E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আপন জীবনের গল্পকার সালাম সালেহ উদদীন

২০১৬ নভেম্বর ২৪ ১৩:৪৭:৪৯
আপন জীবনের গল্পকার সালাম সালেহ উদদীন






 

মনির জামান

আমরা যারা আশির দশকের শেষলগ্নে সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেছি তাদের মধ্যে সালাম সালেহ উদদীন অগ্রগণ্য -সাহিত্যচর্চায় তার নিষ্ঠা আর প্রাণবন্ত গদ্যশৈলীর কারণে। আর তিনি গদ্যচর্চা করেছেন দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। ইতোমধ্যে তার ৪০টি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ নানা ধরনের গদ্য লিখলেও সালাম প্রধানত গল্পকার। প্রতিনিয়ত তিনি নতুন গল্পটাই লিখতে চান। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ৮টি। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে নির্বাচিত ৩ গল্প শ্রেষ্ঠ গল্প প্রেমের গল্প, নির্বাচিত প্রেমের গল্প, সেরা প্রেমের গল্প।

সম্প্রতি সালামের লেখা ‘সেরা গল্প’-এর বইটি হাতে এলো। ১৭৬ পৃষ্ঠার নির্ভুল বইটিতে ২২টি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পই সুন্দর। এর বাইরেও ভালোলাগার মতো বেশকিছু গল্প রয়ে গেছে। অনেকগল্প একসঙ্গে পড়তে পেরে একটি সামগ্রিক সমাজচিত্র প্রত্যক্ষ করেছি। সমকালীন জীবনধারা প্রকাশ পেয়েছে গল্পগুলোর সামগ্রিকতায়। আসলে যারা গল্প লেখেন, তারা রপ্ত করে নেন কীভাবে কয়েকটি পৃষ্ঠারসীমায় চিন্তাকে অনন্য ভঙ্গিতে সাজাতে হয়। এটা তার চর্চা, তার দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস, তার সৃজনশীলতা। আর আমরা এটা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের অভিজ্ঞতা থেকে।

বাংলা ছোটগল্প ইউরোপীয় ভাষায় ছোটগল্পের সমসাময়িক বললে ভুল হবে না। মুদ্রণযন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সাহিত্যের নতুন এই ফর্মের চর্চা শুরু হয় শিল্প বিপ্লবের কাল থেকে। ওই সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছকে বাংলা গল্পের আকড়গ্রন্থ বলা চলে। এরপর শতবর্ষে- বাংলা ভাষায়ও বহু গল্প এবং গল্পকার আমরা পেয়েছি। আর এখন যারা গল্প লিখছেন ঢাকায় কিংবা কলকাতায়- তাদের লেখাগুলো যথাযথভাবে পড়া হচ্ছে কি? অথচ বিশ্বসাহিত্যে ছোটগল্পই এখন সবচেয়ে অগ্রসর ফর্ম। আমরা বিভূতি, তারাশঙ্কর, মানিক, ওয়ালিউল্লাহ, সমরেশ বসু, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প পড়ে নিজেদের চর্চাকে বিকশিত করছি। জীবনানন্দ দাশের মতো কবির লেখা গল্পগুলো কি নতুন গল্পকারদের উদ্ভুদ্ধ করছে না? আমরা তো সাম্প্রতিক সময়ে শহিদুল জহিরের গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এরপরের গল্পকারদের মূল্যায়নের সময় নিশ্চয় এসে গেছে।

এই সময়ে আমরা যদি সালাম সালেহ উদদীনের গল্প পড়ি, তাহলে দেখব- পরিস্থিতির বর্ণনা কতটা সরস হতে পারে। ‘অন্যান্য বৃক্ষ এবং পাখ-পাখালি’ গল্পে সালাম একটা আকড় বৃক্ষের পতনের কথা বলেছেন, সে পতনে প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে। তার মানুষ দেখা অদূরবর্তী কেউ, প্রার্থনার দুইপর্ব, কুকুর ও সন্যাসী- এই গল্পগুলোতে উঠে এসেছে সালামের অভিজ্ঞতার জীবনচিত্র। গল্পগুলো চরিত্রকেন্দ্রিক। বাসার, কাফিল আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম মূর্ত হয়েছে গল্পগুলোতে। ‘কুকুর ও সন্যাসীর দিকে লেজ নেড়ে তাকায়। সন্যাসীর নজরও কুকুরটির দিকে। চার চোখ এক সঙ্গে মিলিত হলো। কুকুরটি নড়েচড়ে বসল...। আসলে গল্পের সহজ-সচলতার ভিতর লুকিয়ে থাকে রহস্য, অন্য বাস্তবতা, যা আপনাকে পাঠে প্রলুব্ধ করবে।

