E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ভোট ব্যাংকের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

২০১৪ জুলাই ০২ ২২:৪৯:০৮
ভোট ব্যাংকের ভবিষ্যৎ রাজনীতি

বিজন সরকার : ভারতে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়লাভ ও সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের দীর্ঘ দিনের ধারনায় ছেদ পড়েছে। মোদীকে ভোট দিয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরাও।

কংগ্রেসের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক চেতনার পোশাকটি মানুষ পরতে চায়নি। গুজরাটের কলঙ্কিত ভূমিকা থাকা স্বত্বেও লুফে নিয়েছে মোদীর উন্নয়নের শ্লোগানটি। ভারতের স্বাধীনতার মালিকানা দাবিদার প্রাচীন দল কংগ্রেসের দুর্নীতি-বান্ধব নীতিই কংগ্রেসের ভরাডুবির কারণ। তাদের এই নীতিই ভারতের উদার জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশকে বিজেপির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের ধারনাটি প্রথাগতভাবে কাজ করেনি। পশ্চিম বঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সিপিএমের দীর্ঘদিনের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি পুরোটাই দখলে নিয়েছে। বাংলাদেশের সাথে মমতার তিস্তা পানি চুক্তির অনীহার অন্যতম কারণ গুলোর একটি হল সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক। কারণ তিস্তার পাড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর আশি ভাগই মুসলমান। এই জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বাইরে গিয়ে মমতা তিস্তা পানি চুক্তিতে সম্মতি দেয়া ভোটের রাজনীতি বিচারে প্রায় অসম্ভব। ঠিক একই কারণে মমতা দৃশ্যত মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির সাথে দূরত্ব বজায় রাখছে।

বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ভোগ করে আসলেও আস্তে আস্তে ভোট ব্যাংকটির প্রতি তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার তাৎপর্যপূর্ণ প্রবণতা ও ইঙ্গিত প্রতীয়মান হচ্ছে। বিএনপি, জামাতসহ দেশের উগ্র ধর্মীয় দল ও গোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের জন্য দায়ী করা হলেও (বহুলাংশে সত্য) গত আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের সময় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার বিচার হওয়া তো দূরের কথা, সঠিকভাবে একটি মামলা পর্যন্ত হয়নি। শত শত মন্দির ভাঙ্গা হলেও কাঊকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তা জানা নেই।

সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে সারা দেশব্যাপী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর মাসব্যাপী হামলা হলেও সরকার দৃশ্যত নীরব ছিল। বরং এই ইস্যুটি কাজে লাগিয়ে বিশ্বের কাছে বিএনপি-জামায়াত শক্তির উগ্রতা মার্কেটিং করেছে দক্ষতার সাথে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে রক্ষায় রাষ্ট্রকে অনেকটা নির্লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। সরকার অসহায় ছিল কিনা তা বোঝা না গেলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার রাজনৈতিক ফলাফল মহাজোট সরকার যে নিয়েছিল তা স্পষ্ট।

রাজনৈতিক দলগুলো দেশের সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের আশ্বাস ও মাল্টি-কালার স্বপ্ন দেখিয়ে পেন্ডুলামের মতো এদিক সেদিক ঘুরিয়ে মারছে। প্রতিটি দলই বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সুশাসন, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও ক্ষমতায় এসেই তা বেমালুম ভুলে যায়। তাদের আসল চরিত্র প্রকাশ পায়।

বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় ভবন-কেন্দ্রিক দুর্নীতি, জঙ্গি বান্ধব রাজনীতি, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন করে দেশ ত্যাগে সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থানে রাষ্ট্রের কৌশলগত ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। ঠিক তেমনি বিগত মহাজোট সরকারের শাসনকালে সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তি বর্গের শেয়ারবাজার ও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট, সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের লাগামহীন দুর্নীতি, ধর্মীয় চরমবাদের সাথে গোপনে আঁতাত করা, সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড দেশের মানুষকে অসহায় করে তুলেছিল।

আগে দেখা যেত যে, রাজনৈতিক নেতারা সন্ত্রাসীদের লালন পালন করত। কিন্তু এই প্রজন্মে এসে দেখা গেল, রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতাদের ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিবর্গকে মাসোয়ারা দিয়ে লালন পালন করছে। আর দেশের জনগণের বিশাল একটি অংশ এই রাজনীতির প্রতি বিমুখ। সুশাসন, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাবেই ধর্ম ঘেঁষা রাজনীতি বিকল্প হিসাবে আসছে। ফলে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম নিয়ে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ রাজনীতি না করার কোন বিকল্প হাতে থাকছে না।

স্বাধীনতাত্তোর দেশের শাসন ব্যবস্থা থাকা সরকারগুলো নিজেদেরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মানুষের ধর্মভীরুতাকে পুঁজি করে। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। ৯০ পূর্ববর্তী সরকার গুলোতে ধর্মীয় দলগুলি সহায়ক শক্তি হিসাবে থাকলেও আস্তে আস্তে এরা শাসন ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণের অনেক ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখছে। জামায়াত-শিবির ২০০১ সালে শুধু সরকারে নয়, সরকারের আদর্শিক পথ প্রদর্শক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

সদ্য অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া উপজেলা পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন বাধা থাকা স্বত্বেও জামায়াতে ইসলামের সাফল্যের পিছনের কারণ গুলো কারো অজানা নয়। ভোটের হিসাবে জামায়াত শিবিরের কচ্ছপের মতো পথচলা যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোটের সমান্তরাল মুখি সেই পরিসংখ্যানটা যেমনটা উদ্বেগের, তেমনি রাজনৈতিক মেরুকরণের। ধর্মীয় গোষ্ঠীর জনসমর্থন যে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা শুধু উপজেলা নির্বাচনই নয়, হেফাজতের মহা সমাবেশেও সেটি দিবালোকের মতো সত্য।

ভারতে বিজেপির উত্থানের প্রভাব বাংলাদেশের ধর্মভীরু মানুষের মননকে পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ধর্ম ভিত্তিক দলগুলো ব্যবহার করবে। প্রতিবেশী দেশের ধর্মীয় উগ্রতা যেমন ভারতের সাধারণ উদার মানুষকে বিজেপিমুখী করেছে, ঠিক একই পরিবর্তনের কাঠামোতে বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা চেতনার রূপান্তর ঘটবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আজ যদি দেশের ভেতরে প্রয়োজন মাফিক সুশাসন ও রাজনৈতিক সততা থাকত, অন্তত বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির রমরমা ব্যবসা প্রসারণের সম্ভাবনা থাকত না।

ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতিতে ভোট ব্যাংকের নতুন নতুন হিসাব হবে। যখনই একটি প্রতিযোগিতা পূর্ণ নির্বাচন দেশের মানুষের সামনে আসবে, তখনইভোটের সমীকরণের বহুমাত্রিক মেরুকরণ তৈরি হবে। ধর্মীয় দলগুলোর উর্ধমুখি ভোটের চেয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিন্মমুখি ভোটের কদর্য বাস্তব প্রেক্ষাপটে অতীতের মতো থাকবে না। মধ্য ডানপন্থীর পাশাপাশি উদারপন্থী দলগুলোর নির্ভরশীলতা ধর্মীয় দলগুলোর ভোট ব্যাংকের দিকে যাবে তা প্রায় হলফ করেই বলা যায়।

লেখক :গবেষক ও কলামিস্ট।

চন্নাম ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, সাউথ কোরিয়া।
Email: [email protected]

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test