E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

যুথিকা বড়ুয়ার গল্প

২০১৬ অক্টোবর ০৫ ১৫:২৬:১১
যুথিকা বড়ুয়ার গল্প







 

অন্নপূর্ণা

এক
পাখীর কলোরবে ঘুম ভেঙ্গে গেল পামেলার। পূর্ব দিগন্তের প্রান্তরে উষার প্রথম সূর্য্যরে কোমল রক্তিমাভা জানালার পর্দা ভেদ করে আবিরের মতো লাল হয়ে ছেয়ে গিয়েছে সারাঘর। ভোরের স্নিগ্ধ মৃদু শীতল বাতাস আমোদিত হয়ে আছে, রংবেরং-এর ফুলের মধুর সৌরভে। কি আনন্দময় হাস্যোৎজ্জ্বল সকাল! যেন মানুষগুলিকে অভিবাদন জানাচ্ছে আর অকুণ্ঠভাবে আহ্বান করছে, প্রকৃতির মন মাতানো বৈচিত্র্যময় রূপ আস্বাদন করার জন্য। চারিধারে হৃদয় আকুল করা কি মধুর আবেশ! ছুঁয়ে যায় মন-প্রাণ, সারাশরীর। ভরে ওঠে পরিতৃপ্তিতে।

চোখ মেলতেই চারিদিকে প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের সমাহার এবং প্রাণবন্ত উচ্ছাসের টানে মুহূর্তে আড়মোড়া ভেঙ্গে মন-প্রাণ চাঙ্গা হয়ে ওঠে পামেলার। ঢং ঢং করে ঘড়ির ঘন্টায় অবগত হয়, সকাল ছ’টা বাজে। হঠাৎ মনে পড়ে, আজ পঞ্চমী। দেবীর বোধনের দিন। আজ সন্ধ্যায় বান্ধবী ঈশিতা, লাবণী, সুলোচনা ওরা সবাই একসাথে বুড়ো শিবতলার পূজামন্ডবে দেবীর বোধন দেখতে যাবে। সেখানে ঈশিতার মামাতো ভাই নিখিলদাও আসবে। খুউব রসিক মানুষ। সবসময় রঙ্গ-ব্যঙ্গ করে। কথায় কথায় হাসায়। দারুণ মজা হবে।

ভাবতে ভাবতে কখন যে গভীর তন্ময়ে কাল্পনায় ডুবে গিয়েছিল, খেয়ালই ছিলনা পামেলার। হঠাৎ টেলিফোনের ঝন্ ঝন্ শব্দে চমকে ওঠে। ভাবলো, ঈশিতার ফোন। এইভেবে দ্রুত রিসিভারটা তুলতে যেতেই পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে ফিস্ ফিস্ শব্দ।

খটকা লাগলো পামেলার। আশ্চর্য, সাত-সকালেই এতো জরুরী তলব মায়ের। ফোনটা এলো কোত্থেকে! আর করলোইবা কে! উৎকণ্ঠায় রিসিভারটা তৎক্ষণাৎ তুলে নিঃশব্দে আড়ি পেতে শোনে। আর শোনামাত্রই বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল। বিবর্ণ হয়ে গেল মুখখানা। ক্ষণপূর্বে যে আনন্দ-উল্লাসে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল, মুহূর্তেই তা ভাটা পড়ে গেল। থেমে গেল ওর প্রাণবন্ত উচ্ছাস। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল মন-প্রাণ সারাশরীর। কে এই ভদ্রলোক? কার মুখ দেখতে চায় না সে? কে তার সর্বণাশ করেছে? কে সে? আর মায়ের সঙ্গেই বা তার কি সম্পর্ক?

হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে পামেলার। ওকে প্রচন্ড ভাবিয়ে তোলে। কেমন রহস্যজনক মনে হয়। কিছু একটা যে ঘটেছে, তা অনুমান করেই অজানা বিভীষিকায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে। উদ্ভ্রান্ত হয়ে দ্রুত ছুটে আসে মায়ের ঘরে। ওর চোখেমুখে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। কিছু বলার ব্যকুলতায় ঠোঁটদু’টো কাঁপছে, বুক কাঁপছে।

ইতিপূর্বে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে রমলা। হঠাৎ পামেলার আগমনে হকচকিয়ে গিয়েছিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো অবস্থা তার। তড়িঘড়ি করে রিসিভারটা তক্ষুণি ধপ্ করে রেখে লাইন কেটে দেয়। একটা ঢোক গিলে ফ্যাস্ ফ্যাস্ শব্দে বলল,-‘কিরে? কি হয়েছে? অমন করে হাঁপাচ্ছিস কেন? কতবার বলেছি, রাতে শোবার আগে ফোনটা অফ্ করে রাখিস। ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তো! যা যা, গিয়ে শুয়ে পড়গে যা, আর কিছুক্ষণ গড়িয়ে নে!’

এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, যেন কিছুই ঘটেনি!

পামেলা নিঃশ্চুপ, নিরুত্তর। মায়ের অভাবনীয় ব্যতিক্রম চেহারা লক্ষ্য করে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হতে থাকে। ওর চোখেমুখে অপার বিস্ময়, মনে সংকট, সংশয়। সৃষ্টি হয় প্রচন্ড মানসিক চাপ। অস্বন্তিবোধ করে। চোখমুখের অদ্ভুত অবয়বে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মায়ের মুখের দিকে। কেমন অস্বাভাবিক লাগছে ওকে দেখতে। ভারাক্রান্ত মন। চোখমুখ ঘেমে একেবারে চুপসে গিয়েছে। কিন্তু মুখে কিছু না বললেও অজ্ঞাত অচেনা লোকের সাথে মায়ের কথোপকথনের বিষয়বস্তুটি অবগতর জন্যই ওযে উৎসুক্য হয়ে আছে, তা বোধগম্য হতেই ওকে উপেক্ষা করে রমলা। -“ওমা, দ্যাখো কান্ড! হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস! বললাম গিয়ে শুয়ে পড়তে, যা!” বলে এক মুহূর্তও আর দাঁড়ায় না। আঁচলে মুখ গুঁজে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ে ঠাকুরঘরে।

