E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

গল্প ।। ক্ষুধা

২০১৭ জানুয়ারি ১৫ ১৩:৪৪:৪১
গল্প ।। ক্ষুধা






 

দোলা আহমেদ
...................................................

প্রাচীন এক মফস্বল শহর।শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে উত্তাল পদ্মা।শহরের বুক ভাসিয়ে চলে গেছে এককালের চঞ্চলা ইছামতি নদী।আজ অবশ্য কোন নদীই তেমন উত্তাল নয়।ইছামতিকে তো এখন খালও বলা যাবে না।বদ্ধ জলাশয় ছাড়া আর কিছু না।পৌড় বাড়ি যেমন শ্রী হীন হয়ে পড়ে ঠিক তেমনই।পদ্মা সারা বছর থাকে রাশ রাশ বালু বুকে নিয়ে শুধু আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে ফিরে পায় তার ফেলে আসা হারানো যৌবনের কিছুটা ছোঁয়া। প্রাচীন শহরের সেই প্রাচীন রুপ নাই।নাই কোন খেলার মাঠ।নাই ফলের বাগান।কৃষি জমিও তেমন নাই এখনআর ; শুধু চারিদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর শপিং মল,বড় বড় দোকান পাট।সব কিছু অনেক দ্রুত পাল্টে গেছে।মানুষ তার সাথে পাল্লা দিয়ে পাল্টাচ্ছে।

এক সময় যাদের অনেক কিছু ছিলো তারা আজ নিঃস্ব প্রায়।এমন অনেক পরিবার আছে এই শহরের মাঝে।তবে এখনো তাদের সেই প্রাচীন বংশ মর্যাদা অক্ষুণ আছে।সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার যখন একে বারে নিঃস্ব হয়ে পরে তবুও তারা কারো কাছে হাত বাড়াতে পারে না।না খেয়ে থাকতে পারে তবু অন্যের দ্বারে যেতে পারে না।

এই শহরের প্রান কেন্দ্রে মামুনদের বাড়ী।আগে চারিপাশে অনেক খোলা জায়গা ছিলো কিন্তু এখন আর তেমন কিছু নাই শুধু বাড়ি-ঘর।এই বাড়ীতেই আজ সারা দিন নানা মানুষের আনাগোনা চলেছে।বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।নারী-পুরুষ বৃদ্ধা-যুবা,শিশু সবাই।মামুনের আব্বা মারা গেছেন।আজ ছিলো তাঁর খয়রাত।মুসলমান ধর্ম মতে মারা যাওয়ার ৪০ দিন পরে সাধ্যমত এলাকার পরিচিত মানুষদের,ফকির-কাঙ্গালদের এক বেলা পেট ভরে খাওয়াতে হয়।তারা তাই বড় একটা গরু কেটেছিলো ।অনেক মানুষ সেই দুপুর হতে আসছে এবং খেয়ে যাচ্ছে।কেউ কেউ আবার খাবার সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।

এখন সন্ধ্যা বেলা।মোটামুটি সব কাজ শেষ।মানুনের স্ত্রী সহ সব ভাই বোন তাদের পরিবার নিয়ে ঘরের মাঝে বসে নানা কথা বার্তা বলছে।সারা দিনের কাজটা কেমন হলো এই সব পারিবারিক আলাপ-আলোচনা।এরই মাঝে কেউ কেউ এখনো আসছে ।কেউ খাচ্ছে আবার কেউ বা শুধু দেখা করবার জন্য আসছেন।দুপুরের খাবার এখনো অনেক খানিই থেকে গেছে।মফস্বল শহরের এই একটা দিক সবাই সবার কাছের মানুষ।বিয়ে-শাদী বা এমন মৃত্যু অনুষ্ঠানে কাউকে না বললেও সে আসে।এতে সবাই খুশি হয়।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে।এমন সময় ওদের বাড়ীতে এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে ওদের পাড়ার এক ভাবী।সাথে তাঁর ছোট দুই ছেলে-মেয়ে।ঐ বাড়িতেই মামুন এক সময় কর্মচারির কাজ করতো।খুব বেশি দিন আগের কথা নয় ।প্রায় ১০/১২ বছর আগের কথা হবে।ঐ বাড়িটা ছিলো এক সময়ের মাঝে এই পাড়ার সব চেয়ে অবস্থা সম্পূর্ণ লোকের বাড়ী।শহরের মাঝে সবাই এক নামে জানতো চিনতো এই বাড়ির কর্তাকে।কি ছিলো না সেই বাড়ীতে!!বাড়ী-গাড়ী,চাকর-বাকর,কর্মচারি ,লজিং মাষ্টার সবই ছিলো।

