E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মহামারি, মাদার তেরেসা এবং রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কার  

২০২০ এপ্রিল ১২ ২২:৪০:১৫
মহামারি, মাদার তেরেসা এবং রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কার  

রহিম আব্দুর রহিম


লেখার শুরুতেই রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতাটির সার-সংক্ষেপ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি। ‘হবু রাজার দেশে গবুরায় মন্ত্রী, একদিন হবুরাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, আমার পায়ে যেন ধুলো বালি না লাগে তার ব্যবস্থা কর। মন্ত্রী গবুরায় মহা বিপদে পড়লেন, চিন্তায় অস্থির, কান্নাকাটি এখন উপায় ! রাজ দরবারে গবুরায় নিরুপায়ের কথা জানালো রাজা মন্ত্রীর প্রতি মহাক্ষেপা সর্বোপরি রাজ্যের জ্ঞানী গুণি, যন্ত্রী, পন্ডিতসহ সবাইকে নিয়ে দরবার বসালো। দরবারে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা শেষেই সিদ্ধান্ত হলো। রাজ্যের ধুলিবালি ঝেড়ে ফেলার। এজন্য সাড়ে সতের লক্ষ ঝাঁটা ক্রয় করে শুরু হলো ঝাড়– দেওয়া। সারা রাজ্য ধুলোয় ভরে গেল, মানুষ হাঁচি-কাঁশি, সর্দি-জ্¦রে আক্রান্ত। ধুলো থামাতে গিয়ে এবার সিদ্ধান্ত নিলো সারা রাজ্যে পানি ছিটানোর, নদীনালা খালবিল, শুকিয়ে গেল, ধরাধাম পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো, জলজ প্রাণি মৎস মরে সাবাড়। আবারও মিটিং বসলো, এবার মিটিংয়ে কেউ বললো, সারাদেশে ফরাস বিছানোর জন্য। কেউ আবার রাজাকে নিশ্চিদ্র ঘরে রাখার পরামর্শ দিল। কেউ বললো চামার ডেকে এনে, দেশ চামড়া দিয়ে ঢেঁকে ফেলার জন্য। সর্বশেষ এক বৃদ্ধ মুচি বললো,

‘নিজের চরণদুটি ঢাকো, তবে ধরনী আর ঢাকিতে নাহি হবে।’

এবার হবুরাজার মন্ত্রী, গবুরায় বলে উঠলো,

‘আমারো ছিলো মনে, কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।’

জুতা আবিষ্কারের সাথে বাস্তবতা মেলানোর দায় পাঠক সমাজের। মুল আলোচনা হলো, সভ্য পৃথিবীতে যুগে যুগে যেমন মহামারী দেখা দিয়েছে, তেমনি মানবতার দৃষ্টান্তও স্থাপন হয়েছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়, ‘যুগেযুগে মহামারি’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র প্রকাশ হয়েছে। যেখানে ‘প্লেগ’, ‘কলেরা’, ‘গুটি বসন্ত’‘ যক্ষ্মা’,‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ এবং ‘ইবোলা’ নামক রোগের সংক্ষিপ্ত ধারণা দেওয়া হয়েছে। ‘প্লেগ’, রোগটি প্রথম মহামারি হয়ে আসে রোমানে। ওই সময় রোমান স¤্রাট জাস্টিয়ান প্লেগ রোগে আক্রান্ত হওয়ায় রোগটির নামকরণ হয়েছিল ‘জাস্টিয়ান প্লেগ’। এই রোগে স¤্রাট বেঁচে গেলেও মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৫ কোটি জনমানুষ রোগটির দ্বিতীয় মহামারি দেখা দেয় ১৩৪৭ সালে। এটা কুখ্যাত বিউবনিক প্লেগের মহামারী এবং এতে ওই সময় আক্রান্ত এলাকায় এক তৃতীয়াংশ লোকের প্রাণহানি ঘটে। ইতিহাস যাকে ‘ব্ল্যাকডেথ’ নামে অবহিত করেছে।