পামেলা নাছোড়বান্দা। মায়ের পিছু পিছু ও ঠাকুরঘরে চলে আসে। টের পেলো না রমলা। হঠাৎ পিছন ফিরতেই চমকে ওঠে। পড়ে যায় বিপাকে। কি জবাব দেবে এখন! ওকে বোঝাবে কিভাবে! মুখ খুললেও বিপদ, না খুললেও বিপদ। উভয় সংকট। বিড়বিড় করে বলল,-“হে করুণাময়ী, দুর্গতিনাশিনী, বিপত্তারিনী, এ আমায় কোন্ পরীক্ষায় ফেলে দিলে মা, মা গো! আমায় শক্তি দাও মা!”

বলে ধপাস করে বসে পড়ে ঠাকুরঘরের চৌকাঠে। চেয়ে থাকে শূন্য দৃষ্টিতে। চকিতে গভীর তন্ময় হয়ে ডুবে যায় কল্পনায়। ধীরে ধীরে জলছবির মতো মনঃশ্চক্ষে ভেসে ওঠে, প্রলয়ঙ্করী বেগে ঘোর অমাবস্যার সেই ভয়াবহ তুফানি রাত। গভীর নিশি। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিদ্যুতের বাঁকা ঝিলিক। মেঘের গুড়–ম গুড়–ম বিশাল গর্জন। সেই সঙ্গে মরা কান্নার মতো বাতাসের একটানা গোঙ্গানী, শন্ শন্ শব্দ। রাজ্যের ধূলোবালি উড়িয়ে, গাছের ডালপালা দুমড়ে মুচড়ে ছুটে চলে দিগ্বিদিকে। চোখে পথ দেখা যাচ্ছিল না। তন্মধ্যে শুরু হয়, মুসলধারে বৃষ্টি। যেন আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। যেদিন প্রসবকালীন জটিলতার প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাত শিশুকন্যার জন্মলগ্নে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে নীরবে চলে গেল পামেলার গর্ভধারিনী মা ও যোগেশ্বর মুখুর্জ্জ্যরে প্রিয়তমা স্ত্রী সাবিত্রী। যেকথা আজও পামেলার অজানা। কিন্তু সেদিন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল, যন্ত্রদানব এতো অসময়ে সাবিত্রীর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দেবে! ভাবতে পেরেছিল কেউ, স্বামী-সন্তান আত্মীয়-পরিজন সকলকে ছেড়ে সাবিত্রী এতো শীঘ্র চিরনিদ্রায় শায়িত হবে! কি হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য! একদিকে যমে মানুষে টানাটানি। অন্যদিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ নবজাত শিশু কন্যা পামেলার একটানা বিরক্তিকর কান্না।

একেই বলে ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিণতি। যেন হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় চোখের নিমেষে ন্তব্ধ হয়ে গেল, যোগেশ্বর মুখুজ্জ্যের সুখী সংসার ও আনন্দোৎচ্ছল জীবননদীর প্রবাহ। ডুবে গেল মাঝ দরিয়ায় তার সংসার নামক তড়ীখানা। যেদিন নিয়তির নির্মমতায় জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহূর্তে প্রিয়তমা পত্নী বিয়োগের শোকে-দুঃখে বিহ্বলে মুহ্যমান যোগেশ্বরের সাজানো নিয়ন্ত্রিত জীবনকে অনিয়ন্ত্রিত করে তুলেছিল। বিরহ-কাতরতায় তাকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছিল। উন্মাদ করে দিয়েছিল। তার সদ্য সুপ্রতিষ্ঠিত সুখী ও আনন্দময় জীবনকে নিষ্পৃহা, নির্মোহ,অর্থহীণ করে তুলেছিল। জীবনের প্রতি, সংসারের প্রতি কোনো আসক্তিই তার ছিলনা। ক্রমান্বয়ে স্ত্রী হারানোর বিরহ যন্ত্রণায় তারুণ্যকে জলাঞ্জলী দিয়ে বেছে নিয়েছিল, সন্ন্যাস জীবন, নির্বাসিত জীবন। মানসিক শূন্যতায় মনোবল, বেঁচে থাকার ইচ্ছা, জীবনের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন-আশা-ভালোবাসা সব বিরহের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।

যোগেশ্বরের ধারণা এবং দৃঢ় বিশ্বাস, সদ্য ভুমিষ্ঠ কন্যা সন্তানই বয়ে এনেছিল, তার সংসারের অমঙ্গল বার্তা। তার জীবনের একমাত্র সর্বণাশের কারণ। সে সর্বগ্রাসী, অলক্ষণী। সর্বোপরি অসহিষ্ণুতার কারণে ক্ষোভে দুঃখে বেদনায় যে অনাগত ভবিষ্যৎবাণী প্রিয়তমা স্ত্রী সাবিত্রীর জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উচ্চারিত হয়েছিল, যোগেশ্বর তা দৃঢ়ভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখে, তার মনের মণিকোটায়। যা আজও একান্তে নির্জনে নিরবিচ্ছিন্ন একাকী সন্ধ্যায় বারবার আঘাত হানে, পীড়ি দেয় তার মুমূর্ষ্য হৃদয়কে। পারেনি, তা হৃদয় থেকে অপসারিত করতে। পারেনি, স্ত্রী হারানোর শোক, দুঃখ বেদনা সব ভুলে গিয়ে নিজ কন্যা সন্তান পামেলাকে গ্রহণ করতে। ওর মুখদর্শণ করতে। পারেনি, আপন সন্তানকে পিতৃ স্নেহ-ভালোবাসার দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখতে। পারেনি, হৃদয়কে স্পর্শ করার মতো নিজ রক্তে গড়া সন্তানের কোনো অবয়বই তার স্মৃতির গ্রন্থিতে ধরে রাখতে। তাই নির্দয় নিষ্ঠুরের মতো সংস্কারপ্রবণ যোগেশ্বর তার কন্যা পামেলাকে পিতার সান্নিধ্য থেকে আজও বিচ্ছিন্ন করে রাখে। যার লালন-পালন ও ভরণ পোষণের সমস্ত দায়-দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে, স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার ছত্রছায়ায় আলগে রাখে যোগেশ্বরে মুখুর্জ্জ্যরে ভগিনী রমলা। আজ এতকাল যাবৎ মাতৃত্বের শূন্য হৃদয় আঙ্গিনা ভরে রাখে নয়নের মণী পামেলার আহাল্লাদে, আবদারে। ওর হাসি-কলোতানের মধুর গুঞ্জরণে। যাকে আজও মা বলে জানে পামেলা।

