E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

'বাংলাদেশে ধর্মানুভূতির আগুনে পুড়ছে সংখ্যালঘুর কপাল'

২০১৭ নভেম্বর ১১ ১৫:২৭:৪৫
'বাংলাদেশে ধর্মানুভূতির আগুনে পুড়ছে সংখ্যালঘুর কপাল'

শিতাংশু গুহ


নাসিরনগর ঘটনার বর্ষপূর্তি হলো রংপুরে। ঘটনা একই, সেই ফেইসবুক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, হাজারো তৌহিদী জনতার হিন্দু বাড়ী আক্রমণ, জ্বালাও-পোড়াও, লুট, শ্লীলতাহানি, এবং ভিকটিমদের আহাজারী। তবে এবার পুলিশের গুলিতে একজন মরেছে। হয়তো পুলিশ হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরো মারাত্মক হতে পারতো। ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার, জুম্মার পর। দেখতে হবে ইমাম সাহেবরা উস্কানী দিয়েছেন কিনা? সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ। ভুয়া ধর্মীয় অনুভূতির বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে পুরো বাংলাদেশ এগিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া ছুটে গিয়েছেন। এবার দেখার পালা রংপুরে সবাই ছুটে যান কিনা? দেশবাসী এই জ্বালাও-পোড়াও এর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে কিনা? না পড়লে বুঝতে হবে, 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়'? এটাও বোঝা হয়ে যাবে, রামু, নাসিরনগর বা রংপুর-ই আজকের বাংলাদেশ! কিছু ধর্মান্ধ উগ্রপন্থীর অনুভূতির দৌরাত্মে অন্যরা দেশান্তরী হচ্ছে। হনুমানের লেজের আগুনে লঙ্কা পুড়েছিলো, বাংলাদেশে ধর্মানুভূতির আগুনে পুড়ছে সংখ্যালঘুর কপাল।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু একটি অসহায় নাম। দেশ স্বাধীন, সংখ্যালঘুরা স্বাধীন নন। কারণ, দেশে 'সবার মাথা, মাথা; কিন্তু সংখ্যালঘুর মাথা অন্যের লাঠি মারার জায়গা'। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শুধু মোল্লাদের লাগে, অন্যদের তা লাগতে নেই? মিডিয়ায় রংপুরের সংবাদ ও ছবিতে ছয়লাপ। ফটো সাংবাদিক মইনুল হোসেনের তোলা এক বৃদ্ধার আহাজারির ছবিটি হৃদয় বিদারক। পেছনে দাউ দাউ করে বাড়ীঘর পুড়ছে, বৃদ্ধা মাথায় হাত দিয়ে বিলাপ করছেন? ফেইসবুকে একজন লিখেছেন, 'মা, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হেরে গেছে। নাসিরনগর, রামু, সাঁথিয়া বলে দিচ্ছে এদেশ তোমার নয়'? কেন বারবার ধর্মানুভূতির অজুহাতে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হচ্ছে, এ প্রশ্ন অবান্তর। কুমিল্লায় জনৈক হাবিবুর রহমান পবিত্র কোরানের অবমাননা করেছিলো, তার বাড়িঘর কেন পুড়েনি, সেটাও বিবেচ্য নয়? প্রশ্ন হলো, আর কত ঘটনা ঘটলে, দেশবাসী বুঝবেন যে, ধর্মকে ব্যবহার করে এটা একটি লাভজনক ব্যবসা এবং একটি সম্প্রদায়কে দেশ থেকে বিতাড়নের পায়তারা? বব ডিলানের সেই বিখ্যাত গানের অনুকরণে বলা যায়, 'আর কত বাড়ীঘর পুড়লে আমরা বুঝবো যে, সত্যিই হিন্দু কপাল পুড়ছে'?

