েছেন নতুনদের? সুদীর্ঘকালের সাহিত্য-পথচলা তাঁকে চিনতে শিখিয়েছে/, কোনটা চাটুকারিতা আর কোনটা সরল মনের উগড়ে আসা কথা। তিনি গ্রহণ করলেন আমার মতামত। এটাও আমার ঈর্ষার কারণ। একটা কথা প্রায় ধ্রুব সত্যের মতো উচ্চারণ করা হয়। তা হচ্ছে– প্রকৃতি শূন্য থাকতে দেয় না কোনোকিছুই। পুরণ হয়ে যায় সবকিছুই। এই কথাটা আমি সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে মানি না। সৃজনপ্রতিভার ক্ষেত্রে মানি না। সেই কারণে বলি– সৈয়দ শামসুল হকের চলে যাওয়ার শূন্যতা পুরণ হবে না কোনোদিনই।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test