E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতির স্বজনই জাতির পিতা শেখ মুজিব

২০২০ এপ্রিল ০৬ ১৩:১৬:৪২
অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতির স্বজনই জাতির পিতা শেখ মুজিব

রহিম আব্দুর রহিম


পাখ-পাখালির কুহুতান, আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, হালধরা মাঝির ভাটিয়ালি সুর, প্রত্যন্ত গ্রামের বুক চিঁড়ে প্রবাহিত মধুমতির শাখা, বাইগার নদী। এই নদীর তীর ঘেঁষে সাজানো গোছানো গ্রাম টুঙ্গিপাড়া, আজ থেকে শতবছর আগের কথা। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ (বঙ্গাব্দ ১৩২৭ এর ২০ চৈত্র) মঙ্গলবার শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা মায়ের আদরের ‘খোকা’ শৈশব থেকেই দুরন্ত, ডানপিটে, নদীতে লাফ-ঝাঁপ, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা, ধুলো কাদায় মাখা-মাখি, বাবুই পাখির বাসা খোঁজা, মাছরাঙার মাছ শিকার অবলোকন, দোয়েল পাখির সুর শোনাই ছিল খোকার শৈশবের বড় নেশা। গ্রামের সব শিশুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরে ফিরে প্রকৃতিকে সে আপন করে নেন। শালিক ও ময়না পাখির ছানা ধরে এনে তাদের সাথে কথা বলা, শিষ দেওয়া, বানর ও কুকুর পোষাই ছিল দুরন্ত ডানপিটে টুঙ্গিপাড়ার এই প্রকৃতিপ্রেমি খোকার। খোকাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে একটি সরু খাল চলে গেছে মধুমতি ও বাইগার নদীর সংযোগ লক্ষ করে। এই খালের পাড়ে বাবা লুৎফর রহমানের ‘কাচারিঘর’ আর এই কাচারি ঘরের পাশেই ছিল খোকার মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের থাকার ঘর। এঁরাই গৃহশিক্ষক হিসেবে খোকাকে আরবী, বাংলা, ইংরেজী ও অংক শেখাতেন। শেখ মুজিবের শৈশবকালের কর্মকান্ডই প্রমাণ করে তিনি ছিলেন মাটি মানুষের প্রিয়জন, পশু-পাখি, গৃহপালিত প্রাণিদের পরম বন্ধু। তার পশু প্রেমই প্রমাণ করে সেই অমর বাণী, ‘‘যেজন সেবেছে পশু, সেইজন সেবেছে ঈশ্বর।’’

শেখ মুজিব ছোট থেকেই ছিলেন যেমন দুরন্ত, চঞ্চল তেমনি দুষ্টুমিতে পরিপূর্ণ। তবে তিনি কোনদিনই তাঁর শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি করেন নি। শিক্ষকদের তিনি প্রচন্ড শ্রদ্ধা করতেন, কখনো মাথা উঁচু করে কথা বলেন নি। নিঁচু হয়ে বিনম্র ভাষায় স্যারদের সাথে কথা বলেতেন। একদিনের এক ঘটনা, খোকা পড়া শেখেনি বলে, তাঁর শিক্ষক তাঁকে কষে এক থাপ্পড় দিয়েছিলেন। এতে খোকা মাটিতে পড়ে যায়।

এই শিক্ষক তাঁদের বাড়ি থেকে অন্য জায়গায় যেদিন চলে যান, সেই দিন খোকা নামের আদর্শ এই শিশুটি ওই শিক্ষকের বিছানাপত্র ও প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় নিজে মাথায় বহন করে তিন কিলোমিটার দুরে ওই শিক্ষকের নতুন কর্মস্থলে দিয়ে আসেন। আসার পথে শিক্ষকের পা ছুঁয়ে আর্শীবাদও নেন। খোকা ছোট থেকেই নামাজ পড়েছেন, রেখেছেন রোজা, আবার গ্রামের হিন্দু পরিবারের সাথে অবাধে মেলামেশা করেছেন, তাদের পূজা-পার্বনে স্বত:স্ফুত অংশগ্রহণ করে প্রসাদ নাড়– খেতে ভুলে নি। ফলে তিনি অসাম্পদায়িক চেতনায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছেন। তিনি কখনই বাবা-মার অবাধ্য হয়নি।