দুই
শ্বশুরকূলের অগাধ সম্পত্তি রমলার। কিন্তু ভোগ করবার কেউ নেই। স্বামীর মৃত্যুকালে স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় বিষয়-সম্পত্তির সমস্ত মালিকানা রমলার নামে উইল করে রেখে গিয়েছিলেন। ওর অবর্তমানে পামেলা। যার লালন -পালনে মুছে গিয়েছিল, বন্ধা নারীর কলঙ্ক। পূরণ করেছিল, মা হওয়ার সাধ। খুঁজে পেয়েছিল নারীর অস্তিত্ব। যার রক্ষণাবেক্ষণে জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়ে রমলা ভুলে গিয়েছিল, স্বামী হারানোর শোক, দুঃখ, বেদনা। ভুলে গিয়েছিল, অকাল বৈধব্যের অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা। আপন গর্ভে ধারণ না করলেও, সন্তান ও মায়ের (নাড়ীর) চিরন্তন একাত্ম বন্ধন না থাকলেও, আদর-স্নেহ-মমতা ও হৃদয় নিঃসৃত ভালোবাসায় দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হয়, এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, আত্মার সম্পর্ক। যার কখনো ছিন্ন হবার নয়। আজ কেমন করে ওর জন্মদাতা পিতার পরিচয় দেবে রমলা! কেমন করে বলবে, ওর পিতা আজও জীবিত!

বস্তুত একথা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে, পামেলার গর্ভধারিনী মা নয় রমলা। যেকথা যোগেশ্বরের শপথ বাক্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আজ এতগুলি বছর বুকের ভিতর পাথর চাপা দিয়ে চন্দ্র, সূর্য্যরে মতো এতবড় একটা সত্য ঘটনাকে গোপন করে রেখেছিল, শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু আজ? আজতো কোনভাবেই আর গোপন রাখা যাবে না। ঠিক এই ভয়ই করেছিল রমলা, সত্য কখনোই চাপা থাকেনা। একদিন না একদিন উদঘাটন হবেই!

কিন্তু পামেলাকে কি জবাব দেবে সে! এখন ও’ আর ছোট নেই। ভালোমন্দ বোঝার যথেষ্ট ক্ষমতা হয়েছে। বয়সের তুলনায় তর তর করে ষোড়শীতেই পূর্ণযুবতী হয়ে উঠেছে। কিন্তু রক্তের সম্পর্ক যাবে কোথায়! পিতার সংস্পর্শে না থাকলেও বংশগত কিছু লক্ষণ থেকেই যায়। কখনো বিলিন হয়না। সংক্রামকের মতোই সেই লক্ষণের জের ধরে বাপের মতোই একরোখা। বিরল সেন্টিমেন্টাল। অনমনীয় জেদ। সহসা হার মানার পাত্রী সে নয়। মায়ের পিছুই ছাড়েনা। ছায়ার মতো অনুসরণ করে রমলার পিছে পিছে চলে আসে ঠাকুরঘরে। কিন্তু ওর মৌনতা, বিমূঢ়তা এবং বিষন্ন চোখের চাহনি লক্ষ্য করে মুখ লুকাবার চেষ্টা করে রমলা। চোখ সড়িয়ে নেয়। কিন্তু পালাবে কোথায়! এক্ষুণি বিস্ফোরণ যে একটা ঘটবে, তা অনুমেয় হতেই বুক ধুক্ ধুক্ করে কেঁপে ওঠে। আসন্ন বিরূপ চিত্র কল্পনা করতেই অশ্রুকণায় চোখদু’টো ছল্ছল্ করে ওঠে। পারলো না সম্বরণ করতে। আঁচল টেনে চোখদুটো মুছতেই দ্রুত মায়ের সন্নিকটে এগিয়ে আসে পামেলা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাপা উত্তেজনায় নরম হয়ে বলে,-“মা তুমি কাঁদছো? কিন্তু কেন? কি হয়েছে? লোকটি কে? কি চায় সে? তিনি কার সম্বন্ধে কথা বলছিলেন?”

আঁচলে মুখে গুঁজে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রমলা। মুখে ভাষা নেই। মনে জোর নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ। অনুভব করে, পায়ের তলা থেকে মাটি যেন একটু একটু করে সড়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ যা কিছু কল্পনায় বিচরণ করছিল, এখন তা চোখের সামনে ক্রমশ জীবন্ত হয়ে ভেসে উঠছে। ভিতরে ভিতরে একটা আশঙ্কায় কুরে কুরে খেতে লাগল এইভেবে, জীবনের শেষ সম্বলটুকুও যদি হারাতে হয়! যদি কখনো আর ‘মা’ বলে না ডাকে! রমলা বাঁচবে কি নিয়ে? কাকে নিয়ে?