নিজের সময়কে তুলে ধরতেই যেন বেশিমাত্রায় সচেষ্ট সালাম। তার গল্পে গ্রাম ও শহরের যুগপথ উপস্থাপনা দেখি। বেশকিছু গল্পে দেখি, গ্রাম থেকে শহরে এসে মানুষ বদলে যাচ্ছে, সংগ্রাম করছে শহরে বাস্তবতার সঙ্গে। আধ্যাত্মিকতার নামে জনজীবনে দীর্ঘকাল ধরে যে গুরুতর প্রতারণা চলছে তার প্রকাশ দেখি ‘টাকা জ্বলে ওঠে অন্ধকারে’ গল্পে গ্রামের ছেলের শহরে হয়ে ওঠার বয়ান আছেÑ ‘ নিম্নবিত্তের প্রতিশোধ’ এবং ‘শীত ও অন্ধকারে আমরা’ গল্পে। ‘বিরহ দূত’ গল্পে স্পষ্ট হয়েছে দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় পক্ষের গোপন উপস্থিতির মনোজ্ঞ চিত্র। সালামের গল্পে যা বহমান তা হলো নিজের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি। যে জীবন পদ্মার চরাঞ্চলের সামন্ত সমাজ থেকে উঠে এসে ঢাকার নাগরিক বাস্তবতার স্থিত হওয়ার সংগ্রামে লিপ্ত; তারই একটা সামগ্রিক ভাষ্য আছে ‘সেরা গল্পে’র পাতায় পাতায়। সালামের লেখায় পরিবার এসেছেÑ মায়ামতায় পূর্ণ হয়ে; যেখানে কখনো কখনো মিতা, প্রিয়তি, মিনতিকে নিয়ে এসেছেন অনন্য বাক্য বিন্যাসে। ‘মৃত মানুষের সিঁড়ি’ গল্পে লেখক বলছেনÑ আজ দেরিতে বাসায় পৌঁছার কারণে মিতার মনটা বিষণœ ও চেহারা ম্লান। প্রিয় মিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেÑ আম্মি, বাবা এসেছে। আরমান দুজনকেই দ্রুত জড়িয়ে ধরল। ঠিক এ মুহূর্তে তার মনে হলো, আলো-আঁধারিতে যে মৃত্যু-ভয় তাকে তাড়া করে বাসা পর্যন্ত নিয়ে এসেছেÑ তা যেন দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

ছোটগল্প এমন এক সাহিত্য ভাষ্য যেখানে লেখক সমাজ-রাজনীতি- অর্থনীতি-সাংস্কৃতির মৌলিক চিত্র তুলে ধরতে পারেন। সালামের গল্পগুলো আমাদের উপহার দিয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর অস্থির-অস্থিতিশীল বাংলাদেশের জনজীবনের বাস্তবচিত্র; যেখানে বেঁচে থাকার সংগ্রামটাই প্রধানরূপে দেখা দিয়েছে। যেখানে ব্যক্তি পরিবার, সমাজ সংঘ একাকার হয়ে আছে। রিকশারোহীর দাহন উৎসব, দুই টাকার নোটে যা ছিল, টাকার চেরাগ প্রভৃতি গল্পে আমরা এই সময়ের চেনা বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করি।

নর-নারীর সম্পর্ক চিরকালই শিল্পী-সাহিত্যিকের উপাত্ত হয়েছে। এই সম্পর্কের রসায়নের আলোকে সমাজ বাস্তবতা উঠে এসেছে সালাম সালেহ উদদীনের গল্পে। নর-নারীর সম্পর্ককে সালাম দেখেছেন সুখ-সৌন্দর্য-সুস্থতার প্রতীক রূপে। সম্পর্কের অসমতা, বহুগামিতা আর নোংরামিকে সালাম সবমময় প্রত্যাখ্যান করতে চান। ‘গুলেন-বারি সিনড্রোমের পর’ গল্পে দেখি বহুগামী পুরুষের দুঃখজনক পরিণতির অদ্ভুত এক চিত্র। আমরা জানি না, আমাদের আগামী দিন। ভোগ এবং বোকামিতে পূর্ণ জীবনকে প্রত্যাখ্যান করতে বলেন এই সময়ের নিষ্ঠাবান গল্পকার সালাম সালেহ উদদীন।

মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারের পর মহাকাব্যের যুগ শেষ হয়ে গীতিকবিতার বিকাশ ঘটে, একই সঙ্গে গদ্যের প্রচলন হয়। আমরা পেয়ে যাই বড় বড় সব উপন্যাস। ছোটগল্পটা এর পাশাপাশি চলছিল। কিন্তু এখন, যখন টিভি-সিনেমার যুগ শুরু হয়ে গেছে, ঘটেছে ইন্টারনেটের বিকাশ, তখন উপন্যাসের চেয়ে ছোটগল্পই পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠেছে। পর পর চীনা এবং কানাডিয়ান গল্পকার নোবেল পেয়ে ছোটগল্পের চাহিদাকে আরো একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।

এই সময়টায় আমরা যারা গল্প লিখি তাদের দায়িত্ব অনেক। এবং বলার ভঙ্গিতে ও আনতে হবে পরিবর্তন, প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ব্যস্ত পাঠকের কথা মনে রেখে। সালামের গল্পে দেখি এ ধরনের সমকালীন প্রবণতা। তার গল্পগুলো চরিত্রকেন্দ্রিক। পরিস্থিতির বয়ান এমনভাবে দিতে চান- যাতে পাঠক শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গল্পে আবিষ্ট থাকতে পারে। এমনকি পাঠের পর আপনার ভাবনার বিস্তার ঘটায়। সালাম সালেহ উদদীন প্রতিটি গল্পে নিজের জীবনেরই কথা বলেন; যে জীবন আপনার, আমার সবার- সেই জীবনই খুঁজে ফেরেন গল্প থেকে গল্পে। সালামের সৃজনশীল প্রচেষ্টা সফল হোক। আরো গল্প পেতে চাই তার কাছ থেকে।



(এমজে/এস/নভেম্বর ২৪, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test