সবে মাত্র যখন প্রথম ফ্রিজ-টিভি এলো এই শহরে তখন এই বাড়িতে ছিলো।কিন্তু কি দিয়ে যে কি হয়ে গেলো আজ আর কোন কিছুই নাই এই বাড়ীতে।বাড়ী বলতে এখন আর কিছুই নাই।শুধু কোন মতে মানুষ থাকবার সামান্য ব্যবস্থা। বাড়ির গৃহকর্তা অসুস্থ।ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোন ভাবে টিকে আছে।তবে একটা জিনিস এখনো আছে সেটা হলো সম্মান।।এলাকার সবাই এবাড়ীর মানুষকে অনেক শ্রদ্ধা-সম্মান করেন।করবেই না কেন !! আগে যখন তাদের সু-দিন ছিলো কারো বিপদে কখনো পিছু থাকে নাই ।কাউকে কোন দিন নিরাশ করে নাই।যেভাবে পেড়েছে মানুষের পাশে থেকেছেন।তাই তো এলাকার সবাই আজো সেই সম্মান দেয় স্বামী-স্ত্রী দুজনাকেই।এই মামুন ও তো বড় হয়েছে ওবাড়ীর অন্ন খেয়ে।আজ তার যে প্রতিষ্ঠা তার পেছনে এ বাড়ীর অবদান অনেক বেশি।সেই জন্য শুধু মামুন নয় ঐ ঘরের মাঝে আর যারা ছিলো তারা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের এই ভাবীকে দেখে।মামুনের ভাই-বোনেরা তাই সবাই বাহিরে ছুটে এলেন।ভাবী একা আসেন নাই।সাথে তার ছোট ২ ছেলে মেয়ে।তাঁর অবশ্য দু’টো সন্তান নয়।৩ ছেলে ২ মেয়ে।এই ছোট দুটোর বয়স হবে মেয়েটার ৯ আর ছেলেটার ৭বছর।

মানুনই প্রথম দেখেছিলো তাদের ভাবীকে।তাড়াতাড়ি উঠানে গিয়ে বড় যে বসবার ঘর, সেই ঘরের মাঝে নিয়ে এলো।ততক্ষণে আর সবাই বারান্দায় এসে গেছে।মামুনের সবার বড় বোনটা তার নাম মাকসুদা ।তিনি অবশ্য এই ভাবীর চেয়ে বয়সে অনেক বড়।তিনিই প্রথম বললেন
মাকসুদা: বৌ’মা এত দেরী করলে কেন?দুপুরে এলে কত ভাল লাগতো।পরিচিত অনেক মানুষ এসেছিলেন !তাও যে এসেছো তুমি সহ বাচ্চারা।অনেক ভাল লাগছে।আব্বা তোমাকে অনেক ভালবাসতেন।
ভাবী: বুবু সারা দিন কিভাবে আসবো?সংসারে কত কাজ।তার উপরে আপনার ভাইয়ের শরীটা তেমন একটা ভাল না।না এলে আপনারা আবার মন খারাপ করবেন তাই এলাম।তাও দেখেন কত রাত হয়ে গেছে।আপনাদের এখানে বলেই আসলাম সব কিছু তো আর বাদ দেওয়া যায় না।
মাকসুদা: ছেলে-মেয়ে দেখি কত বড় হয়ে গেছে !!কত দিন দেখি না।ওদের নিয়ে এসে আরো ভাল করেছো বৌ’মা।ভাই কেমন আছে এখন?আর ছেলে মেয়েরা?
ভাবী: আপনার ভাইয়ের শরীর তো আগেরই মত।ছেলে-মেয়েরা আছে এক রকম।
এই সময়ের মাঝে মামুনের বৌ এলো ভাবীর কাছে।সাথে ছোট একটা মেয়ে ।ভাবী এটা আমার মেয়ে মালতী।
ভাবী: বাহ! বেশ হয়েছে তো।এক দম মামুনের মতই হয়েছে।স্কুলে দিয়েছো?
মামুনের বৌ: না ভাবী এখনো দেই নাই।এই বার দিবো।