বাবা-মা যা বলেছেন, তাই তিনি শুনেছেন, করেছেন। ছোটকালেই তিনি ব্রতচারীনৃত্য শেখেন। যে নৃত্য মানুষকে দেশপ্রেমী করে গড়ে তোলে। সন্ধা নামলেই তিনি পাড়ার সব ছেলেদের সাথে নিয়ে গ্রামের পালাগান, যাত্রাগান শুনতে যেতেন। লুকিয়ে আবার ঘরেও আসতেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি, ফুটবল খেলায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি তাঁর গ্রাম থেকে মধুমতি নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাটে যেতেন ফুটবল খেলতে। এতে করে শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা-মা খুবই খুশি হতেন, তাঁকে অনুপ্রেরণাও দিতেন। বাবা-মা’র অনুপ্রেরনায় শেখ মুজিবুর রহমান শৈশব থেকেই ভালো ফুটবল খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। মাঠে ময়দানে খেলাধুলা করায় মানুষের সাথে তার পরম বন্ধুত্ব এবং দেশপ্রেমিক হওয়ার আদর্শিক শিক্ষা ও প্রকৃতিগত শিক্ষায় শিক্ষিত হন তিনি।

খেলাধুলা যে শুধু শারীরিক যোগ্যতার পাথেয় তা নয়, মাটি মানুষের প্রতি পরম প্রেমবোধ জাগিয়ে তোলে, তার অকাট্য প্রমাণ শেখ মুজিব। যে কারনে তিনি বাঙালির আদি সংষ্কৃতি রক্ষায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিল্পকলা একাডেমী’র কর্মকান্ডে বাঙালি’র আদি সংস্কৃতি লালন পালন এবং সংরক্ষনের নীতিমালা সংযুক্ত করে যান। সংষ্কৃতিমুখী করে যান। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বায়তুল মোকাররম মসজিদ জাতীয় করণ এর সম্প্রসারণ করেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ইসলামী ফাউন্ডেশন। তাবলীগ জামায়াতের জন্য তিনি কাকরাইল মসজিদ নির্ধারণ এবং বিশ্ব ইস্তেমার জন্য টঙ্গীতে জায়গা নির্ধারণ করেন।

শেখ মুজিব গ্রামের শিশু-কিশোরদের সাথে দলবেঁধে পথচলায় তিনি হয়ে ওঠেছিলেন শৈশবের জনপ্রিয় মানুষ। তিনি অন্যের কষ্টে ব্যথিত হতেন। একবার দেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগ দেখা দিলো। কৃষি মাঠে ভালো ফসল হয় নি। শেখ মুজিব তখন গোপালগঞ্জে থাকেন। গ্রামের বাড়িতে গেলেন বেড়াতে। এলাকার মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। চতুর্দিকে দুর্ভিক্ষ, মুজিব আর স্থির থাকতে পারলেন না। সেদিন বাড়িতে কেউ নেই। বাবা লুৎফর রহমান গেছেন পাটগাঁও পোস্ট অফিসে। ফিরতে অনেক দেরি হবে। এই সুযোগে তিনি গ্রামের লোকজনদের ডেকে নিজেদের গোলার ধান বিলিয়ে দেন। বাবা বাড়ি এসে সবকিছু জানলেন, শেখ মুজিবের উপর মনে মনে ক্ষেপে গেলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না।

