E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তুই ঋণ খেলাপি

২০১৯ জুলাই ২৭ ১৮:৩২:১৭
তুই ঋণ খেলাপি

চৌধুরী আবদুল হান্নান


জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর “বহুব্রীহি” ধারাবাহিক নাটকে টিয়া পাখির কণ্ঠে “তুই রাজাকার” বোল ফুটিয়েছিলেন। বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশে এক সময় রাজাকার শব্দটি মানুষ বলতে সাহস পেত না, তখন এ বরেণ্য লেখক গণমানুষের মনের কথাটি একটি পাখির জবানীতে প্রকাশ করেছিলেন, যা ছিল ওই সময়ে টক অব দি কান্ট্রি। রাজাকার শব্দটি আমাদের নিকট একটি ঘৃন্য গালি।

এবার ঘোষিত বাজেটের প্রায় এক পঞ্চমাংসের সমান অর্থ ব্যাংকের ঋণ খেলাপিদের হাতে, মাত্র তিনশত খেলাপি গ্রাহক ১৭ কোটি মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে।

খেলাপি ঋণের বোঝা ব্যাংকগুলো আর বহন করতে পারছে না, ক্রমে আরও ভারী হচ্ছে। এ অতিরিক্ত অর্থ মুদ্রা বাজার ও পুঁজি বাজারে প্রবেশ করে দ্রব্য মূল্যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে, পুঁজি বাজার অস্থির করছে। এ অর্থে অবৈধ অস্ত্র, মাদক ইত্যাদি ব্যবসা গতিশীল হয়, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। প্রতিটি নাগরিকের এ বাজার অস্থিরতার জ্বালা ভোগ করতে হয়।

খেলাপি ঋণ আদায়ের এ যাবৎকাল গৃহীত ব্যাংকগুলোর প্রায় সকল উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক যখন নখদন্তহীন নিধিরাম সর্দারে পরিনত হয় তখন তো এমন হবেই।

অথচ যারা যত বড় খেলাপি, এক সময়ে তারাই আবার বেশি সুবিধা পায় ব্যাংক থেকে। পরিস্থিতি এতটা নাজুক যে, খেলাপিদের বিষয়ে আরও বাড়তি সুবিধা দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীর প্রতি আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা যায়, “যারা ব্যাংক লুট করেছেন, তাদের দুধ কলা দিয়ে পুষছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার দুষ্টর পালন, শিষ্টের পালন।”

জনগণের এক ধরনের চাপে, মিডিয়ার চাপে মাননীয় অর্থমন্ত্রী শীর্ষ ৩০০ ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা সম্প্রতি সংসদে প্রকাশ করেছেন। তাদের কাছে ব্যাংকের আটকা আছে ৫১ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য এর বাইরে অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা আরও ক্ষমতাবান খেলাপি কিন্তু তাদের নাম খেলাপির তালিকায় রাখা যাবে না, কারণ তারা আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে খেলাপি থেকে মুক্ত রয়েছেন।

ব্যাংকিং পরিভাষায় খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত সকলকে একই মানদন্ডে বিচার করা সমীচীন নয়। কারণ অনেকে আছেন যারা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি নন, নানা কারণে তাদের ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদী ভাঙন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তার মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি কারণে যাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, সর্বশান্ত হয়েছেন, তাদের একটা আলাদা তালিকা কেন্দ্রীয়ভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকা জরুরি। তাদের ঋণ সমন্বয়ের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে, সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে হবে। ফলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকগণ দায়মুক্তি পাবে এবং ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমান কমে যাবে।

আর যারা ইচ্চাকৃত ঋণ খেলাপি, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করছে না, আর বেনামি ঋণ, অবলোপনকৃত ঋণের সুবিধাভোগী, তারাই ব্যাংক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, এরাই বিদেশে অর্থ পাচারকারী, সেকেন্ড হোমের মালিক। তারা বেপরোয়া, তারা বিশ্বাস করে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করলে কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। তারা যে পয়সায় ঝলমলে বিলাসী জীবন যাপন করেন, সে অর্থ তাদের অর্জিত নয় বরং যোগসাজশ, কারসাজির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া। যে অর্থ তাকে ফেরত দিতে হবে না, সে অর্থেও ক্ষমতা, দাপট সীমাহীন যার অভিঘাতে নাগরিকেরা বিপর্যস্ত। সমাজের এ সকল রাঘব বোয়াল অর্থনৈতিক সন্ত্রাসীকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা তো জনগণের নেই, কিন্তু নিরন্তর অন্তর্জ্বালা আছে। তাই আমরা ওদের চিহ্নিত করি, আঙ্গুল উঁচিয়ে ঘৃরাভরে বলি-“তুই ঋণ খেলাপি।”

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।

পাঠকের মতামত:

১৯ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test