E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

করোনা : ঈদ-পশুহাট-পরিবহন ও সরকার

২০২০ জুলাই ২০ ১৩:৫৫:১৯
করোনা : ঈদ-পশুহাট-পরিবহন ও সরকার

রণেশ মৈত্র


বাংলাদেশে করোনা পরীক্ষার ফি ধার্য্যরে পর থেকে ক্রমান্বয়ে পরীক্ষার সংখ্যা কমতে থাকে। দিন দিন তা কমতে কমতে বর্তমানে তা এক তৃতীয়াংশ হ্রাস পেয়েছে। হ্রাস পাওয়ার প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। এভাবে কমতে থাকলে আগামী দুই তিন সপ্তাহের মধ্যে তা পূর্বের তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। স্বাভাবত:ই তার ফলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নৈমিত্তিক ব্রিফিং এ সংক্রমণের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যাও কমে আসতে থাকবে। গত ১৫ জুলাই ৩৩ জনের মৃত্যু দেখানো হয়েছে-যা মানুষের মনে আনন্দ সৃষ্টি করার স্থলে করেছে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি।

উদ্বেগ, সংশয়, অবিশ্বাস অবশ্য আগে থেকেও ছিল। কারণ বহু জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামগুলোতে টেষ্টের কোন ব্যবস্থা আজও না থাকায় দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে এই দীর্ঘ সাড়ে চার মাসে মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষের করোনা টেষ্ট করা হয়েছে। ফলে ১৬ কোটি ৮০ লাখেরও বেশী মানুষের করোনা টেষ্ট করা হয় নি। আর সে কারণে আক্রান্তের ও মৃতের সংখ্যাও স্বাভাবত:ই কম রেকর্ড হচ্ছে।

সরকারের বক্তব্য হলো, যাঁদের কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না-তাঁদের করোনা টেষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই। এই কথা আদৌ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত না। কারণ করোনার সংক্রমণ লক্ষণের উপর নির্ভর করে না। কোন লক্ষণ বিন্দুমাত্র নেই কিন্তু করোনা টেষ্টে পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে এমন রোগীর সংখ্যাও প্রচুর। সুতরাং সে কারণে নয়, আসলেই সরকার সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা কোন এক অজানার কারণে কম করে দেখাতে চান-তাই কর বনানো হয়েছে। স্বীকৃত সত্য হলো করোনার জন্য বেকারত্বের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে মানুষের আয় উপার্জন ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে তাঁদের পক্ষে টাকা দিয়ে করোনা টেষ্ট করানো সম্ভব নয় বলেই তাঁরা তা করাতে পারছেন না। এবং সে কারণেই যে আজও সকল জেলায় টেষ্টিংল্যাব স্থাপন করা এবং উপজেলাগুলিতে টেষ্টিং কিটসের ব্যবস্থা করা হয় নি।

এই ভয়াবহ রোগটির সংক্রমণ সারা পৃথিবী জুড়ে, এমন কি আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারতেরও দ্রুত সংক্রমিত ও মৃত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোন যাদুমন্ত্রবলে বাংলাদেশে প্রতিদিনই হ্রাস পাচ্ছে?

ঈদ প্রসঙ্গ

দু’মাস আগে এসেছিল এ বছরের প্রথম ঈদ-ঈদ-উল-ফিতর। মাঠে নামায নিষিদ্ধ করা হলো। মসজিদে জামাত নিয়ন্ত্রণ করে আদেশ দেওয়া হলো। গণ-পরিবহণ বন্ধ রাখা হলো। তবুও মানুষ নানা চ্যানেলে লাখে লাখে ঢাকা ছাড়লো-নিজ বাড়ীতে প্রিয়জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার আশায়।

কিন্তু যা কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিলো তা মানুষ কতটা পালন করেছিল-সে তথ্য কারও কাছে নেই। কিন্তু করোনা দিব্যি ছড়িয়ে পড়েছিল জেলায় জেলায়, গ্রামে-গ্রামান্তরে। তার ফলে জুন মাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলো। সরকারও তার স্বীকৃতি দিয়েছিল।

কিন্তু এবারের ঈদ এ সরকারের পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত চিন্তাশীল ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মনে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। যেমন:

এক. কোরবানীর পশুর হাটের অনুমতি দেওয়া হলো তবে বলা হলো ঐ হাটগুলি যেন ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় না বসানো হয়, যেন বিক্রেতারা সবাই পরস্পর থেকে উপযুক্ত মাপের দূরত্ব বজায় রাখেন, ক্রেতারাও যেন পরস্পর থেকে পরস্পর নির্ধারিত মত দূরত্ব বজায় রেখেঐ হাটগুলিতে চলাফেরা এবং কেনাকাটা করেন, হাটের ইজারাদায়েরা যেন ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাটগুলিতে ঢুকবার এবং বের হওয়ার পথে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ হাত ধোয়ার পানি ও সাবান মজুদ রাখেন এবং সকলেই অধিকতার স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে যতœবান হয়ে পকেটে হ্যা- স্যানিটাইজার রাখবেন, সকলে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ও হ্যা- গ্লাভস পরে হাটে যাতায়াত করবেন।

পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে করোনার ভয়াবহতা বিবেচনায় মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। এ বিষয়ে তাঁদের সাথে আরও কোটি কোটি মানুষ একমত।

কারণ, যতই সরকার বলুন না কেন, হাট বড় বড় সড়কের পাশেই বসবে-নইলে সরু রাস্তা দিয়ে তো পশুবাহী ট্রাক বা ভারী গাড়ী ঘোড়া যাতায়াত করতে পারবে না। শুধুমাত্র ঘনবসিত এলাকায় হয়তো হাট বসতো না যদি স্পষ্ট করে সরকারিভাবে বলা হতো যে নগর, জেলা ও উপজেলা শহরগুলির রেকর্ডেড এলাকার মধ্যে পশুহাট বসানো যাবে না। কিন্তু সরকার তা না বলায় ঐ নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হবে না-একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।

অপরাপর শর্তগুলি যেমন, ক্রেতা-বিক্রেতাদের পরস্পর পরস্পরের মধ্যে পশু হাটগুলিতে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, প্রত্যেকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ও হ্যা-গ্লাভস পরে যাওয়া, হাটগুলিতে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে উপযুক্ত পরিমাণ পানি ও সাবান রাখা এবং সকলেই হাটে ঢুকতে ও বের হওয়ার সময়ে যেন বিধি মোতাবেক হাত ধুয়ে নেন ও সকলে পকেটে স্যানিটাইজার রাখা যে আদৌ ঘটবে না তা অগ্রিম বলে দেওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে আমরা নৈমিত্তিক দেশব্যাপী যে সকল হাট-বাজার বসে তার অভিজ্ঞতাকে স্মরণে আনতে পারি। স্বাস্থ্যবিধিগুলি মানতে হবে একথা অন্তত: টেলিভিশন চ্যানেলগুলি প্রতিদিনই দফায় দফায় প্রচার করে চলেছে। ওগুলি দেখছেন গ্রাম ও শহরের অসংখ্য মানুষ। কিন্তু তাঁরা কি সেগুলি মেনে চলছেন?

তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সরকারের ঐ নির্দেশগুলি প্রতি পালিত হবে না দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। ফলে করোনা সংক্রমণের আশংকা বাড়বে বৈ কমবে না। স্বাস্থ্য বিধিগুলি মানার দায়িত্ব যেমন নাগরিকদের তেমনই আবার তা মানানোর দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের উপর নিশ্চিতভাবেই বর্তায়। ঐ কর্তৃপক্ষরা হলেন সরকার, সিটি কর্পোরেশন সমূহ, পৌরসভা সমূহ, জেলা ও উপজেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদ সমূহ। কিন্তু কার্য্যত: হয়তো দেখা যাবে যেহেতু তাঁরা হাটগুলির ইজারা দিয়ে ইজারাদের কাছ থেকে বিস্তর টাকা নিয়েছেন তাই তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করে সকল আয়োজন করানো থেকে বিরত থাকবেন। এমতাবস্থায় পুলিশই একমাত্র ভরসা হতে পারে যদি সরকার পুলিশকে সকল পশুহাটে ক্রেতা-বিক্রেতা সকলকে স্বাস্থ্য বিধিগুলি দৃঢ়তার সাথে মানাতে বাধ্য করার জন্যে কড়া নির্দেশ দেন। এ যাবত অবশ্য হাট বাজার নিয়ন্ত্রণে বা বিভিন্ন রেড জোন এলাকায় লক ডাউন কার্য্যকর করতে তেমন একটা কঠোরতা এমন কি খোদ রাজধানী শহরেও দেখা যায় নি।

এরপর আসা যাক গণ-পরিবহন চলাচল সম্পর্কিত সরকারি সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে। মাত্র তিন দিন আগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে প্রচারিত হতে দেখা গেল, এবারের ঈদে গণ-পরিবহণ চলবে না। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ নিজ এলাকায় যাবেন না। সকলকেই ঢাকা শহরে থেকেই ঈদ পালন করতে হবে।
পরদিনই ঐ একই চ্যানেলগুলিতে প্রচারিত হলো গণ-পরিবহণ চলবে।

