E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বিশ্বজিৎ বসু’র গল্প

২০১৬ ডিসেম্বর ১৩ ১১:৫৭:১২
বিশ্বজিৎ বসু’র গল্প







 

অনুরাগের দ্বিতীয় দৃশ্য

ট্যাক্সি নিয়ে ক্রাউন ক্যাসিনোর র‌্যাঙ্কে বসে আসে বাবলু। এর আগের দুটি ট্যাক্সি এক সংগে ছেড়ে গেল। মনে হলো তারা একই দলে এসেছিল। এবার বাবলুর পালা। র্যা ঙ্কে যে সংখ্যক ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে তাতে একটা বড় খ্যাপ পেলে পুষিয়ে যাবে। ছোট খ্যাপ পেলে আবার এসে র্যা ঙ্কে পিছনে দাঁড়াতে হবে। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে তার ঠিক নেই। যদি একটা মাতাল অ্যাবোরিজিানল উঠে বসে তাহলে যে কিভাবে ম্যানেজ করবো।ভাবতে থাকে বাবলূ।
ধুর শালা এসব কি ভাবছি। একটা সোবার ভদ্রলোকও তো উঠতে পারে। দিতে পারে পঞ্চাশ টাকা বকশিশ। বাবলু মনে মনে নিজেকেই বলে “শালা বিদেশে এসেছো সুখের আশায়। দেশে রিকসাওলাকে দুটাকা বকশিশ দিয়ে দাতা কর্ণ সাজো। বেড়াতে গিয়ে ডলারের ফুডানি দেখাও। আর এখন বিদেশে ট্যাক্সি চালানোর সময় মনে মনে দাতা কর্ণ খোঁজ”।
মিনিট পাঁচেক পরে তিন নারী এসে দাড়ায় ট্যাক্সি থেকে একটু দুরে। ফুক ফুক করে সিগারেট ফুকতে থাকে আর তাকাতে থাকে ট্যাক্সির দিকে। বাবলূ মনে মনে ভাবে এবার হয়ত পেয়ে যাব। অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।আর যা হোক মাতাল তো না। এখন একটু লম্বা দুরত্বের হলেই হয়।
সিকুরিটি গার্ড এসে স্মোকিং যোনে গিয়ে সিগারেট টানতে বলায় তাদের নেশা শেষ হয়ে গেল বলে মনে হয়। সিগারেটটি পায়ের তলায় পিষে চলে আসে ট্যাক্সির কাছে। সিকুরিটি পায়ের তলায় পিশানো সিগারেটের বাকি অংশ তুলে নিয়ে ফেলে দেয় বিনের ভিতরে।তিন নারীর মধ্যে যে বয়সে বড় সে দৌড়ে যায় সিকুরিটি গার্ডের দিয়ে। বলে উঠে Sorry sorry. সিকুরিটি উত্তর দেয় Ok ok, no problem.
মধ্য বয়স্কা বাবলুকে জিজ্ঞেস করে, – Hi are you free.
Yes I am. বাবলু উত্তর দেয় ।
We will go East Fremantle.
বাবলু মনে মনে ভাবে ।যাক দুরত্ব মন্দ নয়। ভাড়া প্রায় চল্লিশ ডলার হবে। ওখান থেকে যদি একটা এয়ারপোর্ট পেয়ে যায় তাহলে র্যা ঙ্কে চল্লিশ মিনিট বসে থাকা পুষিয়ে যাবে।
Can you please wait for a sec? We are waiting for my husband. মধ্য বয়সি জিজ্ঞেস করে বাবলুকে।
Ok no problem. বাবলু উত্তর দেয়।
ভদ্রমহিলা মোবাইলে ফোন দিয়ে হাসবেন্ডকে চলে আসতে বলে । Please come. I am waiting at the taxi rank in front of Metropole. ফোন নামিয়ে রেখে বাবলুকে বলে ”He is coming. Thanks.” এ থ্যাংকসটা অপেক্ষা করার জন্য। বাবলূ ভাবে। আল্লাই মালুম। এ অপেক্ষা কতক্ষণের ।জুয়াড় আসর থেকে তুলে আনা বলে কথা । বসে থাকা ছাড়া কোন উপায়ও নেই।
অল্পক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে এলো একজন।বয়েসে যুবক।ত্রিশের কোটায়। মুখে ভীষণ বিরক্তির ছাপ। Thanks for coming to my Birthday celebration. ছেলেটি ধন্যবাদ জানায় সাথের অন্য দুজন মহিলাকে ।
তারা উত্তর দেয়। You are welcome.
