E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মাসুম বিল্লাহ’র অণুগল্প

২০১৭ জুলাই ১১ ১১:২৬:১০
মাসুম বিল্লাহ’র অণুগল্প







 

একটা দুপুর মরে গেল

আবিরের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল ইরা। আবিরের চিবুক ছোঁয় ইরার সিঁথি। বিয়ের এত বছর বাদেও কী রকম একটা অনুভূতি হয় আবিরের শরীরে, কেমন একটা কাঁপন লাগে। এ সময় তার কাঁচাপাকা দাড়ি ভর্তি গালে ইরা হাত রাখল। আবির জানে ইরা এখন কী বলবে!—তুমি দাড়ি কাটো না ক্যান?
আবির প্রতিবার আলসেমির কথা বলে। আজ চুপ করে রইল। দুপুরে এক চামচ ভাত বেশি দিয়ে ফেলেছে ইরা, শরীর কেমন ভার হয়ে অছে। তার এক অভ্যাস দুপুরে ভাতঘুম নয়ত বিছানায় খানিকটা সময় গড়াগড়ি দিতে হবে।
ইরা আবিরের গালে হাত রেখেই বলল— কত দিন এভাবে ঘরে বসে কাটাবে?
হঠাৎ চমকে ওঠল আবির। কিছু বলল না।
ইরা মিহি স্বরে আবার বলল—কোনো একটা কাজ-কর্ম কর, এটা তো ভালো দেখায় না, তাছাড়া মেয়েও বড় হয়েছে, ভালো-মন্দ সবি তো বোঝে।... চুপ করে আছ যে?
আবিরের বুক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। তার গলার ভেতর শুকিয়ে কথা আটকে রইল। সে জানে, এখন কথা বলতে গেলে কথা জড়িয়ে যাবে, তাকেও অসহায়ের মত দেখাবে, ইরার চোখের দিকে তাঁকাতে পারবে না!... সে ইরার কোনো দোষ দেখে না, বরং বাইরের মানুষ দোষ দিতে ছাড়ে না, বলে—ইরার অতিরিক্ত ভালোবাসা, প্রশ্রয়, আহলাদ পেয়ে আবির একেবারে মগডালে বসে নিশ্চিন্তে পা নাচাচ্ছে। আবির নিজেও এ সব বোঝে, পুরুষ মানুষের এভাবে কাজকর্ম ছেড়ে ঘরে গা-ঝাড়া হয়ে বসে থাকা মানায় না। সত্যি তো সুফলা এখন ছোট্টটি নেই আর। ছোট্ট সুফলা একবার বলেছিল—ও বাবা, তুমি আমাদের বাসার সামনে একটা দোকান দাও—ফুচকার দোকান! তাহলে আমাকে আর বাইরের দোকান থেকে ফুচকা কিনে খাওয়া লাগবে না।
আবির মেয়ের কথায় সায় দিয়ে বলেছিল—বাবা তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি!
সেদিন ছোট্ট মেয়ে তার বাবার পরাজিত মুখ দেখতে পায়নি।
এরপর আরো অনেক দিন আবিরকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে—এক মাসে বাসাভাড়া ঠিক সময়ে দিতে পারেনি বলে বাড়িঅলা আধপাগলা ছেলে আবিরকে যাচ্ছেতাই কথা শুনিয়েছিল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেদিন অসহায় হয়ে সব হজম করতে হয়েছিল। রাগ ঝেড়েছিল মনে মনে—বাড়িঅলারা একটু ফকির কিসিমেরই হয়, ভাড়াটিয়ার টাকায় তো সংসার চলে!
আজ দুপুরটা রৌদ্দুর ভরা। আকাশ নীল। পেঁজা তুলার মতো মেঘ ছড়িয়ে ছটিয়ে আছে। অলস দুপুর পাড়ি দেওয়ার সব প্রস্তুতি যখন শেষ তখনই ইরা আবিরের এড়িয়ে চলা প্রসঙ্গটা আদরভরা স্বরে তুলল। আবির বুঝল ভাতঘুম হচ্ছে না আজ। সে ইরার ছোড়া তীর সামলানোর মানসিক প্রস্তুতি নিল। আবিরকে চুপ করে থাকতে দেখে ইরা তাকে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল—কি পাথর হয়ে গেলে নাকি?
—আমি নিরিহ মানুষ, আমি কী বলবো?
