E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘দলগত স্বশিক্ষা’ পদ্ধতি

২০১৪ জুলাই ৩০ ১৩:৪৫:৩৪
শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘দলগত স্বশিক্ষা’ পদ্ধতি

বিকে সরকার লালন : সু-শিক্ষণ কেমন হওয়া উচিত?
রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এ বিষয়টির সূচনা করার চেষ্টা করছি। শিক্ষা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “শিক্ষা শুধু সংবাদ বিতরণ নয়, মানুষ সংবাদ বহন করতে জন্মায়নি, জীবনের মূলে যে লক্ষ্য আছে তাকেই গ্রহণ করা চাই। মানব জীবনের সমগ্র আদর্শকে জ্ঞান ও কর্মে পূর্ণ করে উপলব্ধি করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।”

সুশিক্ষন সম্পর্কে ঋষি অরবিন্দ প্রায় একশো বছর আগে বলেছিলেন- “The first principle of true teaching is that nothing can be taught. The teacher is not an instructor or task master, he is a helper and a guide. His business is to suggest and not to impose. He does not actually train the pupil’s mind; he only shows him how to perfect his instruments of knowledge and helps and encourages him in the process. He does not impart knowledge to him; he shows him how to acquire knowledge for himself”

দেখা যাক UNESCO তাঁদের একবিংশ শতাব্দীর জন্য শিক্ষার প্রতিবেদনে কি বলেছেন- ‘Teachers must adapt their relationship with learners, switching roles from ‘soloist’ to ‘accompanist’, and shifting the emphasis from dispensing information to helping learners to seek, organize and manage knowledge, guiding them rather moulding them.” (Learning : The Treasure within UNESCO Report, 1996).

Francis Bacon শিক্ষা ও সমাজ নিয়ে বলেছেন- “তরুণ বয়সে যে সুস্থ সংস্কার গড়ে ওঠে তাই শিক্ষা এবং এটি সর্বাপেক্ষা স্থায়ী হয়। এই সুস্থ সংস্কারই মানুষের জীবনের প্রধান নিয়ামক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। তাই এটি অর্জন মানুষের সার্বিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত”।

গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এবিসি সেলফ্ এডুকেশনে এমন একটি পদ্ধতি-“দলগত স্বশিক্ষা” (Participatory Self-education Approach) অনুসরণ করা হয় যেখানে শিক্ষার্থীদের হাত ধরে ধরে শিখিয়ে পরনির্ভরশীল করা হয় না, মুখস্থ করতে শেখানো হয় না। বরং বিশেষ প্রক্রিয়ায় উদবুদ্ধ আনন্দিত শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বই পড়ার মাধ্যমে; দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতিতে নিজেদের মেধা প্রয়োগের মাধ্যমে(trial & error)-এর মধ্য দিয়ে উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে যায়, হয়ে ওঠে অনুপ্রাণিত, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মপ্রত্যয়ী। কেউ কেউ দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয় অধীত বিদ্যা, অনেকের ক্ষেত্রে কাজকর্মে রীতি-নীতিও হয়ে ওঠে পরিস্ফুট। আমরা নিবিরভাবে তাদের মধ্যে লক্ষ্য করেছি পরিবর্তন। তাই আমাদের শ্লোগান- আলোকিত মানুষ হতে- “স্বশিক্ষার আলোকে বদলাবো নিজেকে, চলো বদলে যাই”। জ্ঞান-ভিত্তিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে প্রতিষ্ঠানটি পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৭ সালে নেত্রকোনা জেলায় কাজ শুরু করে অদ্যবধি নিজস্ব চেষ্টায় তিনটি জেলায় কাজ শুরু করছে।। প্রাথমিকভাবে কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও বর্তমানে প্রাথমিক স্তরেও কাগ শুরু করেছে। এছাড়াও নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালনা করা হয় স্কুল ও গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষাসচেতনতামূলক কর্মশালা আলোকিত মানুষ হতে- “জেগে ওঠো, নম্বরার্থী নয়, শিক্ষার্থী হও”।

