E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মিরাজের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়

২০২২ ডিসেম্বর ০৫ ০০:৫৭:৪০
মিরাজের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয়

স্পোর্টস ডেস্ক : ১৩৬ রানের মাথায় পড়েছে ৯ম উইকেট। তখনও প্রয়োজন ৫১ রান। উইকেটে মেহেদী হাসান মিরাজ। সঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান। এমন ম্যাচও বাংলাদেশ হেরে যাবে ভারতের কাছে? কিন্তু চিত্রনাট্যের তখনও পাঞ্চলাইন যে বাকি! বিস্ময়কেও যা হার মানিয়ে যাওয়ার মতো।

মেহেদী হাসান মিরাজ যে বিস্ময়কর ব্যাটিং করলেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মোস্তাফিজুর রহমানকে নন-স্ট্রাইক প্রান্তে রেখে সিঙ্গেল না নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে জয়ী করে মাঠ ছাড়ার মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং একজন খেলোয়াড় যখন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে এভাবে খেলতে পারে, তখন ভারতের মত দলেরও কিছু করার থাকে না।

এর মধ্যে লোকেশ রাহুল ফেলে দিয়েছিলেন মিরাজের একটি ক্যাচ। ম্যাচের মোড়ও ঘুরে গিয়েছিলো তখন বলা যায়। এরপর মিরাজ খেললেন অতিমানবীয় ইনিংস এবং যোগ্য সঙ্গ দিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।

সে সঙ্গে ইতিহাসের সেরা একটি ম্যাচ জয় করে নিলো বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে ১ উইকেটের এই জয়টি লেখা হয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়।

৩৯ বল খেলে মিরাজের করা ৩৮ রানের ইনিংসটি শত সেঞ্চুরির চেয়েও মূল্যবান। যেখানে বাংলাদেশের হার প্রায় নিশ্চিত। শার্দুল ঠাকুর, মোহাম্মদ সিরাজ, দিপক চাহার, কুলদিপ সেন, শাহবাজ আহমেদ কিংবা ওয়াশিংটন সুন্দরদের দিয়ে একের পর বোলিং করে মিরাজ-মোস্তাফিজের উইকেট ভাঙার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছেন রোহিত শর্মা।

শেষ দিকে যখন বোলাররা ব্যর্থ হচ্ছিলেন এবং মিরাজ ও মোস্তাফিজ একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছিলেন, তখন হতাশায় রোহিত শর্মার চেহারা হয়েছিলো দেখার মত। যেন কেঁদে ফেলবেন। বিরাট কোহলিকেও দেখা গেলো বেশ হতাশাগ্রস্থ। ১৮৬ রান করেও ম্যাচটিতে নিশ্চিত জয় পাচ্ছিলেন যখন, তখন এভাবে বাঁক বদলে গেলে কার মাথা ঠিক থাকে, বলুন!

মুশফিকুর রহিম যখন আউট হয়েছিলেন, তখন মাঠে নামেন মিরাজ। এরপর একে একে আফিফ হোসেন ধ্রুব, এবাদত হোসেন এবং হাসান মাহমুদকে আউট হতে দেখলেন। ১২৮ থেকে ১৩৬- এই ৮ রানের ব্যবধানে বাংলাদেশের ৫ উইকেটের পতন ঘটে। তখনও জয় থেকে ৫১ রান দুরে বাংলাদেশ।

অতিবড় বাংলাদেশ সমর্থকও তখন দুঃস্বপ্নে বিশ্বাস করার কথা নয় যে, বাংলাদেশ জিতবে। ভারতীয় বোলার আর ফিল্ডাররা যেভাবে বাংলাদেশকে চেপে ধরেছে, তাতে জয় পাওয়া তো স্বপ্নেরই ব্যাপার টাইগারদের জন্য।

এমন পরিস্থিতিতে জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নেন মিরাজ। মোস্তাফিজকে নন স্ট্রাইকপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে রেখে দেন শুধু উইকেটটা টিকিয়ে রাখার জন্য। মনে হচ্ছিল, এমন এক গর্তের কিনারায় দাঁড়িয়ে মিরাজ- যেন একটু টোকা লাগলেই পতন ঘটবে।

এমন অবস্থায় কুলদিপ সেনকে এক ওভারে দুটি ছক্কা মেরেই ম্যাচের গতি বদলে দেন। পিন পতন নিরব হয়ে যাওয়া মিরপুরের গ্যালারিতে প্রাণের সঞ্চার করেন। পরের ওভারে মোহাম্মদ সিরাজ ছিলেন বোলার। তাকে কোনো রান না নিয়েই কাটিয়ে দিলেন। শুধু চতুর্থ বলটিকে এক রান নিয়ে প্রান্ত বদল করে নিয়েছিলেন। এছাড়া সিঙ্গেল-ডাবলসের সুযোগ পেলেও মিরাজ উইকেট থেকে নড়েননি।

৪৩তম ওভারেই শার্দুল ঠাকুরের একটি বলকে আকাশে তুলে দেন মিরাজ। ক্যাচটি ধরতে যান লোকেশ রাহুল। হাতে গ্লাভস। মিস হওয়ারই কথা নয়। ভাগ্য ভালো মিরাজের। বলটি তালুতে গেলো না। হাতের কব্জির অংশের দিকে আঘাত করে পড়ে গেলো মাটিতে। বেঁচে গেলেন মিরাজ। তখনও বাংলাদেশের প্রয়োজন ৩২ রান।

