E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ভারত : মহামানবের সাগর তীরে

২০২০ আগস্ট ১৯ ১৭:১৩:১০
ভারত : মহামানবের সাগর তীরে

আবীর আহাদ


আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরম বন্ধু ভারতের সাম্প্রতিক এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন সংক্রান্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন---- যদিও বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে আপাতত: উত্তাপটি স্তিমিত হয়ে আছে । তবে ভেতরে ভেতরে যে বিষয়টি তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে তা সহজেই অনুমেয় । যে দ্বিজাতি তত্ত্ব তথা 'হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি'র উগ্র সাম্প্রদায়িক অপচেতনার করালগ্রাসে ভারতীয় উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়ে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির প্রসব বেদনায় দু'দেশের কোটি কোটি মানুষের জানমাল ও সম্ভ্রম নষ্ট হয়েছিলো, যার বিষময়তা ও ভ্রান্ততা অনুধাবন করে তৎকালীন ভারতীয় জাতীয় নেতৃত্ব দ্বিজাতি তত্ত্বকে মুছে ফেলে ভারতকে সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপক্ষ প্রজাতন্ত্র হিশেবে ঘোষণা করে সাম্প্রদায়িকতা পরিহারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান সৃষ্টি করেন । যদিও ওদিকে পাকিস্তান তাদের রাষ্ট্রকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে তাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিশেবে অদ্যাবধি গণ্য করে আসছে । যার বিষফলস্বরূপ পাকিস্তান একটি ইসলামী জঙ্গিরাষ্ট্র হিশেবে গড়ে উঠেছে । সন্ত্রাসবাদই এখন যেনো পাকিস্তানি সমরনির্ভর মৌলবাদীদের রাজনৈতিক দর্শন হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে । সেখানে প্রতিনিয়ত মুসলমান মুসলমানকে বোমা ও বুলেটে হত্যা করে চলেছে ।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান ও দ্বিজাতি তত্ত্বকে মুছে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনাকে পাথেয় করে নিজেদের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি । ধর্মনিরপেক্ষতাই আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি । যদিও বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক তিরোধানের মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরশাসকসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের মতো একটি ক্ষত সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকার বীজ বপন করে দিয়েছে । তারপরও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সিক্ত ।

ভারত প্রজাতন্ত্র মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বহুকাল অতিবাহিত করে আসছে । আন্ত-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপির শাসনামলে নানান ধর্মীয় ইস্যুতে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটলেও ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণে তেমন বড়ো ধরনের ঘটনা ঘটেনি । কিন্তু আরএসএস দর্শনের সমর্থক বিজেপি তার রাষ্ট্রীয় নানান পদক্ষেপে হিন্দুত্ববাদী নীতি গ্রহণ করার ধারাবাহিকতায় ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ভেঙে পড়তে থাকে । ফলশ্রুতিতে সারা ভারত জুড়ে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটে । বিশেষ করে ভারতের মুসলমানরা এই হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে পড়েছে ।

ভারত প্রজাতন্ত্র মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে বহুকাল অতিবাহিত করে আসছে । আন্ত:সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি শাসনামলে নানান ধর্মীয় ইস্যুতে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু দাঙ্গাহাঙ্গামা ঘটনা ঘটার মধ্য দিয়ে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে চিড় ধরার মধ্য দিয়ে সেদেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে । আরএসএস দর্শনে বিশ্বাসী বিজেপি এই হিন্দু জাতীয়তাবাদী জাগরণকে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার কার্যকরি হাতিয়ার গণ্য করে বসে । তারা তাদের শাসনকার্যের মধ্যে হিন্দুত্ববাদের স্ফূরণ ঘটাতে যেয়ে গোটা ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মনে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনার এমন বিষবাষ্পের জন্ম দেয় যাতে 'হিন্দুস্তান কেবলই হিন্দুদের'-----এ-ধারণার সৃষ্টি হয়ে তারা রাম রাজত্ব গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছে ! হিন্দুস্তান কেবলই হিন্দুদের----এ মহাজাগরণকে বিজেপিও তাদের চিরস্থায়ী ক্ষমতার চাবিকাঠি বিবেচনা করে দেশের বুকে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে অন্ধভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ।

ভারতের মধ্যেই এখন বলা চলে সেই সাবেক দ্বিজাতি তত্ত্ব আবার ফিরে এসেছে । সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা রাম রাজত্ব গড়ার স্বপ্ন এমনভাবে বিভোর হচ্ছে, তারা প্রায় ভুলে যেতে বসেছে যে ভারতের বুকে অন্যান্য অনেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ও বসবাস করে ! বিশেষ করে হিন্দুদের মূল টার্গেট ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় । যেনো তাদেরকে দেশান্তর করতে পারলেই তারা সুখের সর্গে ভাসতে থাকবে !

ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে মনে রাখতে হবে, ভারতের বুকে শুধু শ্রীকৃষ্ণ ও রাম জন্ম নেননি, এখানে গৌতম বুদ্ধ, অশোক, গুরু নানক, চৈতন্য, জৈন, আকবর, অরবিন্দ, শিবাজি, গান্ধী, সুভাষ, মাওলানা আজাদ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বহু মনীষী যার যার মতবাদ ছড়িয়ে গেছেন । বহু পথ, বহু মত, বহু ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর সমন্বিত এ মহাভারত । একটি ধর্মকে তুলে ধরে অন্যান্য ধর্মকে অবদমিত করে রাখা যাবে না----যাবে না একটি সম্প্রদায়কে উত্থিত করে অন্যান্য সম্প্রদায়কে পতিত করা । সর্বধর্ম ও সর্বসম্প্রদায়কে সমন্বিত করেই ভারতমাতাকে পরিচালিত করতে হবে । এবং এ দর্শনেই ভারত গড়ে উঠেছে । ভারতের বিজেপিকে তাই কবিগুরু থেকে উদ্ধৃতি দেই-----

হেথা আর্য হেথায় অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন
শক হুনদল পাঠান মোগল একদেহে হল লীন----
দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে------!