সু-শিক্ষণ এবং দেশের বর্তমান শিক্ষা অবস্থা
বাজারসর্বস্ব যুগে বিজ্ঞাপন অপরিহার্য। হরেক রকম বিজ্ঞাপনের মধ্যে শিক্ষা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনও ভীষণ জনপ্রিয়। ব্যাংঙের ছাতার মত প্রতিদিন গজিয়ে উঠছে শিক্ষা সহায়ক নানান প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কোচিং সেন্টার এবং কিন্ডারগার্টেনগুলো বেশ শক্তভাবে তাদের আসন পাকাপোক্ত করেছে। স্কুল কলেজে শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে উদাসীনতা, অভিভাবকগণের পুজিঁবাদী আচরণ এবং রাষ্ট্রতন্ত্রের ব্যর্থতা- মূলত এসব কারণেই এই ধারার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম। কেউ কাজ করছে স্কুল নিয়ে, কেউ কাজ করছে কলেজ নিয়ে আবার কেউবা কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিয়ে। বেশ লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করে কোচিং মালিকরা মাঠে নামছে কোমর বেধে নুনজল খেয়ে। বলাই হয় প্রচারেই পণ্যের প্রসার। অলিতে গলিতে কোচিং সেন্টারগুলোর পোস্টার, ফেস্টুন আর ব্যানার দেখলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় দেশে গুণগত শিক্ষার উন্নয়নে এক মহাযজ্ঞ চলছে !!!!! একজন দিন মজুর থেকে শুরু করে বড় আমলা পর্যন্ত আপনি আমি সকলেই সুশিক্ষণ চাই। আমরা ক্লাসে ফাস্ট হতে চাই, গোল্ডেন জিপিএ- ৫ পেতে চাই, কিন্ডারগার্টেনের প্লে গ্র“পের বাচ্চাকে মুখস্ত করাতে চাই- বাংলাদেশ কোন মহাদেশে অবস্থিত? ঢাকার প্রাচীন নাম কী কিংবা বাংলাদেশের আয়তন কত? ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রিয় পাঠক আপনি নিজে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানেন তো? বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের চাওয়া-পাওয়া কতটুকু সুসংহত এবং সুনিয়ন্ত্রিত? চাওয়া-পাওয়ার এই সন্ধিক্ষনে আমরা খানিকটা মুশকিলে পড়েছি। পুথিগত বিদ্যা আর সার্টিফিকেট চাই নাকি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন-এর একজন কল্পনাপ্রেমিক সৃষ্টিশীল মানুষ চাই।

বিশেষতঃ সহায়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষার মানোন্নয়নে ব্যর্থ কেন? বিগত সময়ে আমরা দেখেছি- যখন কোন শিক্ষার্থী ভার্সিটি ভর্তি/এইচ.এস.সি-তে বড় সাফল্য নিয়ে আসে তখনি অধিকাংশ কোচিং ব্যবসায়ীরা নানান কৌশলে তাদের ছবি সংগ্রহ করে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে থাকে। তারা দাবি করে তাদের কারণেই এমন অবিস্ময়ণীয় সাফল্য সম্ভব হয়েছে। এমন দাবির পেছনে যুক্তি হলো তাদের প্রতিষ্ঠানে ঐসব সকল শিক্ষার্থীবৃন্দ ভর্তি হয়েছিল (ক্লাস করুক আর নাই করুক) কিংবা ১-২ মাসে ১০-২০ টি ক্লাস করেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে এমন অপসংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলো তাদের মূল দায়িত্ব থেকে সরে এসে বর্তমানে টিচিং/পরীক্ষা নির্ভর না হয়ে অনেকাংশে তারা বিজ্ঞাপন নির্ভর হয়ে পড়েছে। তাই অনেক শিক্ষার্থী ব্যঙ্গ করে বলে- কোচিং হ্েচ্ছ দিল্লীকা লাড্ডু যে খায় সে পস্তায় আবার যে না খায় সেও পস্তায় । এটি দেখতে মাকাল ফলের মতো দূর থেকে আকর্ষণীয় মনে হলেও ভিতরে অনেকটাই ফাঁকা।

