E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এ সকাল অন্ধকারের চেয়েও গভীরতর

২০১৮ জুন ২৮ ১৫:১৪:২১
এ সকাল অন্ধকারের চেয়েও গভীরতর

আবেদ খান


গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ফলাফল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে গেছে, সেটা নিয়ে অনেকে হয়তো আশ্বস্ত বোধ করতে পারেন। কিন্তু আত্মপ্রসাদের কোনো সুযোগ আছে বলে আমার মনে হয় না। এই নির্বাচন কেবল আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির জন্য একটি টেস্ট কেস নয়, এটা একই সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি তথা বিএনপি-জামায়াতের জন্যও একটা বিশেষ টেস্ট কেস। এটাকে আমরা যেভাবেই দেখি না কেন, আগামীতে একটা প্রচ- সংকট তৈরির সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।  এবং বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের নাশকতা তৈরির এক গোপন পরিকল্পনার গন্ধ। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এবার বিএনপি অজুহাত তৈরি করেছে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তাদের পোলিং এজেন্ট বের করে দেওয়া নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপি অনেক কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টই দেয়নি। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট কিছুক্ষণ থেকে চলে যান। বিভিন্ন সরেজমিন প্রতিবেদনই এই চিত্র উঠে এসেছে। হতে পারে যে, বিএনপির দলের ভেতরে যে গভীর হতাশা তৈরি হয়েছে, সেই হতাশার কারণে অনেক পোলিং এজেন্টই সেখানে যেতে পারেনি কিংবা যায়নি। একইসঙ্গে গাজীপুরে বিএনপি-দলীয় যে সাবেক মেয়র জনাব এম এ মান্নান, পুরো নির্বাচনেই তার ভূমিকাটি অত্যন্ত নেতিবাচক ছিল। 

তবে আওয়ামী লীগ যদি মনে করে গাজীপুরে জন-রায় তাদের পক্ষে গেছে, এ নিয়ে আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই। কারণ, গাজীপুর এলাকার অনেক পাতি নেতাকর্মী নানাভাবে দলের ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করেছে, প্রতারণা করেছে। দলগতভাবেও আওয়ামী লীগ একরকম ক্ষতিগ্রস্তই হয়েছে বলা যায়। একমাত্র আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার প্রতি অসামান্য আনুগত্যের জন্যই বড় ধরনের কোনো বিপর্যয় এই নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঘটেনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা এবং অস্বস্তি রয়ে গেছে ঠিকই।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের এই সময়ে কিছু সতর্কবার্তা আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির জন্য জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট কেবল দেশের ভেতরে নয়, বাইরে থেকেও ঘনীভূত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে নীলনকশা তৈরি করা হচ্ছে, সেই ছক অত্যন্ত ভয়াবহ। চোখকান তীক্ষ্মভাবে খোলা রাখলে এর কিছু আলামতও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, লন্ডনে এক পাকিস্তানি মালিকানাধীন রেস্টুরেন্টে পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে নিয়মিত বৈঠক করছেন। এই রেস্টুরেন্টটি ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির কেন্দ্র হিসেবে। জামায়াত এবং বিএনপি এখন একটাই লক্ষ নিয়ে এগোচ্ছে তাদের পাকিস্তানি প্রভুদের ইশারায়। নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকা-সহ সব ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকা-ের সূক্ষ্ম পরিকল্পনার জাল বোনা হচ্ছে এই রেস্টুরেন্টে বসে। এখানে একজোট হয়ে বৈঠক করছে আইএসআই, জামায়াত ইসলাম এবং বিএনপির তারেক রহমান।