পামেলা নাছোড়বান্দা। অধীর আগ্রহে মায়ের মুখপানে চেয়ে ছিল। হঠাৎ ওর কম্পিত কণ্ঠস্বরে চমকে ওঠে রমলা।

-“বলো মা বলো, চুপ করে থেকো না! বলো ঐ লোকটি কে? কে হয় তোমার? সে কেন তোমায় বিব্রোত করছেন? কি জানতে চায় সে?”

মুখ তুলে তাকায় রমলা। অসহায় চোখের চাহনি। ওর ঠোঁট কাঁপে, বুক কাঁপে। র্থ র্থ করে সারাশরীর কাঁপে। বিন্দু বিন্দু শিশির কণার মতো টপ টপ্ করে ঝড়ে পড়ে দু’চোখের বাঁধভাঙ্গা জল প্রপাতরাশি। গলা দিয়ে আর আওয়াজই বের হয়না। কিন্তু পামেলাকে আজ কেমন করে বলবে, ক্ষণপূর্বে যে ব্যক্তির কণ্ঠস্বর টেলিফোনে ভেসে এসেছিল, সে আর অন্য কেউই নয়, ওরই জন্মদাতা পিতা যোগেশ্বর। অথচ একই শহরে বসবাসরত, চাকুরীরত, সুস্থ্য, শক্ত-সামর্থ এবং জীবিত। যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই পামেলার।

ইতিমধ্যে হঠাৎ টেলিফোনের ঝন্ঝন্ শব্দে দুজনেই কেঁপে ওঠে। দ্রুত রিসিভারটা তুলে পামেলা বলল, -“হ্যালো!”

ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই একই কণ্ঠস্বর।-“হ্যাঁ রে রমা, লাইনটা কাইট্টা গেল ক্যান? ভালো আছিস তরা! কি রে, কথা কস না ক্যান? রাগ করছস? কি করুম ক, ক্যামনে বুঝাই তোরে! আমার যে বড় কষ্ট হয় রে! কোনো মতেই যে ভুলতে পারিনা!’

তৎক্ষণাৎ এপাশ থেকে পামেলা বলল,-“আপনি কে বলছেন?”

-“সে কি রে, আমি যোগু, যোগেশ্বর! কথা কইতে কইতে লাইনটা তহন কাইট্টা গেল। শরীল ঠিক আছে তর?”

শুনে থ্ হয়ে যায় পামেলা। বেশ কিছুক্ষণ নিঃশ্চুপ হয়ে থাকে। মনে মনে বলল, যোগেশ্বর, এ আবার কে? লোকটা কোথাকার আমদানি? এই নাম আগে কখনো শুনিনি তো! চোখেও তো দ্যাখেনি কোনদিন! অথচ কথাবার্তায় খুউব ঘনিষ্ঠ মনে হচ্ছে মায়ের! লোকটা কে? কে এই যোগেশ্বর?

ঠিকই অনুমান করেছিল রমলা। এতক্ষণ উৎসুক্য হয়ে কানদু’টো সজাগ করে রেখেছিল। কিন্তু পামেলার চোখ মুখের ভাবভঙ্গি দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভাবলো, নাঃ, ফোনটা তাহলে কোনো বান্ধবী হবে হয়তো! এই ভেবে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। পামেলা টের পেলো না। তন্ময় হয়ে ডুবে গিয়েছিল বিস্ময়ের ঘোরে। কিছুক্ষণ থেমে বলল,-“আমি রমা নই, পলি। কিন্তু আপনি কে বলছেন? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। আমার মায়ের কে হন আপনি?”

যোগেশ্বর নিরুত্তর। জীবনে আজ প্রথমবার আপন সন্তানের স্নেহস্পর্শী শ্রুতিমধুর কোমল কণ্ঠস্বরে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। বিদ্যুতের শখের মতো একটা ঝটকা লাগল সারাশরীরে। আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। হৃদস্পন্দনও আরো দ্রুতগতীতে চলতে থাকে। রূদ্ধ হয়ে যায় কণ্ঠস্বর। একটা শব্দও আর উচ্চারিত হয়না। রিসিভারটা মাটিতে পড়ে যায় হাত থেকে। ষ্ট্যাচুর মতো স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরে ভিতরে টের পায়, অদ্ভুত একটা শিহরণ, কি নিদারুণ একটা কোমল অনুভূতি! সে এক অভিনব অনুভূতি। বড়ই তৃপ্তিদায়ক, আনন্দদায়ক। যা পূর্বে কখনো এমন অনুভব করেনি। উপলদ্ধি করেনি। যা ব্যাখ্যারও অতীত। অথচ কিছুক্ষণ আগেও মন মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়েছিল যোগেশ্বরের। সমানে অকথা-কুকথা বকছিল।

কিন্তু এ আর নতুন কি! প্রত্যেক বছর শারদীয় উৎসবে দেবী দূর্গার আগমনের প্রাক্কালে মাথাটা কেমন বিগড়ে যায় যোগেশ্বরের। হুঁশ-জ্ঞান থাকেনা। একাকী নিঃসঙ্গতায় পাগলের মতো হন্যে হয়ে কল্পনায় খুঁজে বেড়ায়, তার মৃতা স্ত্রী সাবিত্রীকে। তার প্রেয়সীকে। কত মান-অভিমান, অনুযোগ, অভিযোগ। ঠাকুরের কাছে কত নালিশ জানায়।
আজও সেই সকাল থেকে ভারাক্রান্ত মনে চা-জল খাবার নিয়ে বসেছিল। অথচ মুখে রুচি নেই। খাবারের প্রতি এতটুকু ভক্তি নেই। মুখেই ঢুকছিল না। কিন্তু যাদুমন্ত্রের মতো হঠাৎ মানসিক পরিবর্তনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় যোগেশ্বর মুহূর্তের জন্য দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না কি বলবে, কি করবে। কিছুক্ষণ থেমে আপনমনে বিড়বিড় করে ওঠে,-“পলি, আমার সে-ই ছোট্ট শিশুকন্যা! জন্মাবধি যার মুখই দর্শণ করি নাই!”

