E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি

২০২০ সেপ্টেম্বর ২৩ ১৩:৫২:৫৮
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতি

আবীর আহাদ


অনেক জ্ঞানপাপী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে 'জনযুদ্ধ' বলে অভিহিত করেন । এটা তারাই বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে কোনোপ্রকার ভূমিকা রাখেননি অথবা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন । ফলে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের গরিমার প্রতি পরশ্রীকাতরতা ও হিংসাত্মক মনোভাব থেকে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাশ কাটিয়ে জনগণের দোহাই দিয়ে মনের ঝাল মেটানোর লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধকে 'জনযুদ্ধ' বলে থাকেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে 'জনসমর্থিত মুক্তিযুদ্ধ' বলাই দার্শনিক সত্য । কারণ জনযুদ্ধ বলা হলে বুঝায় যে, শুধুমাত্র সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছেন । সব জনগণ কি মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন ? উত্তর: না । জনগণের একটা বিরাট অংশ, বলা চলে ২৫/৩০% জনগণ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলো । তাদের মধ্য থেকেই কয়েক লক্ষ রাজাকার, আলবদর, আলশামস, আলমুজাহিদ, তথাকথিত শান্তি কমিটি ও দালালরা সশস্ত্রভাবে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিশেবে সারা দেশব্যাপী গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, নারীধর্ষণসহ জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করেছিলো । মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বাকি জনগণ তাদেরকে নীরব ও সরব সমর্থন দিয়েছিলো । ঐ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জনগণ ছিলো ধনজনে শক্তিতে বলীয়ান । ফলে তাদের প্রভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনগণ অনেক ক্ষেত্রে ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়সহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করতে পারেননি, তবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন ছিলো । তবে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলকৃত বা শক্তিশালী অবস্থানের এলাকার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন ।

মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলার সুযোগ নেই এ-কারণে যে, সাধারণ মানুষ কি রাইফেল, এসএলআর, স্টেনগান, এসএমজি, এলএমজি, মর্টার, এনারগা, কামান, গোলাবারুদ, ট্যাঙ্ক, বিমান, নৌ তথা প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র বা আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন----না দা কাঁচি খুন্তা কুড়াল ঢাল সড়কি কাতরা ত্রিফলা প্রভৃতি দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন ? দখলদার পাকিবাহিনী কি জনগণের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো, না মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলো ? এ-সব প্রশ্নের উত্তর : না ।

ঐ-সব আধুনিক সমরাস্ত্র দিয়ে পাকিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে একদল অকুতোভয় যুবক দেশের বাইরে ভারতে বা দেশের মুক্তাঞ্চলে গেরিলা ও সম্মুখ সমরে লড়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নেয়াসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বাঙালি সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনী 'সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী' নাম ধারণ করে প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন । বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে লড়েছিলেন মরেছিলেন, মেরেছিলেন, আহত হয়েছিলেন । এভাবে দীর্ঘ ন'মাস জীবনপণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ বা সম্মিলিত কমাণ্ডের অধীনে পাকিবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিলো ।

তবে একথা আমরা অকপটে স্বীকার করবো যে, বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণ আমাদের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে সমর্থন করেছিলেন । প্রায় ত্রিশ শতাংশ জনগণের কেউ কেউ সরাসরি পাকিবাহিনীর পক্ষে, কেউ কেউ তাদের সমর্থনে চুপচাপ বসে ছিলো, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে । সেই সিংহভাগ জনগণের মধ্যকার রাজনৈতিক সচেতন একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীকে যথাসাধ্য খাদ্য ও অন্যান্যভাবে সহযোগিতা করেছিলো । তবে এটাই আসল সত্য যে, আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তিবাহিনী কমান্ড/গ্রুপ ও সামরিক বাহিনী আমাদের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে ক্যাম্প স্থাপন, খাদ্য নির্বাহ, অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণ, গোয়েন্দা কার্যক্রম, যুদ্ধক্ষেত্রে গমন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে আমরা নিজেরাই সবকিছু করেছি । নদী পারাপার, ক্যাম্প স্থাপন, পরিখা খনন, অস্ত্র-গোলাবারুদ বহন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা নিয়েছি ঠিকই, তবে তাদেরকে আমরা উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দিয়েছি । সামরিক নিয়ম-নীতি মোতাবেক আমাদের সেসময়ের জীবন আমরাই নির্বাহ করেছি । জনগণের বিরাট অংশের নৈতিক সমর্থন আমাদের উজ্জীবিত করেছে, সাহস যুগিয়েছে, এটাও সত্য । কিন্তু তাই বলে মুক্তিযুদ্ধকে তথাকথিত 'জনযুদ্ধ' বলা হলে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনী তথা সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য বীর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বকে অবমূল্যায়ন ও অবমাননা করা হয় ; মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করা হয় । সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ঐ জনযুদ্ধের মাঝে গুলিয়ে ফেলা হলে 'মুক্তিযোদ্ধা' নামের স্বকীয়তা থাকে না ।

দেশের ভৌগলিক স্বাধীনতা ও আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে সশস্ত্রযুদ্ধের সাথে যাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক, তারাই মুক্তিযোদ্ধা । তা যদি না হবে, তাহলে কেন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বাহাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সংজ্ঞা দিলেন ? বঙ্গবন্ধু সরকার প্রদত্ত সংজ্ঞাটি এখানে তুলে ধরা হলো :" মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি একটি সংঘবদ্ধ দলের ( ফোর্স) সদস্য হিশেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন ।" পরবর্তীতে অন্যান্য সরকারসহ চলমান আওয়ামী লীগ সরকার কেন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করছেন, ভাতা দিচ্ছেন ? মুক্তিযুদ্ধ যদি জনযুদ্ধই হবে, তাহলে কেনো সরকার এমনকি দেশের সর্বস্তরের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের পৃথকভাবে মূল্যায়ন করছেন ?

এটাই ঐতিহাসিক সত্য যে, জনগণের বৃহত্তর অংশের সমর্থনে সর্বসাকুল্য দেড় লক্ষের মতো সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা দেশকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছেন যার অধিকাংশই ছিলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সন্তান ।
। ঐতিহাসিকভাবে এসব বীরদের মর্যাদা সবার ওপরে----তারা মুক্তিযোদ্ধা ।

কিন্তু এটাও আমরা বেদনার সাথে লক্ষ্য করে আসছি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের জাতীয় মর্যাদা সাংবিধানিক আইন দ্বারা অনুমোদিত নয়, উপরন্তু বিভিন্ন সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর সেই মুক্তিযোদ্ধা সংজ্ঞা পাশ কাটিয়ে নানান গোঁজামিলের সংজ্ঞায় হাজার হাজার অমুক্তিযোদ্ধা, এমনকি রাজাকাররাও অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন ও হচ্ছেন ! এসব কারণেই আমি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও ভুয়ামুক্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকার দাবিতে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলন করে আসছি; নানান যুক্তির ধারাবাহিক লেখনী দিয়ে বিষয়গুলোকে তুলে ধরছি । দাবি বাস্তবায়িত হোক বা না হোক, সেগুলো আজ সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত মানুষের জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে । জাতীয় ইতিহাসের পবিত্রতার প্রয়োজনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের উচিত, মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান ও ভুয়ামুক্ত একটি সঠিক মুক্তিযোদ্ধা তালিকা উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখা ।

সুতরাং এটাই ঐতিহাসিক ও দার্শনিক সত্য যে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ নয়-----মুক্তিযুদ্ধকে 'জনসমর্থিত মুক্তিযুদ্ধ' বলাই যুক্তিযুক্ত ।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

পাঠকের মতামত:

১৯ মার্চ ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test