কেস স্টাডি- ১. বারহাট্রা থেকে আগত রনজিৎ দাস নামে আমাদের একজন অতি সাধারণ সম্ভাবণাময় শিক্ষার্থী এইচ.এস.সি. ১ম বর্ষ থেকে ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট পর্যন্ত এবিসি সেলফ্ এডুকেশনে দীর্ঘ ২ বছর নিয়মিত পড়া-লেখা করে ২০০৯ সালে ঢাবিতে মানবিক বিভাগে ১৩তম স্থান অর্জন করেছিল। অথচ তার ছবি ঢাকার কোচিং সেন্টারগুলো বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে। তার ভাষ্য অনুযায়ী সে একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে ২-৩ মাসের মধ্যে ক্লাস করেছে মাত্র ৪-৫ দিন ।

কেস স্টাডি- ২. ২০১০ সালে শেখ বোরহান উদ্দীন নামে বানিজ্য বিভাগের আমাদের আরো একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। সে বৃহত্তর মনময়সিংহে ১ম তথা ঢাবিতে ৩১তম স্থান অর্জন করেছিল। সে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়নি অথচ তার ছবি ছাপিয়ে ঐসব কোচিং সেন্টারগুলো একই ভাবে ব্যবসা করছে।

কেস স্টাডি- ৩. ২০১২ সালে আব্দুল হালিম ও ইমামুল ইসলাম শিমুল মানবিক বিভাগে যথাক্রমে ঢাবিতে ৪র্থ ও ১৩তম স্থান অর্জন করে। একই ভাবে তাদের ছবিও শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন নামি-দামি কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে।এসব চিত্রই প্রামাণ করে, অধিকাংশ কোচিং সেন্টারই অর্থলিপ্সার হীন প্রতিযোগীতায় লিপ্ত। আমরা এমন অপকর্মের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। গত বছর একুশে টিভিতে কোচিং সেন্টারগুলোর এমন অপতৎপরতা সংক্রান্ত একটি সিরিজ প্রতিবেদন প্রচারিত হলেও কার্যত এসব বন্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

একই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালেও ঢবিতে একজন ৪র্থ ও একজন ৮৪তম স্থান অর্জন করে। আমরা এই ভর্তি পরীক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দেই একারণে যে সারাদেশের মেধাবী শিক্ষার্থী এখানে অংশ নেয়। আর তাই দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতির কার্যকারিতা ও মান নিয়ে যাচাই বাচাই করা সুযোগটা একটু বেশি থাকে।

শেখ হাফিজুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিনি লিখেছেন- গতানুগতিক কোচিং নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা কোন ভাবেই আমাদের শিক্ষার মান আশানুরূপ বৃদ্ধি করতে পারেনি। উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজ (জিপিএ-৫) বৃদ্ধি মানে মান বৃদ্ধি নয়। ২৫ ডিসেম্বর ২০১২ দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১২-১৩ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় (ক খ ও গ) ইউনিটে জিপিএ- ৫ পাওয়া ৪৪ হাজার ৬৪২ জন শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন ১৯ হাজার ৮৬৮ জন বা ৪৫% শতাংশ। বাকী ৫৫% শিক্ষার্থী উত্তীর্ণই হতে পারেনি। ২০১০ ও ২০১১ সালে এই অনুর্ত্তীণের হার ছিল যথাক্রমে ৫২ ও ৫৩ শতাংশ। ভাবুন তো একবার জিপিএ- ৫ পাওয়া ৫৫% শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয় ভর্তি পরীক্ষা পাশ নম্বরই পাননি, চান্স পাওয়া তো দূরের কথা । শিক্ষা মানের বিচারে বাংলাদেশের জন্য এটি অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি সংবাদ।