গত দশ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের ওপর বড়ো ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে সেদেশের মুসলমানসহ ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস, অন্যান্য বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ঐ বিলের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন । তবে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে সেই আন্দোলন আপাতত: স্তিমিত হয়ে আছে । কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার রেশ কিন্তু রয়েই গেছে যা আবার যেকোনো সময় উদগীরণ হতে পারে । আসলে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এসব পদক্ষেপ নেয়ার ফলে গোটা ভারত রাজনৈতিক সংকটে টালটলয়মান । জানি না এর শেষ পরিণতি কতোদূর কোনদিকে গড়ায় !

এ পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশের মানুষও উদ্বিগ্ন । কারণ প্রতিবেশির ঘরে আগুন লাগলে সে-আগুন অন্য প্রতিবেশির ঘরেও লাগতে পারে । আগুন না লাগলেও উত্তাপ তো ছড়িয়ে পড়ে !

এতদঞ্চলে ভারত একটি পরাশক্তি । বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের এ শক্তি অনেক ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যও রক্ষা করে । বিশেষ করে ভারত----বাংলাদেশ পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা মালদ্বীপ মিয়ানমার নেপাল ও ভুটানের তুলনায় অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে একটি বড়ো ভাইয়ের অবস্থানে আছে । ক্ষুদ্র ও দুর্বল প্রতিবেশির সাথে সদ্ভাব সৃষ্টি করে চলার মধ্যেই বড়ো ভাইয়ের মহত্ত্ব নিহিত । কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি ? ভারতের হিন্দুত্ববাদী বা বড়ো ভাইসুলভ আচরণে পাকিস্তান তো পূর্ব থেকেই বটে, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল ইতোমধ্যে তাদের থেকে দূরে সরে গেছে । মুক্তিযুদ্ধে সীমাহীন অবদানের কারণে বাংলাদশ ভারতকে তাদের একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু হিশেবে গণ্য করে । কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে অচলাবস্থা, সীমান্তে হত্যা, কাঁটাতারের বেড়া, পণ্যনীতির অসামঞ্জস্যতা প্রভৃতি সমস্যা এবং সাম্প্রতিককালে ভারতের এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে ।

মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বাঙালি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ পরিচালিত হলেও ধর্মীয় কারণে মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেতনা এদেশের অধিকাংশ মানুষের মনে সুপ্ত হয়ে আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না । তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সাম্প্রদায়িকতা তেমন ছড়িয়ে পড়ে না, কিন্তু বিএনপি জামায়াত ও হেফাজতের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও ভারতবিরোধী উন্মাদনা সৃষ্টি হয় । ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়ে পড়ায় এদেশের মানুষের মনেও ভারতবিরোধী ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার প্রবল উন্মেষ ঘটছে যা একটি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে ।

ভারতকে ভাবতে হবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদী উন্মাদনাকে উস্কে দিয়ে চিরশত্রু পাকিস্তানকে সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার লক্ষ্যে তার চারপাশের সব রাষ্ট্রকেও শত্রু বানিয়ে দিয়ে সে তার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে কিনা তা তাকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে । তাকে আরো ভাবতে হবে, চীনও তাকে কোণঠাসা করতে সদাতৎপর । আমেরিকার সাথে তার যতোই বন্ধুত্ব থাকুক না কেনো, আন্তর্জাতিক প্রভাববলয়ে আমেরিকা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সেটিও তাকে ভাবতে হবে । কারণ আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রু খোঁজার দরকার নেই বলে একটা প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে । তাছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক যুদ্ধে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পরাজয়ের ভেতর দিয়ে আমেরিকারও পরাজয় ঘটেছিলো । সেই পরাজয়ের গ্লানি আমেরিকা ভুলে গেছে-----এটা ভাবার অবকাশ নেই ।

ইতোমধ্যে কিন্তু চীনের সাথে মুখোমুখি প্রাণহানিকর সংঘর্ষ ঘটেও গেছে । অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম শক্তি ও ইউরোপীয় রাজনীতির দাবার চালের বিষয়টিও তাকে মাথায় রাখতে হবে । তাকে মনে রাখতে হবে, তার হিন্দু ধর্মই বিশ্বে একমাত্র ধর্ম নয়----আরো ধর্ম আছে । বিশ্বের বুকে যদি যার যার ধর্মের জাগরণ ঘটে তাহলে কোনো একটি একক ধর্ম নিরাপদ থাকবে না, দেশে দেশে ধর্মের আগুন জ্বলে উঠে গোটা মানবজাতিকে ধ্বংস করে দেবে । ধর্মীয় জাগরণ দিয়ে আভ্যন্তরীণভাবে হয়তো বিজেপি কিছুকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে পারবে, কিন্তু তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভয়াবহ হতে বাধ্য । ভারতকে একথাও মনে রাখতে হবে, কোনো প্রতিবেশীকে অশান্তির আগুনে পুড়িয়ে নিজের শান্তি রক্ষা করা যাবে না ।

ভারতের বর্তমান অনুসৃত রাষ্ট্রীয় নীতির প্রতিক্রিয়ায় তার দেশের মধ্যে যেমন অসন্তোষের দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে, সেই দাবানলে তার চারপাশের রাষ্ট্রেও তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ-অঞ্চলের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করবে তাতে সন্দেহ নেই । সুতরাং ভারতকে নিজের ঘর, প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের রাজনৈতিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে অগ্রসর হতে হবে বলে মনে করি ।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা লেখক গবেষক,চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test