নামটা উচ্চারণের সাথে সাথেই অতীত বর্তমান সব এলোমেলো হয়ে গেল ভাবুক,স্মৃতিকাতর যোগেশ্বরের। চকিতে হারিয়ে যায়, সেদিনের সেই মুহূর্তে, যেদিন প্রিয়তমা পত্নী সাবিত্রীর মহাপ্রয়াণে দ্বিগি¦দিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ভুলেই গিয়েছিলেন নিজের অস্তিত্ব। ভুলে গিয়েছিলেন, নৈতিকতা, মানবিকতা, একটি নিস্পাপ শিশুর জীবনের মূল্যবোধ। যার অভাবে পিতার সান্নিধ্য থেকে, পিতৃস্নেহ থেকে যাকে এতকাল বঞ্চিত করে রেখেছিলেন, আজ তারই মধুর কণ্ঠস্বরে ছুঁয়ে গেল একজন পিতার পিতৃত্বের শূন্য হৃদয়। কানায় কানায় ভরে গেল, আদর-স্নেহ-ভালোবাসায়। এ যেন বর্ণনাতীত এক অভিনব অনুভূতি। অনুভত হয়, পিতৃস্নেহ-মমতা-ভালোবাসার শিথিল বাঁধন কে যেন জোরে টেনে ধরে রেখেছে। সে এক অদৃশ্য বন্ধন শক্তি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনুতাপবোধে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। বার বার অপরাধবোধের তীব্র দংশণে সংকোচ আর সংশয়ে বিচলিত হয়ে ওঠেন। টের পায়, এক ধরণের বেদনানুভূতির তীব্র দংশণ। যা নদীর ঢেউ এর মতো বারবার ফিরে এসে মস্তিস্কের স্নায়ুকোষে আঘাত করতে থাকে। কি কঠিন, অসহনীয় সেই মুহূর্ত! অথচ এমন গহীন অনুভূতি দিয়ে তিনি কোনদিনও অনুভব করেন নি। উপলব্ধি করেন নি। সে এক অদ্ভুদ বৈপরীত্য যোগেশ্বরের।

হঠাৎ প্রগাঢ় আবেগে আপ্লুত হয়ে মন-প্রাণ সারাশরীর ক্রমশ সম্পৃক্ত হতে থাকে, মায়া মোহহীন সংসারের প্রতি, তার নিগৃহীত, পরিত্যাক্ত সন্তান পামেলার প্রতি। সম্পৃক্ত হতে থাকে, জন্মদাতা পিতার আদর-স্নেহ-ভালোবাসার অদৃশ্য বন্ধনে। ইচ্ছে হচ্ছিল, নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিজেকে ধরা দিতে। পিতৃত্ব আর অভিভাবকের দাবি নিয়ে পিতার পরিচয় দিতে। যে মিথ্যে সংস্কারের দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে আপন সন্তানের কলঙ্ক রচনা করে তাকে হৃদয় থেকে বর্জন করেছিলেন, আজ তারই কোমল সুমিষ্টি কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হোক, পিতা শব্দের চিরন্তন সত্য ও পবিত্র ধ্বনী। ঘুঁচে যাক সংস্কারপ্রবণ যোগেশ্বর মুখুর্জ্জ্যরে কু-চিন্তা, কু-সংস্কার। মুছে যাক তার অন্তরের পূঞ্জীভূত সমস্ত গ্লানি। তাই আজ ক্ষণপূর্বে কিশোরী কন্যা পামেলার হৃদয়াকর্ষক শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর ধ্বনী প্রতিঃধ্বনীত হয়ে বার বার কানে বাজতে থাকে যোগেশ্বরের।

এ কেমন বিধাতার লীলাখেলা! ভাগ্যের পরিক্রমায় বাস্তব সত্যতার সংঘাতে যোগেশ্বর আজ নিজেই নিজের কাছে পরাস্ত, অপদস্থ, অনুতপ্ত ও মর্মাহত। ক্ষণিকের মৌনতায় এবং বিমূঢ়তায় যোগেশ্বরে আজ নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। নিজেই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে।

একেই বলে রক্তের টান। শরীরের অংশ, আত্মার সম্পর্ক। যা কোনদিন অস্বীকার করা যায়না। আর যায়না বলেই যোশ্বেরের মতো একজন হতভাগ্য পিতার আদর-স্নেহ-ভালোবাসার কোমল অনুভূতির তীব্র জাগরণে মহাপ্রলয় ঘটে তার হৃদয় পটভূমিতে। অস্থিতিশীলতায় তোলপাড় করে দ্যায় একজন অসহায় পিতার পিতৃত্বের হৃদয়কে। আর তৎক্ষণাৎ চাপা আর্তকণ্ঠে যোগেশ্বর বলে উঠলেন,-“পলি, তার সেই পরিত্যাক্ত কন্যা! তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে যার মুখদর্শণ করেনি, জন্মাবধি যাকে চোখে দ্যাখে নি!”

শাস্ত্রে আছে,-“পিতা পরমেশ্বর! পিতাই স্বর্গ, পিতাই ধর্ম!”-হে প্রভু, আপন সন্তানের পিতা আমি। পিতা হয়ে এ আমি কি করেছি? কেন এমন হলো? এ যে বড়ই অর্ধম! অপরাধ করে ফেলেছি। আমার অপরাধ ক্ষমা করো প্রভু! আমারে ক্ষমা করো!”