মূলত শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে যে আশঙ্কাজনক অধঃপতন হয়েছে, তার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থাটাই দায়ী। স্কুল-কলেজে ভাষা বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা না দেওয়া, বিষয়ভিত্তিক গভীর পাঠদান ও পাঠাভ্যাসের অনুপস্থিতি, পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বিষয়ে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া, শর্টকার্ট, উপায়ে সফল হওয়ার প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভরশীলতা, বাড়িয়ে বাড়িয়ে নম্বর দিয়ে কৃত্রিমভাবে মেধার বিষ্ফোরণ ঘটানোর নীতি- এসব কিছুর সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে শিক্ষার মানে ধস। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাই সর্তক না হলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক ফল গ্রাস করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে”

শেখ হাফিজুর রহমান স্যারের সাথে একমত হয়ে আমরাও মনে করি ব্যাপক বিস্তৃত কোচিং সেন্টারগুলোর এমন কার্যক্রমে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানসহ জাতির সার্বিক মূল্যবোধ। ফলশ্র“তিতে ক্রমান্বয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। বিশ্বাস করতে পারছেনা যে কোচিং/প্রাইভেট ছাড়াও ভাল ফলাফল করা যায়। ভীতি বসত: ঝুঁকে পরছে এসব প্রতিষ্ঠানে। সফল শিক্ষাথী আব্দুল হালিম (৪র্থ মেধাস্থান, মানবিক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) মনে করে সাফল্য নির্ভর করে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা, নিজের প্রচন্ড আগ্রহ এবং ধারাবাহিকভাবে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার উপর। কোচিং/প্রাইভেট দিয়ে খুব বেশি সফল হওয়া সম্ভব নয়। আরেক সফল শিক্ষার্থী ইমামুল ইসলাম শিমুল (১৩ তম, মানবিক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ) মনে করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কলেজ জীবনের দুটো বছরের কঠোর পরিশ্রম বিজ্ঞাপনের অভাবে আলোর মুখ দেখে না। বাবা-মা, ভাই-বোন কলেজ শিক্ষক যাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আজকের যে সাফল্য সেটিরও অকাল মৃত্যু হয়। শুধু বেঁচে থাকে কোচিং সেন্টারের সাফল্য। কেউ এসব খবর জানতেই পারে না। প্রকৃত সত্যটি ঢাকা পড়ে যায়। প্রকৃত সাফল্য আসবে যদি একজন শিক্ষার্থী নিজে পড়া-লেখায় আগ্রহী হয় অন্যথায় নয়। বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলে এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে ভাল কোচিং সেন্টার নেই কিংবা ভাল শিক্ষক নেই সেখানেও শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাবে। নিঃসন্দেহে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক পরিশ্রমী। যথাযত পাঠ্যপুস্তক যোগান দেওয়া সম্ভব হলে বিজয় কেতন উড়বেই। ব¯ু‘ত তাদের সামনে নেই কোন মডেল যাকে তারা অনুসরণ করবে, তাদের সামনে নেই কোন প্রতিষ্ঠান যারা তাদেরকে স্বপ্ন দেখাবে, সঠিক নির্দেশনা দিবে।

