E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মুস্তাফিজ শফি’র গল্প

২০১৭ সেপ্টেম্বর ২০ ১৮:৩৭:০০
মুস্তাফিজ শফি’র গল্প







 

কাচকি মাছ ও নীল ঘাসফুল

‘কাচকি মাছ, তোমার কি আজ মন খারাপ?’
‘তাহলে কথা বলছ না কেন?’
‘এই কাচকি মাছ তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?’
‘এ্যাই... এ্যাই...!’

থেমে থেমে প্রশ্নগুলো করে গেলেও কাচকি মাছ সাড়াশব্দ করে না। নীল ঘাসফুল এবার ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুম হয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। ভোর দেখার জন্য এই জায়গাটি খুবই আকর্ষণীয়। দেবদারু, আম আর কামরাঙ্গা- সামনের তিনটি গাছ এখানে একটি শান্তি শান্তি ভাব এনে দিয়েছে। তার কাছে এখানকার ছোট্ট দোলনাটি একান্তই প্রিয়। বাসা করার জন্য চড়ুই পাখিগুলোর নিস্ফল আসা-যাওয়া দেখতে দেখতে মিস্ত্রি ডেকে বারান্দার দেয়ালের সঙ্গে ছোট ছোট কয়েকটি বাক্স বানিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে সে কয়েক মাস আগে- শুধু চড়ুই দম্পতি নয়, এক শালিক দম্পতিও এখানে একটি বাক্সে বাসা বানিয়ে সংসার পেতেছে। ওদের ওড়াওড়ি, প্রেম, আবার মাঝে মাঝে খুঁনসুটি- বেশ ভালোই লাগে তার।

একবার ঘরে ঢুকে আটকে গিয়েছিল একটি চড়ুই। বারান্দায় তার সঙ্গীটার তখন সে কী চেঁচামেচি। যেনো পুরো বাড়িটাই মাতিয়ে তুলছিল। পাখির ভাষা জানলে নিশ্চয় জোর দিয়ে বলা যেত এটা চেঁচামেচি নয়, কান্না, হাহাকার। মানুষ যেমন করে তার একান্ত প্রিয়জনের জন্য।

অনেক চেষ্টায় পাখিটিকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার পর সঙ্গীটার যে আনন্দ সেটাও কিন্তু স্পষ্ট বুঝা যায়। ওদের আনন্দিত আচরণ আর ঠোঁটে ঠোঁট ঘষাঘষিও সেদিন প্রত্যক্ষ করেছে ঘাসফুল।

আজকেও বারান্দায় আসতেই চড়ুইগুলো বেশ চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। বোধ হয় বক্সে নতুন বাচ্চা ফুটেছে। ঘাসফুলের অবশ্য এই চেঁচামেচি খারাপ লাগে না। সে দোলনায় বসে পাখিদের শুনিয়ে শুনিয়েই কাচকি মাছের সঙ্গে কথা বলে যেতে থাকে।

চড়ুইগুলো বেশ নির্লজ্জ, ওরা যে কারো সামনেই ভালোবাসাবাসি শুরু করে দেয়। আর ওদের দেখে ঘাসফুল শুধু ভেতরে ভেতরে হিংসায় মরে। ওর কাচকি মাছ এরকম হতে পারে না কেন?

‘দেখে নিও, আমরাও একদিন পাখি হয়ে যাব। বাবুই পখির মত আমাদের একটি আকর্ষণীয় বাসা থাকবে, নিজেদের বোনা। আমি ডিম পাড়ব, তারপর দুজন মিলে তা দেব। ফুটফুটে দুটো বাচ্চা হবে আমাদের। খাবারও সংগ্রহ করে আনব দু’জন।’

চারতলার বারান্দা থেকে সামনের রাস্তাটিকে অন্য রকম লাগে। ভোরের শান্ত পরিবেশ থাকবে আরও কিছুক্ষণ। তারপর শুরু হবে জীবনের চলাচল। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে ঢাকার রাস্তায়ও মানুষ এখন রীতিমতো দৌড়ায়। সবচেয়ে ভালো লাগে পোশাককর্মীরা যখন দলবেঁধে একসঙ্গে কর্মস্থলের দিকে ছুটতে থাকে। তখন মনে হয়, এদের হাত ধরেই জীবনের গতি পেয়েছে বাংলাদেশ।