বিবেকের তীব্র দংশণে যোগেশ্বর মুর্ছাণ্বিত, বেদনাহত, বাক্যাহত। ক্রমাণ্বয়ে মনঃস্তাপ আর অনুশোচনার আগুনে পাষাণ হৃদয় বিগলিত হয়ে স্নেহাসম্পাদে সঞ্চালিত হতে থাকে তার মন-প্রাণ সারাশরীর। অনুভব করেন, হৃদয় স্পর্শ করা এক অভিনব স্নেহানুভূতি। যা মরমে মরমে উপলদ্ধি করতে গিয়েই হঠাৎ মন উদাস করা নির্জন নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে অভাবনীয় ভাবনার উৎপত্তি হয় তার মস্তিস্কের মধ্যে। প্রশ্ন করেন নিজেকে, স্ত্রী হারানোর শোকে দুঃখে ফুলের মতো একটা নিস্পাপ শিশুকে তার পিতার স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে তার নিঃসঙ্গ জীবনে কি পেয়েছে সে? তার সংস্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন করে একদন্ড শান্তি পেয়েছিলেন কোনদিন? কখনো কি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলেন? কখনো সুখনিদ্রায় জীবনযাপন করতে পেরেছিলেন কোনদিন?

অথচ ক্রোধের বশে দীর্ঘদিন যাবৎ অহেতুক অন্তর্কলহে শুকিয়ে শরীর তার অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। বয়সের তুলনায় চিন্তাশক্তি ও প্রাণশক্তি অনেক কমে গিয়েছে। কর্মক্লান্ত দিনের শেষে নিথর নিস্তেজ হয়ে বাড়ি ফিরে এসে ক্ষিদে-তৃষ্ণাও মালুম হয়না। পা টান টান করে শুয়ে পড়েন বিছানায়। প্রায়ঃশই উপবাসে অনিদ্রায় রজনী অতিবাহিত করেন। কোন কোনদিন ঘুমের ঘোরে আবোল-তাবোল বকতে বকতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধড় ্্ফড়্ করে ওঠেন। জন শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে বুক। প্রচন্ড কষ্ট হয়। অথচ মুখ ফুটে বলতে পারেন না। বুকের কষ্ট-বেদনাগুলি তরল হয়ে নীরবে বেরিয়ে আসে দু’চোখের কোণায়। কিন্তু এতবড় একটা সত্যকে আজ কেমন করে উন্মোচন করবেন! কি কৈফেয়ৎ দেবেন তিনি?

ভাবতে ভাবতে ক্ষণপূর্বের সেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ের অসহ্য বেদনানূভূতির তীব্র দংর্শণে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠেন। হঠাৎ পূঞ্জীভূত দ্বিধা আর দ্বন্ধের কালো ছায়া সড়ে গিয়ে হৃদয়গহ্বরে জাগ্রত হয়, পিতৃত্বের তীব্র অনুভূতি। মুহূর্তেই রক্তের স্রোতের মতো শরীরের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে, শিরা-উপশিরায় সঞ্চালিত হতে থাকে। একদন্ড স্বস্তি পাচ্ছেন না। তক্ষুণি কক্ষ্যচ্যুত উল্কার মতো উর্দ্ধঃশ্বাসে মরিয়া হয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসেন বাইরে।

রিসিভারটা তখনও হাতে ধরা ছিল পামেলার। গলা ফাটিয়ে বার ক’য়েক হ্যালো বলে চেঁচালো। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে রিসিভারটা ধপ্ করে রেখে দ্যায়। বিব্রত হয়ে বলল,-“রাবিশ, ননসেন্স! দিলো সক্কাল বেলায় মুডটা অফ্ করে, ষ্টুপিড!”

শুনতে পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয় রমলা। রান্নাঘর থেকে হাক ডাক দিয়ে বলল,-“কি রে পলি, সক্কালবেলা এসব কথা তুই কাকে বলছিস?”

গলার স্বর বিকৃতি করে পামেলা বলল,-“কে আবার, তোমার ঐ যোগেশ্বর না ঈশ্বর নামধারী লোকটা। কথাবার্তা শুনে তো মনে হলো, তোমার বাল্যবন্ধু।” অট্টহাস্যে ব্যঙ্গ করে বলল,-“হেঃ, লোকটা গাঁজা ফাজা খেয়ে বসেছিল বোধহয়! আমার নাম বলতেই ব্যস, বেটার মুখে তালা লেগে গেল!”

চোখমুখ রাঙিয়ে রান্নাঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে রমলা। সামান্য চটে গিয়ে ফোঁস করে ওঠে।-“ছিঃ পলি, উনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ মানুষ। তোমার পিতৃসমতূল্য, গুরুজন। অমন অকথ্য ভাষায় মন্তব্য করে তাকে অসম্মান কোরো না! শত হলেও...!” কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। পামেলার চোখে চোখ পড়তেই বলল,-“তা কি কথা হলো ওঁর সাথে?”

লম্বা একটা হাই তুলে পামেলা বলল,-“তা’হলে আর বলছি কেন! কিন্তু মম, এখনো বললে না তো!”
-“কি কথা?”
-“কে ঐ লোকটা? ফোনটা নিশ্চয়ই তারই ছিল।”
কিঞ্চিৎ বিব্রোত কণ্ঠে রমলা বলল,-“হবে কেউ। তাতে কোনো ক্ষতি হচ্ছে আমাদের!”
-“আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু এখনো পেলাম না!”
গম্ভীর হয়ে রমলা বলল,-“এতো ভাবনার কি আছে! একদিন তুমি নিজেই সব জানতে পারবে। অযথা বিব্রোত করোনা আমায়! কি পাপ যে করেছিলাম, আরো কত কি লেখা আছে কপালে, ভগবানই জানে!”
ইতিপূর্বে মুখ ভার করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ে পামেলা। পা’দুটো টান টান করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। রমলা বিড় বিড় করে বকতে বকতে চলে গেল রান্নাঘরে।