প্লেগের তৃতীয় মহামারিটি হয়, উনবিংশ শতকের মধ্যভাগে। চীনের ক্যাস্টন শহরে ১৮৯৪ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে জুন পর্যন্ত প্রায় ৮০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল। ১৯০০-১৯০৪ সালে সানফ্রান্সিস্কোর চায়না টাউনে প্লেগের আক্রমণ ঘটে। পরে ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অঙ্গরাজ্যের অকল্যান্ড ও ইস্ট বেঙ্গল এলাকায় এটা ছড়িয়ে পড়ে। সর্বশেষ এই রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লস এঞ্জেলেস শহরে। বন্য ইঁদুরের মধ্যে এই রোগটি বিদ্যমান থাকায় তাদের সংষ্পর্শে এলে মানুষের মাঝে এই রোগ ছড়াতে পারে বলে রোগ বিশেষজ্ঞরা ধারনা করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্লেগ মহামারি রোগটি ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। তবে এই রোগে ১৯৯৪ সালেও ভারতের ৫ টি প্রদেশে প্রায় ৭০০ জন আক্রান্ত হয়েছিল। এতে মারা যায় ৫২ জন। ‘কলেরা’, রোগটি সারাবিশ্বে প্রথম মহামারি আকারে দেখা দেয় ১৮০০ সালে। এটি প্রথম দেখা যায় তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের বাংলা অঞ্চলে। এই রোগকে ‘ওলাওঠা’ নামে ডাকা হতো। এখনও প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এযাবত প্রায় ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৭ সালে ইয়েমেনে এক সপ্তাহে কলেরায় অন্তত ১১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ‘গুটিবসন্ত’, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম থেকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু। বিংশ শতাব্দীতে গুটি বসন্তে প্রায় ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

আগে গুটি বসন্তে মৃত্যুর হার ছিল ৩০ শতাংশ। এই রোগ আয়ত্বে আসায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে গুটিবসন্ত নির্মুলের ঘোষণা দেয়। ‘যক্ষ্মা’, গবেষকদের মধ্যে গত দুই শতাব্দিতে ১০০ কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ২০২০ সালের মধ্যে ৬ থেকে ৯ লাখ মানুষ যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাবে। ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণামতে ১৯১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ০৫ কোটি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এর পরিমাণ ১০ কোটির বেশি হতে পারে। ‘ইবোলা’, ভাইরাস প্রথম বিজ্ঞানীদের নজরে আসে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে। যখন আফ্রিকার (বর্তমান) দক্ষিন সুদান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর ইয়ামিবুকু গ্রামের মানুষ এতে আক্রান্ত হয়।

ইবোলা নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ভাইরাসটির নামকরণ হয় ইবোলা। ১৯৭৬ সালে ইবোলা ভাইরাসের সেই আঘাতে ‘বর্তমান’ দক্ষিন সুদানে রোগাক্রান্ত মানুষের অর্ধেকের বেশিই মারা গিয়েছিল। ইয়ামিবুকু গ্রামে মৃত্যুর হার ছিল আরও ভয়াবহ। সেখানে আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে ৮৮ জনেরই মৃত্যু হয়েছিল। ৩২০ বছর পূর্ব থেকে মহামারী রোগ-ব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটে আসছে। তবে সম্প্রতি ২০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু করে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ডেঙ্গু নামক রোগে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আক্রান্ত হয়েছিল ৫৯,৮৩৩ জন। এতে মৃত্যু হয়েছিল ৩০৪ জনের। এই ডেঙ্গু সারা পৃথিবীর প্রায় দেশগুলোতে দেখা গিয়েছিল। বর্তমান নভেল করোনা ভাইরাস রোগটি মহামারি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কারণ, এই রোগটি সারা পৃথিবীতেই সমানভাবে গেঁড়ে বসেছে। বিগত বিশ বছরে আরও সাতটি নতুন রোগের ভাইরাস চিহ্নিত হয়েছে।

এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে ডেঙ্গু, ২০০১ সালে নিঁপাভাইরাস, ২০০৭ সালে বার্ডফ্লু বা এভিয়ান, ২০০৮ সালে চিকনগুনিয়া, ২০০৯ সালে সোয়াইনফ্লু এবং ২০১৪ সালে চট্টগ্রামে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়। পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিনই পৃথিবীতে রোগ-ব্যাধির উত্থান-পতন ঘটবে এটাই বাস্তবতা। সভ্য পৃথিবীর আধুনিক যুগে করোনা ভাইরাস নিয়ে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা রোগতত্ত্ব ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ হলো। কারণ, দুঃসময়-দুর্দিন অর্থাৎ যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং মহামারিতে তিন স্তরের মানব সেবক নিজের জীবন দিয়েও সামনের দিকে এগুতে থাকে তারা হলেন প্রথমজন, ‘সৈনিক ও পুলিশ’, দ্বিতীয়জন ‘চিকিৎসক’ এবং শেষজন ‘সাংবাদিক’। ফলে এদেরকে সমাজের অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এবারের এই মহামারিতে দেশের অনেক চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে চিকিৎসকরা রোগের ভয়ে পালিয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগসহ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে।