রংপুরের ঘটনার দায় অবশ্যই প্রশাসনের। কিন্তু শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে না দিয়ে রাজনীতিকদের এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মানুভূতি নুতন কোন ব্যাধি নয়, এটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে নূতন আঙ্গিকে। সেটা শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত থেকে উত্তম, রসরাজ বা এমনতর আরো অনেক দৃষ্টান্ত আছে। কোনটার সত্যতাই মেলেনি। রংপুরেও মিলবে না, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই তোড়জোড় করুন না কেন? বাংলাদেশ আইটি ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। টিটু রায়, অর্থাৎ যে আইডি প্রোফাইল থেকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ উঠেছে সেটা যে ভুয়া তা বের করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়? আমাদের স্মার্ট তরুণরা ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে সেটা উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুলে গেছেন, ওনার আমলে এমত অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে, কোনটারই বিচার হয়নি, পুলিশ হয়তো চার্জশিটই দেয়নি। নাসিরনগরে অভিযুক্তরা সবাই জামিনে মুক্ত। রামু, নন্দীরহাট, অভয়নগর কোনটারই বিচার হয়নি। এমনকি ২০০১-এর অত্যাচারেরও বিচার হয়নি! ছেলেবেলায় দোকানে লেখা দেখতাম, 'বাকি চাহিয়া লজ্জা দেবেন না'? এখন একইভাবে বলা যায়, 'সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার চাহিয়া লজ্জা দেবেন না'?

রংপুরের ঘটনার জের নাকি চট্টগ্রামেও পড়েছে। সেখানে ঐতিহ্যবাহী 'সাঁধুর মিষ্টির দোকান' শুক্রবার লুটপাট হয়েছে, কর্মচারীদের মারপিট করা হয়েছে, এমনকি দোকানের সাইনবোর্ড পর্যন্ত পাল্টে গেছে। 'সাঁধুর মিষ্টির দোকান' হয়েছে, 'সাইট ফর শাহ্জালাল প্রপার্টিজ লিঃ'। প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, কোতয়ালী থানার পঞ্চাশ গজ দূরে হিন্দুবাবুর দোকানের সাইনবোর্ড, শেয়ার-টেবিল দুমড়ে-মুচড়ে বাইরে ফেলে দেয়া হয়েছে। দোকানে রাজভোগ, রসমালাই, মিষ্টি গড়াগড়ি খাচ্ছে থানার সামনের রাস্তায়। মালিক-কর্মচারীদের বেধড়ক মার্ দিয়ে টেনে-হেঁচড়ে বের করে সেখানে লাগানো হয়েছে তিনটি বড়বড় তালা। সামনে থানা থাকলেও এতে পুলিশের অনুভূতিতে আঘাত লাগার কোন খবর পাওয়া যায়নি? তবে ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, টিটু রায় যাতে ভারতে পালতে না পারে তাই সীমান্তে রেড-এলার্ট জারি করা হয়েছে। সাবাস। এক সামান্য টিটো রায়কে ধরার জন্যে এত তোড়জোড়, অথচ যে হাজারো জনতা মিছিল করে হিন্দুপল্লী আক্রমণ করলো, তাদের বিরুদ্ধে তিনি কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন তা কিন্তু আমরা জানলাম না?

রংপুরে এই ঘটনা ঘটলো ১০ই নভেম্বর ২০১৭। অথচ এইদিনে গণতন্ত্রের জন্যে প্রাণ দিয়েছিলো নূর হোসেন। নূর হোসেন উদাম গায়ে পিঠে 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক' লিখে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। পুলিশের গুলীতে ২৬ বছরের তরুণ নূর হোসেন সেদিন নিহত হন। তখন যে সাংবাদিকরা সেখানে ছিলেন তাদের মতে, অন্তত: আমাদের সিটি এডিটর তোজাম্মেল আলী অফিসে এসে বলেছিলেন, 'ঐ লেখার জন্যে তাকে টার্গেট করে হত্যা করা হয়'। রওশন এরশাদ অবশ্য বলেছেন, 'এরশাদ নন, আন্দোলকারীরাই নূর হোসেনকে হত্যা করেছে'।, তিনি কারণও বলেছেন, তারমতে, লাশ হলে আন্দোলন জমে? নূর হোসেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্মরণীয় শহীদ। কিন্তু যে গণতন্ত্রের জন্যে নূর হোসেন প্রাণ দিয়েছেন সেই গণতন্ত্র এখনো বাংলাদেশে 'সোনার হরিণ'। গণতন্ত্র থাকলে, এবং সকল নাগরিকের সমান অধিকার থাকলে দেশে বারবার নাসিরনগর-রংপুর ঘটনা ঘটতে পারেনা। বিচারহীনতা এবং প্রশাসনিক উদাসীনতা এজন্যে বহুলাংশে দায়ী। এ ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলছে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে আর যাই হোক, বড়াই করা চলেনা?

লেখক : কলাম লেখক, নিউইয়র্ক।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test