এই সব নানা ছোট খাটো কথা বার্তা চলছিলো।ভাবীর ছেলে-মেয়ে দুটো চুপচাপ তাদের মায়ের পাশে বসে ছিলো।এক দম চুপচাপ।জড়োসড়ো হয়ে।
এক জন বলে উঠলো পাশ থেকে, বাহ !! বাচ্চা’রা তো ভারী শান্ত।এমন দেখাই যায় না আজকাল।কিন্তু এত মন মরা কেন?মুখটা কেমন শুকনো শুকনো।
ভাবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন: সারা দিন ঘুমায় নাই।সেই জন্য হয়তো এমন লাগছে তাই বলে তার সন্তানের দিকে তাকালো।দুজনার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
মামুনের এক বোন তাদের নাম জিজ্ঞাসা করলো-মেয়েটা আস্তে করে বললো,চাঁপা
ছেলেটাও বোনেরই মত বললো,রাসেল।
ও দিকে পাশের ঘর হতে মামুন ডাকতে এলো ,ভাবী আসেন ।অল্প একটু খেয়ে নেন।
ভাবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,এই জন্যই আমি দিনের বেলা আসতে চাই নাই।তোমরা খাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করবে। আজ তো আবার না বলাটাও ভাল না।
বুবু এগুলো খাবারের হক তো আসলে দুস্থ কাঙ্গালদের।একদম গরীব দুঃখিদের।এগুলো আসলে তো ওদের হক।কি বলেন ?এই বলে তিনি মাকসুদা বুবুর দিকে তাকালেন, তাদের অতিথি ভাবী।

মাকসুদা বুবু: ঠিক বলেছো বৌ’মা।তবে আমরা যারা ঘরের মানুষ তারা তো আব্বার অনেক কাছের।আর তাছাড়া মামুন তো বড়ই হয়েছে তোমাদের ওখানে।তোমরা আমাদের অনেক আপন।তাই কিছু মনে করবে না।সবাই আমরা নিজের পরিবার ।
ভাবী: আমি শুধু এলাম আপনাদের দেখতে।আর তা ছাড়া চাচা মিঞার সাথে প্রায়ই দেখা হতো রাস্তায়।খুব মনে পড়ে। আমি একাই আসতাম কিন্তু ওরা বললো আমার যাবো তাই আর না বললাম না।
এই কথা গুলো বলতে বলতে ছেলে-মেয়েকে সাথে করে পাশের ঘরে গেলেন ভাবী।

খাবার টেবিলের পাশেই ছিলো দাঁড়িয়ে মানুনের স্ত্রী আর ওর ছোট ভাই মাসুমের স্ত্রী।পাশের ঘর থেকে মাকসুদা বুবুও এলেন তাদের সাথে সাথেই।হাত ধুয়ে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ভাবী বসলেন খাবার টেবিলে।
টেবিল ভরা খাবার।কত কিছু আজ ওরা রান্না করেছে।মাছ,মাংস,ডাল,সব্জী আর সাদা ধবধবে চিকন চালের ভাত।
সব কিছু দেখে কেমন জানি একটা মোচর দিলো এই ভাবী নামক অসহায় মানুষটার মনের মাঝে।তার মনের কথা শুধুই তিনি জানেন আর জানেন তার অন্তর্যামী।
রাসেল ছোট ।তাই তাকে তার মা বললেন ‘মাছ খাওয়ার দরকার নাই।তুমি মাংসই খাও।দেখো ভাতটা অনেক সুন্দর।সাদা ধবধবে চিকন চাল।লজ্জা করো না এখানে।পেট ভরে খাও।সবাই এখানে তোমার চাচা-ফুপু।আমাদেরই বাড়ীর মত –’

