E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ও পাখি তোর যন্ত্রণা

২০১৪ জুলাই ২৮ ১২:১৫:২৩
ও পাখি তোর যন্ত্রণা

সাইফ বরকতুল্লাহ :

থ্রি পিস দোকানের অলিগলিতে হায়!
পাখি রাখছে টাঙ্গিয়ে
প্লাস্টিকের ডলগুলো রঙ বেরঙের
পাখিতে দিলো রাঙ্গিয়ে,
ডানা কাটা পাখি, মশার ভয়ে মশারি পাখি
আপা নিয়া যান, ঈদের কয়দিন আর বাকি
সিরিয়ালের নাম ভাঙ্গিয়ে হায়! ফ্যাশনে সয়লাব মার্কেট
হুজুগে মেতে বাঙালি, ঐতিহ্য বিকিয়ে ভরে ধাঙ্গর পেট৷
ও সুন্দরী আপারা সানি লিউন দিছেন নাকি বাদ?
এবার বুঝি পাখি ফ্যাশনে ভরবেন মনের সাধ?'


সামহয়্যার ইন ব্লগে কাজী ফাতেমা ফ্যাশনের রাজ্যে পাখি- শিরোণামে এই কবিতা লিখেছেন৷

দুই.

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার হালিমা খাতুন। বয়ষ ১৩। বাবা আম ব্যবসায়ী আব্দুর সাত্তার। মেয়ে হালিমা দুই সপ্তাহ আগে বাবার কাছে এবারের ঈদে পাখি থ্রিপিস কিনে দেওয়ার আবদার করে। বাবা তাকে কয়েকদিন পর জামাটি কিনে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু জামা কিনে দিতে দেরি হওয়ায় গত ৯ জুলাই কিশোরী হালিমা নিজের ঘরে অভিমানে গলায় ফাঁস দেয়।বিষয়টি টের পেয়ে পরিবারের লোকজন দ্রুত তাকে উদ্ধার করে আশঙ্কাজনক অবস্থায় শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির কয়েকদিন পর চিকিৎসকরা জানান হালিমা আশঙ্কামুক্ত। এ অবস্থায় গত রোববার সকালে হালিমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু এরপর থেকে সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে ও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি। এ অবস্থায় বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার সকাল ৬টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

এ খবরটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক ঝড় তোলে।

তিন.

চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের শিলা খাতুন। বয়স ১৫ বছর। এ মেয়েটিও আত্মহত্যা করে৷ আত্মহত্যার কারণ বাবা ঈদের জন্য তাকে পাখি পোশাকটি কিনে দিতে পারেননি৷

চার.

খুলনার পাইকগাছার শারমিন আক্তার। এবারের ঈদে পাখি থ্রি-পিস কিনে না দেয়ায় তার স্বামী মোঃ সাইদুল ইসলামকে তালাক দিয়েছেন৷

পাঁচ.

এবার গাইবান্ধায় ঈদের পোশাক ‘পাখি’ না পাওয়ার কষ্টে আত্মহত্যা করেছে নূরজাহান খাতুন নামের আরেক কিশোরী। রবিবার সকাল ১০টার দিকে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহ ইউনিয়নের মাস্তা গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহত নূরজাহান মাস্তা গ্রামের নূর আলমের মেয়ে। কয়েক দিন আগে একই ধরনের ঘটনায় চাপাইনবাবগঞ্জে আত্মহত্যা করেছিল এক কিশোরী। নিহতের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঈদ উপলক্ষে নূরজাহান মা ও বড় বোনের কাছে পাখি পোশাক চায়। ওই পোশাক কিনে না দেওয়ায় নূরজাহানের সঙ্গে তার মা ও বোনের বাগবিতণ্ডা হয়। কষ্টে-অভিমানে সকাল ১০টার দিকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে নূরজাহান। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে গোবিন্দগঞ্জ থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। [সূত্র: আরটিএনএন]

ছয়.