তৃতীয় যে মেয়েটি এদের সাথে মনে হচ্ছে সে অষ্টাদশী। যুবকটি যখন তাদের ধন্যবাদ দিচ্ছিল বয়স্ক মহিলা তখন ওর দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসছিল। হঠাৎ অষ্টাদশী মেয়েটি তার হ্যান্ড ব্যাগ হতে বের করে একটা ফুলের তোড়া। এগিয়ে ধরে জনের দিকে। Happy birth day to you. ছেলেটি Thank you বলে হাতে তুলে নেয় ফুলের তোড়া।
এরপর চলতে থাকল মোবাইলের ফটোসেশন। একজন এসে বাবলুকে বলে Can you please take some photo for us. You can start your meter. বাবলু এগিয়ে গিয়ে বলল No problem.
অষ্টাদশী তার মোবাইল টা এগিয়ে দেয় বাবলুর হাতে। চারজন দাড়িয়ে যায় ছবি তোলার জন্য। মাঝখানে ফুলের তোড়া নিয়ে ছেলেটি। ফুলের তোড়ার উপর লেখা “Happy Birthday to John”.
ফটোসেশসন শেষে শুরু হলো কোলাকুলি। সবাই সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরছে।একে আপরের গালে চুমু খাচ্ছে। বাবলু মনে মনে ভাবে।কোন দেশে এসেছিরে বাবা । বউ ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সাথে এভাবে কোলাকোলি করা যায়! বিয়ের পরে বউকেও তো সবার সামনে এভাবে জড়িয়ে ধরাও যায় না। আর চুমুতো দুরের কথা।
বিদায় নিয়ে এক দরজা দিয়ে জন এবং অন্য দরজা দিয়ে তার স্ত্রী এসে বসে ট্যাক্সির পিছনের ছিটে। অন্য দুজন হাত নেড়ে বিদায় জানায় “ See you John, See you Lara. ট্যাক্সির জানালা খুলে জন এবং লারা উত্তর দিল ”See you ”.
ট্যাক্সিতে উঠে জন বলে “Thanks for waiting. Let go to Palmyra. বাবলু উত্তর দেয় OK আর মনে মনে ভাবে শালা গেল দশ টাকা কমে।এরপর ট্যাক্সি স্ট্রাট দিয়ে মিটার চালু করে, রওনা দেয় পলমাইরার দিকে।
ট্যাক্সির ভিতর শুনশান নিরবতা।কারও মুখে কোন কথা নেই। র্যা ঙ্ক থেকে বেরিয়ে বল্টন এভ্যেন্যুর গোলচক্কর পার হয়ে ট্যাক্সি এসে থামে গ্রেট ইষ্টার্ণ হাইওয়ের ট্রাফিক সিগন্যালে। সামনে পিছনে কয়েকটা গাড়ি।বাবলু ব্যাক ভিউ মিরর দিয়ে দেখতে পায় দুজনেই বেশ গম্ভীর।জন এর মনোযোগ স্মার্ট ফোন এর স্ক্রিনের দিকে। ট্যাক্সি ডানে টার্ন নিয়ে ছুটে ফ্রিমেন্টেলের দিকে।
ফ্রিমেন্টেল ওয়ের্স্টান অস্টেলেয়ার প্রথম রাজধানী এবং পোর্ট সিটি। প্রায় একশ বছর আগে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়েছে বিশ কিলোমিটার ভিতরে পার্থ শহরে। সোয়ান নদীর পারে।
এক কিলোমিটার পড়েই একটা ওভারপাস ব্রিজ । ব্রিজের নিচ থেকে শুরু হয়েছে আলবেনি হাইওয়ে। যা প্রায় সাড়ে চারশ কিলোমিটার দীর্ঘ। শেষ হয়েছে আলবেনী শহরে।শহরটি ভ্রমনের জন্য বিখ্যত। মৎস্য শিকারীরা পার্থ থেকে সেখানে যায় স্যালমন মাছ ধরতে। সেখানে একটি বিশেষ স্থানের নামই স্যালমন পয়েন্ট। ব্রিজটি সংযোগ করেছে গ্রেট ইষ্টার্ন হাইওয়ে এবং ক্যানিং হাইওয়েকে। ক্যানিং হাইওয়ে শেষ হয়েছে ফ্রিমেন্টেল শহরের প্রবেশ মুখে। আর গ্রেট ইষ্টার্ন হাইওয়ে শেষ হয়েছে কার্লগোর্লি শহরে।