এসব বৈঠক থেকেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে শেখ হাসিনাকে নিশ্চিহ্ন করার, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির শ্বাস রোধ করার। অর্থাৎ এটা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রভূমি। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ইন্ধনে এসব ষড়যন্ত্রের ছক সাজানো হয়েছে প্লান-এ থেকে শুরু করে প্লান-এফ পর্যন্ত। এই ছয়টি পরিকল্পনার ছক তারা এমনভাবে কষেছে যে, যদি প্রথম পরিকল্পনা তথা প্লান-এ কার্যকর না হয়, তাহলে প্লান-বি ধরে এগোবে। এভাবে তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম ও ষষ্ঠ পরিকল্পনাও তারা সাজিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে গ্রেফতারকৃত অবসরপ্রাপ্ত এক মেজরের ভিডিয়ো চ্যাটিং থেকেও আমার এর আভাস পাই। এটা একটি প্লানের একটি অংশ মাত্র। এরচেয়েও ভয়ঙ্কর একটি দিক হলো, আমরা যদি লক্ষ করি তাহলে বুঝতে পারব গত ছয় মাস ধরে জামায়াত ইসলামের কোনো প্রকাশ্য অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাস্তবতা হলো জামায়াত ইসলাম অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছে গোপনে। কিছুদিন আগে জামায়াতের একজন শীর্ষনেতা তার কর্মীদের সঙ্গে একটি বৈঠকে বলেছেন যে, আমরা এখন শুধু অপেক্ষা করছি। গোটা বাংলাদেশকে ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে।

এ থেকে বোঝা যায় এতদিন ধরে জামায়াত ইসলামের চুপ থাকার কারণ। তারা কঠিন প্রস্তুতি নিয়েছে মরণকামড়ের, অপেক্ষায় আছে মোক্ষম সময়ের। আরেকটি বিষয় এখানে আরো বেশি প্রণিধানযোগ্য, সেটি হচ্ছে, যে তিনজন বিএনপি নেতা বিভিন্ন সময় ভারতে গিয়েছেন এবং ভারতে গিয়ে তারা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন যাতে ভারতের মানসিকতার পরিবর্তন আনা যায়। বিএনপি যে ভারতবিরোধী নয়, সেটা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন তারা।

এই কথার ভেতরে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। তারা ভারত গিয়েছে এটা ঠিক। এই ত্রিমূর্তির একজন গত দু বছরে ভারতে প্রায় ৪৩ বার গিয়েছেন। এবং কোনো কোনো মহলের সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন সংখ্যালঘু বিধায়কের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তিনি। এবং সেখানেও বিএনপি নেতৃত্ব চেষ্টা করেছে ওইসব বিধায়কের মাধ্যমে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে অস্থির করতে।

প্রকৃতপক্ষে কোনো না কোনো অজুহাতে বিএনপি কিন্তু আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এবং জাতীয় নির্বাচন তছনছ করার ব্যাপারে আরো সহিংস পথ অবলম্বন করার ব্যাপারে তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপাতত দেশের জনগণকে বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যই তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

তারা শুধু অপেক্ষা করছে বিশ্বকাপ ফুটবল এবং কোরবানি ঈদ শেষ হয়ে যাবার। এর পরই তারা পথে নেমে যাবে তাদের ছক অনুযায়ী। এবং তারা দাবি করে যে, ইতোপূর্বে তারা যে-ধরনের নাশকতা করেছে এবারের নাশকতা তার সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বিশেষ করে শেখ হাসিনার অনুগামী কেউ যেন তাদের হাত থেকে রেহাই না পায়Ñএমন পরিকল্পনা নিয়েই তারা মাঠে নামবে। এবং তারা পরিস্কার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, যেভাবেই হোক একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশোধ তারা নেবেই। যারা এই বিচারের সঙ্গে কোনো না কোনো সহমত পোষণ করেছে, বিচারে সহযোগিতা করেছে, সপক্ষে কথা বলেছে সবাইকেই তারা তাদের নিজস্ব আইনে শাস্তি দেবে। ইতোমধ্যে আমরা এরকম কয়েকটি ঘটনা খেয়াল করেছি।

সম্প্রতি শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের ছেলে সুমন জাহিদকে হত্যা করা হয়। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত দুইজনের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন। তার এই হত্যার ঘটনা আত্মহত্যা বলে চালানো হচ্ছে। এই প্রপাগান্ডা চালানোর মধ্যেও বোঝা যায় যে, স্বাধীনতাবিরোধীদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক একটিভ আছে। পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসন, সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী সব পেশাজীবী মহলেই তাদের এই নেটওয়ার্ক একটিভ আছে। তারা এক্ষেত্রে প্রথম যে অপারেশন করেছিল, সেটা হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের ট্রাইব্যুনালকে কীভাবে বিতর্কিত করা যায়। এখানে কেবল জাতীয় ভাবেই না, আন্তর্জাতিক ভাবেও চক্রান্ত ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক, যিনি আত্মীয়সূত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত, তার বিভিন্ন লেখালেখি ও কর্মকা-ের ভেতরেও আভাস পাওয়া যায় যে, কীভাবে নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে সঙ্গোপণে এগোচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। কীভাবে সক্রিয় হচ্ছে তারা।