ঝালকাঠি জেলার স্টেশন রোডে ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসার সিরিয়াল ‘বোঝে না সে বোঝে না’ দেখা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী এবং কন্যার তুমুল বিতণ্ডা হয়েছে। বিতণ্ডা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, এক সময় ২১ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনই ভেঙে ফেলেছেন বাড়ির মালিক রফিক মোল্লা। শনিবার রাতে ঝালকাঠি শহরের স্টেশন রোডে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, স্টার জলসার বিভিন্ন সিরিয়াল দেখা নিয়ে এই পরিবারে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লাগে। এমনই ঘটনায় শনিবার রাতে স্বামী রফিক মোল্লার সঙ্গে তার স্ত্রী ও কন্যার তর্ক হয়। প্রতিবেশীরা এসে তাদের শান্ত করে। তবে রাগে-ক্ষোভে রফিক মোল্লা নিজের টেলিভিশন ভেঙে ফেলেন। এদিকে, সংবাদ মাধ্যমে ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি-বাংলা ও স্টার জলসা বাংলাদেশে সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে খবর জেনে রবিবার রফিক মোল্লা উল্লাস প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এদেশের একান্নবর্তী পরিবারে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতে এসব টিভি চ্যানেল ও সিরিয়াল বন্ধ করলে দেশবাসী উপকৃত হবে।[সূত্র:আরটিএনএন]

সাত.

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সোনার তরী কাব‌্যগ্রন্থে দুই পাখি কবিতায় লিখেছেন-

খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে

বনের পাখি ছিল বনে।

হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, এই পাখি সেই পাখি নয়। খাঁচার পাখিও নয়। বনের পাখিও নয়। এই পাখি হলো স্টার জলসার সিরিয়াল বোঝে না সে বোঝে না’র এক চরিত্র। ওই সিরিয়ালে পাখি পিউয়ের বোন। এই পাখি এখন মার্কেটে উড়ছে। এবার ঈদে ক্রেজ হিসেবে এই পাখি ড্রেস নিয়ে সরগরম। শুধু তাই নয়, সংবাদ মাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়ায় এই পাখি ড্রেস নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

আট.

কিন্তু কেন এরকম ঘটনা ঘটছে? বাংলাদেশে কী কোন নিজস্ব পোশাক নেই? গত ২৩ জুলাই শারমীনা ইসলাম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরে লিখেছেন, আমাদের দেশের খ্যাতিমান ডিজাইনাররাও এ বিষয়ে বেশ আক্ষেপ করে বললেন এভাবে চললে দেশের নিজস্ব পোশাক নিয়ে আমরা যে গর্ব করতাম সেটা আর থাকবে না। কারণ আমাদের তাঁত শিল্প মার খাচ্ছে, এই ভিনদেশি আগ্রাসনের কাছে। বরেণ্য ডিজাইনার এমদাদ হক দুঃখ করে বলেন, আমরা ভারতে যেখানে একটি প্রদশর্নীর আয়োজন করতে পারি না, ওদের দেশের কারও সঙ্গে মিলে করতে হয়, সেখানে ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমরা ওদের দেশের ফ্যাশন হাউসের উদ্বোধন করি। আসলেই তো তাই যেখানে আমাদের ত্রিশটি চ্যানেলের একটিও দেখানো হয় না, আর আমাদের দেশে ওদের সব চ্যানেল চলছে দেদারসে। [সূত্র: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ]

নয়.

আমাদের গর্ব করার মত আড়ং, দেশি দশ, ক্র্যা ক্রাফটস, বিবি রাসেল ফ্যাশন, দেশীয় বুটিক, কুটির শিল্প আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। নকশী কাঁথা, টাঙ্গাইল শাড়ি এতই জনপ্রিয় যে ভারতের বিখ্যাত দেবদাস মুভিতে ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলে কেন আমরা বিদেশে প্রস্তুত পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি ? আমাদের ছেলেমেয়েরা কেন ভারতীয় নায়িকা নির্ভর পোশাক পছন্দ করছে? এর উত্তর কে দেবে? আর এর দায় কে নেবে?

দশ.

আমাদের প্রতিটি পরিবারের সন্তানদেরকে অভিভাবকের বোঝাতে হবে দেশীয় পোশাক, সংস্কৃতি অন্য যে কোনো দেশের থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নিজের দেশের পণ্য ভালোবেসে ব্যবহার করতে শিখতে হবে আমাদের। আর এর জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে আরো বেশী দায়িত্ব নিতে হবে। আজ প্রত্যেক বাড়ির ড্রয়িং রুমে টিভিতে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি চ্যানেল। কিন্তু কেন ? আমাদের চ্যানেলগুলোতেও তো ভাল নাটক হয়। আমাদের পরিবারকে আমাদেরই উদ্ধুদ্ধ করতে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা করতে। নইলে সমাজের বারোটা বাজবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও গবেষক

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test