কার্লগোর্লি শহরটি মাইনিং সিটি হিসাবে পরিচিত। এখানে রয়েছে অস্ট্রেলিযার বৃহত্তম ওপেন পিট সোনার খনি। এই ওপেন পিট সোনার খনিটি সুপার পিট হিসাবে পরিচিতি। কার্লগোর্লির আরেকটি বড় সম্পদ হচ্ছে চন্দন কাঠ। এখানকার চন্দনকাঠ অস্ট্রেলিয়া সরবরাহ করে দেশের বাইরে।
ব্রিজের উপর উঠতেই জন উচ্চস্বরে বলে উঠল “Don’t touch me. You ruined my birthday. তারপর নিরবতা। কিছুক্ষণ পর আবার জনের উচ্চস্বরে জিজ্ঞাসা- Why did you call me? Who are you to call me?
লারা চাপা স্বরে বলে উঠল ”Don’t shout Please. We are in taxi”
জন এবার চাপাস্বরে বলল ”You ruined my birthday. I am giving this status on the facebook. See! Look look look”. She ruined my birthday. look look.
লারা চাপা স্বরে আবারও বলল “Thats Ok, no problem give it. Don’t shout please.’’

এভাবেই চলতে থাকলে দুজনের রাগ অনুরাগ। জনের একটাই কথা You ruined my birthday. Why did you call me? Who are you to call me? Who gave you permission to call me?
লারার চাপা স্বরে একটাই কথা “Don’t shout please.”
ট্যাক্সি এগিয়ে চলছে ক্যানিং হাইওয়ে ধরে। জন চাপা স্বরে আবারও বলে উঠল ” You ruined my birthday.” লারা এবার নিরুত্তর।
আবারও শুনশান নিরবতা। গাড়ীর অডোমিটারের পাশে ঘড়িতে রাত এগারটা বিশ। আালফ্রেড কোভে নর্থলেক রোড সিগন্যাল পার হয়ে পাহাড়ী ঢাল বেয়ে উপরে উঠছে গাড়ী। ডানে প্রেস্টন পয়েন্ট রোড হয়ে ইস্ট ফ্রিমেন্টেল যাবার রাস্তা। হঠাৎ পিছনের সিট থেকে জন বলে left! Left1 left!. হার্ড ব্রেক করে বাবলু গাড়িটি ঢুকিয়ে দেয় ইট বসানো গলিতে। ভাগ্যিস পিছনে কোন গাড়ী ছিল না । তা হলে নিশ্চই হর্ন খেতে হতো। এখানে সাধারণত কেউ হর্ণ বাজায় না। শুধুমাত্র সতর্ক করার জন্য হর্ণ বাজায়। এখানে বিনা কারণে কাউকে হর্ণ দিলে সে অপমানিত বোধ করে।
গলির ভিতরে দুপাশে প্রতিটি বাড়ীর সামনে দুটো করে রাবিশ বিন পজেশন করে রাখা । সবুজ ঢাকনা ওয়ালাটা ব্যবহার হয় ডাস্টাবিন হিসাবে আর হলুদ ঢাকনা ওয়ালাটা ব্যবহার হয় রিসাইকেল বিন হসাবে। কাল সকালে কাউন্সিলের গাড়ি এসে রাবিশ গুলো নয়ে যাবে।
Stop stop, left here. বাবলূ লক্ষ্য করে এদের রাবিশ বিন দুটো এখনও নামানো হয়নি এবং থামিয়ে দেয় ট্যাক্সি।তারপর গাড়ীর গিয়ার চেঞ্জ করে পাকিং করে ট্যাক্সি । হ্যান্ড ব্রেক টেনে দেয়। ভাড়ার মিটার সাময়িক বন্ধ করে ঘুরে তাকায় জনের দিকে।
