E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার প্রদীপ নিভে গেল

২০১৯ মার্চ ১২ ১৪:৩০:৪২
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার প্রদীপ নিভে গেল

রোবায়েত ফেরদৌস


২০১৮–এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পর ডাকসু নির্বাচন নিয়ে একটি আশা টিমটিম করে জ্বলছিল। ওই দুই নির্বাচনের পর নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই আশার প্রদীপ এবার নিভে গেল কি না, সেই প্রশ্নের জন্ম হলো। ডাকসুর এই নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক কি না এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়ে গেলাম কি না, সেই আশঙ্কাও দেখা দিল। এ থেকে সহজ উত্তরণের পথ নেই। ভেবেছিলাম এরপর দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে। আর এর মধ্য দিয়ে দেশে একটি তরুণ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। সেটি প্রথম ধাক্কা খেল এই ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

অনেকে বলেন, ‘ডাকসু একটি মিনি পার্লামেন্ট। এটি দেশের গণতন্ত্রের সূতিকাগার’। এর মধ্যে হয়তো কিছুটা অতিশয়োক্তি আছে, কিন্তু কিছু সত্যও এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। সেই সত্যটিও এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। কয়েকটি হলে আমি দেখেছি ভোটারদের কৃত্রিম লাইন, যেটা অনেক ভোটারও অভিযোগ আকারে বলছিলেন। ভোট দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। এক ছাত্রকে আমি দেখলাম, সে সাভার থেকে আসে। তিন-চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে সে ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেছে। অনেকে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দিতে না পেরে ফিরেও গেছেন। রোকেয়া হলে আমরা দেখলাম দুই দফা ভোট হলো, আবার তা বাতিলও হলো। আর কুয়েত-মৈত্রী হলে যা ঘটল, তা খুবই ন্যক্কারজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন কলঙ্ক আর হতে পারে না। আমি মনে করি, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এর সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।

কুয়েত-মৈত্রী হলের প্রভোস্টকে যখন সরিয়ে দেওয়া হলো, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা দেখে আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু এরপরে আবার যা হলো, তা আমাদের ব্যথিত করেছে। সুফিয়া কামাল হলে দেখলাম, একটি মেয়ে বৈধ কাগজপত্র দেখানোর পরেও তাকে ভোট দিতে দেওয়া হলো না। আমি মনে করি, জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের দায়িত্ব থাকা প্রশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হলো। কাজেই শিক্ষক হিসেবে আমরা যে একটি উচ্চ নৈতিকতার কথা বলতাম, সেটি আর থাকল না। এর কারণ হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের পক্ষের শিক্ষকেরাই হলসহ বিভিন্ন প্রশাসনের দায়িত্ব পান। ফলে তাঁদের ভেতরে কোথাও এমনটা থাকে যে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনকে জয়ী করতে হবে। এটা হয়তো সরকারপ্রধান চান না। তিনি হয়তো চান, সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।

কিন্তু এই যে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি হয়েছে। যাঁরা একজন শিক্ষককে বড় পদ এনে দেন, তার বিনিময়ে তাঁর পক্ষে কাজ করার কোনো পূর্বশর্ত তৈরি হয় কি না, সেটা এবার সুস্পষ্টভাবে সামনে এল। প্রশাসনের বড় পদে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যেও এই ক্ষমতার সেতুবন্ধের ধারণা কাজ করে। এটা একধরনের অন্তর্গত দাসত্ব তৈরি করে।

আর এই নির্বাচনে যাঁরা বিরোধী ছিলেন, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, এই নির্বাচনে তাঁরা জয়ী হয়ে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে যে প্রশ্নগুলো উঠেছিল, তা আবারও তাঁরা তুলবেন। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জাতীয় পর্যায়ের সংগ্রাম আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলবেন তাঁরা। সেই ভয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে বাড়তি ভয় হিসেবে কাজ করেছিল বলে আমার মনে হয়। কাজেই শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির লেজুড়বৃত্তি এর মধ্য দিয়ে এক হয়ে গেল।

এই ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতির কোনো গুণগত পরিবর্তন হবে না বলে আমার মনে হয়। আমরা এই নির্বাচনকে নিয়ে দেশের গুণগত পরিবর্তনের যে আশা দেখেছিলাম, তা এবার বাস্তবতায় এসে হোঁচট খেল।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও কলামনিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test