এরপরের ওভারেই দিপক চাহারকে তিনটি বাউন্ডারি মারেন তিনি। মোট নিলেন ১৫ রান। পরের ওভারে শার্দুল ঠাকুরকে বাউন্ডারি মারেন মোস্তাফিজুরও। যেন ব্যাটিং করার নেশায় পেয়ে বসেছে তখন মিরাজ এবং মোস্তাফিজকে।

শেষ ৫ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন হয় বাংলাদেশের ৮ রান। দিপক চাহারের কাছ থেকেই (৪৬তম ওভারে) ৮ রান নিয়ে নিলেন মিরাজ এবং মোস্তাফিজ। ৫১ রানের অবিশ্বাস্য এবং অবিচ্ছেদ্য এক জুটি গড়ে জিতিয়ে দিলেন বাংলাদেশকে। হাতে তখনও বাকি পুরোপুরি ৬টি ওভার (২৪ বল)।

১৮৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে প্রথম বলেই উইকেট বিলিয়ে দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। দীপক চাহারের করা ইনিংসের প্রথম বলেই স্লিপে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন সাজঘরে। এরপর ১৪ রান করে বিদায় নেন এনামুল হক বিজয়। ২৯ বলে খেলেন তিনি এই ইনিংসটিত। মোহাম্মদ সিরাজের বলে মিডউইকেটে ক্যাচ তুলে দেন ওয়াশিংটন সুন্দরের হাতে।

২৬ রানে ২ উইকেট পড়ার পর বাংলাদশে দলের বিপর্যয় রক্ষা করার জন্য ভালোভাবেই হাল ধরেছিলেন অধিনায়ক লিটন দাস এবং সিনিয়র ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। ৪৮ রানের জুটিও গড়ে তোলেন তারা; কিন্তু ভালো খেলতে খেলতে হঠাৎ করেই উইকেট দিয়ে বসলেন অধিনায়ক লিটন দাস। বাংলাদেশ দলের রান তখন ১৯.২ ওভারে ৭৪। ৪১ রান নিয়ে ব্যাট করছিলেন লিটন।

২০তম ওভারে বল করছিলেন ওয়াশিংটন সুন্দর। ওভারের দ্বিতীয় বলটিকে ফাইন লেগে গ্লান্স করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বলটি ছিল স্লোয়ার এবং হালকা টার্ন করেছিল। যে কারণে বল ব্যাট ছুঁয়ে গিয়ে জমা পড়ে উইকেটের পেছনে লোকেশ রাহুলের হাতে। আউট হয়ে যান লিটন দাস।

এরপর সাকিব এবং মুশফিক মিলে জুটি বাধেন। কিন্তু জুটিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেনি বিরাট কোহলির এক অসাধারণ ক্যাচের কারণে। ২৪তম ওভারের তৃতীয় বলে সেই ওয়াশিংটন সুন্দরের স্লোয়ারে ধরা খেয়ে গেলেন সাকিব।

বোলারকে ভালোভাবে বুঝতে পারেননি সাকিব। তিনি বলটিকে ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন। এক্সট্রা কভাবে কোহলি ঝাঁপিয়ে পড়ে এক হাতে ক্যাচটি তালুবন্দী করেন। এ ধরনের ক্যাচ ম্যাচের চিত্রও বদলে দিতে পারে। ভারত কী তবে কামব্যাক করলো ম্যাচে! ৩৮ বলে ২৯ রান করে আউট হন তিনি।

বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং শক্তি মিডল অর্ডার। তিন সিনিয়র সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম এবং মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই তিন ব্যাটারের ওপর ভর করেই বাংলাদেশ অনেক দুর যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। এই তিন সিনিয়রের কাছ থেকে বড় কোনো ইনিংস বেরিয়ে এলো না। উল্টো কম রানে আউট হয়ে তারা বাংলাদেশ দলকেই বিপদে ফেলে দিলেন। সবচেয়ে বাজে বিষয় হলো দুই অভিজ্ঞ ব্যাটার পরপর দুই বলে আউট হয়ে গেছেন। তাদের আউট হওয়ার পর বিপদেই পড়ছে বাংলাদেশ।

৪৫ বল খেলে ১৮ রান করেছেন মুশফিকুর রহিম। উইকেটে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও মোহাম্মদ সিরাজের বলে বোল্ড হয়েছেন নিজের ব্যাটে কানায় বল লাগিয়ে। তার আগেই আউট হয়েছে তার ভায়রা ভাই মাহমদুউল্লাহ রিয়াদ। ৩৫ বলে শাদুল ঠাকুরের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে যান ১৪ রানে। ১২৮ রানের মাথায় আউট হয়েছেন দুই ভায়রা ভাই।

১৩৪ রানের মধ্যে পড়ে ৭ম উইকেটও। আফিফ হোসেন ধ্রুব ১২ বলে ৬ রান করে আউট হয়ে গেছেন তিনি। ১৩৬ রানের মধ্যে আউট হন এবাদত হোসেনে এবং হাসান মাহমুদও। এরপরই রূপকথা লেখেন মিরাজ এবং মোস্তাফিজ।

এর আগে সাকিব আল হাসান আর এবাদত হোসেনের বোলিং তোপে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপ। ৪১.২ ওভারে ১৮৬ রানেই গুটিয়ে যায় রোহিত শর্মার দল। সর্বোচ্চ ৭৩ রান করেন লোকেশ রাহুল। সাকিব আল হাসান ৩৬ রানে নেন ৫ উইকেট এবং এবাদত হোসেন ৮.২ ওভার করে নেন ৪ উইকেট। বাকি উইকেটটি নেন মেহেদী হাসান মিরাজ।

(ওএস/এএস/ডিসেম্বর ০৫, ২০২২)

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test