নির্মাণাধীন একটি দোতলা বাড়ি আছে ও-পাশে। এই ভোরে সেখানকার ছাদে ওরা কারা। বোঝা যাচ্ছে আলিঙ্গনরত দু’জন মানবমানবী। আহারে ওদের কি ঘর নেই? ঘাসফুলের খুব কষ্ট হয়। ছাদগুলোতে একই সঙ্গে এরকম কতো স্মৃতি থাকে- প্রেমের, আলিঙ্গনের এমনকি আত্মহত্যার বা খুনেরও। সে চোখ ঘুরিয়ে নেয়। বেশিক্ষণ তাকানো যায় না ওদিকে। সে যে দেখছে ওরা নিশ্চয় সেটা বুঝতে পারছে না।

রিয়াকে এক সময় নীল ঘাসফুল বলে ডাকত সোহেল। তখন সে নিজেকে নুইয়ে রাখা মৌণ তৃণই ছিল। আর সোহেল কবে থেকে কাচকি মাছ? রবীন্দ্রনাথ ঘাসফুলের খুব প্রিয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সে রবীন্দ্রচেতনা ধারণ করার চেষ্টা করে। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত। প্রেম, বিরহ, উৎসব, পূজা সব গানই যেনো তার উদ্দেশ্যে লিখে গেছেন গুরুদেব। তিনি বেঁচে থাকলে ঠিকই সে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াত।

‘তুমি এমন করে আমায় বোঝ কীভাবে। তুমি কি জানতে তোমার গানের বার্তার প্রতিভূ হয়ে আমি আসব, আসবই কোনকালে।’

উত্তরে গুরুদেব কী বলতেন সেটা আন্দাজ করতে পারে না ঘাসফুল। তবে নিশ্চয় তিনি স্মিত হাসতেন। আচ্ছা আগেকার আমলের কোন মনীষীরই হাসির কোন ছবি নেই কেন? তাহলে তারা কি হাসতেন না, সব সময়ই ছবির মত গম্ভীর হয়ে বসে থাকতেন? ভেবে পায় না রিয়া। গুরুদেবের একটি ঝলমলে হাসির ছবি দেখতে ইচ্ছে হয় তার।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ওদের মধ্যে প্রায়ই আলোচনা হয়। এক্ষেত্রে ওরা দু’জন মোটামুটি গবেষকই হয়ে ওঠেছে বলা যায়।

‘এখানেই রবীন্দ্রনাথের স্বার্থকতা। একান্ত আপনার হয়েও নানা জনের হয়ে উঠেন তিনি।’ বলে যায় সোহেল। এই সময়ের আলোচিত কবি সোহেল কায়সার। তাকেও ঘাসফুল মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করে বসে। সে বিব্রত হয়, হাসে, আর ঘাসফুলের দিকেই নত হয়ে আসে বারবার।

‘বিশাল রবীন্দ্ররাজ্যে আমি তো এককণা ধূলিমাত্র। তিনি যদি তিমি হন, তাহলে আমি সর্বোচ্চ কাচকি মাছ।’

অতি উৎসাহের সঙ্গে সোহেলের ‘কাচকি মাছ’ শব্দটি লুফে নেয় ঘাসফুল- ‘‘তোমাকে আমি আপাতত এ নামেই ডাকব। তবে কিছুদিনের মধ্যেই কাচকি বদল, তখন তোমার নাম হয়ে যাবে তিমি মাছ। তুমি কি সেটা টের পাচ্ছ? তোমাকেও রবীন্দ্রনাথের মত তিমি মাছের শক্তি অর্জন করতে হবে কবি। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ তোমাকে নিয়েও এভাবে আলোচনা করে যাবে কেউ কেউ। তোমার লেখা পাবে চিরন্তন সাহিত্যের রূপ।’’

