E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

ক্ষুদ্রঋণের প্রসার, তাহলে এত লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে কেন?

২০১৪ জুলাই ২৫ ০৯:৫৯:৫৪
ক্ষুদ্রঋণের প্রসার, তাহলে এত লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে কেন?

ড. আর এম দেবনাথ : একটি কাগজে ক্ষুদ্রঋণের ওপর একটা স্টোরি দেখলাম গত সপ্তাহে। স্টোরিতে বেশ কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে, করা হয়েছে অনেক মন্তব্য। তথ্যে বলা হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ কমছে। গ্রাহকের সংখ্যা কমছে। অনেক ‘এনজিও’ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। বলা হয়েছে, বড়রা পুঁজি স্থানান্তর শুরু করেছে অন্য ব্যবসায়। এসবের ওপর কিছু তথ্য স্টোরিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। আমি ঐসব তথ্যে যাব না। স্টোরিতে বলা হয়েছে ক্ষুদ্রঋণ কমার কারণগুলোর কথা। কারণগুলোর মধ্যে আছে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হ্রাস, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর তদারকী। ড. ইউনূসকে নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে আস্থাহীনতা, সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প উদ্যোগ বিশেষ করে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’ গঠন, সঞ্চয়ভিত্তিক নানা প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি।

ক্ষুদ্রঋণ হ্রাস এবং ঋণগ্রহীতার সংখ্যা হ্রাসের তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পাল্টা তথ্য আমার কাছে নেই। হতে পারে তা কমেছে। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কমার কারণগুলো। যে কারণের কথা স্টোরিতে উল্লেখ করা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে ঘটনা ধরা পড়ে। বলা হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা হ্রাস পেয়েছে। কী সুযোগ-সুবিধা হ্রাস পেয়েছে তা স্টোরিতে উল্লেখ থাকলে সে সম্পর্কে আলোচনা করা যেত। এতদসত্ত্বেও যে বিষয়টির ওপর আলোচনা করা যায় তা হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর তদারকী। একথা জানা বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো, এনজিওগুলো, এমনকি ক্ষুদ্রঋণের জন্য খ্যাত গ্রামীণব্যাংকও দীর্ঘদিন কাজ করেছে কোন তদারকী সংস্থার অনুপস্থিতিতেই। ২০০৬ সালে ‘মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি’ আইন পাস হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) যার প্রধান গবর্নর স্বয়ং। আইন পাসের ৫ বছর পর তৈরি হয় বিধিমালা। অর্থাৎ কার্যত নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিপূর্ণ কাজ শুরু হয় মাত্র তিন বছর আগে। অথচ আমাদের দেশে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা ‘এনজিওরা’ শুরু করে স্বাধীনতার পর পরই বলা যায়। ১৯৮৩ সালে সরকারের উদ্যোগে জাতীয় সংসদের আইনে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রামীণব্যাংক। এটা কোন ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ নয়। এটা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো। আবার এটা কোন তফসিলী ব্যাংকও নয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকানুন একে মানতে হয় না। আবার এনজিও মন্ত্রণালয়ের অধীনেও এটি নয়।

