E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অমুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদে শুদ্ধি অভিযান চাই

২০২০ আগস্ট ৩১ ১৬:২২:৪৭
অমুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদে শুদ্ধি অভিযান চাই

আবীর আহাদ


বাংলাদেশের আবহমানকালের  ইতিহাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুমহান নেতৃত্বে  একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এক অনন্য চেতনায় ভাস্বর । এই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই পৃথিবীর ইতিহাসে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অভ্যুদয় ঘটেছে । আর সেই বাংলাদেশের নির্মাতা হিশেবে বীর মুক্তিযোদ্ধারাই জাতীয় ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান । তাদের সীমাহীন শৌর্য বীর্য ত্যাগ ও বীরত্বই বাঙালি জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ । সেই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার মধ্য দিয়েই কেবল বাঙালি জাতির পিতার মর্যাদা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা মহিমান্বিত হতে পারে ।

ইতিহাসের সেই জাতীয় মর্যাদা ও অহংবোধ কেবল বঙ্গবন্ধু ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সেই মর্যাদা ও অহংবোধকে ম্লানসহ সেই পবিত্র নামে ভাগ বসিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানি করার হীনলক্ষ্যে একশ্রেণীর চেতনাহীন তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতৃবৃন্দ ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন সরকারের দুর্বল ও গোঁজামিলের সংজ্ঞার সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কহীন একটি চক্রের নিকট থেকে অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় বলিয়ান হয়ে তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে যে অপকর্ম করেছেন, সেই অপকর্মটি হলো ইতিহাসের সবচাইতে বড়ো দুর্নীতি ।

এই অপকর্মের মধ্য দিয়ে যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন তারাই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা । যারা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তারা হলেন ভুয়ার কারিগর । আর বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ না থাকার ফলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) একই পথ অনুসরণ করে তথাকথিত বিশেষ ক্ষমতা বলে অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলেছে ! এ অবস্থায়, বলা চলে, সরকারই এখন ভুয়া সৃষ্টির কারিগর হিশেবে আবির্ভূত হয়েছে !

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি হাজার হাজার রাজাকারও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দিব্যি বছরের পর বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করে চলেছে । বিশেষ করে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাজাকার-আলবদরসহ তাদের দলীয় লোকজন মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজারকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় স্থান দেয়া হয়েছে, একথা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রী বিরোধী দলে থাকার সময় অভিযোগ করে বলেছিলেন যে, তারা ক্ষমতায় এলে এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উচ্ছেদ করবেন । কিন্তু তারাই আজ একনাগাড়ে দীর্ঘ বারো বছর ক্ষমতায় আছেন, ভুয়া উচ্ছেদ দূরের কথা, তাদের আমলেও প্রায় ত্রিশ হাজার অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে ।

স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি-জামায়াত জোট মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে হেলাফেলা করেছে তাদের দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার কী করে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে গোঁজামিল সংজ্ঞায় অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দেয়ার কার্যক্রমে লিপ্ত হলো, তা ভাবতেই পারা যায় না । বিএনপি-জামায়াতের অনুসরণে তারা এ অপকর্মটি করে নিজেদের আদর্শের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাতে সন্দেহ নেই ! বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো একটি আবেগপ্রবণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিশেবে সরকার কোন খেয়ালে আ ক ম মোজাম্মেল হকের মতো একজন অতি নিরীহ, অকর্মণ্য ও অযোগ্য ব্যক্তিকে পর পর দু'টার্ম এ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করেছেন তা আমাদের বোধগম্য নয় ।

তিনি আজ এতোটি বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পরিচ্ছন্ন তালিকা তো করতেই পারলেন না, উপরন্তু তিনি অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে চলার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন । শুধু তাই নয়, রাজাকার তালিকায় কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করে গোটা জাতির কাছে তিনি একজন অপদার্থই নন, নিজেকে তিনি নিজেই বেআক্কেল বলে অভিহিত করেছেন ! তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি, ফ্রি চিকিৎসা, ফ্রি যাতায়াত, বীর নিবাস, গৃহলোন, মুক্তিযোদ্ধা কবর ইত্যাদি বিষয়ে অতিকথন দিয়ে অকারণেই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জনসমক্ষে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন । তাঁর কথাবার্তা আচার আচরণ ইত্যাদির কারণে একজনও মুক্তিযোদ্ধা তাকে মন্ত্রী হিশেবে চান না । তারপরেও তিনি মন্ত্রিত্বের আসন অলঙ্কৃত করে আছেন ! কী বিচিত্র মানসিকতা !

আমি বারবার বলেছি এবং এটিই সত্য যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দেড় লক্ষের নিচে । কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা সরকারিভাবে দাঁড়িয়েছে দু'লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের মতো । অর্থাত্ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আশি/পঁচাশি হাজার অমুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছেন । এই অমুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাষ্ট্রীয় ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করে আসছেন । এ জন্য আমি সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়ে আসছি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদার স্বার্থে তাদের একটি স্বচ্ছ ও নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা দরকার । এটি করা মোটেই কোনো দূরহ কাজ নয় ।

বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞার আলোকে একটি উচ্চতর বিচার বিভাগীয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই তদন্ত কমিশনের নেতৃত্বে এ কাজটি মাত্র ছ'মাসের মধ্যেই সম্পন্ন করা সম্ভব । জাতির জীবন থেকে এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুতের নামে প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি । সুতরাং নতুন এ প্রক্রিয়ায় আর মাত্র ছ'টি মাস অতিবাহিত হলে নিশ্চয়ই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না । জাতির গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় প্রায় লক্ষখানেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদার ওপর কালিমা লেপন করার অর্থ বিশাল অপরাধ ও মহাদুর্নীতির নামান্তর । এই অমুক্তিযোদ্ধাদেরও দুর্নীতিবাজ-লুটেরা হিশেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে । আর এই সব অমুক্তিযোদ্ধাদের কারিগরাদেরও দুর্নীতিবাজ বলে অভিহিত করা যেতে পারে ।

বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি ফরিদপুর থেকে যে দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করছেন----সেই শুদ্ধি অভিযানকে কঠোরতার সাথে সমগ্র দেশে পরিচালনা করার পাশাপাশি অমুক্তিযোদ্ধা ও ভুয়ার কারিগরদের পাকড়াও করার একটি কর্মসূচি তথা অভিযান পরিচালনার দাবি জানাচ্ছি-----যে অভিযানের রূপরেখা ওপরে আগেই বর্ণনা করা হয়েছে । অন্যান্য দুর্নীতিবাজ মাফিয়া লুটেরাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধ অঙ্গনের অভিশাপ এই অমুক্তিযোদ্ধা ও তাদের কারিগরদের বিরাট পার্থক্য রয়েছে । সাধারণ দুর্নীতিবাজ লুটেরা ও মাফিয়ারা রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাট করছে, কিন্তু অমুক্তিযোদ্ধা ও তাদের কারিগররা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ ও দেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ ধ্বংস ও লুট করছে । ওদের থেকে এদের অপরাধ আরো গুরুতর । একটির সঙ্গে দেশের অর্থনীতি জড়িত, অপরটির সঙ্গে জাতির জাতীয় মর্যাদা ও আত্মাভিমান জড়িত । ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত বিষয়টিকে বরং রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ বলে গণ্য করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে । সুতরাং, চলমান দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের পাশাপাশি অমুক্তিযোদ্ধা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করার জন্য আমি সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

২৪ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test