এতে করে প্রমাণ হয়, আদর্শ বাবা-মা’রাই পারেন একজন দেশদরদী মানবপ্রেমী মানুষ সৃষ্টি করতে। পরিবেশ, প্রতিবেশের বাস্তবতায় ব্রিটিশ পাকিস্তানের অত্যাচার, অনাচার, নিপীড়ন, নির্যাতনের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিতে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ এর ৭ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে বজ্রকন্ঠে ঘোষনা দেন ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’’ শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। শৈশবের খোকা হয়ে ওঠেন, ‘জাতির পিতা’, অমর ইতিহাসে গ্রন্থিত হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এই জাতির পিতার ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ৫২তম জন্মদিনে এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী? এই প্রশ্নের জবাবে, বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’

এরপর তিনি বেদনা বিঁধুর কন্ঠে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না, আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটিনা এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নেই, অন্যের খেয়ালের যে কোন মুহুর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে, আমি জনগনের একজন, আমার জন্মদিনই কি? আর মৃত্যু দিনই কী? আমার জনগনের জন্যই আমার জন্ম-মৃত্য।’ তাঁর এই বক্তব্যই প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু বিশাল হৃদয় ও মহৎ গুণ ও মনের অধিকারী ছিলেন, দেশের মানুষকে তিনি প্রচন্ড ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্মদিনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মনি সিংহ বলেছিলেন, ‘১৯৫১ সালে কারাগারে বসেই শেখমুজিব বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরিকল্পনা করেছিলেন।’

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার স্ব-পরিবারকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কুলাঙ্গাররা চেয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তা হয় নি, বরং পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্য বিশাল জায়গায় স্থান পেয়েছেন।

তথ্যসূত্র : ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখমুজিবুর রহমান’, ‘আমার পিতা -শেখ হাসিনা।’ ‘তিনিই বাংলাদেশ’ ড. আতিউর রহমান।

লেখক: শিক্ষক, কলামনিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।

পাখ-পাখালির কুহুতান, আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, হালধরা মাঝির ভাটিয়ালি সুর, প্রত্যন্ত গ্রামের বুক চিঁড়ে প্রবাহিত মধুমতির শাখা, বাইগার নদী। এই নদীর তীর ঘেঁষে সাজানো গোছানো গ্রাম টুঙ্গিপাড়া, আজ থেকে শতবছর আগের কথা। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ (বঙ্গাব্দ ১৩২৭ এর ২০ চৈত্র) মঙ্গলবার শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা মায়ের আদরের ‘খোকা’ শৈশব থেকেই দুরন্ত, ডানপিটে, নদীতে লাফ-ঝাঁপ, বন্ধুদের সাথে মেলামেশা, ধুলো কাদায় মাখা-মাখি, বাবুই পাখির বাসা খোঁজা, মাছরাঙার মাছ শিকার অবলোকন, দোয়েল পাখির সুর শোনাই ছিল খোকার শৈশবের বড় নেশা। গ্রামের সব শিশুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরে ফিরে প্রকৃতিকে সে আপন করে নেন। শালিক ও ময়না পাখির ছানা ধরে এনে তাদের সাথে কথা বলা, শিষ দেওয়া, বানর ও কুকুর পোষাই ছিল দুরন্ত ডানপিটে টুঙ্গিপাড়ার এই প্রকৃতিপ্রেমি খোকার। খোকাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে একটি সরু খাল চলে গেছে মধুমতি ও বাইগার নদীর সংযোগ লক্ষ করে। এই খালের পাড়ে বাবা লুৎফর রহমানের ‘কাচারিঘর’ আর এই কাচারি ঘরের পাশেই ছিল খোকার মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের থাকার ঘর। এঁরাই গৃহশিক্ষক হিসেবে খোকাকে আরবী, বাংলা, ইংরেজী ও অংক শেখাতেন। শেখ মুজিবের শৈশবকালের কর্মকান্ডই প্রমাণ করে তিনি ছিলেন মাটি মানুষের প্রিয়জন, পশু-পাখি, গৃহপালিত প্রাণিদের পরম বন্ধু। তার পশু প্রেমই প্রমাণ করে সেই অমর বাণী, ‘‘যেজন সেবেছে পশু, সেইজন সেবেছে ঈশ্বর।’’

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test