E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমরা কি আদৌ মানুষ ?

২০১৮ আগস্ট ২০ ১৩:৪৬:৫৮
আমরা কি আদৌ মানুষ ?

তৈয়ব আলী


আমরা কি আসলেই মানুষ ? এখনও মানুষ আছি? মানবের যা গুণ, যা দায়িত্ব তা করি? কেন এসেছি পৃথিবীতে? কখনও কারো জানতে ইচ্ছে করে না? নাকি শুধু রাত থেকে দিন হবে আবার দিন থেকে রাত হবে আর টিকটক করে ঘড়ি চলতে থাকবে সময় শেষ হবে সাথে আমিও একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। নাকি ভাল করে লেখাপড়া শেষ করে ভাল চাকরি, বিদেশ ভ্রমণ, সুন্দরী পত্নী পাওয়া, দামি গাড়ি চড়া, পত্রিকায় নাম আসা আরও অনেক কিছু চায়। মানে যাদেরকে সমাজে এলিট ক্লাস বলা হয় সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়া।

তাহলে আমার প্রশ্নও হলো, এগুলো আছে এমন মানুষের অভাব নেই। তারা কি সবাই সুখি? সবাই হয়তো বলতে পারে এমন হতে হবে যেন তোমায় নিয়ে মানুষ যেন চিন্তা করে যখন তুমি থাকবে না। কিন্তু আমার কাছে এমনটা মনে হয় না। আমার মনে হয় আমার অনুপস্থিতিতে (মৃত্যুর পর) যদি কেউ বছরে, মাসে, দিনে, ঘণ্টায়, মিনিটে বা সেকেন্ডে একবার হলেও ভালোবেসে মনেকরে তাহলেই আমি সার্থক।

আমরা সবাই খুব ব্যস্ত। এই ব্যস্ততায় আমারা আমাদের অনুভূতিগুলো দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। হারাচ্ছি মনুষ্যত্ব ও ভালোবাসা। তাতে কি সুখ খুঁজে পাচ্ছি?

এখন আমি ভার্সিটিতে পড়ি। হঠাৎই শুনলাম যে খুব তাড়াতাড়ি সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবে। তারপর সেদিন বিকেলেই একটা এস্যাইনমেন্ট(ফিল্ডে) আছে সেটা স্যার করাবেন। তো স্বাভাবিক ভাবেই ঈদের আগে বাসায় যাবো টিকেট করেছি সেই সময় যদি এমন ঘটনা হয় তাহলে কেমন টা লাগে।। অন্য দিকে স্নেহময়ী মা ফোন করে যখন বলেন যে ভাল করে পরীক্ষা দিস। পড় ভাল করে। ফোন রাখার আগে বলে পরীক্ষা কবে শেষ হবে। তখন তো ঠিকই বুঝতে পারি যে, তিনি অপেক্ষা করছেন। শুধু বলতে পারছেন না যে, বাবা পরীক্ষা দেয়া লাগবে না চলে আয়। এইসব ভেবে মনে মনে ওই শিক্ষকের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। কিন্তু পরে অবধারনগত অসংগতি দিয়ে মনকে বুঝলাম আর চিন্তা করলাম এই শিক্ষক আমার বস কিন্তু তার বস তার সাথে কেমন আচরণ করেন। হয়ত তিনি কোন ঈদেই বাসায় যেতেই পারেন না। হয়তো তিনি সন্ধ্যায় পরিবারের সাথে বসে কোনদিন এক কাপ চাও খেতে পারেন নি। হয়তো তার বস তার ছুটি দেননি এবারও দিবে না। কারণ সেই বস হতে উন্নতির শিখরে উঠতে গিয়ে এতো উপরে উঠে গেছেন যেখানে আর এই আবেগ মাগা কথার দাম নেই। সেখানে শুধু আর্থিক ভালোবাসা।
কিন্তু আমরা যদি কম আয় করি, কমভোগ করি, চাহিদা কমিয়ে দেই তাহলে প্রয়োজনটাই মূল প্রাধান্য হিসেবে দাঁড়াবে।

আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ বোধ করি যখন অনেক দিন পর বাসায় গিয়ে কলিং বেল দেই আর মা চাবি নিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসেন। বুঝতে পারি অপেক্ষা শেষ হওয়ার হাসি এটা। ওই হাসি দেখার যে সুখ, যে আনন্দ তা আর অন্য কিছুর সাথে তুলনা হয় না। কিন্তু এখন এই হাসির আনন্দের পাশাপাশি কিছুটা কষ্টও পায়। কারণ যখন বাবা ছিলেন তিনি দরজাটা খুলতেন। এখন দরজা খুলতে আসেন একজন।