ঘাসফুলের একটা ছোট্ট বারান্দা ছিল আগে থেকেই। দোলনাটি সেখানেই ছিল। কাচকি মাছই এটা তাকে দিয়েছিল কোন এক জন্মদিনে। নীলক্ষেতের পরিচিত জগত ছেড়ে সে যখন উত্তরায় ভিন্ন পরিবেশে আসে তখনও এই দোলনা আর কাচকি মাছ ছাড়া অন্যকিছু তার সঙ্গী হয়নি।

আচ্ছা কাচকি মাছ আজ গেল কোথায়, সাড়া দিচ্ছে না কেন? কবিতায় কীসব লিখছে সে আজকাল।

‘এমন বৃষ্টির রাতে কান্নার শব্দ শুনতে শুনতে
একদিন মরে যাব আমি।
শিয়রে পড়ে থাকবে তোমার হাতপাখা,
কুঁড়েঘরে মাটির সোদাগন্ধ,
বারান্দায় শীতলপাটি,
ওপাশে বেলিফুলের ঝোঁপ।’

এটাতো ঘাসফুলেরই একান্ত নিজের কথা। কাচকি মাছ সেটা লিখবে কেন। এ ধরনের কবিতা পড়তে গেলে মনটা কেমন ভারি হয়ে আসে। কবিতার একেবারে শেষে লিখেছে সে-

‘...পারোতো লিখে রেখ এপিটাফ-
জমা-খরচের খাতায় রেখে যেতে কিছু ঋণ,
ঝরাপাতা হবে বলে সেও এসেছিল একদিন।’
‘কাচকি মাছ শুনছ? এই কবিতা কিন্তু আমার। এটা তুমি আমার এপিটাফে লিখে দিও। দিও কিন্তু।’
এবার সাড়া দেয় কাচকি মাছ।
‘সে আবার কি? এটাতো আমি তোমার কাছে দিয়ে যাব আমার এপিটাফে লিখবে বলে। আমিতো তোমার আগেই যাব।’
‘না না আমিই যাব আগে। ওই যে একদিন বাজি ধরেছিলাম না? সেটাতে আমিই জিতব। প্রতিবার তোমার কাছে হারি। শেষ বাজিতে আর হারব না।’

‘তুমি আর কোন দিন আমাকে এটা বলবে না। তোমার কাছে আমার মৃত্যুঞ্জয়ী টিপটা আছে না। সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর রাতে যেটা আমি তোমাকে পরিয়ে দিয়েছিলাম। কই, ডাক্তারতো তোমাকে ছয় মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল তুমি কি পেরেছ যেতে? হিসাব করে দেখ দেড় বছর চলে। দেখে নিও তোমার ওই হাতুড়ে ডাক্তারের কথা মিথ্যে প্রমাণিত হবে। অন্তত; আমার আগেতো তুমি যাবেই না।’

ঘাসফুল এবার চুপ হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। প্রতিটা মানুষের ভেতরেই অন্তর্গত এক হাহাকার থাকে। কেউ কেউ নিজেই ঢুকতে পারে না তার গভীরে। আসলেই কি সে তার হাহাকার ছুতে পারে? কে বলে পায়নি সে কাচকি মাছকে? সেতো সব সময়ই তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘুর ঘুর করে আশেপাশে। এখনও যত কবিতা ওর প্রকাশিত হয় তার বেশিরভাগ জুড়েই আছে সে।

ঘোরের মধ্যে ঘাসফুল একে একে আবৃত্তি করতে থাকে প্রিয় কবি সোহেল কায়সারের কবিতা। তার কাচকি মাছের কবিতা-

‘...মায়া তো মায়াই, যতো দূরে যায়, ততো তার দীর্ঘ হয় ছায়া’
কিংবা
‘...বিষণ্নতার কাছে এরকম ফিরে আসার নামই ইতিহাস
আমি সেই ইতিহাসের কাছে বারবার ফিরে আসি।’
কিংবা
‘মাঝে মাঝে শুনি কেউ নাম ধরে ডাকে
প্রিয় ডাক নাম,
মনে রেখ সেই ডাক নামটিরে...’