তিন
দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে, পড়ন্ত বিকেলে ক্লান্ত সূর্য্য অস্তাচলে ঢলে পড়েছে। চারিদিকে পূজো পূজো রব। মন্ডবে মন্ডবে ঢাক বাজজে, ঢোল বাজজে, চন্ডীপাঠ হচ্ছে। দূর থেকে ক্ষীণ শব্দে রেকর্ডে অতুলপ্রসাদী গান বাজজে, শোনা যাচ্ছে। পাড়ার শিশু-কিশোর-কিশোরী, নবিন-প্রবীন সকলেই খুশীর পাল তুলে মেতে উঠেছে শারোদৎসবের আনন্দমেলায়, মিলনমেলায়। পামেলা তখনও নিজের সাজ-সজ্জা ও প্রসাধনের পরিচর্যা নিয়ে খুউব ব্যস্ত। হঠাৎ গাড়ির শব্দ শুনে চমকে ওঠে। জানালায় উঁকি দিয়ে দ্যাখে, ধূতি-পাঞ্জাবী পরিহিত একজন অচেনা অপরিচিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে দ্রুত ওদের বাড়ি দিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। পামেলা দৌড়ে মাকে গিয়ে বলে,-“দ্যাখো তো মা, কে যেন আসছে আমাদের বাড়িতে!”

বুঝতে দেরী হলো না রমলার। কে আর আসবে! আসার মতো কেইবা আছে সংসারে! কিন্তু শোনা মাত্রই বুকটা কেঁপে উঠল। মুখখানাও বিবর্ন হয়ে গেল। মনে মনে বলল,“নিশ্চয়ই যোগুদাই আসছে। কিন্তু এতকাল পর এ বাড়িতে কিসের জন্য? কি চায় সে? এতগুলি বছর পেরিয়ে গেল, মেয়ের খোঁজ-খবর নিয়েছিল কোনদিন? বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে, সে খবরও তো কোনদিন ন্যায়নি? দর্শণও তো দেয়নি কোনদিন! বুকের জ্বালা এখনো কি ওর মেটেনি? কেমন মানুষ সে? নিজের সন্তানের প্রতি এতটুকু মায়া-মমতা নেই ওর অন্তরে। মেয়েটাকেও একটু শান্তিতে থাকতে দেবেনা কোনদিন! কিন্তু আজ কোন্ পরিচয়ে সে সম্মুখে এসে দাঁড়াবে? কি পরিচয় দেবে সে? পারবে, নিজের অপরাধ স্বীকার করে পলিকে গ্রহণ করতে? পিতার পরিচয় দিতে? একবারও কি ভেবে দেখেছে সেকথা? নির্ঘাৎ চিৎকার চেঁচামিচি করে তুলকালামকান্ড একটা বাঁধিয়ে বসবে। পাড়ার লোক জড়ো করবে। তামাশা দেখাবে। কিন্তু পলি, আজ ওকে সামালাবে কে? কি কৈফেয়ৎ দেবে সে? নানান চিন্তায় ক্রমশ জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে রমলা।

ইতিপূর্বে কলিং-বেলের রিংটা ঝিনঝিন্ করে বেজে উঠতেই বুক ধুক্ ধুক্ করে বুকটা ওঠে রমলার। আসন্ন বিরূপ পরিস্থিতির অনুমানিক চিত্র কল্পনা করেই বিষাদে ভরে যায় মন-মানসিকতা। অগত্যা শিথিল ভঙ্গিতে দরজাটা খুলে দিতেই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে যোগেশ্বর। বড় বড় চোখ মেলে বিস্মিত দৃটিতে থাকেন পামেলার মুখের দিকে! স্বগোতক্তি করে ওঠেন,-এ কি, এ যে অবিকল আমার সাবিত্রী! সেই নাক, সেই চোখ, কপালের মাঝে সেই জোড়া ভ্রু। মায়ের মতো সেই ডাগর চোখের মায়াবী চাহনি। পিষ্ঠদেশ জুড়ে সেই ঘন কালো লম্বা কোঁকড়ানো চুল। যেন সাবিত্রীর পূণর্জনম ঘটেছে! এ-ই ওর সেই কন্যা? নিজের রক্ত দিয়ে গড়া সেই সন্তান? তার শরীরের অংশ?

আর ভাবতে পারছেন না যোগেশ্বর। সারাদূপুর ভবঘুরের মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে সময় অতিবাহিত করেছেন। একরাশ দ্বিধা আর দ্বন্দ্ব নিয়ে মনের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করেছেন। এখন তিনি বড্ড ক্লান্ত। এবার একটু শান্তি পেতে চান। অথচ এই মুহূর্তে ক্লান্তি আর অবসন্নতার এতটুকু রেশ কোথাও নেই তার শরীরে ও মনে। খুঁজে পেলেন প্রবল প্রাণশক্তি, ইচ্ছাশক্তি। জীবনে নতুন করে জাগ্রত হয়, বেঁচে থাকার সাধ। কি নিদারুণ সেই অনুভূতি! সে এক নতুন বিস্ময়!

মুহূর্তে আনন্দাশ্রুর প্লাবনে প্লাবিত হয়ে ভরে গেল শুস্ক মরুভূমির মতো যোগেশ্বরের হৃদয়-মন-প্রাণ সারাশরীর। অব্যক্ত আনন্দ-বেদনার সংমিশ্রণে অশ্রুসজলে চোখদু’টো সিক্ত হয়ে ওঠে। প্রাণ ভরে দেখেও সাধ মেটেনা। অথচ অপরাধীর মতো ক্ষমা প্রার্থীর মতো করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন। কি অসহায় তার চাহনি। থরথর করে হাত কাঁপে। ঠোঁট কাঁপে। ভারি হয়ে আসে গলার আওয়াজ।

অবলীলায় দু’হাত প্রসারিত করে দিয়ে বললেন,-“আয় মা আয়! আমার বুকে আয়! আজ তোরে দুচোখ ভরে দেখি! কতকাল দেখি নাই!”