সু-শিক্ষণ এবং এবিসি সেলফ্ এডুকেশন
শিক্ষার মানোন্নয়নে সত্যিকার অর্থে যেসব সহায়ক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে আমরা তাদের বিপক্ষে নই তবে প্রশ্ন করতে চাই তাদের কার্যক্রমে কতটুকু শিক্ষার গুণগত মানের উন্নতি হচ্ছে। সরকারসহ বিভিন্ন সচেতন মহল থেকে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধের দাবি উঠলেও কার্যত তেমন অগ্রগতি নেই। আমরা বন্ধের পক্ষে নই, সংস্কারের পক্ষে, পরিবর্তনের পক্ষে। কোচিং সেন্টারগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরণের প্রভাব রয়েছে। বিশেষ নেতিবাচক দিক হলো এখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের চেয়ে পরীক্ষায় গ্রেডিং বৃদ্ধিতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। নম্বর ব্যতিত তারা অন্য কিছু ভাবতে পারে না। অনুশাসিত অভিভাবকগণও সংগত কারণে সন্তানের ভাল গ্রেড অর্জনে এগিয়ে আসেন । অধিকাংশ অভিভাবকগণ নেতিবাচক এই স্রোতে ঘা ভাসিয়ে দিচ্ছেন। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে প্রাথমিক,মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে জ্ঞার্নাজনের চেয়ে নম্বর পাওয়ার প্রবণতা বেশি। এই অসুস্থ্য সংস্কারটি ভেঙ্গে যায় যখন একজন শিক্ষার্থী অনেক ভাল রেজাল্ট (ডাবল গোল্ডেন জিপিএ-৫) নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে পাশ নম্বর তুলতে পারেনা। পক্ষান্তরে দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন ও পাশ নম্বর দুটোই অর্জন করতে সক্ষম হয়। অভিভাবকগণও তাদের সন্তানদের শ্রেষ্ঠ আর সর্বগুণ সম্পন্ন করে তোলার জন্য যেকোন কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত হন।

ইতিমধ্যে আমরা অবগত যে জিপিএ- ৫ বৃদ্ধি মানে শিক্ষার মান বৃদ্ধি নয়। নেত্রকোনাসহ দেশের সকল কোচিং পরিচালকদের আমরা আমন্ত্রণ জানাই আসুন সনাতনী ধারার কোচিং পদ্ধিতি থেকে বের হয়ে দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতি (Participatory Self-education Approach) শুরু করি। যখন মোবাইল, ইন্টারনেট, টিভি কিছুই ছিল না তখনও আশির দশকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় মফস্বল এলাকা থেকে শতকরা ৮০ জনের অধিক পাশ করতো। বর্তমানে এই পরিসংখ্যান অতি নগণ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে যার টাকা ব্যয় করেও মানসম্মত শিক্ষা নেই। দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছরে কোচিং পদ্ধিতি আমাদের দেশকে মানসম্মত শিক্ষায় এগিয়ে নিতে পারে নি। আমরা বিশ্বাস স্বল্প টাকা ব্যয় করে চঝঅ পদ্ধতি প্রয়োগ করে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব। গতানুগতিক কোচিং পদ্ধতিতে এইচ.এস.সি ১ম বর্ষ থেকে শুরু করে ভার্সিটি ভর্তি কোচিং পর্যন্ত ১ জন শিক্ষার্থীর পিছনে শুধু নানা রকম টিউশন ফি বাবদ গড়ে ব্যয় হয় প্রায়- ৭০-৭৫ হাজার টাকা। ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা ৭-৮%। অন্যদিকে চঝঅ পদ্ধতিতে গড়ে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ২০-২৫ হাজার টাকা। চান্স পাওয়ার সম্ভাবনা ৭০-৮০%। সম্মানিত পাঠক একটু ভেবে দেখুন তো কোনটি আমাদের প্রয়োজন কোচিং নাকি দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতি।

