E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান আহসান জহির আর নেই

২০১৪ ডিসেম্বর ০৬ ১৮:৪১:২৯
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান আহসান জহির আর নেই

স্পোর্টস ডেস্ক, ঢাকা : বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান আহসান জহির মারা গেছেন। প্রতিটি প্রথমের সাথেই জুড়ে থাকে বিশেষ মাহাত্ব্য। প্রথম কীর্তীর সাথে যে কোনোভাবেই অন্য কিছুর তুলনা চলে না। বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলার ইতিহাস খুব দীর্ঘ না হলেও খুব ছোটও নয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বধীন হলেও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে প্রথমবারের মতো পেশাদার ক্রিকেট লিগ চালু হয় ১৯৭৩-৭৪ মৌসুমে। সেবার অসমাপ্ত ঢাকা ক্রিকেট লিগে শতক হাঁকাতে পারেনি কোনো ব্যাটসম্যানই। পরের বারও শতকবিহীন কেটেছে ঢাকা ক্রিকেট লিগ। তবে ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট চাম্পিয়নশিপে সবটুকু আলো নিজের উপর কেড়ে নেন বরিশালের ডানহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান আহমেদ জহির। সেবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচে কুমিল্লার বিপক্ষে ১০০ রানের ইতিহাস গড়া শতক হাঁকান আহসান জহির। এরপর থেকে প্রতিবছরই একাধিক সেঞ্চুরি দেখেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট। কিন্তু প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করে রেখেছেন এই কৃতি ক্রিকেটার।  বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় রেকর্ডকৃত সেই সেঞ্চুরিটিই হয়ে আছে ইতহাসের অংশ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখন ক্রিকেট খেলা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয়। দেশে তখন ক্রিকেট সরঞ্জামের প্রকট অভাব। নেই পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। সাথে ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়ার ঝুঁকিও। সব মিলিয়ে এক প্রতিকূল পরিবেশে ক্রিকেট খেলা না যেন যুদ্ধ জয়। ঠিক সে সময়ই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরিশালের হয়ে ব্যাট হাতে নেমে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনাল খেলা দেখতে আসা হাজার হাজার দর্শককে বিমোহিত করেন। এক কথায় সেটা ছিলো অভাবনীয়। জাতীয় ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলতে আসাটা তার কাছে ছিলো এলাম-দেখলাম-জয়করলাম ঠিক এরকম। একবার ভেবে দেখুন ফাইনালের মতো ম্যাচে সেঞ্চুরি তাও আবার দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম হিসেবে রেকর্ড বইয়ে ঠাই পাওয়া ইনিংস। যার মাহাত্ব্য সত্যিকার অর্তেই একটু বেশি।

ক্রিকেটে জহিরের হাতেখরি ভাইদের কাছ থেকেই। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানি ক্রিকেট কোচ মাস্টার আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোচিং দেয়ার সময় জহিরের স্ট্রেট ব্যাটের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়ে বলেন- বাচ্চা, তোমার স্ট্রেট ব্যাটের ব্যাটিং দেখে বলতে পারি তোমাকে আউট করা যেকোনো বোলারের জন্য বেশ কঠিন হবে। এখানে বেশির ভাগ ব্যাটস্যোনেরই ক্রস ব্যাটে খেলার প্রবণতা বেশি। সেই কোচ জহিরকে বলেছিলেন তুমি যদি দেখে শুনে হেড ডাউন করে খেলো তুমি অনেক রান পাবে। বাধ্য ছত্রের মতো পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে কোচের দেওয়া পরমর্শ অনুযায়ী ব্যাটিং করে গেছেন জহির। ফলটাও পেয়েছিলেন হাতে নাতেই।