এখন প্রশ্ন জাগে, ঢাকা শহরে যাঁরা বসবাস করেন তাঁদের বড় অংশই সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। এবারের ঈদে সরকারি ছুটি থাকবে মাত্র তিনদিন এবং কিছুতেই তা আর বাড়ানো হবে না বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় জানিয়েছেন।
যদি সকল সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ঢাকাতেই ঈদ করেন তাহলে নিশ্চিয়ই তাঁরা ঢাকায় অবস্থানরত পরিবার-পরিজনসহ ঢাকাতেই ঈদ করবেন-ঢাকার বাইরে কোথাও যাবেন না।

আর থাকেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী এবং কর্মচারীবৃন্দ। এঁদের সংখ্যাও একেবারে কম না। কিন্তু যেহেতু সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আজ চার মাস যাবত বন্ধ এবং কত দিনে তা খুলবে তা অনিশ্চিত তাই তাঁদের মধ্যে যাঁদের বাড়ীতে ঢাকার বাইরে তারা তো বহু আগে থেকেই নিজ নিজ শহর বা গ্রাম এলাকায় গিয়ে বসবাস করছেন। তাই এঁদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই ঈদে ঢাকার বাইরে যাবেন।

কলকারখানা তো বেশীর ভাগই বন্ধ। সুতরাং সেগুলিতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীরা গ্রামের বাড়ীতে অনেক আগেই চলে গেছেন। সামান্য যে কয়েকটি কল-কারখানা খোলা আছে, সেগুলির শ্রমিক-কর্মচারীরা যদি হাল বকেয়া বেতন-বোনাস পান তবেই তো ঈদ করতে বাড়ী যাবেন। যেহেতু বেতন-ভাতা প্রাপ্তি অনিশ্চিত তাই নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না তবে সব কিছু প্রতিবন্ধকতা সত্বেও কিছু সংখ্যক ঢাকার বাইরে অবশ্যই যাবেন।

আর যাবেন ব্যবসায়ীদের পরিবারপরিজন। তাই উপরে বর্ণিত হিসাব যদি মোটামুটি সঠিক হয় তবে অন্যান্য বছরের মোটামুটি সঠিক হয় তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় যাত্রী চলাচল ঘটার কথা। তাই যেহেতু যাত্রী কম হবে এবং তদুপরি স্বাস্থ্য বিধি মেনে অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলতে হবে-তাই মালিকরা যে ভাড়া তিনগুণ বাড়িয়ে দেবেন তাতে সন্দেহ নেই। সরকার এ ব্যাপারে প্রতিবারেই হুঁশিয়ারী দিয়ে থাকে এবারও দেবে। কিন্তু ফল ফলবে না তাতে অতীতের মতই।
যে সংখ্যক যাত্রী এবার চলাচল করবেন তাদের ঘড়ে বাড়তি ভাড়া বহনের বোঝা না চাপিয়ে এবং বেসরকারি পরিবহনগুলিতে স্বাস্থ্যবিধি মানার নিশ্চয়তা না থাকায় যে বাড়তি ঝুঁকি-তা এড়াতে বেসরকারি সড়ক পরিবহন বন্ধ রেখে বি.আর.টি.সি’র সকল একতলা-দোতলা বাস বিভিন্ন রুটে ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে এক সপ্তাহ পর পর্যন্ত চলানো হোক। তাতে যাত্রীরা বাড়তি ভাড়া বহন এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুযোগ পাবেন। না হলে, যদি বেসরকারি পরিবহনই সার্বিক দায়িত্ব পালন করে তবে ঐ স্বাস্থ্য বিধির বিড়ম্বনা বলে দিয়ে গাড়ী ভর্তি যাত্রী নিয়ে মার্চের আগের ভাড়ায় চলার ব্যবস্থা করা হোক-যাত্রীদের স্বার্থে।

এবারে আসা যাক করোনা প্রসঙ্গে। সংক্রমণ মৃত্যু কমছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও আন্তর্জাতিক রেড ক্রস বার বার উদ্বেগ প্রকাশ করছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে করোনার অবনতি ঘটবে এমন আশংকা। তাই সৌদি আরবে হজ্ববন্ধের মত এবার ঈদে কোরবানী নিষিদ্ধ করলেও গণপরিবহন বন্ধ রাখলে কি করোনা ভাইরাস সংক্রমণ সহজ হতো না?
এর ফলে সরকারের করোনা নিয়ন্ত্রণের কাজগুলির মধ্যে একটা সমন্বয় সাধিত হতো মানুষও সংকামুক্ত হতো ।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test