প্রসঙ্গ হালকা করতে চাইল আবির।
—এ ছেলে বলে কী! অবাক হয় ইরা। পুরুষ মানুষ কাজ না করে কতদিন ঘরে বসে থাকতে পারে? তোমারে অনেক অাহ্লাদ দিছি—আর না—সংসার চালানোর দায়িত্ব তোমার, আমি আর নেই...
—কাজ করতে ইচ্ছে করে না, ইরু।
—দুনিয়ার আর কোনো দিকে খেয়াল না দিয়ে শুধু লেখালেখি করতে ইচ্ছে করে তোমার, না?
—না আরও ইচ্ছে করে—ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে, সারাক্ষণ তোমার আশেপাশে থাকতে ইচ্ছে করে, চেয়ে চেয়ে তোমাকে দেখত ইচ্ছে করে!... আর...
—বুড়ো কালে এত ঢং কোথা থেকে আসে তোমার?
—এন্ড্রু দার গানটা শোনোনি—চুল পাকিলে লোকে হয় না...
—সব সময় এমন হেয়ালি ভালো লাগে না, আচ্ছা, মেয়েটার সামনেও তোমার শরম লাগে না?
—নিজের মেয়ের কাছে শরম কী? ও আমার আপন মেয়ে, পর হলেও না হয় একটা কথা ছিল!
—নাক ফাটিয়ে দেবো, এই একদম শয়তানি করবে না বলে দিচ্ছি...
—আমি সিরিয়াস, তুমি কী বলবে, বলো, ইরা...
—তুমি কি জানো বাজারের চালের কেজি কত, ডিমের হালি কত?
—আমি জানি না, তুমি জানো, ইরা?
—আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলো তো, তোমার গল্পের চরিত্ররাও কী তোমার মতো এমন—সংসারধর্ম নেই, বাজারে যায় না, চাল-ডাল-নুনের দাম জানে না? —সিনেমা-নাটকে আমরা কী দেখি—নায়িকা টয়লেটে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে, নায়ক বাজারের ব্যাগ নিয়ে মাছের কেজি কত শুনছে...বুঝলে ইরা, বাজার-সদাই খুবই ঝামেলা কাজ, কী দরকার ঝামেলায় জড়ানো, কয়দিনের দুনিয়া বলো!...তাই আমার লেখার চরিত্রদের আমি একটু শান্তিতে বসবাসের সুযোগ দিচ্ছি, লেখকের এই তো ক্ষমতা, স্বাধীনতা!
—আসছে আমরা ক্ষমতাঅলা, যে-না আমার লেখক তার আবার ক্ষমতা! তোমারে কেউ লেখক বলে গোনে? কই কখনো তো দেখলাম না, তোমার একটা লেখা ছাপা হতে, না কখনো লেখা নিয়ে কেউ ১০টাকা হাতে দিতে...এ সব ভুজুংভাজুং ছাড়ো, কাজেকর্মে নামো, তা না-হলে তোমার মাথা ফাটাবো আমি—
বলে দিলাম...
—আমার লেখা তোমার কাছে ভুজুংভাজুং! লেখক আবার নতুন করে কি কাজ করবে, তার তো কাজ একটাই—লেখা, লেখালেখি করা, মাথার মধ্যে লেখা নিয়ে চিন্তা করা...
—দুনিয়ায় কি আর কোনো লেখক নেই? তারা চাকরি করছে না? ব্যবসা করছে না? তারা পারলে তুমি পারবে না কেন?
—সবাই কি সব পারে? পৃথিবীর একজন না-পারলে ক্ষতি কী?
—পৃথিবীর ক্ষতি না-থাকলেও আমার আছে, আমার সন্তানে আছে...
—ইরা, আসো, আমরা পৃথিবীটাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে আজকের দুপুরটাকে উপভোগ করি...
—আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাকে কয় জায়গায় গিয়ে কয়টা বাচ্চা পড়াতে হয়—তুমি জানো? এক মুহূর্ত দম ফেলার সুযোগ পাই না...
আবির কিছু বলার সুযোগ পেল না। ইরা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আবির মনে মনে বলল—একটা দুপুর মরে গেল, ইরা!
আবিরের চোখ জলে ভ'রে এল।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test