তার সেঞ্চুরির মাহাত্ব্য আরও বেড়ে যায় যখন জানবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন কুমিল্লা ছিলো সবচেয়ে শক্তিশালি দল। সেখানে স্বমহিমায় আলো ছড়িয়ে সব বাঘা বাঘা বোলারদেরকে হতাশ করে হয়ে যান ইতিহাসের অংশ। কারণ নিজের প্রতিভা ও ব্যাটিং দক্ষতায় জহিরের কোনো সংশয় ছিলোনা। তবে প্রতিপক্ষের সেরা বোলারদের তোপের মুখে শুরুতে কিছুটা নার্ভাস থাকলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে খোলস ছেড়ে বেরিয়েছিলেন। বিশেষ করে প্রথম বাউন্ডারিটা মারার পর থেকেই নার্ভাসনেস গায়েব। আর সাথে সাথে মনে ভর করেছিলো গভীর আত্মবিশ্বাস। ডাবল ফিগারে পৌছাতেই জহিরের মনে হলো ফাস্ট বল , সুইং কিংবা স্পিন কোনোটাই খেলতে সামান্যতম অসুবিধাও হচ্ছে না। হাজার হাজার দর্শকদের সামনেই খেলে চলেছেন প্রপার ক্রিকেটিং শট। ট্রেডমার্ক স্ট্রেইট ড্রাইভ, স্কয়ার কাট, কাভার ড্রাইভ, পুল, হুক। বলে রাখা ভালো ওই লিগেই তিনি দেখিয়েছিলেন কিভাবে ফাস্ট বোলারদের শর্ট বলে পুল ও হুক করতে হয়। পুল ও হুক শটে তিনি ছিলেন মাস্টার। দেখতে দেখতে অর্ধশতক হয়ে গেল। এরপর যেন রান করাটাকে সহজতর কোনো কাজে পরিণত করলেন। দেখতে দেখতে নার্ভাস নাইনটিজ এর ঘরে। এবার এলো সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত। প্রায় দশ হাজার দর্শকের সামনে শতরানের মাইলফলকে পৌঁছালেন। দর্শকদের কড়তালিতে মুখোরিত হয়ে উঠল পুরো পল্টন এলাকা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে করলেন ইতিহাস গড়া সেই অবিস্মরনীয় সেঞ্চরি। তবে সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে সেঞ্চুরিকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো আহসান জহিরের সাবলিল ভঙ্গিমা। যেন তিনি আগে থেকেই জানতেন নিজের মতো খেলতে পারলে সেঞ্চুরি হবেই। একেই বলে আত্মবিশ্বাস। ২০৭ মিনিটে এক ডজন বাউন্ডারিতে ১০০ রানের ইনিংসটি ছিলো নয়নাভিরাম। প্রতিটি শটই ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লেগে ঠিকরে বেড়িয়ে যাচ্ছিলো।

বরিশালের ছেলে, ঢাকায় বেড়ে ওঠা, ময়মনসিংহে ক্রিকেট পাঠ পাওয়া আহসান জহিরের কাছে ১৯৭৫ সালের ১৩ মার্চ যেন অলৌকিক একদিন বলে মনে হয়েছিলো। জহির জীবনে কখনো এ দনটির কথা ভুলবেন না। এ কথা না বললেই নয় রেকর্ড কিংবা ইতিহাসের পাতায় ঠাই পেতে যতটুকু ভাগ্যের সহায়তা প্রয়োজন তার সবটুকুই পেয়েছিলেন আহসান জহির। কারণ আহসান জহিরে আগেই প্রথম সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটিতে প্রায় নিজের করে নিয়েছিলেন আবাহনীর সে সময়কার অধিনায়ক আলিউল ইসলাম। কিন্তু বিধাতার নৈকট্য যে বরাদ্দ ছিলো আহসান জহিরের জন্য। তানাহলে দু ওভার বাকি থাকতেও তাকে ৯৯ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়তে হবে? এক্ষেত্রে অবশ্য বোলারদের নেতিবাচক বোলিংও কম দায়ী নয়।

আসলে আসাধরণ কোনো কিছু করতে গেলে ভাগ্যের সহায়তা লাগেই। সেটি পেয়েছিলেন বলেই আজ ইতিহাসের পাতায় আহসান জহির। রেকর্ড গড়া সেই দিনটির কথা মনে হলেই কিছুটা আনমনে হয়ে যান এই কিংবদন্তী। হওয়াটাই যে স্বাভাবিক। এই একটি ইনিংসই যে তাকে অমরত্ব দান করেছে। যতদিন থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ঠিক ততদিনই টিকে থাকবে অহসান জহিরের বীরত্বগাথা।

প্রথম জাতীয় ক্রিকেটের ফাইনালের আগের ম্যাচেও দলের পক্ষে সর্বোচ্ছ ৪২ রান করেছিলেন জহির। ফাইনালে আহসান জহিরের এ ইনিংস দেখে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব তাকে ১৯৭৫-৭৬ মৌসুমে তাদের দলে খেলায়। ময়মনসিংহ লিগে শিকল গোষ্ঠির হয়ে সিরাজ মেমোরিয়ালের হয়ে ১৯৭৬-৭৭ সালে সেঞ্চুরি (১১২) এবং পরে ঢাকা লিগে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিংয়ের উদিতির বিরুদ্ধে ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমেও (১০১) সেঞ্চুরি করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও লাভ করেন সম্মানসূচক ‘ব্লু’ উপাধি। ব্যাক্তিগত জীবনে আহসান জহির ওরিয়েন্টাল এজেন্সিজ ও সিলভার এন্টারপ্রাইজের চিফ এক্সিকিউটিভ। তার ছোট ভাই আহসান জাকির বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব পদে অধিষ্ঠিত। তিনিও ঢাকা ও চট্ট্রগ্রাম লিগে দীর্ঘদিন সুনামের সাথে ক্রিকেট খেলেছেন। আরেক ভাই আহসান নাজির আবাহনী ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।


(ওএস/পি/ডিসেম্বর ০৬, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

১৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test