সঠিক নির্দেশনা, পরিচালনা তত্বাবধান এবং উৎসাহ দিয়ে বিগত ৬ বছরে আমাদের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর বিচরণ ঘটেছে বাংলাদেশের প্রায় সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি মানদন্ডে দু’বছর বৃহত্তর ময়মনসিংহে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। ২০০৮ থেকে আজ পর্যন্ত নেত্রকোনা জেলা থেকে মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের ভার্সিটি ভর্তিতে সেরা সাফল্যের ৮০% এর অধিক আমাদের শিক্ষার্থীর। নেত্রকোনা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগে বিগত ৫ বছরে যারা ভর্তির সুযোগ পেয়েছে একজন ব্যতিত সবাই দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতি-এর শিক্ষার্থী। বিগত ৭-১০ বছরের মধ্যে এই প্রথম এ বছর নেত্রকোনা থেকে ঢাবিতে বাণিজ্য বিভাগে চান্স পেয়েছে একটি মেয়ে- শারমিন জাহান- নেত্রকোণা সরকারি কলেজ, সেও আমাদের শিক্ষার্থী। চঝঅ পদ্ধতির মাধ্যমে এবছরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ ও ১৩ তমসহ সর্বমোট ৪২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি আমাদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে চায় আমরা তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।

বর্তমানে মানসম্মত শিক্ষার খোঁজে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা/ময়মনসিংহে কোচিং করতে যাওয়ার প্রবণতা দিনে দিনে কমছে। বরং ১ম বার ঢাকা/ময়মনসিংহে কোচিং করে ভার্সিটিতে ভর্তি না হতে পেরে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে নেত্রকোনায় এসে এবিসি সেলফ্ এডুকেশনে ভর্তি হচ্ছে। তাদের অভিমত অধিকাংশ বড় বড় কোচিং সেন্টারে সারাদেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে শতকরা ১০ জনের অধিক চান্স পায় না। অন্যদিকে এবিসি সেলফ্ এডুকেশনের সাফল্যের পরিসংখ্যান শতকরা ৮০ জনের অধিক, খরচও কম। তার চেয়েও বড় কথা এই পদ্ধতিতে বই পড়া শেখা হয়, নোট বা বস্তাপচা শীট নামক বিশেষ জিনিসে অভ্যস্থ করানো হয় না।

আমরা বিশ্বাস করি বিশ্বায়নের এই যুগে কোচিং নয়, চাই জ্ঞান-ভিত্তিক দলগত স্বশিক্ষা পদ্ধতি, চাই বই পড়া। গতানুগতিক কোচিং করে ছাপোষা কেরানী, পেটি অফিসার হওয়া যায় কিন্তু একজন যতীন সরকার, নির্মেলেন্দু গুণ কিংবা খালেকদাদ চৌধুরী হওয়া সম্ভব নয়। আলোকিত মানুষ হতে প্রয়োজন স্বশিক্ষার। তাই প্রতিথযশা সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী অনেক আগেই বলেছেন- “সুশিক্ষিত ব্যক্তি মাত্রই স্বশিক্ষিত”। এই স্বশিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সাধারণ শিক্ষির্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করতেই এবিসি সেলফ্ এডুকেশন নিরবে নিভৃতে চঝঅ পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের এবিসি সেলফ্ এডুকেশন, এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের নেত্রকোনা। শিক্ষা সেবার নামে সকল ধরনের প্রতারণা বন্ধ হোক, এগিয়ে আসুক শুভ বুদ্ধির মানষেরা, বাংলাদেশের মানচিত্রে সুচিত হোক আলোকিত নেত্রকোনা। আমাদের প্রিয় এই নেত্রকোনা জেলায় শিক্ষা সেবার নামে কেউ প্রতারণা করুক এটি কোন ভাবেই কাম্য নয়। আমাদের সন্তানদের জীবন নিয়ে কেউ ব্যবসা করুক এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা প্রচার করছি স্বশিক্ষার পক্ষে। আমরা কাজ করছি নতুন-সমাজ বিনির্মাণ করতে। আমরা এগিয়ে চলছি স্বশিক্ষা দিয়ে স্বনির্ভর দেশ গড়তে।

লেখক : নির্বাহী প্রধান, এসোসিয়েশন ফর বেটার কমিউনিটি ([email protected])

পাঠকের মতামত:

২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test