আমরা আমাদের কাজে, ব্যস্ততায় দিন দিন এই ছোট ছোট অনুভূতির ভালোলাগার বিষয়গুলো হারাচ্ছি। দিন দিন সবাই খুব যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। স্মার্টফোন নিয়ে স্মার্ট হয়ে পাশাপাশি দুইজন নির্বাক বসে ফেসবুকে ভার্চুয়াল বন্ধুদের সাথে চ্যাট করছি। কিন্তু পাশে বসে থাকা বন্ধুর কোন খবরই রাখছি না। আমার মনে হয় আমারা নিজেকে ভালবাসতে ভুলেগেছি। নিজের জন্য সময় দিতে ভুলেগেছি। সেই জন্য যান্ত্রিক হয়ে এক এক সময় আমরা আমাদের আচরণ জন্তুতে পরিণত করছি।

হয়তো এই জন্যই যে কাউকে জিজ্ঞেস যদি করা হয় তুমি অতীতের কোন অংশে ফিরে যেতে চাও, তখন সবাই ছেলেবেলার কথায় বলে।

ইদানীং চারপাশের অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হয়। চারপাশে শুধু টাকার খেলা। রাজনীতির খেলা। সবখানে। অফিসে, ক্লাস, হাটে-বাজারে, রাস্তায়, ঘরে..। যার যতো ক্ষমতা বা টাকা তার সাথে তৈলাক্ত আলোচনাও তত বেশি। সবাই একটু ভালো থাকার জন্য চাটুকারিতাই করছে। কে কার ঘাড়ে পা দিয়ে উপরে উঠতে পারবে সেই চেষ্টা সবার। কিন্তু এভাবে ভালো থেকে কি লাভ ? যেখানে নিজের কোন অস্তিত্বই থাকে না।

হয়ত এই বছরের এই ঈদটায় আমার আগে বাড়ি যাওয়ার শেষ প্রয়াস। কারণ পরের বছর হয়তো আমাকেও সেই কোন না কোন বসের অধীনে চাকরি করতে হবে। তখন কি করব?
আমিও কি তখন চাটুকার হয়ে যাবো ?

আমি চাই না এমন জীবন, আমি চাই না এই বাঁধাধরা নিয়ম। সবাই বলে মানুষ বাঁচে তার কর্মে কিন্তু আমার মতে মানুষ বাঁচে তার ভালো একটা মনের কারণে। আমি মনে করি, একজন মানুষ কখনোই নিজের জন্যে পৃথিবীতে আসে না। পরস্পর সহযোগিতা আর সহমর্মিতায় একে অন্যের জন্য সহায়ক হয়ে থাকতে এসেছে এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে। তা নাহলে একজন রিক্সাওয়ালাও যা উপার্জন করে তার জন্য তা যথেষ্ট ছিল। তার জন্য তাকে অন্য কারও চিন্তা করা লাগতো না।

লাখ লাখ টাকা দিয়ে পশু কোরবানি করে মানুষ দেখানো আল্লাহকে খুশি করার চেষ্টা একান্তই বৃথা হবে। যদি না নিজের মনের পশুত্বকে মুছে ফেলতে পারি। যদিও বা এই পশু কেনা নিয়েও আমাদের পাল্লাপাল্লি। কে কত টাকা দিয়ে কতো বড় পশু কিনেছি। যদি এমন হতো, যে যত বেশি বড় পশু কিনবে সে তত বড় পশু। তাহলে সবাই মনে হয় চড়ুই পাখি কোরবানি করত। আমাদের সব কিছুই হলো লোক দেখানো বা মেকি।

একটা গানের দুটো লাইন খুব মনে পড়ে, 'এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই'। কিন্তু দুনিয়াতে মানুষ আছে কিন্তু মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষ নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মানুষ না হয়ে যদি ফানুস হয়ে স্বল্প সময়ের জন্য উড়ে গিয়ে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারতাম সেটা মনে হয় খারাপ হত না।

কারণ চারপাশে শুধু অহংকার, হিংসা, লোভ, চাটুকারিতা, অন্যের ক্ষতির কামনা-বাসনা আরও অনেক কিছু। যেগুলো দেখলে আবার ওই একই প্রশ্ন জাগে যে, আমারা কি মানুষ ?

(লেখক : ছাত্র, জার্নালিজম কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ)

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test