E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধু ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব

২০১৯ অক্টোবর ২৮ ১৬:০০:৩৮
বঙ্গবন্ধু ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব

এবিএম সালেহ উদ্দীন


বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে অর্থ্যাৎ পাকিস্তান আমলেই ভারতবর্ষের একজন আলোচিত রাজনীতিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন । এই প্রতিষ্ঠালাভের অন্যতম কারণ গণমানুষ । গণমানুষের মুক্তি, অধিকার আদায়ের প্রত্যয়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন । গণতন্ত্রের মানসপূত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির একজন বিশ্বাসী ও নিবেদিতপ্রাণ অন্যতম অনুজপ্রতিম বিশ্বাসী নেতা ছিলেন তিনি । সোহরাওয়ার্দি যেমন তাঁর প্রভাবপ্রত্তি জমিদারিসহ সমগ্র সম্পদ সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিলীন করে রাজনীতিতে অংশ করে সাধারণ মানুষের কাতারে চলে এসেছিলেন । মজলুম জননেতা মাওলানা ভাষানীর সংগেও একনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন । বঙ্গবন্ধুর দুই মহান রাজনৈতিকগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাষানীর আন্তর্জাতিক পরিচিতি ছিল । তবে পরবর্তীতে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ রাজনীতির ধারবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি অনেকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল । পূর্বসূরী নেতাদ্বয়ের মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর সমগ্রজীবন গণমানুষের স্বার্থে ব্যয় করেছেন । জনগণের স্বস্তি- শান্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন । তিনি সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে বহুবার জেল খেটেছেন । 

মহান ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে শুরু করে দেশ স্বাধীনের পূর্বমুহুর্ত জনগণের জন্য পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর মতো এত বৈচিত্রময় চড়াই-উৎরাই এবং এত জেল খাটার নজীর আর কোন রাজনৈতিক নেতার জীবনে
ঘটেনি । তিনি পাকিস্তান সরকারের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি সবসময় সোচ্চার ও প্রতিবাদী ভূমিকায় ছিলেন । উনিশ শো একাত্তুর সালের পঁচিশে মার্চের কালোরাতে পাকহানাদার বাহিনীর মাধ্যমে গণহত্যা শুরুর আগে অর্থ্যাৎ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীজীবন কাটান । পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আগে সেটিই ছিল তাঁর সর্বশেষ জেলজীবনের সবচেয়ে উৎকন্ঠিত সময় । তিনি ছিলেন তৎকালীন সময়ের নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি ও জনকল্যাণের একনিষ্ঠতাই তাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে বেশি পরিচিত করে তোলে ।

বিশ্বের বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অগ্রনীভূমিকা রাখতে গিয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেচে নিয়েছিলেন । বিশ্বের মানবতাবাদী এই নেতা ২৭ বছর জেল খেটেছেন । জীবনের কঠিনতম সময়ে কারানিবাস এবং নানাবিধ নির্যাতন সয়েও মানবতার মুক্তি সংগ্রামে পিচ

পা হন নি । বর্ণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অনড় ও সোচ্চার । গণমানুষের স্বার্থে নিজের নীতিবোধের সুদৃঢ় অবস্থানের ফলেই নেলসন ম্যান্ডেলা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান পৃথিবীতে মানবতার স্বার্থে, স্বাধীনতা ও গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন হয় । সেসব আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী এবং অংশগ্রহনকারীরা কারাবরণ করেন,নির্যাতনের শিকার হন, এমনকি অনেকের ফাঁসি হয় ও করুণ মৃত্যু ঘটে । প্যাসিবাদ ও শোষণের শিকার হয়ে কত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয় । এমন অনেক দৃষ্টান্ত আছে ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের কারাবরণ করার (ফাঁসির আদেশসহ) এমন অনেক ঘটনা আছে । সেসব ইতিহাসের অংশ হতে পারে ।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উথ্যানপর্ব এবং তার বহুমাত্রিক বিচক্ষণতায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়ার ফলে তিনি ছিলেন বিশ্বের একজন আলোচিত রাজনীতিক । গণমানুষের মু্ক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার করতে গিয়ে রাজনীতির সাথে দীর্ঘজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে কারাবরণের বিষয়টি তাঁকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছিল ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সৌদী আরবসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন না দিলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরার পর সেসব দেশের সমর্থন আদায় করতে
সক্ষম হন । বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ভাষণ প্রধান করেন । সেটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম ঐতিহাসিক ভাষণ । আন্তর্জাতিক বিশ্বে সেই ভাষণের (মাতৃভাষা বাংলায়) পর বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি আরও বেশি বেগবান হয় ।

একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে সাতই মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসক্রোস (বর্তমান সোহরওয়ার্দি উদ্যান)ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ঐতিহাসিক এবং আজ তা ইতিহাসের অংশ । এই ভাষণটির মুলকথা স্বাধীন বাংলাদেশ ।

ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসু'র একটি বিখ্যাত উক্তি, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও,আমি তোমাদের স্বাধীনতা দিব '।

আন্তর্জাতিক বিশ্বে সুবাস চন্দ্র ছিলেন একজন বিশ্ব রাজনীতিক ।

তারও অনেক পরে এসে স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু বলেছেন:

"রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।"

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সর্বশেষ পর্যায়ে সাতই মার্চের উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগামসংকেত ।

বাংলাদেশের মহান মুক্তযুদ্ধ ও স্বাধীনতার জন্য এই ভাষণটি ঐতিহাসিক এবং এর গুরুত্ব অপরিসীম । এই ভাষণের প্রেরণায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র মানুষ স্বাধীনতার জন্য ব্যগ্র-ব্যাকুল ও উদ্দীপ্ত উত্তাল হয়ে

উঠেছিলেন । এই ভাষণের মূল প্রেরণা শুধু বাংলাদেশ নয় পৃথিবীর স্বাধীনতাবন্চিত নিপীড়িত মানুষকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রেরণাদায়ক ও শক্তি-উদ্দীপক হতে পারে ।

অন্যকিছু না হলেও শুধু সাতই মার্চের ভাষণের কারণেও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্বে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ।
পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরনার উৎস হিসাবে জাতীয়কবি কাজী নজরুল ইসলামের'বিদ্রোহী'কবিতা যেমন চিরঅক্ষয় ও অবিস্নরণীয় । 'বিদ্রোহী' কবিতার মর্ম উপলব্ধিতে যেমন বিশ্বের শান্তি ও মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে অনুপ্রেরনা,সাহস ও শক্তি যুগায় ।
তেমনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর নিপীড়িত গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামে উদ্দীপ্ত ও জাগরণ সৃষ্টি করতে পারে । সাহস যুগাবে পারে ।

নতুন রাষ্টপুন্জের দায়িত্ব হাতে নেয়ার পর বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিগণিত করতে । তাঁর স্বপ্ন ছিল দুঃখি ও নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে । কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ! সময় তাঁকে সেটি সম্পন্ন করতে দেয় নি ।

তবে তাঁর স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হলেও কিংবা ভুল করে থাকলেও গণমানুষের নেতা হিসাবে তিনি ছিলেন সফল ।

এখানে কমরেড হিলটনের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ছে : "সফল মানুষেরা কাজ করে যায় । ভুল করে ভুল শোধরায়, কিন্তু হার মানে না ।"

বঙ্গবন্ধুও সে রকম সাহসী মানুষ ছিলেন । তিনি গণমানুষের স্বার্থে নিজের সর্বস্ব বিলীন করতে প্রস্তুত ছিলেন । আজ যারা তাঁকে নিয়ে রাজনীতি করছেন তারা তাঁকে কতটুকু ভালোবাসেন । তাদের দেমাগে আসল বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু ধারণ করেন । দেশ ও গণমানুষের জীবনের নিরাপত্তা, স্বস্তি-শান্তি নিয়ে কতটুকু ভাবছেন ।

নাকি স্বার্থপরের মতো নিজের প্রভাব ও কুটিল প্রতিপত্তিকে শুধু বাড়ানোর অপচেষ্টা করছেন । এ প্রশ্নটি সময়ের ।

শেষ করবার আগে মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে শেষ করছি ।

"সম্পন্ন করবার আগে সবকিছুই অসম্ভব মনে হয় ।"

বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছেন এবং সফলও হয়েছেন । এইদিক থেকে তিনি সফল নেতা । তিনি স্মরণীয় । তিনি অনির্বাণ ।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক ।

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test