E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্যাম বেনেগাল কি পারবেন ?

২০১৯ মে ০৭ ২২:৩৬:১৮
শ্যাম বেনেগাল কি পারবেন ?

সৌমিত্র দেব


জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক বানাতে ঢাকায় এসে এপ্রিল মাসের দুটো দিন ব্যস্ত সময় পার করেছেন ভারতের বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। তিনি এই বায়োপিকের নির্মাতা হবেন এ কথা অনেক দিন ধরেই শুনছিলাম। বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি । ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু এবং নেতাজী সুভাষ বসুর মতো ব্যক্তিত্বদের জীবনী নিয়ে বায়োপিক বানানোর অভিজ্ঞতা তার আছে । তাই বঙ্গবন্ধুর ওপরে কাজ করতে গিয়ে তিনি কি বলেন, সেটা জানার খুব আগ্রহ আমার ছিল । শ্যাম বেনেগাল প্রথমেই তেজগাঁওয়ের চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) যান । বিএফডিসির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। দুপুরের খাবার খেয়ে তিনি ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কবিরপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিল্ম সিটিতে যান।

বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক কীভাবে বাংলাদেশে বানানো হবে, কারিগরি সুবিধা কী কী থাকবে, কলাকুশলী—এসব নিয়ে আলোচনা হয়। তিনি ছবিটি বাংলা ভাষায় হোক—এটাই চেয়েছেন। শিল্পী নিয়ে এখনো তেমন কিছুই চূড়ান্ত করেননি বলেও জানতে পারি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জেনেছি, সেখানে শ্যাম বেনেগাল বলেছেন, টিমওয়ার্কে সিনেমা তৈরি হয়। বাংলাদেশি মেধাবীরা এই ছবির সঙ্গে যুক্ত হবেন। এ দেশেই ছবিটির দৃশ্যধারণ করব। তাই আমি ঢাকায় এসেছি, এখানে কী ধরনের সুবিধা পাব তা দেখতে। এ ছাড়া নানা বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। এটা ঠিক যে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন ব্যক্তিত্বের জীবনী নিয়ে ছবি নির্মাণ করাটা আমার জন্য গর্বের বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দারুণ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই ছবির কাজ করতে গিয়ে সম্পর্কটা আরও উন্নতর জায়গায় পৌঁছাবে। বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় মাপের একজন জাতীয় নেতাকে নিয়ে ছবির কাজটি সততার সঙ্গে করতে চাই।

কিন্তু আমাদের মনে কিছু প্রশ্ন রয়েই গেল । ভালো কথা বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে ছবিটি বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হবে। আনন্দের বিষয় ২০২০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে এই ছবি মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ছবির নাম কী হবে এবং বাজেট কত—এ নিয়ে কিছুই জানাননি বরেণ্য এই পরিচালক।

বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে নির্মিতব্য ছবিটি নিয়ে গত বছর অক্টোবরে শ্যাম বেনেগাল বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ছবিটি বানানোর জন্য তিনি এখন পুরোপুরি প্রস্তুত এবং ছবির নাম ভূমিকায় কে অভিনয় করবেন, তা নিয়েও তিনি ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। তাঁর কথায়, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই বাংলাদেশ থেকে কোনো অভিনেতা এই চরিত্রে অভিনয় করুন। কারণ, সেটাই বেশি সমীচীন হবে। আর তিনি একটু রোগা হলেই ভালো, কারণ জীবনের বেশি অংশ শেখ মুজিব নিজেও কিন্তু বেশ সরু আর রোগা ছিলেন। খুব কম লোকই এটা খেয়াল করেন যে শেখ মুজিবের যে বিশাল, ভারিক্কি চেহারার ছবিগুলোর সঙ্গে আমরা বেশি পরিচিত, সেটা তাঁর জীবনের পরের দিকের। শেষ দিকে তাঁর কিছুটা ওজন বেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু জীবনের বেশি সময় তিনি রীতিমতো রোগাই ছিলেন, যেমনটা টিপিক্যাল বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও অ্যক্টিভিস্টরা হন আরকি!’ আমার মনে হয় শ্যাম রোগা বলতে এখানে স্লিম বুঝিয়েছেন । তরুণ বঙ্গবন্ধুর যে সব ছবি পাওয়া যায়, তাতে তাকে স্লিমই দেখায় । পরবর্তী কালে দীর্ঘ কারাজীবন এবং নানা ধরণের চাপে তার চেহারায় ভারিক্কি এসেছিল । বয়সটাও বিবেচনায় নিতে হবে । সে অর্থে বঙ্গবন্ধু স্লিমই ছিলেন । কিন্তু কখনই তিনি টিপিক্যাল বাঙালি বুদ্ধিজীবী বা অ্যক্টিভিস্টএর মত ছিলেন না। তার শালপ্রাংশু চেহারা সব সময়ই অন্য ১০ জন থেকে আলাদা ছিল ।

