E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আতিথেয়তা

২০১৭ অক্টোবর ১৯ ১৮:২০:৩৮
পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আতিথেয়তা

চৌধুরী আবদুল হান্নান


গত ৯ অক্টোবর সমকালে ‘কবে এসেছ, কবে যাবে?’ (লেখক, নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত) শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়েছে।

‘বুঝতে পারছি, তুমি দুপুরে খেয়ে যাবে না, তবে পরবর্তীতে এলে অবশ্যই খেয়ে যেতেই হবে তোমাকে’- পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাসায় আগত অতিথির প্রতি গৃহকর্তার এমন উক্তিকে উপজীব্য করে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আতিথেয়তার বিষয়ে আমাদের একটি নেতিবাচক ধারনা ও বিশ্বাস জন্ম লাভ করেছে। তা থেকে ভিন্ন ও বিপরীত একটি অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আমি তাড়া অনুভব করছি।

৯০ এর দশকের শেষ দিকে দশ বছরের মেয়ের জরুরী চিকিৎসার জন্য কোলকাতায় যেতে হয়েছিল। সাথী হয়েছিলেন অপূর্ব কুন্ডু নামে এক বন্ধু। তিনি মাগুরার ব্যবসায়ী। তার মেয়ে অপর্নার বিয়ে হয়েছে কোলকাতা সেই সুবাদে মাঝে মাঝে তার কোলকাতায় যাওয়া আসা। কোলকাতায় অবস্থানকালে তার জামাই সোমনাথ আমাদের সম্পূর্ন গাইডেন্স সাপোর্ট দিয়েছে।

ওদের রাসবিহারী এ্যভেনিউ এর বাড়ির কাছাকাছি একটি হোটেলে আমরা ছিলাম। তবে অধিকাংশ সময় খাওয়া-দাওয়ার পর্ব তাদের বাসায় এক টেবিলে এক পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথেই হতো। এতে তাদের বিরল এক উচ্চ মানবিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

ডাক্তার দেখানোর জন্য সিটি মেডিকেল সেন্টারে যথারীতি মেয়েকে নিয়ে লাইনে দাড়িয়েছি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে ডেকে নিয়ে সম্মানের সাথে আলাদা বসতে দিলেন।

বিনয়ী ডাক্তার প্রথমে কুশল বিনিময় করে ঢাকার পূর্বের প্রেসক্রিপশন দেখে বললেন, ‘অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ খাওয়ার ফলে মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা হয়ে থাকতে পারে। এমনিতেই সেরে যাবে। অযথাই ভয় পেয়েছেন।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবার ফুরফুরে মেজাজে দর্শনীয় স্থান দেখার পালা।
পরদিন সোমনাথ নিজে গাড়ি চালিয়ে হোটেলে এসে বললো, ‘কাকা অন্তরাকে ডাকুন, চলুন হাওড়া ব্রীজ দেখে আসবেন।’

পরের দিন তাদের পারিবারিক ড্রাইভার দিয়ে ইকোপার্ক, সাইন্স সিটিসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখানোর ব্যবস্থা করলো। কোলকাতায় অবস্থানকালে ঈদুল আজহার ঈদ ছিল। ঈদের দিন পারিবারিক পরিবেশ ছেড়ে আনন্দহীন আমরা দু’জনে হোটেলেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি সোমনাথ টিফিন বক্সে করে পোলাও আর মুরগির রোস্ট নিয়ে হাজির। মেয়ের মুখের নিরানন্দ দূর করে আনন্দে ভরে দিল। আগের দিন অপর্না কৌশলে জেনে নিয়েছিল ঈদের দিন মুসলিমদের মূল খাবার কি।

এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বা কেবল একটি পরিবারেরই ঘটনা ভাবা যায় না বরং এটাই সামগ্রিক চিত্র। ওদের আতিথেয়তার বিষয়ে প্রচলিত বিশ্বাস সত্য নয়। রসালো প্রচারনা মাত্র।
ওপার বাংলার মানুষের আতিথেয়তার ক্ষেত্রে এপার বাংলার মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারনা কীভাবে বদ্ধমূল হলো সে মনস্তত্ত্ব এক গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে দুটি কারণ এথানে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে আমার বিশ্বাস।

‘ভারত আমাদের শত্রু, ওরা পূর্ব পাকিস্তানকে দখল করে নিয়ে যাবে’- বাজ্ঞালিদের শাসন -শোষন করার কুট কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের ২৪ বছর যাবৎ এরুপ প্রচারনা প্রতিবেশী দেশের প্রতি ক্ষোভ আর ঘৃনরা জন্ম দিয়েছে। এ মনোভাব আজও অনেকেই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

৭১ সালে হিন্দু-মুসলমান এক কোটি শরনার্থী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়ে তাদের সামাজিক অবস্থার ওপর এক বিরুপ চাপ সৃষ্টি করেছিল, বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরাট একটি সচেতন অংশ আছেন যারা ৪৭ সালে জন্মভূমি ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন। আর এপাড়ে রয়ে গেছে তাদের শিকড় এবং স্বজনেরা। দ্বিজাতি-তত্তে¡র ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তান তাদের নয়-এমন ভাবনা থেকেই দেশত্যাগ।

শরনার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে তাদেও পুরনো স্ব-জাতি আত্মীয়দের খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হবে, তা খুবই স্বভাবিক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আত্মীয় শরনার্থীদের অতিথির মত সমাদর করা অসম্ভব ছিল। অসময়ের একাধিক অতিথির আগমনে গৃহকর্তা যদি বলেই ফেলেন ‘... পরবর্তীতে এলে অবশ্যই খেয়ে যাবেন’ তা অস্বাভাবিক থাকে না। যুদ্ধকালীন সময়ে কোনো কিছুই স্বাভাবিক থাকে না। অতিথি আপ্যায়নের এ জাতীয় হালকা কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে মুখে মুখে। রসালো কথা দ্রুত প্রচার পায়, হয়েছেও তাই। তবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বেশি সচেতন। বলা হয় ওরা আজ যা ভাবে ভারতবর্ষের অন্যরা আগামীকাল তা ভাবে।

আতিথ্যের ঘাটতির বেদনা ভুলে যদি বিপদে আশ্রয় দেয়ার আনন্দ মনে রাখা যেত তা হলে এতদিনে প্রতিবেশীর প্রতি বিরুপ ধারনা পাল্টে যেত।

বিদায়ের দিন সময়মত ট্রেন ধরার সুবিদার্থে সোমনাথ আমাদেও শিয়ালদহ রেল ষ্টেশনে পৌঁছে দিল, সাথে অন্তরার জন্য বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের বই ‘সন্দেশ’ সহ অনেকগুলো শিশুতোষ বই ।
আমরা ভালোটা আকড়ে ধরবো, চর্চা করবো তা যত অল্পই হোক কিন্তু মন্দটা নয়, কোনো ভাবেই নয়।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test