আমরা মনে করি, কোন রোগীর চিকিৎসক রোগের ভয়ে পালায়নি, তবে যা কিছু রটে, তার কিছুটা বটে, এটা আমরা স্বীকার করে নিতেই পারি। একই সাথে দৃঢ়চিত্তে বাস্তবতার আলোকে বলা যায় শুধু বাংলাদেশের নয় সারা পৃথিবীর বহুনিন্দিত পুলিশ প্রশাসনকে দিবারাত্রি মাঠে থাকতে দেখেছি, দেখছি। অটুট রয়েছে সংবাদকর্মীরাও তবে ক্ষেত্রবিশেষে অনেক সাংবাদিকই টেবিল ছেড়ে বাসায়, কেউ আবার মাঠ ছেড়ে বাড়িতে রয়েছে এমনটিও শোনা যাচ্ছে জোরে-সোরে। যাই হোকনা কেন, যে তিন শ্রেণির মানব সেবক মানব সভ্যতার কল্যাণে নিয়োজিত তাদের নিরাপত্তার জন্যেও সরকার এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ সরকার তাদের নিরাপত্তা প্রদানে যথাযথ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। শত হতাশার মাঝেই হয়তো বা আমরা সহসায় সু-সংবাদ পেয়ে যাবো এটাই নিশ্চিত।

তবে হতাশা যেন আমাদের মরার আগেই না মেরে ফেলে সেদিকে আমাদেরকেই সজাগ হতে হবে। লেখাটি শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কারের কাহিনী দিয়ে। শেষ করতে চাচ্ছি অন্য একটি কাহিনী দিয়ে। মাদার তেরেসা ১৯১০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মগ্রণের ৪ বছর পর অর্থাৎ ১৯১৪ সালে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা জুড়ে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯১৮ সালে। দীর্ঘ ৫ বছরের যুদ্ধে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুযজ্ঞতে কোমলমতি তেরেসার মনে জেগে ওঠে মানুষের সেবার ব্রত। আর সে থেকেই এই দরিদ্র পরিবারের সন্তান মাদার তেরেসা পৃথিবীর মানব কল্যাণে নিয়োজিত হয়। দুর্গন্ধময় দগদগে কুষ্ঠরোগীদের তিনি নিজ হাতে ঘা ধুয়ে দিয়েছেন, তাদের স্নান করিয়েছেন, তাদের সেবা দিয়েছেন।

অথচ ওই সময় মানব সভ্যতা মনে করতেন, ‘কুষ্ঠ’, ছোঁয়াচে রোগ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়। ওই সময় বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ শরনার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেও মাদার তেরেসা সেবা দিতে এসেছিলেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে ঘুর্ণিঝড়ে যখন বাংলাদেশের লাখো মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখা দেয়, ওই সময় ৮১ বছর বয়ষ্ক মাদার তেরেসা বাংলাদেশে আসেন।

বর্তমান অবস্থায় বলতে দ্বিধা নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী এবং শক্তিশালী ইতিহাস সৃষ্টিকারি বাংলাদেশী বাঙালি সেবকদের একটি অংশ মাদার তেরেসা হওয়ার সুযোগ পেয়েও তা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন, একই সাথে নন্দনালের কলঙ্কটি যে গলায় বেঁধেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। লকডাউন, হোমকোয়ারেন্টাইনের নামে গ্রামে, পাড়া মহল্লায়, রাস্তায় রাস্তায়, ইট পাথর ফেলে, বাঁশ বেঁধে, গাছের গুড়ি ফেলে যা করা হচ্ছে তা কি হিতে বিপরীত হতে পারে কি না তা কি ভেবে কেউ দেখেছেন? আমরা বিশ্বাস করতে রাজি নই, আমরা এখনো জুতা আবিষ্কার কবিতার অধম!


লেখক : শিক্ষক, শিশু সংগঠক, নাট্যকার ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৩ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test