অবশেষে আমার সুযোগ হলো শ্যাম বেনেগালের মুখোমুখি হবার । ৩ এপ্রিল বুধবার বিকেলে রাজধানীর সচিবালয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তথ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নির্বাচিত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্যাম বেনেগাল। তথ্যসচিব আবদুল মালেক ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখার যুগ্মসচিব অশোক পারমার, ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের উপ-মিশন প্রধান বিশ্বদীপ দে, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আজহারুল হক এসময় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে সাংবাদিক হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম ।৮৪ বছর বয়সী শ্যাম বেনেগালকে দেখতে যথেষ্ট সজীব ও সক্ষম মনে হল। বৈঠকের শুরুতে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে তথ্যমন্ত্রী বলেন, `২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে দু’দেশের মধ্যে যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ বিষয়ক চুক্তির সূত্র ধরে বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক যে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে সেটির পরিচালক হিসেবে শ্যাম বেনেগালের এটি প্রথম বাংলাদেশ সফর। তাকে সহায়তার জন্য ভারত তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে, বাংলাদেশও অনুরূপ একটি কমিটি গঠন করতে চলেছে। সিনেমাটির প্রয়োজনে সম্ভাব্য সকল সুবিধা দেবে বাংলাদেশ।’

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে এক বছর-মুজিব বর্ষের মধ্যেই এ চলচ্চিত্র নির্মিত হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

শ্যাম বেনেগাল তার বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত উদ্বেলিত ও সম্মানিত বোধ করছি। আমি চাই ইতিহাসের সঠিক প্রতিফলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও একটি জাতির জন্মকথা তুলে ধরতে। বাঙালি জাতির জন্ম ইতিহাসে যেমন বিজয়ের আনন্দ আছে, তেমনি আছে হারানোর ব্যাথাও-যেমনটি আছে গ্রিক ট্রাজেডিতে।’

‘বঙ্গবন্ধুর ওপর সিনেমাটি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে হলেও বেশিরভাগ শিল্পী ও কলাকুশলী বাংলাদেশ থেকেই অংশ নেবেন’ উল্লেখ করে শ্যাম বেনেগাল বলেন, ‘দু’দেশের লেখক ও গবেষকবৃন্দই এ কাজে সহায়তা করবেন এবং সিনেমার প্রয়োজনে দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো স্থানে দৃশ্যধারণে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’

এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ‘এখনো এ চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্ধারিত হয়নি’ বলে জানান শ্যাম বেনেগাল। সাংবাদিকরা চলচ্চিত্র সম্পর্কে যত প্রশ্ন করেছেন তার জবাবে বেনেগাল শুধু বলেছেন ‘নট ইয়েট’ । এর অর্থ হলো- এখনো প্রস্তুত নন তিনি ।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতির পিতা ।হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি । তার জীবনীর সঙ্গে পৃথিবীর সকল বাঙালির আবেগ জড়িত ।শ্যাম বেনেগাল কি পারবেন সেই আবেগ ধারণ করতে ? এই সাক্ষাৎকারে তা বোঝা গেলো না। বিশেষ করে মুজিব বর্ষের মধ্যেই এতো বড় একজন ব্যক্তিত্বের বায়োপিক নির্মাণ সহজ ব্যাপার নয় ।বিদেশী নির্মাতা বাঙালির আবেগ ধারণ করতে পারবেন না, বিষয়টা সে রকম নয় । বিদেশী রিচার্ড অ্যাটেনবরো মহাত্মা গান্ধীর বায়োপিক নির্মাণ করে দেখিয়েছেন, সেটা সম্ভব । শ্যাম বেনেগাল কি পারবেন তাকে ছাড়িয়ে যেতে? যদি পারেন, তাহলে বাঙালি ও বাংলাদেশ তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে ।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র অভিনেতা।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test