কাচকি মাছকে সে কী শুধু মনে রেখেছে? না, সঙ্গেও রখেছে। সেই কাচকি মাছের সঙ্গেই তার ওঠাবসা এবং চলাফেরা। সে আছে কাচকি মাছের দীর্ঘ ছায়ার ভেতরেই। কেউ টের না পেলেও এক অন্যরকম প্রভাবে কাচকি মাছ তাকে আগলে রাখে। এগিয়েও দেয় সামনে।

এইতো সেদিন সন্ধ্যায় ক্লাবে গান শুনতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে সে। নীল শাড়িতে ওকে মানায় ভালো। পরেছেও তাই। কিন্তু ভুলে গেছে টিপটা দিতে। দরজা খুলে ল্যান্ডিংয়ে পা রাখতেই আগলে দাঁড়ায় কাচকি মাছ।

‘আরে আরে করেছ কী? টিপ কোথায়? এটা ছাড়া কি তোমাকে মানায়?’

সত্যিইতো টিপ ছাড়া ওকে মানায় না। সে ঘরে ফিরে নীল টিপ কপালে লাগিয়ে আবার কাচকি মাছের সামনে দাঁড়ায়।
‘এবার হলো তো?’
‘না আরেকটা জিনিস বাকি আছে। চলো সামনের ফুলের দোকান থেকে তোমাকে বেলি ফুলের মালা কিনে দেব।’

এক গাদা ওষুধ খেতে হয় তার। ডাক্তার বলেছেন খালি পেটে খাওয়া যাবে না কোনভাবেই। কিন্তু সেতো খাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন। যেদিনই খালি পেটে ওষুধ খেতে যাবে সেদিনই চোখ বড় বড় করে তাকায় কাচকি মাছ।
‘খবরদার খালি পেটে খাবে না কিন্তু।’
চোখের চাহনী দেখেই তখন করণীয় বুঝে যায় ঘাসফুল।

‘কাচকি মাছ, তুমি কি জানো মায়ের চাকরি আগামী মাসেই শেষ? নীলক্ষেতের বাসাটি ছেড়ে দিতে হবে। চলো একবার যাই সেই বারান্দায়, যেখানে কতদিন আমরা দু’জন বসেছি মুখোমুখি। তোমার সেই দোলনাটিও যেখানে প্রথম রেখেছিলাম। বাসাটি ছেড়ে দেওয়ার আগে চলো একটু বসি গিয়ে সেখানটায়। যেখানে লেপ্টে আছে আমাদের অনেক স্মৃতি। ডাক্তার বলেছে, রেস্ট নিতে হবে, অনেক রেস্ট। ওরা আমাকে যেতে দেবে না। তুমি আমাকে জোর করে নিয়ে যাও। এই কাচকি মাছ, শুনছ না কেন? অ্যাই, আ্যই।’

সাজ্জাদও এবার জেগে উঠেছে। পাশ ফিরেই দেখে বিছানায় রিয়া নেই। ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর পরও এতো ভোরে উঠে গেছে। গেল কোথায়? খুঁজতে খুঁজতে সেও বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

‘তোমাকে ডাক্তার বলেছে বেড রেস্টে থাকতে আর তুমি কি না এখানে বসে আছো।’

‘এখানেই বসতে আমার বেশি ভালো লাগে যে। ঘুম ভেঙে গেলে কি করব, কত আর বিছানায় শুয়ে থাকা যায়? প্লিজ তুমি যাও। আমি আসব একটু পরে।’

সাজ্জাদ বুঝতে পারে একগুয়ে স্বভাবের রিয়াকে তার ইচ্ছার বাইরে এখান থেকে ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। আর কোনো কথা না বলে সে বরং ভেতরে চলে যায়।

সাজ্জাদ সামনে থাকলে রিয়া বরাবরই তার কাচকি মাছকে হারিয়ে ফেলে। ও চলে যাওয়ার পরই সে আবার ডাকতে শুরু করে।

‘কাচকি মাছ তুমি কোথায়? এই কাচকি মাছ। শুনছো না কেন? এ্যাই এ্যাই...।’

কোনো সাড়া মেলে না কোথাও। কাচকি মাছ কি শুনতে পাচ্ছে ঘাসফুলের এই ডাক? হারিয়ে যাওয়া কাচকি মাছরা কি আসলেই এইসব ডাক শুনতে পায়?


পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test