সুতরাং গাজীপুরের এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর যারা মনে করছেন যে, নিষ্কণ্টকভাবে আওয়ামী লীগ তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় সরকার গঠন করতে যাচ্ছে তারা এখনো দিনের আলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকে অন্ধকার দেখতে পারছেন না। তারা বুঝতে পারছেন না এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার?

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে শক্তিশালী করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যে ঐক্য সাধিত হয়েছিল, সেই ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায়েই আসন্ন বিপদ হতে পরিত্রাণ পাবার উপায় নেই। স্বাধীনতাবিরোধীরা মরিয়া হয়ে এবার সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন উপাসনালয়, সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবন, আদালত প্রাঙ্গণকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানাতে চেষ্টা করবে। হজরত শাহজালাল ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও কোনো অবস্থাতেই নিরাপদ নয়। বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় ধর্মীয় লেবাসে তারা তাদের গোপন আস্তানা গড়ে তুলতে সক্রিয়। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্নভাবে ঢাকাকে ঘেরাও করা। নাশকতার মাধ্যমে ঢাকা অচল করে দেওয়া।

আমি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করেছি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এক গভীর আত্মতৃপ্তিতে ডুবে আছে। সেই আত্মতৃপ্তির ভেতরেই লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর অসতর্কতা। বলা যায়, এটাই সবচাইতে বড় আশঙ্কার দিক। মনে রাখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হিসেবে এই সরকারকে এখন তিনটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এর এক নম্বরে আছে জামায়াত ইসলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য প্রতিহত করতে তারা হেন ষড়যন্ত্র নেই যে করেনি। বহুদিন ধরেই প্রতিশোধ স্পৃধায় তারা ফুঁসছে। অপেক্ষায় আছে মোক্ষম সময়ের। দুই ও তিন নম্বরে রয়েছে বিএনপি ও পাকিস্তান। জামায়াত ও পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে বিএনপি সবরকম উপায়ে পুনরায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। গতবার তারা সফল হয়নি। কিন্তু সেই ব্যর্থতা থেকেও তারা শিক্ষা নিয়েছে, ছক কষছে নতুনভাবে। আর পাকিস্তান প্রতিশোধ নিতে চায় একাত্তরের পরাজয়ের। কাজেই গাজীপুরে আওয়ামী লীগের এই বিজয়কে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার সতর্কতা বলেই আমি মনে করি।

এখন সময় এসেছে আত্মশুদ্ধির। আওয়ামী লীগের ভেতরে যেসব অনুপ্রবেশকারী ঘাপটি মেরে আছে, তাদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এসব অনুপ্রবেশকারীসহ দুর্নীতিবাজ ও বিভেদ সৃষ্টিকারী নেতাকর্মীদের হাত থেকে অবিলম্বে রক্ষা করতে হবে আওয়ামী লীগকে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশ এখন তারুণ্যময় একটি দেশ। তিন কোটির বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে বাংলাদেশের। তরুণদের অপব্যবহার না করে বিকশিত করতে হবে। তাদেরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করতে হবে বাংলাদেশপন্থী তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। নতুন প্রজন্মের মধ্যে নারী প্রতিনিধি রয়েছে অর্ধেকের কাছাকাছি। সুতরাং এই নারীশক্তিকেও চালিত করতে হবে সঠিকপথে। সাংস্কৃতিক শক্তিকে নতুনভাবে সংগঠিত করতে হবে, জাগিয়ে তুলতে হবে যাতে তরুণরা বিপথগামী না হয়। এভাবে সর্বক্ষেত্রে নব নব জাগরণ ছাড়িয়ে দিতে হবে তরুণদের মধ্যে। নচেৎ রক্ষা করা যাবে না বাংলাদেশকে।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test