E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ব্যাংক কমিশন নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি

২০১৯ মে ১৯ ১৭:১৯:০৩
ব্যাংক কমিশন নয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি

চৌধুরী আবদুল হান্নান


অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা রোগীকে স্বাস্থ্যকর সুষম খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া অর্থহীন, কারণ তার খাদ্য গ্রহণের স্বাভাবিক ক্ষমতাই নেই। ব্যাংক খাত কতটা রোগাক্রান্ত, রোগের মাত্রা কতটা গভীর সংকটের দিকে ধাবমান তা কেবল ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা অবহিত তা নয় সাধারণ জনগণের কাছেও তা পৌঁছে গেছে।

কোনো প্রতিষ্ঠানের সংকটকাল মোকাবেলা করার জন্য কিছু সৎ, সাহসী, দক্ষ, স্বাধীনচেতা জনবলের প্রয়োজন হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর চারপাশে অসৎ, দুর্নীতিবাজ লোকের সংখ্যাধিক্য টের পেয়ে “চোরের খনি” বলে একটি কথা ক্ষোভের সাথে উচ্চারণ করেছিলেন।

কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজের দর্শনের অধ্যাপক এবং বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের শিক্ষক সাইদুর রহমান তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। শিক্ষক এসেছেন ছাত্রের সাথে দেখা করতে, যিনি এখন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “স্যার, আপনি তো অনেক মানুষকে চেনেন, দয়া করে আমাকে ১০০ ভালো মানুষের আলাপ করে দেবেন? আমি আবার তাদের নিয়ে চেষ্টা করে দেখি।”

বর্তমানে রাষ্ট্রের অর্থভান্ডার ব্যাংকগুলোর সংকটকাল থেকে উদ্ধার করার জন্য কিছু ভালো মানুষের বড় প্রয়োজন। ভালো মানুষ কাছেই আছে ঠিকই, তাদের কদর নেই, তারা কোনঠাসা। ব্যাংক খাতের স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা নেই, বরং ঠুটো জগন্নাথে পরিনত করে রাখা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা ব্যাংকের মূল সমস্যা তৈরী করে রেখেছে, তারা বেপরোয়া, তারা বুঝতে পেরেছে, ঋণ পরিশোধ না করলে তাদের কেউ কিছু করতে পারবে না। তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং আর্থিক প্রতাপ অসীম, অর্থশক্তির দুর্দান্ত ক্ষমতার কাছে আমরা বার বার অসহায় হয়ে পড়েছি। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংকে যে বিপুল অংকের বেনামি ঋণ রয়েছে তার সুবিধাভোগী এ সকল ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা, ওরা ঋণ নেওয়ার সকল কলা-কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে, পথ চিনেছে।

বিষফোঁড়া আরও আছে, অনেক ঋণ খেলাপিরা উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত খেলাপির খাতা থেকে নাম কাটিয়ে নেন, নতুন করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়।
এ সকল অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ঠেকাতে ব্যাংক কমিশনের দরকার নেই, বিদ্যমান আইন প্রয়োগই যথেষ্ট। ভালো মানুষ খুঁজতে দূরে যেতে হয় না। ইতিপূর্বে ব্যাংকগুলোতে যে বড় বড় আর্থিক কেলেংকারী সংঘটিত হয়েছে, সেখানে যে সকল কর্মকর্তা এ অনৈতিক কাজে বাধার সৃষ্টি করেছিল, তারাই তো ভালো মানুষ।

যারা “বড় কর্তার” অনৈতিক নির্দেশ অবলীলায় মেনে না নেওয়ার জন্য রোষানলে পড়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের সুরক্ষা দিলে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাংকের ভিতরেই একটি প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

ব্যাংকিং কমিশন গঠনের পক্ষে অনেকেই মতামত দিয়ে চলেছেন, মনে হবে চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। অথবা এতদিন কোথায় ছিলেন? ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুস্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বলয় বিদ্যমান আছে, প্রয়োজন কেবল তা কার্যকর রাখা। তাছাড়া, প্রতিটি ব্যাংকের একটি বিজ্ঞ পরিচালনা পরিষদ রয়েছে, তারাই তো ওই ব্যাংকটির “ব্যাংক কমিশন” হিসিবে কাজ করতে পারেন।

এক অদৃশ্য শক্তি ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে, ঋণ খেলাপিরাই এর নেপথ্য নায়ক। কারণ টাকার ক্ষমতা সীমাহীন, আর যদি সেই টাকা নিজের কষ্টার্জিত না হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণকারীদেন একটা গোলক-ধাঁধায় কেউ আটকে রেখেছে, যাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেরাপিরা, আদালতের স্থগিতাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই সুযোগে ব্যাংক থেকে আরও অর্থ বের করে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারে। তাদের সুযোগ সুবিধা দেওয়ার যত আয়োজন।

এই দুই বড় দৈত্যকে আটকাতে কোনো কমিশনের দরকার নেই, নতুন আইনেরও প্রয়োজন নেই, বিদ্যমান আইন প্রয়োগই যথেষ্ট। দরকার কেবল সদিচ্ছার। তবে ইঁদুর ও বিড়ালের বন্ধুত্ব হয়ে গেলে ক্ষেতের শষ্য রক্ষা করা যায় না।

ব্যাংকে কর্মরত ভালো মানুষদের সুরক্ষা দেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতকে শক্তিশালী করা ও একক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্পণ করা এবং বিদ্যমান আইন-কানুন-বিধি-বিধান সঠিক প্রয়োগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ব্যাংক খাতকে সঠিক পথে পরিচালনার মূলমন্ত্র্।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test