E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উলুধ্বনিতে একই সাথে ধর্মীয় ও সংস্কৃতির চেতনাবোধ

২০১৮ জুন ২৪ ২৩:৫০:৫৯
উলুধ্বনিতে একই সাথে ধর্মীয় ও সংস্কৃতির চেতনাবোধ

সাব্বির খান


সংস্কৃতি যদি ক্ষতিকর না হয়, তাহলে তা নিজেদের জীবনাচরণে ব্যবহার করার মধ্যে ধর্ম কোন বাধা হতে পারেনা। বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী এবং তাদের প্রধান মিত্রদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনের প্রাকঃকালীন প্রচারণায় ঢালাও প্রচার করেছে এই বলে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশের মসজিদে-মসজিদে আযানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে। দেশ হিন্দুদের দখলে চলে যাবে ইত্যাদি।

খুবই নীচুমানের প্রোপাগান্ডা হওয়া স্বত্বেও, এ প্রচারণা নির্বাচনের সময়ে কোন এক অমোঘ কারণে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। অথচ এই প্রচারণার বিপরীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্র দলগুলোর উপযুক্ত জবাব বা কৌশল অবলম্বন করতে না পারার কারণে স্বাধীনতার পক্ষের প্রগতিশীল দলগুলোকে একাধিকার নির্বাচনে হেরে তার খেসারত দিতে হয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিচারে এ ধারা বর্তমানেও চলমান আছে বললে অত্যুক্তি করা হবেনা।

এই ধরনের অপপ্রচারের কারণ কি হতে পারে, তা নিঃসন্দেহে ভাববার বিষয়। বাংলাদেশ, ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পূজার সময় উলুধ্বনি দেয়। বিয়ে, পূজা-পার্বণ ছাড়াও প্রায় প্রতিটা আনুষ্ঠানিকতায় উলুধ্বনি দিয়ে মঙ্গল প্রার্থনা করে। এশিয়ার এ অঞ্চলের হিন্দু মহিলারা জিহ্বা কম্পায়নের মাধ্যমে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই শব্দটি মুখ থেকে বের করে থাকেন, যাকে আমরা উলুধ্বনি বলে জানি। একে ইংরেজিতে বলে Ululation। আমাদের অঞ্চলে শত-সহস্র বছর ধরে চলে আসা উলুধ্বনি একট সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় চর্চায় পবিত্র বলে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এখানে লক্ষণীয় যে, একটা অঞ্চলের চর্চিত সাংস্কৃতিক উপকরণ কালক্রমে বহুল অনুশীলনের পথ ধরে এক সময় তা ধর্মীয় সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ তা ধর্মে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

উলুধ্বনি দেয়াটা একটা আনুষ্ঠানিকতা যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এই আনুষ্ঠানিকতা শুধুমাত্র আমাদের অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই করে থাকেন বলে একটা মোটা দাগের ভুল ধারণা আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। মজার ব্যাপার হলো, এই উলুধ্বনি শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই নয়; এর চর্চা বিশ্বের অন্যান্য এলাকাতেও সমানভাবে দেখা যায়। অথচ সে অঞ্চলের চর্চার সাথে হিন্দু ধর্মের কোন সম্পর্ক বা যোগসাজশ নাই। আমাদের অঞ্চলের মত বিশ্বের ভিন্ন প্রান্তেও নানান সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, উল্লাস-আনন্দ, এমনকি শোক প্রকাশের সময়ও সমান স্বরে উলুধ্বনির ব্যবহার হয়ে থাকে।

ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় যে, উলুধ্বনির উৎপত্তিস্থল মূলত আরবে। বিশেষ করে বর্তমানেও বিভিন্ন আরব দেশের বিয়ের অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি উচ্চারিত হতে শোনা যায়। অর্থাৎ উলুধ্বনির প্রথাটা এসেছে মূলত আরব অঞ্চল থেকে। যেমন সৌদি আরবের কট্টর ওয়াহাবিপন্থা অবলম্বনকারী মুসলমানেরা তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে উলুধ্বনি দিয়ে বধূবরণ বা বিদায় জানায়, যা অনলাইনের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ছাড়াও ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপে যে কেউ চাইলেই দেখতে পাবেন। আরবের মহিলারা সাধারণত উলুধ্বনি দেন, যা তাদের সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য এবং অনুশীলিত। সৌদি আরবের মত একটি দেশে, যেখানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নিয়ম-কানুন থাকা সত্ত্বেও উলুধ্বনির সংস্কৃতি তারা বিসর্জন দেননি। এখানে মজার ব্যাপার হলো, সৌদি আরবে উলুধ্বনির ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ ফতোয়া পর্যন্ত আছে, যেখানে উলুধ্বনিকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

বিখ্যাত ইসলামিক স্কলার আল শেখ আল সাদির এক বক্তব্যকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে সৌদি আরবের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক শেখ হানি আল জুবায়ের বলেছেন:
“The default ruling for all verbal and non-verbal customs is that they are lawful and permitted. They are not to be prohibited or even frowned upon unless they present an express violation of Islamic Law or bring about some evil consequences. The basic permissibility of things is established by the Qur’ân and Sunnah.”

অর্থাৎ অনুশীলিত কোন সংস্কৃতির সাথে যদি ধর্মীয় প্রার্থনার কোন যোগসাজশ না থাকে এবং সেই সংস্কৃতি যদি স্থানীয় সংস্কৃতি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা পালন করার জন্য বাধা তো নেইই, বরং উৎসাহিত করা উচিত! অর্থাৎ মুল ব্যপারটি হচ্ছে, নিজের সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে অন্য সংস্কৃতি গ্রহণ করার মধ্যে যেমন কোন গৌরব নাই, তেমনি অন্য সংস্কৃতিকে ধর্মের নামে চালিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও সমাধিকভাবে অসুন্দর এবং পরিত্যাজ্য।

সেই পুরনো আমল থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূতিকাগার বিনির্মিত হয়েছিল সুফিবাদ সংস্কৃতির প্রভাবযুক্ত এক মানবিক ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে। পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সেই অনুশীলিত ধর্মীয় অনুশাসনের আধুনিক রূপান্তরই হচ্ছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’, যা পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সাথে নিশ্চয়ই সমার্থক নয়। বাহাত্তরে বাংলাদেশে ও তারও আগে থেকে আধুনিক ভারতের সাংবিধানিক অনুশাসন ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকে হলেও, অনুশীলনের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটু-একটু করে বিদায় নেওয়া শুরু করেছে স্মরণযোগ্য অতীত থেকেই।

ধর্মচর্চায় ব্যক্তি স্বাধীনতার চূড়ান্ত অনুমোদনই হচ্ছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’, যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতার বলয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি অনুমোদন। ধর্মীয় মৌলবাদের হীনচরিতার্থ পূরণের লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞাকে পঁচাত্তর পরবর্তী ইতিহাস বিকৃতির মতই পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চলেছে এবং পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা নাস্তিকবাদের সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের তুলনা করার হীনপ্রয়াস পেয়েছে, যা একাধারে মিথ্যা ও মনগড়া। সব ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের পূর্ণাঙ্গ রূপই হচ্ছে আমাদের অঞ্চলের ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’, যা পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সংজ্ঞা এবং চর্চা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।

আধুনিক বাংলাদেশে অনেকেই তাঁদের সন্তানদের বাংলা নাম দেয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। প্রচলিত এবং অনুশীলিত বাংলা সংস্কৃতির প্রত্যেকটা বিষয়কে ধর্মবিরোধী সংস্কৃতি বলে প্রচারণা চালানো বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এর বিপরীতে তারা এদেশে আরব সংস্কৃতিকে সুপ্রতিষ্ঠা দেয়ার অকৌশল হিসেবে ধর্মের দোহাই দিয়ে তা প্রচার করার হীনচেষ্টা করেন, যা একাধারে অনৈতিক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার প্রতি অবজ্ঞা স্বরূপ।

‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি’ মূল ধর্মের সৌন্দর্যকেই শুধু নষ্ট করে না, সেই সাথে কলুষিত করে সমাজ, দেশসহ গোটা জাতিকে। বাংলাদেশে আদর্শিক রাজনীতির প্রচণ্ড অভাবের সুড়ঙ্গ পথ ধরে অসুস্থ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে বার বার এবং তা প্রায় দুই যুগের অধিক কাল ধরে এদেশেরই বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর হাত ধরে। মতের অমিল থাকতেই পারে, তবে এর উদাহরণগুলো এতোই দৃশ্যমান যে, সেগুলো কি অস্বীকার করা সম্ভব? পঁচাত্তর পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করেছেন তাদের বিভিন্ন অপকর্মের ‘দোহাই’ হিসেবে। ধর্মের আড়াল না পেলে তাদেরকে অনেক ‘নষ্টামি’ করা থেকেও হয়ত বিরত থাকতে হতো। আর এইসব ধর্মের দোহাইগুলোর যোগান দিয়েছে একাত্তরে বাংলাদেশের পরাজিত মৌলবাদী শক্তি এবং তাদের মিত্র দোসর দলগুলো।

পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিটি নির্বাচনের পূর্বে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট যুদ্ধে যে অপপ্রচার চালিয়েছে তার প্রধান অংশ জুড়েই ছিল ভারতের সাথে ঐতিহাসিকভাবে এই দলটির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভারত বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়িয়ে অনেকবারই স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি বোকা বানিয়েছে বাংলার জনগণকে। তাদের প্রোপাগান্ডামূলক অপপ্রচারগুলোর মধ্যে ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিক্রি করে দেবে প্রতিবেশী ভারতের কাছে।

ভোটের রাজনীতিতে এই স্বাধীনতাবিরোধী দুষ্টচক্রটি সবচেয়ে বেশি যে প্রচারণাটি চালিয়ে বাংলাদেশের সহজ সাধারণ মানুষের মনে অমূলক ভীতির সঞ্চার ঘটিয়ে মহামূল্যবান ভোটগুলো হাতিয়ে নিয়েছে তা হলো- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে এই দেশ আর মুসলমানদের থাকবে না, মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, আযানের ধ্বনী উচ্চারণ হবে না, মুসলমানদের জোর করে হিন্দু বানানো হবে ইত্যাদি। অথচ আরবের ওয়াহাবী পন্থাবলম্বীরা সকাল বিকাল উলুধ্বনি দেয়। আরব দেশে উলুধ্বনির পক্ষে ফতোয়া এবং আদালতের রায় থাকতে পারলে, বাংলাদেশে কিভাবে সেই ওয়াহাবী এবং মওদুদীবাদীরা প্রোপাগান্ডা চালাতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়!

প্রতিপক্ষের অপপ্রচার চালানোর ক্ষেত্র তৈরির জন্য দায়ী স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলোর অজ্ঞানতা এবং বিশ্বরাজনীতির প্রতি অবজ্ঞা। রাজনীতি শুধু ক্ষমতা লাভ এবং ত্যাগ করা নয়, এটা বোঝার ক্ষমতা অনেক রাজনৈতিক নেতারই নাই। একটা দেশের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা চালালে তার উপযুক্ত জবাব দেয়া যেমন জরুরী, তেমনি জবাবটা যেন নির্ভুল হয় সেজন্য যথেষ্ট পড়াশুনা করাও সমানভাবে জরুরী। অথচ আমাদের আধুনিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই অভ্যাস দু’টো একেবারে নাই বললেই চলে। যে কারণে মৌলবাদী, ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলো অশুদ্ধ প্রচারণা চালিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিদের বোকা বানাতে পারে। সরকারের উচিত জনসচেতনতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার পাশাপাশি সুশিক্ষিত, জ্ঞানী রাজনীতিবিদদের অগ্রাধিকার দেয়া, যাতে তাঁদের নেতৃত্বে দেশের জনগণও তার সুফল ভোগ করতে পারে।

সাব্বির খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক।
ইমেইল : [email protected]

কৃতজ্ঞতা : সিলেট টুডে ২৪

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test