মেয়ের দিকেও তাকিয়ে বলতে লাগলো,কোন লজ্জা নাই তোমাদের এখানে।যা লাগে,যেটা খুশি পেট ভরে খাও।কোন দিন আসা হয় না তাতে কি? সবাই আপন জন এখানে।
মেয়েকে বললেন ভাবী,মাংসাটা বেশী করেনে।দেখ কি সুন্দর হয়েছে।
কে রান্না করেছে মামুন? বললেন ভাবী।
নওশের চাচা।
নওশের বাবুর্চি এই শহরের মাঝে সব চেয়ে নাম করা।এক নামে সবাই চেনে।
ও তাই এমন ভাল হয়েছে রান্নাটা।এমন সুন্দর ঘ্রাণ।বললেন ভাবী।
ওদিকে মামুনের স্ত্রী বললো,ভাবী আপনি তো কিছুই নেন নাই।মাংস না নিয়েই শুধু বলছেন।কখন থেকে দেখতে পাচ্ছি শুধু ডাল দিয়ে ভাত মাখছেন কিন্তু মুখে দিচ্ছে না।
মাসুমের বৌ তাড়াতাড়ি করে মাংসের বাটিটা নিয়ে এলো।
তাড়াতাড়ি বাঁধা দিলেন ভাবী,না রে বৌ’মা আমার ডাল দিয়েই ভাল লাগছে।
এই বার মাকসুদা বুবু মাছ নিয়ে এলেন ভাবীর পাতে তুলে দিবেন তাই।
তাড়াতাড়ি ভাবী বললেন, বুবু দেবেন না।আমার পেট ভরা ।এখন খাওয়ার সময় না কি!!অবেলায় খেয়েছি তাই আর পারছি না।মাছ-মাংস খেতে পারবো না।এই ডালটাই অনেকভাল লাগছে।তাই তো এটাই খেলাম।মনে হচ্ছে কত দিন পরে খেলাম।এই বলতে বলেতে তার কন্ঠটা ধরে এলো।আর কোন কথা বলতে পারলেন না তাদের এই ভাবী।আস্তে করে উঠে চলে গেলেন হাত ধুতে।

কিভাবেই বা তিনি আর সবার সামনে শক্ত হয়ে কথা বলবেন।আর কতক্ষণ করবেন এদের সামনে ভাল থাকবার অভিনয়?বাড়ীতে পেট ভরে মিথ্যা খাওয়ার গল্প আর কতক্ষণ করবে এই অসহায় মানুষটা।আর কত ক্ষণ!!

ঘরে তার অভূক্ত অসুস্থ স্বামী।অন্য ছেলে ও মেয়ে।সেই গত কাল সারা দিন পরে রাতের বেলা একটা হাড়ির মাঝে সামান্য চাল আর ডাল দিয়ে কোন রকমে সেদ্ধ করে মুঠো মুঠো খেয়েছে এই মানুষ গুলো।তার পর থেকে আর কারো পেটে পানি ছাড়া আর কিছুই পড়ে নাই সারাদিনে।সারা দিনে অনেক চেষ্টা করেছে বড় ছেলেটা কিন্তু কোন কিছু জোগাড় করতে পারে নাই ।বড় ছেলেটা অবশ্য রাতে যেভাবেই হোক কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই।এই ছোট দুটোকে কিভাবে আর না খাইয়ে রাখবে তাদের মা।এই মাছুমরা আর কত কষ্ট সহ্য করবে?
সারাদিন বাচ্চা দুটো কিছুই খায় নাই।তাই তো ওদের জন্য আজ আসা এই খয়রাত বাড়িতে।মাছ-মাংস তারা কেউ খেতে পারে নাই।ছোট হলে কি হবে ওরা তো জানে শুধু ওদের পেটা তো নয়।ওদের বাবা-ভাই-বোন সবাই উপোস আছে।তাই তো তারা সবাই শুধু ডাল আর ভাত দিয়ে এ দিনের চরম ক্ষুধা নিবারণ করলো ।

তাদের মনের কষ্টটা শুধু তারা নিজেরা জানে আর জানলো রাতের অন্ধকার।কারণ -এইবাড়ি হতে আসবার সময় আর কেউ কোন কথা বলে নাই।নিরব ভাবেই সবাই চলে এসেছে তাদের কাছে বিদায় নিয়ে !








(ডিএ/এস/জানুয়ারি ১৫, ২০১৭)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test