কার্যত এর কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন যাবত গ্রামীণব্যাংক, ব্র্যাক জাতীয় প্রতিষ্ঠানসহ দেশের বিরাটসংখ্যক ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে আইনী নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুপস্থিতিতে। এক সময় অভিযোগ ওঠে এরা অতিরিক্ত সুদ নেয়, টাকা স্যাঙ্কশন করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু টাকা কেটে রাখে। জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায় করে। এর প্রেক্ষাপটে সরকার ‘এমআরএ’ তৈরি করে। ‘এমআরএ’ ইতোমধ্যে কয়েকটি ভাল পদক্ষেপ নিয়েছে। এমআরএ’র বিধিমালা কঠোরভাবে পালিত হচ্ছে এখন। ক্ষুদ্রঋণের সার্ভিস চার্জের হার ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ এখন মাত্র ২৭ ভাগে নির্ধারিত হয়েছে। সঞ্চয়ের ওপর ন্যূনতম ৬ ভাগ সুদ প্রদান করতে হয় এখন। ঋণ প্রদানের সময় বিভিন্ন প্রকারের কর্তন এখন নিষিদ্ধ। এখন ‘এমআরএ’ থেকে সনদপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষুদ্রঋণ দিতে হলে হিসেবপত্র ‘অডিট’ হয়। এই হচ্ছে বর্তমানে চালু বিধিবিধান। এখন পাঠক বলুন, এর কোন্টা অযৌক্তিক? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মকানুনের অভাবে যাচ্ছেতাই সুদ চার্জ করছে। ঋণ প্রদানের সময় নানা ধরনের কর্তন করছে। সঞ্চয়ের ওপর কোন লাভ দিচ্ছে না ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে বিধিবিধান করা কী অন্যায় হয়েছে? না, অন্যায় হয়নি। বরং দীর্ঘদিন নিয়মকানুন না চালু করে আমরা একটা বিরাট খাতকে অনুমতি দিয়েছি গরিব মানুষকে শোষণ করতে। সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। ব্যাংকগুলোর জন্য আছে বাংলাদেশ ব্যাংক, বীমা কোম্পানিগুলোর জন্য আছে ‘ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (ইডরা)। শেয়ারবাজারের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এমন কোন সংগঠন দেশে নেই যার কোন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই। হ্যাঁ, ছিল না, গ্রামীণব্যাংকের, ছিল না ক্ষুদ্রঋণ দাতা প্রকল্পগুলোর। যখনই নিয়ন্ত্রণের কথা উঠে তখনই অভিযোগ, সরকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ কারণেই ক্ষুদ্রঋণ হ্রাস পাচ্ছে। এ কথাটি যে কত সারগর্ভশূন্য তা আর বুঝিয়ে বলার দরকার করে না। আসা যাক আরেক কারণে। স্টোরিটাতে বলা হয়েছে, ক্ষুদ্রঋণের বিকল্প উদ্যোগও নাকি ক্ষুদ্রঋণ কমার অন্যতম প্রধান একটা কারণ। বিকল্প উদ্যোগ হিসেবে ‘পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক’-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বত্র বাজার অর্থনীতির কথা, বাজার অর্থনীতির ব্যাংকিং, বীমার কথা। প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, মেধার কথা। এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারী খাতের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যদি সরকার তার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে পারে তাহলে আপত্তি কোথায়? সরকার বরং আমি মনে করি গোড়াতেই ভুল করেছে। স্বাধীনতার পর পর দেশের আনাচে-কানাচে সরকারী ব্যাংকগুলোর শাখা খোলা হয়। বলা যায়, তিন বছরের মধ্যে ৩-৪ হাজার শাখা খোলা হয়। উদ্দেশ্য কৃষিঋণ, পল্লীঋণ দেয়া। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হয়, ছোট ছোট ঋণ দেবে অন্য ধরনের প্রতিষ্ঠান। অথচ সরকারী ব্যাংক স্বাধীনতার পর থেকেই ছোট ছোট ঋণ দিচ্ছিল। সোনালী, জনতা, অগ্রণী ইত্যাদি ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ছিল। পুরনো রেকর্ড ঘাটলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। স্বাধীনতার পর পর আমি নিজেও ৪০০০ টাকা ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যথাসময়ে পরিশোধ করেছি। সুদের হার ছিল অল্প।

হঠাৎ দেশে কী ঘটল, অদ্রুত এক যুক্তি দিয়ে এনজিওগুলোকে উৎসাহ দেয়া হলো। তারা ক্ষুদ্রঋণে, কৃষিঋণে ৩০-৪০ শতাংশ সুদ নিতে পারে। এতে কোন দোষ নেই। বলা হলো এগুলোতে ইনটেনসিভ মনিটরিং লাগে। অতএব খরচ বেশি। অথচ সুদ বেশি। একথা তো সরকারী ব্যাংকের বেলায়ও সত্যি। তাহলে সরকারি ব্যাংক কৃষিঋণ দিচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণ দিলে তার সুদের হার ১০-১২ শতাংশের বেশি করা যাবে না বলে বিধান। অথচ এনজিওরা এখনও ২৭ শতাংশ সুদ চার্জ করতে পারে। এক দেশে দুই বিধান কেন করা হলো? পরক্ষণেই বলা হচ্ছে, সরকারি ব্যাংক লোকসান দিচ্ছে। অথচ কেউ বলল না সরকারি ব্যাংক কম সুদে ঋণ দিয়ে ব্যবসা করছে। এতে তো কম লাভ হবেই। এই দ্বিচারিতার ফল আমরা পাচ্ছি এখন। এনজিওগুলো দেশবাসীকে লুণ্ঠন করল। অথচ তাদের প্রশংসায় মার্কিনীরা সোচ্চার। এই বিষয়টা আমাকে খুব পীড়া দেয়। মার্কিনী এবং তার দোসরদের দ্বিচারিতায় সবারই কষ্ট পাওয়া উচিত। আমি মনে করি সরকারি ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্রঋণে কার্যকর সুদহার চার্জ করতে দিলে তাদের পারফরমেন্স অনেক ভাল হতো। সরকার যে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে তাও সমর্থনযোগ্য। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো খালি মাঠে গোল দিয়ে যাবে; এটা কোন কাজের কথা নয়। তৃতীয় যে কারণটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে, বিকল্প সঞ্চয় প্রকল্প। দেশে যত বেশি বিকল্প সঞ্চয় প্রকল্প হবে ততই মঙ্গল। পরিষ্কার আমরা দেখলাম ‘মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম)’ নামীয় একজাতের ব্যবসা সারা দেশের মানুষকে লুণ্ঠনের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করেছে। তারা হাজার হাজার কোটি টাকা নানা লোভনীয় সঞ্চয় প্রকল্প দিয়ে লুট করেছে। ‘ডেসটিনি’, ‘যুবক’,‘ ‘কাজল ব্রাদার্স’ ইত্যাদি তার প্রমাণ। একদিকে মানুষের সঞ্চয় কম। সঞ্চয় বলা যায় স্থবির প্রায় দেড় দশক ধরে।

অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন কর পদক্ষেপ বিশেষ করে ভ্যাট এবং অগ্রিম আয়কর যা উৎসে কাটা হয়। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। তার ওপর বিভিন্ন ‘এনজিও’ এমএলএম কোম্পানি, এমনকি বীমা কোম্পানিগুলোও গ্রামের মানুষের সঞ্চয় লুট করছে। এটা হচ্ছে এবং হতে পারছে যেহেতু সরকারের সঞ্চয় প্রকল্প, বিকল্প সঞ্চয় প্রকল্পের ভীষণ অভাব। এই সুযোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মানুষকে লুট করছে। এখন সরকার যখন বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্প গ্রহণ করছে তখন বলা হচ্ছে- এ কারণে ক্ষুদ্রঋণ হ্রাস পাচ্ছে। এসবের অর্থ আমি অন্তত বুঝি না। তার মানে কী এই যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে দিতে হবে? এর অর্থ কী এই যে সরকার কোন বিকল্প সঞ্চয় প্রকল্প বাজারে ছাড়তে পারবে না? বিষয়টি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। পরিশেষে আমি ক্ষুদ্রঋণ সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। অনেকদিন যাবত বলা হচ্ছে ক্ষুদ্রঋণ হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের ওষুধ। এর দ্বারা দারিদ্র্য বিমোচন হবে। ঠিক আছে তাহলেই আমার প্রশ্ন কয়েকটা।

এক কোটি বাংলাদেশী বিদেশে কাজ করে। তারা নিয়মিত রেমিটেন্স পাঠায় পরিবারে। এক কোটি ওয়েজ আর্নারের পরিবারের সদস্য কত? চারজন করে খানাপ্রতি ধরলে ৪ কোটি লোক হয় যাদের ক্ষুদ্রঋণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এবং তারা দারিদ্র্যসীমার উপরেই থাকার কথা। ৪০ লাখ পোশাককর্মী বাংলাদেশে। তাদেরও মাসিক একটা রোজগার আছে, যা দিয়ে ডাল-ভাত মোটামুটি খাওয়া যায়। এখানেও হবে মোট দেড় কোটি লোক। নানা ধরনের শ্রমজীবী আছে লাখ লাখ। তাদের পরিবারের রোজগার একটা আছে যা দিয়ে তারা ডাল-ভাত খেতে পারে। এদেরও ক্ষুদ্রঋণের দ্বারা দারিদ্র্য বিমোচন করতে হবে বলে মনে হয় না। এখানেও কম করে হলেও দেড় কোটি লোক। তিন ক্ষেত্রেই হয়ে যায় ৭ কোটি লোক। বলা হচ্ছে, ক্ষুদ্রঋণের গ্রহীতা নাকি দুই কোটি। চারজন করে হিসেবে নিলে এখানে ‘কভার’ হওয়ার কথা ৮কোটি লোক। তাহলে মোটে হয় ১৫ কোটি। এমতাবস্থায় ৪ কোটি লোক (২৫ শতাংশ) দারিদ্র্যসীমার নিচে হয় কিভাবে? এসব শুধুই প্রশ্ন। আমি জবাব পাই না। ক্ষুদ্রঋণের ‘মাজেজা’ বুঝতে পারছি না। যে আমেরিকানরা রেস্তরাঁয় খেয়ে কত টাকার বিল হলো তা ক্যালকুলেটর ছাড়া বলতে পারে না তারা ক্ষুদ্রঋণের ‘মাজেজা’ এত বেশি কেমনে বোঝে?

লেখক : সাবেক প্রফেসার বিআইবিএম

সৌজন্য : জনকণ্ঠ

(এএস/জুলাই ২৫, ২০১৪)

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test