E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

রাজনীতিকদের স্বপ্ন প্রসঙ্গে

২০১৮ মে ১৭ ১৯:২১:১৫
রাজনীতিকদের স্বপ্ন প্রসঙ্গে

প্রবীর বিকাশ সরকার


 

কোনো কোনো উৎস থেকে জানতে পারি ১৯৪৩ সালে যখন সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানি থেকে পালিয়ে জাপানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য অনেকদিন প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল।

সুভাষচন্দ্র বসু বিপ্লবী সেনাবাহিনীর প্রধান হলেও আদতে রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিকামী স্বাপ্নিক ছিলেন। রাজনীতিবিদের শুধু রাজনীতি করলেই হয় না, তার সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও স্বপ্ন থাকতে হয়। তবেই তিনি প্রকৃত রাজনীতিবিদ।

রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্র বসুর স্বপ্ন ছিল তাই তিনি কালক্ষেপ না করে জাপানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন, হাসপাতাল, সেবাসংস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি ঘুরে ঘুরে পরিদর্শন করেছিলেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন জাপান তখন এশিয়ার একমাত্র শিল্পোন্নত সাম্রাজ্য। জার্মানিতে অবস্থানকালীন সেদেশেরও এরকম প্রতিষ্ঠানসমূহ দেখেছিলেন বলে ধারণা করা যায়। মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে জাপানের মতো উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলবেন।

১৯৫৭ সালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী জওহর লাল নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে জাপানে এসেছিলেন। সেইসময় দুজন কোথায় কোথায় ভ্রমণ করেছিলেন, কি কি দেখেছিলেন জানা যায় না, তবে ভারতের উপহার হিসেবে একটি হাতির বাচ্চা উপহার দিয়েছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের শিশুদের আবেদনে সাড়া দিয়ে। জাপানের রাজনীতিবিদরা স্বপ্ন দেখেছিলেন হাতির মতো বিপুলাকারে শিশুরা বেড়ে উঠুক যারা আগামী জাপানকে গড়বে। তাই তারাও ভারতকে অনুরোধ করেছিলেন। জাপানের শিশুরা হাতির খুব ভক্ত।

১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুব রহমান জাপান সরকারের আমন্ত্রণে এদেশ ভ্রমণ করেছিলেন শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে। যে-ক’দিন তিনি জাপানে ছিলেন সে-ক’দিন এই দেশটিকে ঘুরে ঘুরে দেখার কৌতূহলের শেষ ছিল না তাঁর! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় প্রশাসন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, হোটেল, প্রাচীন বাড়ি পরিদর্শন করেছেন।এমনকি জাহাজে চড়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সাংসদ, শ্রম মন্ত্রী, স্বাস্থ্য মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশির (১৯১৬-৮২) অনুরোধে তাঁর জন্মস্থান ওয়াকায়ামা-প্রিফেকচারেও গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক ও বাংলাভাষার পণ্ডিত অধ্যাপক কাজুও আজুমা দোভাষী হিসেবে।

আমি যখন ছাত্র জাপানে তখন অধ্যাপক আজুমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তখন একবার আমাকে বলেছিলেন, উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি জাপানকে দেথে বঙ্গবন্ধু এতই অভিভূত হয়েছিলেন যে বারংবার একাধিক রাজনীতিবিদকে, বুদ্ধিজীবীকে কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করেছেন, বিশ্বযুদ্ধের ছাইভস্ম থেকে কীভাবে তোমরা এই দেশকে গড়ে তুললে!

শুধু অধ্যাপক আজুমাই নন, অধ্যাপক ড. নারা ৎসুয়োশি, অধ্যাপক ফুকিউরা তাদামাসা, প্রবীণ প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, লেখক-গবেষক তানাকা মাসাআকি, রাজনীতিবিদ ইশিকাওয়া তামোন প্রমুখ আমাকে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের অসম্ভব কৌতূহল জেগেছিল জাপানকে দেখে! তিনি জাপানের মতো বাংলাদেশকে গড়তে চেয়েছিলেন। বলেছেনও সেই স্বপ্নের কথা! যেকারণে জাপানের প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ যাঁরা ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহযোগী ও একনিষ্ঠ ভক্ত তাঁরা ব্যাপক সাড়া দিয়েছিলেন।তাঁদের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ জাপানের মতো হোক, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নেতাজিরও এই একই স্বপ্ন ছিল। শুধু তাই নয়, আমি যেসব তথ্য খুঁজে পেয়েছি, সেসব পড়ে বিস্মিত হয়েছি যে, জাপানের সেইসময়কার অধিকাংশ বড় বড় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ বঙ্গবন্ধুর দেশটির প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহসহকারে নানা পরিকল্পনা ও প্রকল্প তৈরি করেছিলেন! (এই বিষয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিও।) কিন্তু বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জাপানের সব স্বপ্ন মুছে গিয়েছে। জাপানিরা কী গভীরভাবে শোকাভিভূত হয়েছিলেন তা জানতে পারি অধ্যাপক কাজুও আজুমা এবং অধ্যাপক ফুকিউরা তাদামাসার ভাষ্য থেকে। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর বাকশালের যে পরিকল্পনা তার মূল অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন জাপানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে।

জাপানের এই ৩৫ বছরের জীবনে আমি বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিকের সঙ্গে জাপানে সাক্ষাৎ করেছি, সঙ্গ দিয়েছি---তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদকে আমি পেয়েছি যিনি জাপানে এসে রাসবিহারী বসুকে, নেতাজিকে, তোজো হিদেকিকে, বিচারপতি রাধাবিনোদ পালকে জানতে চেয়েছিলেন আমার কাছে। আমি তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় তাঁকে নিয়ে গিয়েছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন হোটেলের কক্ষে নিভৃতে, প্রবীর, নেতাজি এবং বঙ্গবন্ধুর অনেক স্বপ্ন ছিল জাপানবিষয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু জাপানের মতো গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, এবং একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলেছিলেন, বাংলাদেশি রাজনীতিক কারো কোনো স্বপ্ন নেই। রাজনীতিবিদদের ইতিহাসজ্ঞান থাকতে হয়, স্বপ্ন থাকতে হয়।

এই মানুষটি হচ্ছেন একদা আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা দেওয়ান সুলতান আহমদ। একজন সুরুচিসম্পন্ন, অগাধ পাণ্ডিত্য এবং অভিজাত রাজনীতিবিদ যিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার যে দলটি গঠিত হয়েছিল সেই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। নানা কারণেই তিনি পরে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

রাজনীতিবিদদের ইতিহাসজ্ঞান থাকতে হয়, স্বপ্ন থাকতে হয়। আমার এক অনুজ বন্ধু বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান-শাখার সভাপতি শেখ এমদাদ বলেছে, জননেত্রী প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা যতবার জাপান এসেছেন ততবার মুগ্ধ হয়েছেন। ২০১০ সালে তিনি সারারাত গাড়িতে করে ঘুরেছেন মহানগর টোকিও। সুরম্য প্রাচ্যনগরী টোকিওর মতো ঢাকাকে গড়ে তোলার স্বপ্নই যে তাঁর মনে পাপড়ি বিস্তার করেছে তা আর না বললেও চলে। কিন্তু স্বপ্ন দেখলেই হয় না, স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার মতো শক্তিও থাকা চাই।

(ছবি: বঙ্গবন্ধু ও তানাকা মাসাআকি ১৯৭২ সালে ঢাকায়।ছবিটি আমি Free Asia সংস্থার একটি সেমিনারে প্রদর্শন করেছিলাম ২০১৪ সালে।)

লেখক : জাপান প্রবাসী সাহিত্য গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test