E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বন্ধু ফারুকের মৃত্যু এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের জন্ম

২০১৯ ডিসেম্বর ২৪ ২২:৫৫:৪৫
বন্ধু ফারুকের মৃত্যু এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের জন্ম

অধ্যাপক ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন


কী দু:সহ দিন ছিল আমাদের। পেশাগত বিচরণের জায়গাগুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে স্বাস্থ্যখাতে ড্যাবের দু:শাসন বেড়েই চলছে। সরকারী সব চাকুরিতে যেন আমরা নিষিদ্ধ। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাস ছাড়া। ফাইনাল প্রফ পাশ করেও ইন্টার্ণশীপ করতে পারছে না অনেকেই।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ (রমেক) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আমার বন্ধু, একই ব্যাচের। রমেক ছাত্রলীগের ১৯৯০ সালের সভাপতি ছিলেন রায়হান ভাই, সাধারণ সম্পাদক ছিল ফারুক। সেবার নবীন বরণে প্রধান অতিথি ছিলেন আজকের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ভাই, বিশেষ অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আশিকুর রহমান (পরবর্তীতে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী), আর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমি ছিলাম প্রধান বক্তা। ঢাকা থেকে আরো গিয়েছিল সেসময়ের জনপ্রিয় ব্যাণ্ড ‘ডিফারেন্ট টাচ’। সেবারই রংপুরে ফারুকের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।

একানব্বইয়ে জামায়াতের সহায়তায় ক্ষমতায় এসেই স্বাস্থ্যখাতে ড্যাবের দু:শাসন কায়েম হয়, আমরা আকস্মিক নির্যাতনের মুখে পড়ে যাই। বন্ধু ফারুক ফাইনাল প্রফ পাশ করেও ক্যাম্পাস ছাড়া, বাধ্য হয়ে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ণশীপ করে। বন্ধুবৎসল ফারুক ময়মনসিংহ মেডিক্যালে থাকাকালিনও অল্পদিনের মধ্যেই সবার মন জয় করে ফেলে। ময়মনসিংহ মেডিক্যালের বন্ধুরা দেখা হলে এখনো ফারুকের কথা বলে।

ইন্টার্ণশীপ শেষ করে ঢাকায় এলে ফারুকের সাথে আবার দেখা হয়, ফারুক একটা ক্লিনিকে কাজ করে। আমাদের প্রায়ই দেখা হত শাহবাগে, তৎকালিন পিজি (আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালের লাইব্রেরীর পাশের ক্যান্টিনে কিংবা বটতলায়। আমাদের মস্তিষ্কে তখন গিজগিজ করে সংগ্রাম। অন্যায়কে মেনে না নেবার স্বভাবটা তখনো প্রকট। আমরা ‘আনএমপ্লয়েড ডক্টরস এসোসিয়েশনের’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হবার চেষ্টা করি। বরিশাল মেডিক্যালের পারভেজ ভাই, মুহিত ভাই, সাচ্চু ভাই, সিলেট মেডিক্যালের জাহাঙ্গীর ভাই, শাম্মী ভাই (বর্তমানে প্রয়াত), রংপুর মেডিক্যালের রায়হান ভাই, ফারুক, ময়মনসিংহ মেডিক্যালের মামুন, ঢাকা মেডিক্যালের মনিসুর বাবু, আমি....আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা সব একসাথে মিটিং করি, আন্দোলন করি। তখন আমরা তীব্রভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী চিকিৎসকদের জন্য একটি জাতীয় একটি সংগঠনের তীব্র অভাব বোধ করি। আমরা জোর গলায় নিজেদের একটি সংগঠনের জন্য দাবী তুলি।

এরকম সময়ে একটি দূর্ঘটনা ঘটে যায়। সামান্য একটি অসুখের চিকিৎসার জন্য ফারুক একটি ক্লিনিকে ভর্তি হলে সেখানে তার অপারেশন হয়। সেই অপারেশনে জনৈক প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ সার্জনের চরম অবহেলা ও অদক্ষতায় আমাদের বন্ধু ফারুক টিটেনাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আমরা অনেক চেষ্টা করেও ফারুককে বাঁচাতে পারিনি।পরবর্তীতে আমাদের আরেক বন্ধু মামুন ফারুকের চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর প্রতিবাদে বিএমডিসিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের করেছিল।

ফারুকের চিকিৎসায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর প্রতিবাদে বিবৃতি দেবার মত আমাদের নিজস্ব বৃহৎ কোন চিকিৎসক সংগঠন তখন ছিল না। আমি, মামুন, রায়হান ভাই, মুহিত ভাই, পারভেজ ভাইসহ কয়েকজন বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসভবন ২৯, মিন্টো রোডে জননেত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে ছুটে গেলাম। সব শুনে আপা জানতে চাইলেন, কেন এখনো আমাদের চিকিৎসকদের সংগঠন করা হয়নি। এখনকার মত তখনো আমি যুগপৎ বিপ্লবী এবং বোকা ছিলাম। আমি আপাকে বললাম, ‘ওনারাতো বলেন আপনি নাকি মানা করেছেন।’ আপা তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠন করবার ব্যাপারে আমাদের নির্দেশ দিলেন।

আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ শুরুতে চাননি ড্যাবের মত আমরাও কোন চিকিৎসক সংগঠন করি। তাদের বক্তব্য ছিল, চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন হল বিএমএ, এর বাইরে ড্যাবের মত সংগঠনের দরকার নেই। তাদের এই বক্তব্যটি নি:সন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, তবে তখনকার বাস্তবতায় মেনে নেবার মত ছিল না। একদিকে ড্যাবের দু:শাসন, অন্যদিকে বিএমএও তাদের দখলে। নিজস্ব চিকিৎসক সংগঠন ছাড়া তখন আমাদের কাছে খুব বেশী বিকল্প ছিল না।

ফারুকের মৃত্যুর পর একটি সংগঠন গড়ার জন্য আমাদের তৎপরতা আরো জোরদার হয়। সমমনা চিকিৎসকদের নিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকটি সভা হয়। তার মধ্যে শেষ সভাটি হয় ধানমণ্ডি তিন নম্বর রোডে ডা. মোমেন ভাইয়ের মালিকানাধীন জেনারেল ফার্মাসিউটিক্যালসের অফিসে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই সভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় আমি বলেছিলাম, ‘নিজস্ব সংগঠনবিহীন আজকের মধ্যাহ্নভোজনই হোক শেষ মধ্যাহ্নভোজন।’ নেতৃবৃন্দ আমাদের এই অনুরোধটি রেখেছিলেন। তারপরের ঘটনাগুলো খুব দ্রুত গড়ায়। প্রয়াত এমপি ডা. আবু ইউসুফের সভাপতিত্বে গঠিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মহাসচিব নির্বাচিত হল অধ্যাপক ডা. এম এ কাদেরী এবং ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। প্রথম কমিটির আমি ছিলাম গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক ডা. ইসমাইল খান, দপ্তর সম্পাদক পদে ছিলেন ডা. ইশতিয়াক মিল্টন ভাই। বিভিন্ন পদে আরো ছিলেন ডা. শফিকুর রহমান, বদিউজ্জামান ডাবলু ভাই, নজরুল ভাই, শারফুদ্দিন ভাই, জগলুল ভাই, খালেক ভাই, জাহিদ ভাই, রোকেয়া আপা, খান ভাই, জামালউদ্দিন চৌধুরী ভাই, এমদাদ ভাই, সফু ভাই, যোসেফ, চিশতীসহ প্রবীন-নবীন আরো অনেকে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ নামটি প্রস্তাব করেছিলেন ডা. নোমান ভাই। সংবিধান লেখার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন কালাম ভাই ও ডা. শারফুদ্দিন ভাই।

স্বাচিপের প্রথম পোস্টারটি প্রকাশ করেছিলাম ১৯৯৪ সালের বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে। পোস্টার ছাপানোর টাকা দিয়েছিলেন ডা. মোমেন ভাই। প্রথম সেই পোস্টারটির শ্লোগান হিসেবে আমার ছোট্ট একটা কবিতার পংক্তি ব্যবহার করেছিলাম:
‘বাংলাদেশ-
হৃদয় দিয়ে আগলে রাখি
কীর্তি দিয়ে সাজাই।’

এভাবেই স্বাচিপের জন্মের সাথে বন্ধু ফারুক জড়িয়ে আছে। আমাদের নতুন প্রজন্মসমূহের কথা ভেবে স্বাচিপের জন্মের ইতিহাস লিখে রেখে গেলাম, যাতে তারা সত্যটুকু জানতে পারে। বর্তমান নেতৃবৃন্দের অনেকেই স্বাচিপের জন্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন না বা এর বিস্তারিত ইতিহাস জানেন না। শুনেছি স্বাচিপের বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্যবৃন্দের নামের যে তালিকা আছে, তাতে আমাদের অনেকেরই নাকি নাম নাই। আমি অবশ্য এটা সত্য না মিথ্যা তা জানি না, কারণ তালিকাটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে এটুকু জানি, আমার প্রসঙ্গ উঠলে বর্তমানের এক নেতা নাকি বলেছিলেন, ‘এটা আবুল হাসনাৎ মিল্টন না, এটা হল ইশতিয়াক মিল্টন।’ অথচ প্রকৃত সত্য হল দুই মিল্টনই স্বাচিপের জন্মের বেদনার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, দুজনই স্বাচিপের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

ফারুক মারা গিয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১৭ মার্চ। প্রায় ২৬ বছর হয়ে গেলো ফারুককে দেখি না। তবু প্রাণে বাজে ওর কথা, কারণে- অকারণে মনে পড়ে ওকে। আমরা যে প্রতিকূল সময়ের বন্ধু, আমরা কী করে ভুলে থাকবো ফারুককে!

তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস বন্ধু। তোর জন্য চোখের জল আর ভালবাসা আজো বহমান।

পুনশ্চ: লেখাটা লিখতে গিয়ে অনেক পুরোনো স্মৃতি সামনে এসে দাঁড়ালো। অনেক খুঁটিনাটি ঠিকমত মনে করতে পারলাম না। সমমনা চিকিৎসকদের বলছি, লেখাটিতে সংযোজন করবার মত যদি কিছু থাকে জানাবেন। আমি চাই ভবিষ্যতের স্বার্থেই
সত্য ইতিহাসটুকু সংরক্ষিত থাকুক।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, অস্ট্রেলিয়া আওয়ামীলীগ।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test