বুকের মাঝে হাতটা বুলিয়ে অনুভব করেন, এক ধরণের স্নিগ্ধ শীতলতায় বুকটা তার জুড়িয়ে গেল। একেই বলে সংযোগ। মনে মনে বললেন,-সেই চওড়া লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিতা, এলোকেশী। ললাটে বড় একটা ফোটা। ঠিক একই বেশে পঞ্চমী তিথীতে প্রথম দেখেছিলাম আমার সাবিত্রীকে! ইতিমধ্যে নিজেই পামেলাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, -“আমার অন্নপূর্ণা মা! আমার আনন্দময়ী মা! আমায় চিনতে পেরেছিস মা!”

ফোঁস করে লম্বা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,-“ওরে, আমিই তোর হতভাগ্য পিতা, যোগেশ্বর! হ্যাঁ, আমিই যোগেশ্বর, তোর জনমদাতা পিতা। আজ আমি বড় একা, বড়ই নিঃসঙ্গ! বুকটা আমার বহুকাল যাবৎ শূন্য হয়ে আছে মা! বাবা বলে একটিবার আমায় ডাক মা! মন যে আমার বড় উতলা হয়ে আছে! বড় আশা নিয়ে এসেছি মা, এই বুড়ো ছেলেটাকে শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিসনে! আয় মা আয়, আমার বুকে আয়!” বলতে বলতে হাউ হাউ করে সজোরে কেঁদে উঠলেন যোগেশ্বর।

অপ্রস্তুত পামেলা মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এসব শুনে যেন আকাশ থেকে পড়ে! নিজের কানদু’টোকে কিছুতেই ওর বিশ্বাস হয়না। ওকি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে নাকি! এ তো স্বপ্নেরও অতীত! কল্পনাই করা যায়না! অথচ চন্দ্র সূর্য্যরে মতো নিতান্তই বাস্তব সত্য। যাকে এতকাল মৃত বলে জেনে এসেছে, আজ সশরীরে সেই ব্যক্তিই ওর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। এক ঝটকায় পিতার আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে আসে পামেলা। প্রচন্ড আলোড়ণ সৃষ্টি হয় মনের মধ্যে। হাজার প্রশ্নের ভীঁড়ে ওকে বিচলিত করে তোলে। পূঞ্জীভূত অভিমান, ক্ষোভ আর একরাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে মায়ের মুুখপানে পলকহীন নেত্রে চেয়ে থাকে। কিন্তু কি বলবে রমলা! অপ্রত্যাশিত যোগেশ্বরের আগমন ও অভাবনীয় ভাবমূর্তি লক্ষ্য করে বিস্ময়ে থ্ হয়ে গিয়েছিল। যা কখনো কল্পনাই করতে পারেনি। চোখেমুখে নালিশ কিংবা অভিমানের ছাপ বিন্দুমাত্র কোথাও নেই যোগেশ্বরের। দীর্ঘদিন পর বুকের পাথর সড়ে গিয়ে মুখখানা কি শান্ত, স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। অথচ একটা শব্দও উচ্চারিত হয়না কারো। ভিতরে ভিতরে খুশীর প্ল¬াবনে প্লাবিত করে হৃদয়ের দুকূল ছেয়ে গেলেও অভিমান আর অব্যক্ত খুশীর সংমিশ্রণে চোখদু’টো ছল্ছল্ করে ওঠে রমলার। কিন্তু ওর ঐ নীরব নির্বিকার আচরণে সত্য প্রমাণিত হতেই মনকে প্রচন্ড আন্দোলিত করলো পামেলার। একরাশ মনবেদনা, অভিমান নিয়ে চোখেমুখের বিচিত্র অবয়বে অনবরত বকতে থাকে। কিন্তু ওর কোনো কথাই কানে তোলে না রমলা। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে।

হঠাৎ কান্নাজড়িত কণ্ঠে মায়ের হাতদু’টো সজোরে চেপে ধরে বলে,-“তবে কেন তোমার এই বেশ মা? তুমি কেন বৈধব্যের রীতি-নীতিগুলি সব যথাযথ পালন করো? একাদশী করো, নিরামিশ আহার ভোজন করো! কেন, কেন করো এসব? একথা কেন তোমরা এতদিন আমায় বলোনি? বলো মা বলো, কেন বলোনি? তোমাকে আজ বলতেই হবে, কেন তোমার এই বেশ বলো?”

পামেলার সন্নিকটে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে যোগেশ্বর। মৃদুস্পর্শে ওর মাথায় হাতটা বুলিয়ে বললেন,-“ওকথা বলে ওর মনে আর কষ্ট দিসনে মা! ওতো আমার ছোটবোন রমা, তোর পিসি। হতভাগিনী কপাল দোষে অকাল বৈধব্যেই জীবনের সব রং মুছে গিয়েছে। তোর মা বহুদিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। রমাই কোলে পিঠে করে তোকে লালন-পালন করেছে, বড় করেছে। তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে বল!”

ক্রোধ আর অভিমানে ফেটে পড়ে পামেলা। মুহূর্তে চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে। অশ্রুজলে প্লাবিত হতে থাকে ওর চোখমুখ, সারাশরীর। হিচকি টেনে কেঁদে কেঁদে বলে,-“তবে কেন এতদিন আমায় দেখতে আসো নি? আমায় কেন দূরে সরিয়ে রেখেছিলে? কোন্ অপরাধে? কি অপরাধ করেছিলাম আমি? পিতার সংস্পর্শ থেকে কেন এতদিন আমায় বঞ্চিত করে রেখেছিলে? তোমরা কেন আমায় এতবড় শাস্তি দিয়েছ? কেন? কিসের জন্যে? তোমরা কেন একথা আমায় এতদিন জানাও নি?”
বলে পিতা যোগেশ্বরের মুখপানে চোখ তুলে একপলক চেয়েই দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বিকট শব্দে বন্ধ করে দেয়।

রমলা বলল,-“দিলে তো মেয়েটার আনন্দ মাটি করে! যাও দাদা, শিগগির যাও, এবার সামলাও তোমার মেয়েকে!”

লেখক : কানাডা প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test