ক্রেডিট কার্ডটা বের করে দিয়ে জন জিজ্ঞেস করে How much ।
কার্ডটা হাতে নিয়ে বাবলু জানায় Thirty three dollars sixty five cents. ট্রানজেকশান কম্প্লিট করে পিছনে দিকে ঘুরে দেখে জন ডান হাতে ধরে আছে মানিব্যাগটাকে। ভিতরে ১০০ ডলারের অনেকগুলো নোট। বাবলু মনে মনে ভাবে ও এজন্য। নিশ্চই ভাল লাভ হচ্ছিল জুয়া খেলায়। বউ ডেকে নিয়ে আসাতে যত রাগ এখন ব্উ এর উপর।
আচমকা পঞ্চাশ ডলারের একটা নোট মানিব্যাগ থেকে বের করে এগিয়ে ধরে বাবলুর দিকে। Take this fifty dollars and drop her any where you like.
বাবলুর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা। বলে কি লোকটা। জুয়ার নেশায় স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে নাকি। বাবলু লারার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মলিন মুখ। তারপর জনকে জিজ্ঞেস করে “Are you serious”.
Yes I am. জন উত্তর দেয়।
বাবলূ বলে “Mate, I have no permission to interfere between you. If you permit I want to say something”.
No problem you can say. জন অনুমতি দেয়।
Why did she call you from the casino? I know the cause.
জন যেন আকাশ থেকে পড়ে। You know that cause!
Yes I know! বাবলূ উত্তর দেয়।
জন জানতে চায়। What is that cause?
The Cause is “She loves you so much and more than any others”
মুহূর্তের মধ্যে জনের সব রাগ কোথায় মিলিয়ে যায়। হো হো করে ফেটে পড়ে আট্টহাসিতে । লারা পাশের সিট থেকে বলে উঠে “ Thank you driver. Thank you. ডলারের নোটটা জন ফিরিয়ে নেয় নিজের মানিব্যাগে।দুজনেই নেমে পরে ট্যাক্সি থেকে।
বাবলু ট্যাক্সিটা একটু এগিয়ে ত্রিপয়েন্ট টার্ণ করে ফিরতে থাকে মুল রাস্তার দিয়ে। হঠাৎ ওর মনে হয় ধন্যবাদ দিয়ে ওদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হয় নাই। বাবলু গাড়িটা থামায় ওদের গ্যরেজের সামনে। ডান পাশের গ্লাসটা খুলে মুখ বাড়িয়ে দেয় Thank you বলার জন্য।
গ্যারেজের সামনে চলছে অট্টহাসিতে মিলিয়ে যাওয়া অনুরাগের দ্বিতীয় দৃশ্য। দুজনের প্রত্যেকে এক হাতে ধরে রেখেছে একটা করে বিনের হাতল অন্য দুই বাহুর বন্ধনে দুজন।আষ্ঠে পৃষ্ঠে বাধা। দুজনের ঠোঁট গভীর চুম্বনে।
দৃশ্যটা দেখে আর থ্যাঙ্ক ইউ টা আর দেয়া হয় না বাবলুর । মনে মনে ভাবে এখানে থ্যাঙ্ক ইউ টা বড়ই অতিরিক্ত। আস্তে করে একটু হর্ন বাজিয়ে শরিক হয় তাদের আনন্দে। তারপর গাড়ির গ্লাসটা বন্ধ করে রওনা দেয় পরবর্তি যাত্রীর উদ্দেশ্যে।

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test